শারু তুলতে গিয়ে সেই রাইমেয়ে পেটে দাঁত বিঁধিয়েছে
আপাতত এটাই খবর, দোষ তারই পিদিমের নীচেকার
বেআব্রু অন্ধকার জানে নি সে
এ পথে বুদ্ধ আসে নি কোনদিন, এলে তাকে খুন করো (সিদ্ধার্থ)
এমনই কিছু পঙক্তিতে নাবিক জন্মের সুনিশ্চিত দিকচিহ্ন নির্দেশ করেছেন কবি রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়। বইয়ের নাম-কবিতা নাবিক জন্মের ভবিষ্য-এ তিনি বললেন – ‘i don’t write poetry, i only pretend to write’। তখনই এই একটিবারের জন্যে কবির সততা নিয়ে প্রশ্ন জাগে মনে। কেন? প্রেম এখানে সনাতন নয়, তাই ভাবায়। জীবনদর্শন ক্লিশে মধ্যবিত্তে আবদ্ধ নয়, তাই মুক্তি শোনায়। কাব্যভাষা সতর্ক সাবধানী, তাই সৎ পাঠক হ’তে আকাঙক্ষা জাগে। কবি যখন বলেন – ‘আমাদের পাসপোর্টে গিনি ও মদের সুযোগ ছিল/ কিছু বেশী’, তখন মাথা বাঁচিয়ে ঢুকে পড়া যায় তাঁর সার্কাসের তাঁবুতে। যেখানে ‘বহুছিদ্র ঘেরাটোপের অর্থ সুস্থ বায়ুচলাচল ও স্থায়ী পরিগম’।
‘নাবিক জন্মের ভবিষ্য’ বইটির কবিতার বিষয়গুলিকে মোটামুটিভাবে ৩ ভাগে ভাগ ক’রে নিলাম আমার পাঠ-অভিজ্ঞতা অনুসারে।
১। প্রেম বা বলা ভালো প্রেম বিষয়ক।
২। সমকাল, যা কিনা কবির সময়ের আদ্যান্ত বিশ্লেষণ।
৩। দর্শন – বস্তুজগত এবং অনুভবের মধ্যে অনায়াস যাতায়াত।
বলা নেওয়া ভালো, প্রত্যেকটি কবিতাতেই এই ১, ২, ৩ বা ১-২, ২-৩ বা ৩-১-এর পারম্যুটেশান-কম্বিনেশান ঘটেছে সার্থক কবিতার মত ক’রেই।
তা প্রেম শুনেই ছন্দোবদ্ধ ছড়া পড়তে এলে ঠকবেন। সাবধান পাঠক, এখানে পরিচিত কুঞ্জে অলির গুঞ্জন নেই। তাই প্রেম বলতে গদগদ যে বাজারিত সিরাপ আজকাল হাতে মুখে লেগে যায়, তার ছিটেফোঁটাও অনুপস্থিত এখানে। তাহলে? ‘দুটো ভিন্ন নারী ও পুরুষ। তাদের অফুরন্ত গল্পের গ্রহমাটি। প্রেম ও মৈথুন।’ স্মি-কথা ১ এবং ২-এর মতোই আত্মহত্যার রাত, বাসভূমি, সারদিয়া, আংরাখা – ১, ২, ৩-এর মত কবিতাগুলিতে নিখাদ প্রেমায়ন ঘটেছে কবিস্বত্তার। সেই কারণেই ‘স্মি-র শরীরে কোনও আঁচড় নেই।’ না। রাজর্ষির কবিতায় স্থূল শরীর নেই। আবার অহেতুক স্নিগ্ধ প্রেমালাপও অনুপস্থিত। বলা যেতে পারে, পরিমিত রোমান্টিসিজমের সাথে নতুন কালিতে কলম ডুবিয়েছেন কবি। নাহলে ‘স্থির এক পর্যটনের মত তোমার দুবাহু ঠেলে উঠে আসে/ শীর্ণ এক নদী, আমাকে মাস্তুল জেনো’ বা ‘... তোর নাম দিলাম পুনর্ভবা।/ মাস পয়লা তোর কাছেই যাবো।/ বুকে ফোটাবি অমন জ্যোৎস্না। মাধুকরী আদায় দিবি।’ – এমন সব পঙক্তি কোথা থেকে এল?
আগেই বলেছি প্রেমের সাথে মিশে গেছে কবির সমকাল এবং সময়োচিত দর্শন। তাই যখন পড়ি – ‘দেখছিস না তোর তোরমুজ থেকে মদ চোঁইয়াচ্ছে ক্রিস্টাল/ আর তাকেই আলো ভেবে ওরা কেমন দাঁড় হাঁকাচ্ছে’ (আত্মহত্যার রাত) বা ‘গানভাঙা ঘুমের মধ্যে সোঁদায়/ বহুজাতিক চামড়ার গন্ধ,/ কবুতরী ভেসে যাচ্ছে প্রত্নতত্ত্বের শেষ নিদর্শন...’ (গ্রাম-নগর সমতা অথবা নীল-তাঁবেদার), তখন কবির সাথেই ‘সময়ের জন্য সময়ান্তর’ হতে ইচ্ছে করে। এরকম বহু লাইন একের পর এক উদ্ধৃত করতে ইচ্ছা করে। আমাদের সময়ে দাঁড়িয়েই রাজর্ষি সময়কে ক্যানভাসিত করেছেন নিপুণভাবে। এই প্রসঙ্গে সিদ্ধার্থ, মৈথুন থেকে উঠে আসা অমৃতত্ত্বের পরবর্তী শুনানি, নাবিক জন্মের ভবিষ্য বা গপদ্য-র কথা বিশেষ ক’রে উঠে আসে। পাঠকের নিমগ্ন পাঠ দাবী করে কবিতাগুলি। অনুভবের দেওয়ালের মধ্যে দিয়ে আমরা যাতায়াত করতে শুরু করি কবির নির্দেশিত পথ ধরে।
ভাষার প্রয়োগ (নাকি শব্দক্ষেপণ বলবো?) নাবিক জন্মের ভবিষ্য বইটির উপভোগ্য বৈশিষ্ট্য। শব্দের বিজ্ঞানসম্মত পরিমাপও এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। ‘যেমন আকাশের উল্টোমুখে সমুদ্র ঝোলে/ আর তোমার গর্ভের দেওয়ালে দেওয়ালে ধারালো নখ’ (নাবিক জন্মের ভবিষ্য) বা ‘উলঙ্গ থেকে ঝর্ণা নামালে পাথর ভেসে যেতে পারি’ (সারদিয়া) – এমন সব কথা সাম্প্রতিক অন্যান্য কাব্যগ্রন্থ পাঠে পেলাম কই? খুব সহজ কিছু শব্দও ব্যবহারের তারতম্যে এবং হিসেবী প্রয়োগে জাদু ঘটিয়েছে। যেমন, ‘ত্বরণজ যোগফল হঠাৎই কামড় খেলে/ দুর্দিনে প্লেগ নেমে আসে/ ইঁদুরদৌড়ের কাছে শিল্পময় বর্ণমালা স্রোত/ একটা দুটো ফুটে ওঠে আসন্নমড়ক’। এমন ম্যাজিক কী মনে রাখবেন না পাঠক? আর তাই, নিঃসন্দেহে রাজর্ষি চট্টোপাধ্যায়ের নাবিক জন্মের ভবিষ্য এ সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিতার বই।
বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ বইটি ই-বুক আকারে নিচের লিংকে পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু চটুল ও সহজপাচ্য সনাতন সুন্দরের আশায় ক্লিক করবেন না দয়া করে।
লিংক – Click This Link