somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা নববর্ষ উদযাপন : মুসলিমদের করণীয়

১৪ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ভূমিকা
নববর্ষ, বর্ষবরণ, পহেলা বৈশাখ— এ শব্দগুলো বাংলা নতুন বছরের আগমন এবং এ উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব-অনুষ্ঠানাদিকে ইঙ্গিত করে। এই উৎসবকে প্রচার মাধ্যমসমূহে বাঙালির ঐতিহ্য হিসেবে রঞ্জিত করা হয়ে থাকে। তাই জাতিগত একটি ঐতিহ্য হিসেবে এই উৎসবকে এবং এর সাথে সম্পৃক্ত কর্মকাণ্ডকে সমর্থন যোগানোর একটা বাধ্যবাধকতা অনুভূত হয় সবার মনেই – এ যে বাঙালি জাতির উৎসব! তবে বাংলাদেশে বসবাসরত বাঙালি জাতির শতকরা ৮৭ ভাগ লোক আবার মুসলিমও বটে, তাই স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে:নববর্ষ উদযাপন এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানাদি যেমন: রবীন্দ্রসংগীতের মাধ্যমে বর্ষবরণ, বৈশাখী মেলা, রমনার বটমূলে পান্তা-ইলিশের ভোজ, জীবজন্তু ও রাক্ষস-খোক্কসের প্রতিকৃতি নিয়ে গণমিছিল – এবং এতদুপলক্ষে নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা, হাসি-ঠাট্টা ও আনন্দ উপভোগ, সাজগোজ করে নারীদের অবাধ বিচরণ ও সৌন্দর্যের প্রদর্শনী, সহপাঠী সহপাঠিনীদের একে অপরের দেহে চিত্রাংকন – এসবকিছু কতটা ইসলাম সম্মত? ৮৭ ভাগ মুসলিম যে আল্লাহতে বিশ্বাসী, সেই আল্লাহ কি মুসলিমদের এই সকল আচরণে আনন্দ-আপ্লুত হন, না ক্রোধান্বিত হন? নববর্ষকে সামনে রেখে এই নিবন্ধে এই বিষয়টি আলোচিত হয়েছে।
বাংলা সনের উৎপত্তি :
মোঘল সম্রাট আকবরের হাত ধরে বাংলা সনের পথচলা। বাংলা সন প্রবর্তনের পিছনে প্রধানত দু’টি কারণ পরিলক্ষিত হয়। প্রথমতঃ আকবরের শাসনকার্য হিজরী সন অনুযায়ী পরিচালিত হ’ত। এতে খাজনা আদায়ে অসুবিধার সৃষ্টি হ’ত। কারণ চান্দ্রবর্ষ প্রতি বছর ১০/১১ দিন এগিয়ে যায়। এটি আল্লাহর বিশেষ করুণা যে, তিনি ইবাদতকে চন্দ্রের সাথে নির্দিষ্ট করেছেন। এতে করে যুগ পরিক্রমায় আরবী মাসগুলো সব ঋতুতেই আসে। সূর্যের সাথে সম্পৃক্ত হলে চিরকালই এক মওসুমে ছিয়াম অথবা অন্যান্য ইবাদত পালন করতে হ’ত। কারণ সূর্যের সাথে সৌরবর্ষের হিসাব থাকায় দিন-মাস-ঋতুর গণনা সব সময় একই থাকে। শস্য উৎপাদন ও খাজনা আদায়ের সমন্বয় সাধনের জন্য সম্রাট আকবর সৌরবর্ষের হিসাবে বাংলা সালের প্রবর্তন করেন।[বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ এপ্রিল ২০১৪, পৃঃ ৭]
ইতিহাসে দ্বিতীয় যে কারণটির উল্লেখ রয়েছে, তা হল- আকবরের ছিল পাঁচ শতাধীক স্ত্রী।[Akber had over five thousand wives. Vindication of Hurangz. p. 143] মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন নানা ধর্মের স্ত্রীদের মধ্যে হিন্দুপ্রধান দেশ ভারতে আকবরের হিন্দু স্ত্রীদের সংখ্যা ছিল বেশী। মুসলিম শাসক আকবরের হেরেমে সকল স্ত্রী নিজ নিজ ধর্ম পালন করত। পৃথক পৃথক উপাসনালয় ছিল তাদের জন্য। তবে আকবরের জীবনে হিন্দুয়ানী ষ্টাইল আছড়ে পড়ে মূলতঃ হিন্দু স্ত্রীদের সংখ্যাধিক্যের কারণে। তৎকালীন হিন্দুরা আকবরের নিকট দাবী জানায়, যীশুখৃষ্টের সাথে খৃষ্টাব্দ, মুহাম্মাদের সাথে হিজরী সাল জড়িত। আমাদের জন্য পৃথক কিছু নেই। অথচ হিন্দু হিতৈষী বাদশাহ হিসাবে হিন্দুদের কল্যাণে আপনার পৃথক সালের ব্যবস্থা করা উচিত। অতঃপর তাদের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রবর্তন করা হল ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ সনের।[গোলাম আহমাদ মোর্তাযা, ইতিহাসের ইতিহাস, পৃঃ ১০৫] এটিই পরবর্তীতে ‘ফসলী সন’, অতঃপর ‘বাংলা সন’ বা বঙ্গাব্দ নামে প্রচলিত হয়। উল্লেখ্য, সম্রাট আকবরের নির্দেশে বাংলা সনের উক্ত ক্যালেন্ডার প্রস্ত্তত করেন তৎকালীন পন্ডিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ উল্লাহ সিরাজী।
আকবর সিংহাসনে আরোহণ করেন ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দের ৫ নভেম্বর মোতাবেক হিজরী ৯৬৩ সালের মুহাররম মাসে। তখনো বঙ্গে শকাব্দ চালু ছিল যার শুরুর মাস ছিল চৈত্র। শকাব্দ হল- মধ্য এশিয়ার প্রাচীন রাজা ‘শক’ কর্তৃক প্রবর্তিত সাল। এটি বাংলা সাল থেকে ৫১৫ বছর বেশী ও খৃষ্টসাল থেকে ৭৮ বছর কম (অর্থাৎ ১৪২১+৫১৫/২০১৪-৭৮=১৯৩৬, এখন শকাব্দ ১৯৩৬)।
আকবরের সিংহাসনারোহণের মাস মুহাররমের সাথে শকাব্দের বৈশাখ মাস পড়ে যাওয়ায় তিনি ‘তারিখ-ই-ইলাহী’ বা ফসলী সনের শুরু করেন বৈশাখ মাস দিয়ে। সেই থেকে চৈত্রের পরিবর্তে বৈশাখ দিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। আববরের আদেশে ১৫৮৫ খৃষ্টাব্দ মোতাবেক ৯৯২ হিজরীতে ফসলী সন বা বাংলা সনের ফরমান জারী হয়। ৯৯২ হিজরীতে আদেশ জারী করলেও ৯৬৩ হিজরীতে আকবরের সিংহাসন আরোহণের সাল থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। ৯৬৩ সালে বাংলা ও হিজরী সাল একই ছিল। অতঃপর হিজরী সাল প্রতি বছর ১০/১১ দিন এগিয়ে যাওয়ায় (২০১৪ইং/১৪২১ বঙ্গাব্দ-৯৬৩) ৪৫৯ বছরে হিজরীবর্ষ এগিয়ে গেছে ১৫ বছর। ফলে এখন বাংলা ১৪২১ আর আরবী ১৪৩৬।
ইংরেজী সালের বর্তমান রূপ যেভাবে এল :
খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে মধ্য আমেরিকার মেক্সিকোতে এক উচ্চমান সভ্যতা ছিল। যার নাম ‘মায়া সভ্যতা’। মায়াদের সংখ্যা তাত্ত্বিক জ্ঞান, গ্রহ-নক্ষত্রের গতিবিধি পর্যবেক্ষণে অসাধারণ দক্ষতা, শিল্পকলার উন্নতি ইত্যাদিতে ইতিহাস বিস্মিত। তারাই প্রথম আবিষ্কার করে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আসতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন।
বলা হয়ে থাকে, নিজেদের গণনার সুবিধার্থে সর্বপ্রথম রোমানরা ক্যালেন্ডার তৈরী করে। তাতে বছরের প্রথম মাস ছিল মারটিয়াস। যা বর্তমানের মার্চ মাস। এটি তাদের যুদ্ধ দেবতার নামানুসারে নামকরণ করা হয়। অতঃপর খৃষ্টপূর্ব ১ম শতকে জুলিয়াস সিজার কয়েক দফা পরিবর্তন ঘটান ক্যালেন্ডারে। তৎকালীন প্রখ্যাত জোতির্বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় তিনিই প্রথম ক্যালেন্ডারে (মায়াদের আবিষ্কৃত সূর্যকে পৃথিবীর প্রদক্ষিণ কাল) ৩৬৫ দিন ব্যবহার করেন। দীর্ঘদিন পর্যন্ত তার উদ্ভাবিত ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ বাজারে প্রচলিত থাকে। বহুকাল পরে এই ক্যালেন্ডার সংশোধন করে নতুন একটি ক্যালেন্ডার চালু হয়। দু’জন জোতির্বিজ্ঞানীর সাহায্যে খৃষ্টধর্মের ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরী ১৫৭৭ সালে জুলিয়াস প্রবর্তিত প্রচলিত ক্যালেন্ডারটিতে পরিবর্তন আনেন। অবশেষে ১৫৮২ সালে আরেক দফা সংষ্কার করে বর্তমান কাঠামোতে দাঁড় করান। পরিবর্তিত এ ক্যালেন্ডারে নতুন বর্ষের শুরু হয় জানুয়ারী দিয়ে, যা গ্রীকদের আত্মরক্ষার দেবতা ‘জানুস’-এর নামে রাখা হয়। আমাদের ব্যবহৃত বর্তমান ইংরেজী ক্যালেন্ডারটি ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’। প্রায় সারাবিশ্বে প্রচলিত ইংরেজী ক্যালেন্ডার এখন এটিই।
ইংরেজী সালের সাথে বাংলা সালের সমন্বয় :
ইংরেজী সালের মত বাংলা সালেও ৩৬৫ দিন। মূলতঃ পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট ৪৭ সেকেন্ড অর্থাৎ প্রায় ৬ ঘণ্টা। চার বছর পর এই ৬ ঘণ্টা ১ দিনে পরিণত হয়ে ৩৬৬ দিন হয়ে যায়। ইংরেজী ১২ মাসের মধ্যে ৭ মাস ৩১ দিনে (৭´৩১=২১৭), ৪ মাস ৩০ দিনে (৪´৩০=১২০), ফেব্রুয়ারী মাস ২৮ দিনে মোট (২১৭+১২০+২৮)= ৩৬৫ দিন। চার বছর পর ফেব্রুয়ারী মাস ২৯ দিনে হয়। যে বছর ফেব্রুয়ারী মাস ২৯ দিনে হয় সে বছরের দিন সংখ্যা হয় ৩৬৬ এবং বছরটির নাম Leapyear। ২৯ ফেব্রুয়ারীর দিনটির নাম Leap day। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে এই নিয়মটি প্রচলিত হয়ে আসছে।
বাংলা সালের সাথে খৃষ্টাব্দের মিল করতে ড. মুহাম্মাদ শহীদুল্লাহকে প্রধান করে বাংলা একাডেমীর উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ঐ কমিটি ১৭ ফেব্রুয়ারী ১৯৬৬ সালে বাংলা সালের সংস্কার করেন এভাবে-
১. বছরের প্রথম পাঁচ মাস (বৈশাখ, জৈষ্ঠ্য, আষাঢ়, শ্রাবণ ও ভাদ্র) গণনা হবে ৩১ দিনে।
২. পরের সাত মাস (আশ্বিন, কার্তিক, অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন, চৈত্র) গণনা হবে ৩০ দিনে।
৩. ইংরেজী লিপ ইয়ারে বাংলা ফাল্গুনের সাথে ১ যোগ হয়ে ৩১ দিনে হবে।
এই সংস্কারের ফলে এখন প্রতি ইংরেজী বছরের ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ হয়। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঙ্গালীরা এ সংস্কার গ্রহণ করেনি। ফলে বাংলা সাল হ’লেও তাদের সাথে তারিখে আমাদের মিল নেই।
বৈশাখ উদযাপনের গোড়ার কথা :
সম্রাট আকবরের সময়কাল থেকেই পহেলা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। চৈত্রের শেষ দিনে বঙ্গের জমিদারদের নিকট প্রজারা তাদের সকল খাজনা, মাশুল, শুল্ক পরিশোধ করত। পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ তারা উৎসবের আয়োজন করত। মূলতঃ তাদের এদিনের প্রধান কাজ ছিল একটি হালখাতা তৈরী করা। হালখাতা মানে বর্তমান খাতা বা নতুন হিসাব বহি। অর্থাৎ নতুন বছরের যাবতীয় হিসাব নতুন করে শুরু করার খাতা। এটা হল পহেলা বৈশাখ উদযাপনের প্রচলিত ইতিহাস।
বর্ষবরণ হয় যেভাবে :
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্ষবরণ হয় দুইবার। একবার তাবৎ বিশ্বের সাথে ইংরেজী নববর্ষ উদযাপন। নিজস্ব সংস্কৃতিতে আরেকবার বৈশাখ উদযাপন। অবশ্য বৈশাখ উদযাপনটাই যেন বাঙ্গালির ‘অবশ্য পালনীয়’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈশাখ মাতাল জনৈক লেখক পহেলা বৈশাখের চিত্রাঙ্কনে লিখেছেন- ‘শিশুরা খেলছে, বড়রা বেড়াচ্ছে, প্রেমিক-প্রেমিকারা কূজনে মগ্ন, খুশিতে, লাবণ্যে, মাধুর্যে সব পরিবেশ ঝলমল করে উঠে। ওরা না থাকলে যেন মিথ্যে হত আকাশের তারা ফোটা, মিথ্যে হত জীবনের মানে’।[নয়াদিগন্ত, ১৪ এপ্রিল, পৃঃ ৭]
ইংরেজী নববর্ষ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালিত হয়। আমেরিকাতে হয় সবচেয়ে বড় নিউইয়ার পার্টি- যাতে ৩০ লাখ লোক অংশগ্রহণ করে। অষ্ট্রেলিয়ার সিডনিতে প্রায় ১৫ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ৮০ হাযারের মত আতশবাজি ফুটানো হয়। মেক্সিকোতে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২-টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে ১২-টা ঘণ্টা ধ্বনি বাজানো হয়। প্রতি ঘণ্টা ধ্বনিতে ১টি করে আঙ্গুর খাওয়া হয়, আর মনে করা হয়, যে উদ্দেশ্যে আঙ্গুর খাওয়া হবে সে উদ্দেশ্য পূরণ হবে। ডেনমার্কে আবার কেমন লঙ্কাকান্ড! ডেনিশরা প্রতিবেশীর দরজায় কাঁচের জিনিসপত্র ছুড়তে থাকে। যার দরজায় যতবেশী কাঁচ জমা হবে, নতুন বছর তার তত ভাল যাবে। আর কোরিয়ানরা যৌবন হারানোর ভয়ে রাতে ঘুম থেকে বিরত থাকে। তাদের বিশ্বাস বছর শুরুর সময় ঘুমালে চোখের ভ্রু সাদা হয়ে যায়। বাংলাদেশে রাত বারটা বাজার সাথে সাথে আতশবাজি, নাচ-গান, হৈ-হুল্লোড়, উন্মত্ততা শুরু হয়। নতুন পোশাক, ভাল খাবার, বিভিন্ন স্পটে ঘুরতে যাওয়া, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পালিত হয় ইংরেজী নববর্ষ।
অপরদিকে বাংলাদেশে বৈশাখ বরণের চিত্রও ভয়াবহ। পহেলা বৈশাখ শুরু হয় ভোরে। সূর্যোদয়ের পর পর। মূল অনুষ্ঠান শুরু হয় ৩১ চৈত্র; চৈত্র সংক্রান্তির মধ্য দিয়ে। চৈত্র সংক্রান্তি মানে চৈত্রের শেষদিন। এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে চৈত্রকে বিদায় ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানো হয়। সূর্যাদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ছায়ানটের শিল্পিরা বিশ্বকবির বৈশাখী গান ‘এসো হে বৈশাখ, এসো এসো…’ গেয়ে সূর্যবরণের মাধ্যমে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়।
জানা প্রয়োজন, রমনার বটমূল পহেলা বৈশাখের ধমনী। যে গাছের ছায়ায় ছায়ানটের মঞ্চ তৈরী হয় সেটি বট গাছ নয়। অশ্বত্থ গাছ। সুতরাং বটমূল নয় অশ্বত্থমূল। বটমূল হল প্রচলিত ভুল শব্দের ব্যবহার।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে বৈশাখের প্রধান আকর্ষণ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ বের হয়। দেশের সমৃদ্ধি কামনায় শোভাযাত্রা বের হয় বলে এর নাম ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণে মূর্তি-মুখোশ মিছিলে ঢাক-ঢোল, কাঁসা-তবলার তালে তালে চলতে থাকে সঙ্গীত-নৃত্য, উল্লাস-উন্মত্ততা। এ শোভাযাত্রায় এ বছরের শ্লোগান ছিল, ‘জাগ্রত কর, উদ্যত কর, নির্ভর কর হে’। লক্ষণীয় যে, মঙ্গল শোভাযাত্রার মঙ্গল কামনার প্রতীক হল চারুকলার ম্যাসব্যাপী পরিশ্রমে বানানো ঘোড়া, হাতি, ময়ূর, পেঁচা, পুতুল, পাখি, মূর্তি, বিভিন্ন মুখোশ প্রভৃতি।
পান্তা-ইলিশ যেভাবে :
সব কিছু ছাপিয়ে পানতা-ইলিশ হয়ে ওঠেছে বৈশাখের এক অপরিহার্য অনুষঙ্গ। ইট-বালিতে সিমেন্টের ন্যায়। পান্তা-ইলিশ বিহীন বৈশাখের গাথুঁনী যেন বালুময়, খড়খড়ে, ক্ষীয়মান। বৈশাখে পান্তা-ইলিশের সংযোজনকারীদের অন্যতম সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল নিজেই উল্লেখ করেছেন কিভাবে তারা এর সূচনা করেন। তার জবানীতে ঘটনাটি এরূপ- ৫ সেগুনবাগিচা বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ছিল দৈনিক দেশ এবং সাপ্তাহিক বিপ্লবের কার্যালয়। সেকারণেই সেখানে বসত লেখক আড্ডা। আমি ছিলাম একজন নিয়মিত আড্ডারু। ১৯৮৩ সাল। চৈত্রের শেষ। চারদিকে বৈশাখের আয়োজন চলছে। আমরা আড্ডা দিতে দিতে পান্তা-পিয়াজ-কাঁচা মরিচের কথা তুলি। দৈনিক দেশের (প্রয়াত) বোরহান ভাই রমনা বটমূলে পান্তা-ইলিশ চালুর প্রস্তাব দিলেন। আমি সমর্থন দিলাম। প্রথমে আমাকে দায়িত্ব নিতে বললেন। কারণ সেই আড্ডায় আমিই একমাত্র বহিরাগত। ফলে কাজটা সম্পাদন করতে সুবিধা হবে। আমি একা রাজি না হওয়ায় কবি ফারুক মাহমূদ আমাকে নিয়ে পুরো আয়োজনের ব্যবস্থা করলেন। নিজেদের মধ্যে পাঁচ টাকা করে চাঁদা তোলা হল। বাজার করা আর রান্না-বান্নার দায়িত্ব দিলেন বিল্পব পত্রিকার পিয়নকে।
প্রথমে আমরা পান্তা আর ডিম ভাজা দিতে চাইলাম। কিন্তু ডিমের স্থলে স্থান পেল জাতীয় মাছ ইলিশ। রাতে ভাত রেঁধে পান্তা তৈরী করে, কাঁচা মরিচ, শুকনো মরিচ, পেঁয়াজ, ইলিশ ভাজা নিয়ে ‘এসো হে বৈশাখের আগেই ভোরে আমরা হাজির হ’লাম বটমূলের রমনা রেষ্টেুরেন্টের সামনে। সঙ্গে মাটির সানকি। মুহূর্তের মধ্যে শেষ হলো পান্তা-ইলিশ। এভাবে যাত্রা শুরু হলো পান্তা-ইলিশের (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ এপ্রিল ২০১৪, পৃষ্ঠা- ১)।
ইসলাম ধর্মে উৎসবের রূপরেখা
আমরা অনেকে উপলব্ধি না করলেও, উৎসব সাধারণত একটি জাতির ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে সম্পৃক্ত হয়। উৎসবের উপলক্ষগুলো খোঁজ করলে পাওয়া যাবে উৎসব পালনকারী জাতির ধমনীতে প্রবাহিত ধর্মীয় অনুভূতি, সংস্কার ও ধ্যান-ধারণার ছোঁয়া। উদাহরণস্বরূপ খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের বড়দিন তাদের বিশ্বাসমতে স্রষ্টার পুত্রের জন্মদিন। মধ্যযুগে ইউরোপীয় দেশগুলোতে জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নববর্ষ পালিত হতো ২৫শে মার্চ, এবং তা পালনের উপলক্ষ ছিল এই যে, ঐ দিন খ্রিষ্টীয় মতবাদ অনুযায়ী মাতা মেরীর নিকট ঐশী বাণী প্রেরিত হয় এই মর্মে যে, মেরী ঈশ্বরের পুত্রের জন্ম দিতে যাচ্ছেন। পরবর্তীতে ১৫৮২ সালে গ্রেগরীয়ান ক্যালেন্ডারের সূচনার পর রোমক ক্যাথলিক দেশগুলো পয়লা জানুয়ারী নববর্ষ উদযাপন করা আরম্ভ করে। ঐতিহ্যগতভাবে এই দিনটি একটি ধর্মীয় উৎসব হিসেবেই পালিত হত। ইহুদীদের নববর্ষ ‘রোশ হাশানাহ’ ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত ইহুদীদের ধর্মীয় পবিত্র দিন ‘সাবাত’ হিসেবে পালিত হয়। এমনিভাবে প্রায় সকল জাতির উৎসব-উপলক্ষের মাঝেই ধর্মীয় চিন্তা-ধারা খুঁজে পাওয়া যাবে। আর এজন্যই ইসলামে নবী মুহাম্মাদ (সা.) পরিষ্কারভাবে মুসলিমদের উৎসবকে নির্ধারণ করেছেন, ফলে অন্যদের উৎসব মুসলিমদের সংস্কৃতিতে প্রবেশের কোন সুযোগ নেই। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।” [বুখারী: ৯৫২; মুসলিম: ৮৯২]
বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ সম্পর্কে বলেন: “উৎসব-অনুষ্ঠান ধর্মীয় বিধান, সুস্পষ্ট পথনির্দেশ এবং ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানেরই একটি অংশ, যা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: ‘তোমাদের প্রত্যেকের জন্যই আমি একটি নির্দিষ্ট বিধান এবং সুস্পষ্ট পথ নির্ধারণ করেছি।’ (সূরা আল-মায়িদাহ, ৫:৪৮)
‘প্রতিটি জাতির জন্য আমি অনুষ্ঠান [সময় ও স্থান] নির্দিষ্ট করে দিয়েছি যা তাদেরকে পালন করতে হয়।’ (সূরা আল-হাজ্জ্ব, ২২:৬৭)
যেমনটি কিবলাহ, সালাত এবং সাওম ইত্যাদি। সেজন্য তাদের [অমুসলিমদের] উৎসব-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া আর তাদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে অংশ নেয়ার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই উৎসব-অনুষ্ঠানের সাথে একমত পোষণ করা অর্থ কুফরের সাথে একমত পোষণ করা। আর এসবের একাংশের সাথে একমত পোষণ করা অর্থ কুফরের শাখাবিশেষের সাথে একমত হওয়া। উৎসব-অনুষ্ঠানাদি স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যার দ্বারা ধর্মগুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়।…নিঃসন্দেহে তাদের সাথে এসব অনুষ্ঠান পালনে যোগ দেয়া একজনকে কুফরের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর বাহ্যিকভাবে এগুলোতে অংশ নেয়া নিঃসন্দেহে পাপ। উৎসব অনুষ্ঠান যে প্রতিটি জাতির স্বকীয় বৈশিষ্ট্য, এর প্রতি রাসূলুল্লাহ (সা.) ইঙ্গিত করেছেন, যখন তিনি বলেন: ‘প্রত্যেক জাতির নিজস্ব ঈদ রয়েছে, আর এটা আমাদের ঈদ।’
এছাড়া আনাস ইবনে মালিক (রা.) বর্ণিত: “রাসূলুল্লাহ (সা.) যখন [মদীনায়] আসলেন, তখন তাদের দুটো উৎসবের দিন ছিল। তিনি (সা.) বললেন, ‘এ দুটো দিনের তাৎপর্য কি?’ তারা বলল, ‘জাহিলিয়াতের যুগে আমরা এ দুটো দিনে উৎসব করতাম।’ রাসূলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমাদেরকে এদের পরিবর্তে উত্তম কিছু দিয়েছেন: ইয়াওমুল আদহা ও ইয়াওমুল ফিতর ।’” (সূনান আবু দাউদ)
এই হাদীস থেকে দেখা যাচ্ছে যে, ইসলাম আগমনের পর ইসলাম বহির্ভূত সকল উৎসবকে বাতিল করে দেয়া হয়েছে এবং নতুনভাবে উৎসবের জন্য দুটো দিনকে নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সাথে অমুসলিমদের অনুসরণে যাবতীয় উৎসব পালনের পথকে বন্ধ করা হয়েছে।
ইসলামের এই যে উৎসব – ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা – এগুলো থেকে মুসলিম ও অমুসলিমদের উৎসবের মূলনীতিগত একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য স্পষ্ট হয়, এবং এ বিষয়টি আমাদের খুব গুরুত্বসহকারে লক্ষ্য করা উচিৎ, তা হচ্ছে:
অমুসলিম, কাফির কিংবা মুশরিকদের উৎসবের দিনগুলো হচ্ছে তাদের জন্য উচ্ছৃঙ্খল আচরণের দিন, এদিনে তারা নৈতিকতার সকল বাঁধ ভেঙ্গে দিয়ে অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়, আর এই কর্মকান্ডের অবধারিত রূপ হচ্ছে মদ্যপান ও ব্যভিচার। এমনকি খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বহুলোক তাদের পবিত্র বড়দিনেও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যকে জলাঞ্জলি দিয়ে মদ্যপ হয়ে ওঠে এবং পশ্চিমা বিশ্বে এই রাত্রিতে বেশ কিছু লোক নিহত হয় মদ্যপ অবস্থায় গাড়ী চালানোর কারণে।
অপরদিকে মুসলিমদের উৎসব হচ্ছে ইবাদতের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। এই বিষয়টি বুঝতে হলে ইসলামের সার্বিকতাকে বুঝতে হবে। ইসলাম কেবল কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি নয়, বরং তা মানুষের গোটা জীবনকে আল্লাহর সন্তুষ্টি অনুযায়ী বিন্যস্ত ও সজ্জিত করতে উদ্যোগী হয়। তাই একজন মুসলিমের জন্য জীবনের উদ্দেশ্যই হচ্ছে ইবাদত, যেমনটি কুরআনে আল্লাহ ঘোষণা দিচ্ছেন: “আমি জ্বিন ও মানুষকে আমার ইবাদত করা ছাড়া অন্য কোন কারণে সৃষ্টি করিনি।” (সূরা আয যারিয়াত, ৫১:৫৬)
সেজন্য মুসলিম জীবনের আনন্দ-উৎসব আল্লাহর বিরুদ্ধাচরণ ও অশ্লীলতায় নিহিত নয়, বরং তা নিহিত হচ্ছে আল্লাহর দেয়া আদেশ পালন করতে পারার মাঝে, কেননা মুসলিমের ভোগবিলাসের স্থান ক্ষণস্থায়ী পৃথিবী নয়, বরং চিরস্থায়ী জান্নাত। তাই মুসলিম জীবনের প্রতিটি কাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে থাকবে তাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ, তাদের ঈমান, আখিরাতের প্রতি তাদের অবিচল বিশ্বাস, আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালবাসা।
তাইতো দেখা যায় যে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা – এ দুটো উৎসবই নির্ধারণ করা হয়েছে ইসলামের দুটি স্তম্ভ পালন সম্পন্ন করাকে কেন্দ্র করে। ইসলামের চতুর্থ স্তম্ভ সাওম পালনের পর পরই মুসলিমরা ঈদুল ফিতর পালন করেন, কেননা এই দিনটি আল্লাহর আদেশ পালনের পর আল্লাহর কাছ থেকে পুরস্কার ও ক্ষমার ঘোষণা পাওয়ার দিন বিধায় এটি সাওম পালনকারীর জন্য বাস্তবিকই উৎসবের দিন – এদিন এজন্য উৎসবের নয় যে, এদিনে আল্লাহর দেয়া আদেশ নিষেধ কিছুটা শিথিল হতে পারে, যেমনটি বহু মুসলিমদের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা এই দিনে আল্লাহর আদেশ নিষেধ ভুলে গিয়ে অশ্লীল কর্মকান্ডে লিপ্ত হন, বরং মুসলিমের জীবনে এমন একটি মুহূর্তও নেই, যে মুহূর্তে তার ওপর আল্লাহর আদেশ নিষেধ শিথিলযোগ্য। তেমনিভাবে ঈদুল আযহা পালিত হয় ইসলামের পঞ্চম স্তম্ভ হাজ্জ পালনের পর পর। কেননা ৯ই জিলহজ্জ হচ্ছে ইয়াওমুল আরাফা, এদিনটি আরাফাতের ময়দানে হাজীদের ক্ষমা লাভের দিন, আর তাই ১০ই জিলহজ্জ হচ্ছে আনন্দের দিন – ঈদুল আযহা। এমনিভাবে মুসলিমদের উৎসবের এ দুটো দিন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহকে বেশী করে স্মরণ করার দিন, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন এবং শরীয়তসম্মত বৈধ আনন্দ উপভোগের দিন – এই উৎসব মুসলিমদের ঈমানের চেতনার সাথে একই সূত্রে গাঁথা।
নতুন বছরের সাথে মানুষের কল্যাণের সম্পর্ক
নতুন বছর নতুন কল্যাণ বয়ে আনে, দূরীভূত হয় পুরোনো কষ্ট ও ব্যর্থতার গ্লানি – এধরনের কোন তত্ত্ব ইসলামে আদৌ সমর্থিত নয়, বরং নতুন বছরের সাথে কল্যাণের শুভাগমনের ধারণা আদিযুগের প্রকৃতি-পুজারী মানুষের কুসংস্কারাচ্ছন্ন ধ্যান-ধারণার অবশিষ্টাংশ। ইসলামে এ ধরনের কুসংস্কারের কোন স্থান নেই। বরং মুসলিমের জীবনে প্রতিটি মুহূর্তই পরম মূল্যবান হীরকখন্ড, হয় সে এই মুহূর্তকে আল্লাহর আনুগত্যে ব্যয় করে আখিরাতের পাথেয় সঞ্চয় করবে, নতুবা আল্লাহর অবাধ্যতায় লিপ্ত হয়ে শাস্তির যোগ্য হয়ে উঠবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বছরের প্রথম দিনের কোন বিশেষ তাৎপর্য নেই। আর তাই তো ইসলামে হিজরী নববর্ষ পালনের কোন প্রকার নির্দেশ দেয়া হয়নি। না কুরআনে এর কোন নির্দেশ এসেছে, না হাদীসে এর প্রতি কোন উৎসাহ দেয়া হয়েছে, না সাহাবীগণ এরূপ কোন উপলক্ষ পালন করেছেন। এমনকি পয়লা মুহাররামকে নববর্ষের সূচনা হিসেবে গণনা করা শুরুই হয় নবীর (সা.) মৃত্যুর বহু পরে উমার ইবনুল খাত্তাবের (রা.) শাসন আমলে। এ থেকে বোঝা যায় যে, নববর্ষ ইসলামের দৃষ্টিতে কতটা তাৎপর্যহীন, এর সাথে জীবনে কল্যাণ-অকল্যাণের গতিপ্রবাহের কোন দূরতম সম্পর্কও নেই, আর সেক্ষেত্রে বাংলা নববর্ষের কিই বা তাৎপর্য থাকতে পারে ইসলামে?
কেউ যদি এই ধারণা পোষণ করে যে, নববর্ষের প্রারম্ভের সাথে কল্যাণের কোন সম্পর্ক রয়েছে, তবে সে শিরকে লিপ্ত হল, অর্থাৎ আল্লাহর সাথে অংশীদার স্থির করল। যদি সে মনে করে যে, আল্লাহ এই উপলক্ষ দ্বারা মানবজীবনে কল্যাণ বর্ষণ করেন, তবে সে ছোট শিরকে লিপ্ত হল। আর কেউ যদি মনে করে যে নববর্ষের আগমনের এই ক্ষণটি নিজে থেকেই কোন কল্যাণের অধিকারী, তবে সে বড় শিরকে লিপ্ত হল, যা তাকে ইসলামের গন্ডীর বাইরে নিয়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আর এই শিরক এমন অপরাধ যে, শিরকের ওপর কোন ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে চিরতরে হারাম করে দেবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন: “নিশ্চয়ই যে কেউই আল্লাহর অংশীদার স্থির করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন, আর তার বাসস্থান হবে অগ্নি। এবং যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই।” (আল-মায়িদাহ, ৫:৭২)
শুভাশুভ নির্ণয় ও তাতে বিশ্বাস স্থাপনের ব্যাপারে রাসূল (ছাঃ) বলেন الطِّيَرَةُ شِرْكٌ ‘কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শিরক’।[আবু দাউদ হা/৩৯১২; ইবনু মাজাহ হা/৩৫৩৮; তিরমিযী, মিশকাত হা/৪৫৮৪]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন, لَيْسَ مِنَّا مَنْ تَطَيَّرَ، أَوْ تُطِيَّرَ لَهُ أَوْ تَكَهَّنَ، أَوْ تُكِهِّنَ لَهُ أَوْ سَحَرَ، أَوْ سُحِرَ لَهُ ‘যে কুলক্ষণে বিশ্বাস করে এবং যাকে সে বিশ্বাস করায়, যে ভাগ্য গণনা করে এবং যাকে সে ভাগ্য গণনা করে দেয়, যে জাদু করে এবং যাকে সে জাদু করে দেয়- তারা আমাদের (উম্মাতে মুহাম্মাদীর) অন্তর্ভুক্ত নয়। [সিলসিলা ছহীহাহ হা/২১৯৫]
বাংলা নববর্ষ উদযাপনের সাথে মঙ্গলময়তার এই ধারণার সম্পর্ক রয়েছে বলে কোন কোন সূত্রে দাবী করা হয় , যা কিনা অত্যন্ত দুশ্চিন্তার বিষয়। মুসলিমদেরকে এ ধরনের কুসংস্কার ঝেড়ে ফেলে ইসলামের যে মূলতত্ত্ব সেই তাওহীদ বা একত্ববাদের ওপর পরিপূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
নববর্ষের অনুষ্ঠানাদি: শয়তানের পুরোনো কূটচালের নবায়ন
আমাদের সমাজে নববর্ষ যারা পালন করে, তারা কি ধরনের অনুষ্ঠান সেখানে পালন করে, আর সেগুলো সম্পর্কে ইসলামের বক্তব্য কি? নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে: বৈশাখী মেলা, যাত্রা, পালাগান, কবিগান, জারিগান, গম্ভীরা গান প্রভৃতি বিভিন্ন লোকসঙ্গীতের ব্যবস্থা, প্রভাতে উদীয়মান সূর্যকে স্বাগত জানান, নতুন সূর্যকে প্রত্যক্ষকরণ, নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে শিল্পীদের সংগীত, পান্তা-ইলিশ ভোজ, চারুশিল্পীদের শোভাযাত্রা, রমনার বটমূলে ছায়ানটের উদ্যোগে রবীন্দ্রনাথের আগমনী গান “এসো হে বৈশাখ…”, এছাড়া রেডিও টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান ও পত্রপত্রিকার বিশেষ ক্রোড়পত্র।
এবারে এ সকল অনুষ্ঠানাদিতে অনুষ্ঠিত মূল কর্মকান্ড এবং ইসলামে এগুলোর অবস্থান সম্পর্কে পর্যালোচনা করা যাক:
সূর্যকে স্বাগত জানানো ও বৈশাখকে সম্বোধন করে স্বাগত জানানো: এ ধরনের কর্মকান্ড মূলত সূর্য-পূজারী ও প্রকৃতি-পূজারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অনুকরণ মাত্র, যা আধুনিক মানুষের দৃষ্টিতে পুনরায় শোভনীয় হয়ে উঠেছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সমাজের অনেকেরই ধর্মের নাম শোনামাত্র গাত্রদাহ সৃষ্টি হলেও প্রকৃতি-পূজারী আদিম ধর্মের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নকল করতে তাদের অন্তরে অসাধারণ পুলক অনুভূত হয়। সূর্য ও প্রকৃতির পূজা বহু প্রাচীন কাল থেকেই বিভিন্ন জাতির লোকেরা করে এসেছে। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব ১৪ শতকে মিশরীয় “অ্যাটোনিসম” মতবাদে সূর্যের উপাসনা চলত। এমনিভাবে ইন্দো-ইউরোপীয় এবং মেসো-আমেরিকান সংস্কৃতিতে সূর্য পূজারীদেরকে পাওয়া যাবে। খ্রিষ্টান সম্প্রদায় কর্তৃক পালিত যীশু খ্রিষ্টের তথাকথিত জন্মদিন ২৫শে ডিসেম্বরও মূলত এসেছে রোমক সৌর-পূজারীদের পৌত্তলিক ধর্ম থেকে, যীশু খ্রিষ্টের প্রকৃত জন্মতারিখ থেকে নয়। ১৯ শতাব্দীর উত্তর-আমেরিকায় কিছু সম্প্রদায় গ্রীষ্মের প্রাক্কালে পালন করত সৌর-নৃত্য এবং এই উৎসব উপলক্ষে পৌত্তলিক প্রকৃতি পূজারীরা তাদের ধর্মীয়-বিশ্বাসের পুনর্ঘোষণা দিত। মানুষের ভক্তি ও ভালবাসাকে প্রকৃতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সৃষ্টির প্রতি আবদ্ধ করে তাদেরকে শিরক বা অংশীদারিত্বে লিপ্ত করানো শয়তানের সুপ্রাচীন “ক্লাসিকাল ট্রিক” বলা চলে। শয়তানের এই কূটচালের বর্ণনা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা কুরআনে তুলে ধরেছেন: “আমি তাকে ও তার জাতিকে দেখেছি, তারা আল্লাহকে ছেড়ে সূর্যকে সিজদা করছে এবং শয়তান তাদের কার্যাবলীকে তাদের জন্য শোভনীয় করেছে…” (সূরা আল নামল, ২৭:২৪)
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে রাত্রি-দিন, সূর্য-চন্দ্র। তোমরা সূর্যকে সিজদা করো না, চন্দ্রকেও না। সিজদা কর আল্লাহকে- যিনি এগুলোকে সৃষ্টি করেছেন, যদি তোমরা তাঁরই ইবাদত কর (৪১ঃ৩৭)।
আজকের বাংলা নববর্ষ উদযাপনে গান গেয়ে বৈশাখী সূর্যকে স্বাগত জানানো, আর কুরআনে বর্ণিত প্রাচীন জাতির সূর্যকে সিজদা করা, আর উত্তর আমেরিকার আদিবাসীদের সৌর-নৃত্য – এগুলোর মধ্যে চেতনাগত কোন পার্থক্য নেই, বরং এ সবই স্রষ্টার দিক থেকে মানুষকে অমনোযোগী করে সৃষ্টির আরাধনার প্রতি তার আকর্ষণ জাগিয়ে তোলার শয়তানী উদ্যোগ।
নববর্ষে মুখোশ নৃত্য, গম্ভীরা গান ও জীবজন্তুর প্রতিকৃতি নিয়ে মিছিল: গম্ভীরা উৎসবের যে মুখোশ নৃত্য, তার উৎস হচ্ছে কোচ নৃগোষ্ঠীর প্রাচীন কৃত্যানুষ্ঠান এবং পরবর্তীতে ভারতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধগণ এই নৃত্য আত্তীকরণ করে নিজস্ব সংস্করণ তৈরী করে। জন্তু-পূজার উৎস পাওয়া যাবে প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সভ্যতার কিছু ধর্মীয় মতবাদে, যেখানে দেবতাদেরকে জন্তুর প্রতিকৃতিতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনিভাবে নববর্ষের কিছু অনুষ্ঠানে প্রাচীন পৌত্তলিক ধর্মীয় মতবাদের ছোঁয়া লেগেছে, যা যথারীতি ইসলামবিদ্বেষীদের নিকট অত্যন্ত পছন্দনীয়, এগুলো তাদের আধ্যাত্মিক আবেগ-অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর জন্য সত্য ধর্মের বিকল্প এক বিকৃত পথ মাত্র। ইসলামের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সকল প্রকার মিথ্যা দেবতার অবসান ঘটিয়ে একমাত্র প্রকৃত ইলাহ, মানুষের স্রষ্টা আল্লাহর ইবাদাতকে প্রতিষ্ঠিত করা, যেন মানুষের সকল ভক্তি, ভালবাসা, ভয় ও আবেগের কেন্দ্রস্থলে তিনি আসীন থাকেন। অপরদিকে শয়তানের ষড়যন্ত্র হচ্ছে বিবিধ প্রতিকৃতির দ্বারা মানুষকে মূল পালনকর্তার ইবাদত থেকে বিচ্যুত করা। আর তাই তো ইসলামে প্রতিকৃতি কিংবা জীবন্ত বস্তুর ছবি তৈরী করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত যে রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন: “কিয়ামতের দিন সবচেয়ে কঠিন শাস্তি ভোগ করবে [জীবন্ত বস্তুর] ছবি তৈরীকারীরা।” [বুখারী: ৫৯৫০; মুসলিম: ২১০৯]
ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীস থেকে জানা যায়, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন: “যে কেউই ছবি তৈরী করল, আল্লাহ তাকে [কিয়ামতের দিন] ততক্ষণ শাস্তি দিতে থাকবেন যতক্ষণ না সে এতে প্রাণ সঞ্চার করে, আর সে কখনোই তা করতে সমর্থ হবে না।” [বুখারী:২২২৫; মুসলিম: ২১১০]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যে ঘরে কুকুর ও ছবি থাকে সে ঘরে রহমত ও বরকতের ফেরেশতা প্রবেশ করে না। [বুখারী, মিশকাত হা/৪৪৮৯]
নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন অশ্লীলতা: শিরকপূর্ণ আচার-অনুষ্ঠানের পরেই নববর্ষের অনুষ্ঠানাদির মধ্যে সমাজ-বিধ্বংসী যে বিষয়গুলো পাওয়া যাবে, তা হচ্ছে নারীকে জড়িয়ে বিভিন্ন ধরনের অশ্লীলতা। বৈশাখী মেলা, রমনার বটমূল, চারুকলার মিছিল, এর সবর্ত্রই সৌন্দর্য প্রদর্শনকারী নারীকে পুরুষের সাথে অবাধ মেলামেশায় লিপ্ত দেখা যাবে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন- দুই শ্রেণীর জাহান্নামী রয়েছে, যাদের আমি এখনও দেখিনি। এমন সম্প্রদায়, যাদের হাতে গরু পরিচালনা করার লাঠি থাকবে। তা দ্বারা তারা মানুষকে প্রহার করবে। আর নগ্ন পোষাক পরিধানকারী নারী, যারা পুরুষদেরকে নিজেদের দিকে আকৃষ্ট করে এবং নিজেরাও পুরুষের দিকে আকৃষ্ট হয়। তাদের মাথা বক্র উঁচু কাঁধ বিশিষ্ট উটের ন্যায়। তারা জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। এমনকি জান্নাতের সুগন্ধিও পাবে না। অথচ উহার সুগন্ধি এত এত দূর থেকে পাওয়া যায়’। [মুসলিম, মিশকাত হা/৩৫২৪]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমি জান্নাত দেখলাম। লক্ষ্য করলাম তাতে অধিকাংশ অধিবাসী দরিদ্র। জাহান্নাম দেখলাম। লক্ষ্য করলাম, তাতে অধিকাংশ অধিবাসী নারী’। [মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৫২৩৪]
পৃথিবীতে আল্লাহ মানুষকে যে সকল আকষর্ণীয় বস্তু দ্বারা পরীক্ষা করে থাকেন, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে নারী। রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেন: “আমি পুরুষের জন্য নারীর চেয়ে বড় কোন ফিতনা রেখে যাচ্ছি না।” [বুখারী: ৫০৯৬; মুসলিম:২৭৪০]
সমাজ নারীকে কোন অবস্থায়, কি ভূমিকায়, কি ধরনের পোশাকে দেখতে চায় – এ বিষয়টি সেই সমাজের ধ্বংস কিংবা উন্নতির সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত অতীব গুরুত্বপূর্ণ এক বিষয়। নারীর বিচরণক্ষেত্র, ভূমিকা এবং পোশাক এবং পুরুষের সাপেক্ষে তার অবস্থান – এ সবকিছুই ইসলামে সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের নির্দেশ দ্বারা নির্ধারিত, এখানে ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রথা, হালের ফ্যাশন কিংবা ব্যক্তিগত শালীনতাবোধের কোন গুরুত্বই নেই। যেমন ইসলামে নারীদের পোশাকের সুনির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়া আছে, আর তা হচ্ছে এই যে একজন নারীর যা স্বতই প্রকাশমান তা ব্যতীত দেহের অন্য কোন অঙ্গই বহিরাগত পুরুষেরা দেখতে পারবে না। বহিরাগত পুরুষ কারা? স্বামী, পিতা, শ্বশুর, পুত্র, স্বামীদের পুত্র, ভাই, ভ্রাতুষ্পুত্র, ভগ্নীপুত্র, মুসলিম নারী, নিজেদের মালিকানাধীন দাস, যৌনকামনাহীন কোন পুরুষ এবং এমন শিশু যাদের লজ্জাস্থান সম্পর্কে সংবেদনশীলতা তৈরী হয়নি, তারা বাদে সবাই একজন নারীর জন্য বহিরাগত। এখানে ব্যক্তিগত শালীনতাবোধের প্রশ্ন নেই। যেমন কোন নারী যদি বহিরাগত পুরুষের সামনে চুল উন্মুক্ত রেখে দাবী করে যে তার এই বেশ যথেষ্ট শালীন, তবে তা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হলেও ইসলামে গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা শালীনতা-অশালীনতার সামাজিক মাপকাঠি প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়, আর তাই সমাজ ধীরে ধীরে নারীর বিভিন্ন অঙ্গ উন্মুক্তকরণকে অনুমোদন দিয়ে ক্রমান্বয়ে এমন পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারে যে, যেখানে বস্তুত দেহের প্রতিটি অঙ্গ নগ্ন থাকলেও সমাজে সেটা গ্রহণযোগ্য হয় – যেমনটা পশ্চিমা বিশ্বের ফ্যাশন শিল্পে দেখা যায়। মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রে কিংবা ভারতবর্ষে যা শালীন, বাংলাদেশে হয়ত এখনও সেটা অশালীন – তাহলে শালীনতার মাপকাঠি কি? সেজন্য ইসলামে এধরনের গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়কে মানুষের কামনা-বাসনার ওপর ছেড়ে দেয়া হয়নি, বরং তা কুরআন ও হাদীসের বিধান দ্বারা নির্ধারণ করা হয়েছে। তেমনি নারী ও পুরুষের অবাধ মেলামেশা ও অবাধ কথাবার্তা ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কেননা এই অবাধ মেলামেশা ও অবাধ কথাবার্তাই ব্যভিচারের প্রথম ধাপ। যিনা-ব্যভিচার ইসলামী শরীয়াতের আলোকে কবীরা গুনাহ, এর পরিণতিতে হাদীসে আখিরাতের কঠিন শাস্তির বর্ণনা এসেছে। এর প্রসারে সমাজ জীবনের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ে, ছড়িয়ে পড়ে অশান্তি ও সন্ত্রাস এবং কঠিন রোগব্যাধি। আল্লাহর রাসূলের হাদীস অনুযায়ী কোন সমাজে যখন ব্যভিচার প্রসার লাভ করে তখন সে সমাজ আল্লাহর শাস্তির যোগ্য হয়ে ওঠে। আর নারী ও পুরুষের মাঝে ভালবাসা উদ্রেককারী অপরাপর যেসকল মাধ্যম, তা যিনা-ব্যভিচারের রাস্তাকেই প্রশস্ত করে। এ সকল কিছু রোধ করার জন্য ইসলামে নারীদেরকে পর্দা করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, নারী ও পুরুষের বিচরণ ক্ষেত্র পৃথক করা এবং দৃষ্টি অবনত রাখার বিধান রাখা হয়েছে। যে সমাজ নারীকে অশালীনতায় নামিয়ে আনে, সেই সমাজ অশান্তি ও সকল পাপকাজের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়, কেননা নারীর প্রতি আকর্ষণ পুরুষের চরিত্রে বিদ্যমান অন্যতম অদম্য এক স্বভাব, যাকে নিয়ন্ত্রণে রাখাই সামাজিক সমৃদ্ধির মূলতত্ত্ব। আর এজন্যই ইসলামে সুনির্দিষ্ট বৈবাহিক সম্পর্কের বাইরে যে কোন প্রকার সৌন্দর্য বা ভালবাসার প্রদর্শনী ও চর্চা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শনের ফলাফল দেখতে চাইলে পশ্চিমা বিশ্বের দিকে তাকানোই যথেষ্ট, গোটা বিশ্বে শান্তি, গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ঝান্ডাবাহী খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি ছয় মিনিটে একজন নারী ধর্ষিত হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত তথাকথিত সভ্য দেশে মানুষের ভিতরকার এই পশুকে কে বের করে আনল? অত্যন্ত নিম্নবুদ্ধিসম্পন্ন লোকেও সহজেই বুঝতে পারে যে স্রষ্টার বেঁধে দেয়া শালীনতার সীমা যখনই শিথিল করা শুরু হয়, তখনই মানুষের ভিতরকার পশুটি পরিপুষ্ট হতে শুরু করে। পশ্চিমা বিশ্বের অশালীনতার চিত্রও কিন্তু একদিনে রচিত হয়নি। সেখানকার সমাজে নারীরা একদিনেই নগ্ন হয়ে রাস্তায় নামেনি, বরং ধাপে ধাপে তাদের পোশাকে সংক্ষিপ্ততা ও যৌনতা এসেছে, আজকে যেমনিভাবে দেহের অংশবিশেষ প্রদর্শনকারী ও সাজসজ্জা গ্রহণকারী বাঙালি নারী নিজেকে শালীন বলে দাবী করে, ঠিক একইভাবেই বিভিন্ন পশ্চিমা দেশে দেহ উন্মুক্তকরণ শুরু হয়েছিল তথাকথিত “নির্দোষ” পথে।
নারীর পোশাক-পরিচ্ছদ ও চাল-চলন নিয়ে ইসলামের বিধান আলোচনা করা এই নিবন্ধের আওতা বহির্ভূত, তবে এ সম্পর্কে মোটামুটি একটা চিত্র ইতিমধ্যেই তুলে ধরা হয়েছে। এই বিধি-নিষেধের আলোকে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, নববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নারীর যে অবাধ উপস্থিতি, সৌন্দর্য প্রদর্শন এবং পুরুষের সাথে মেলামেশা – তা পরিপূর্ণভাবে ইসলামবিরোধী, তা কতিপয় মানুষের কাছে যতই লোভনীয় বা আকর্ষণীয়ই হোক না কেন। এই অনুষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের মুসলিম সমাজের ধ্বংসের পূর্বাভাস দিচ্ছে। ৫ বছরের বালিকা ধর্ষণ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মত বিদ্যাপীঠে ধর্ষণের সেঞ্চুরি উদযাপন, পিতার সম্মুখে কন্যা এবং স্বামীর সম্মুখে স্ত্রীর শ্লীলতাহানি – বাংলাদেশের সমাজে এধরনের বিকৃত ঘটনা সংঘটনের প্রকৃত কারণ ও উৎস কি? প্রকৃতপক্ষে এর জন্য সেইসব মা-বোনেরা দায়ী যারা প্রথমবারের মত নিজেদের অবগুন্ঠনকে উন্মুক্ত করেও নিজেদেরকে শালীন ভাবতে শিখেছেন এবং সমাজের সেই সমস্ত লোকেরা দায়ী, যারা একে প্রগতির প্রতীক হিসেবে বাহবা দিয়ে সমর্থন যুগিয়েছে।
ব্যভিচারের প্রতি আহবান জানানো শয়তানের ক্লাসিকাল ট্রিকগুলোর অপর একটি, যেটাকে কুরআনে “ফাহিশাহ” শব্দের আওতায় আলোচনা করা হয়েছে, শয়তানের এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন: “হে মানুষ! পৃথিবীতে যা কিছু হালাল ও পবিত্র বস্তু আছে তা থেকে তোমরা আহার কর আর শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করো না। সে তো তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু । সে তো তোমাদের নির্দেশ দেয় মন্দ ও অশ্লীল কাজ [ব্যভিচার, মদ্যপান, হত্যা ইত্যাদি] করতে এবং আল্লাহ সম্বন্ধে এমন সব বিষয় বলতে যা তোমরা জান না।”(সূরা বাক্বারাহ্, ২:১৬৮-১৬৯)
এছাড়া যা কিছুই মানুষকে ব্যভিচারের দিকে প্রলুব্ধ ও উদ্যোগী করতে পারে, তার সবগুলোকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে কুরআনের নিম্নলিখিত আয়াতের দ্বারা: “তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। অবশ্যই এটা অশ্লীল কাজ ও নিকৃষ্ট পন্থা।” (সূরা আল ইসরা, ১৭:৩২)
ব্যভিচারকে উৎসাহিত করে এমন বিষয়, পরিবেশ, কথা ও কাজ এই আয়াত দ্বারা নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে।
বিভিন্ন সাজে সজ্জিত পর্দাবিহীন নারীকে আকর্ষণীয়, প্রগতিশীল, আধুনিক ও অভিজাত বলে মনে হতে পারে, কেননা, শয়তান পাপকাজকে মানুষের দৃষ্টিতে শোভনীয় করে তোলে। যেসব মুসলিম ব্যক্তির কাছে নারীর এই অবাধ সৌন্দর্য প্রদর্শনকে সুখকর বলে মনে হয়, তাদের উদ্দেশ্যে আমাদের বক্তব্য:
ক. ছোট শিশুরা অনেক সময় আগুন স্পর্শ করতে চায়, কারণ আগুনের রং তাদের কাছে আকর্ষণীয়। কিন্তু আগুনের মূল প্রকৃতি জানার পর কেউই আগুন ধরতে চাইবে না। তেমনি ব্যভিচারকে আকর্ষণীয় মনে হলেও পৃথিবীতে এর ধ্বংসাত্মক পরিণতি এবং আখিরাতে এর জন্য যে কঠিন শাস্তি পেতে হবে, সেটা স্মরণ করলে বিষয়টিকে আকর্ষণীয় মনে হবে না।
খ. প্রত্যেকে নিজেকে প্রশ্ন করে দেখি, একজন নারী যখন নিজের দেহকে উন্মুক্ত করে সজ্জিত হয়ে বহু পুরুষের সামনে উপস্থিত হয়ে তাদের মনে যৌন-লালসার উদ্রেক করে, তখন সেই দৃশ্য দেখে এবং সেই নারীকে দেখে বহু-পুরুষের মনে যে কামভাবের উদ্রেক হয়, সেকথা চিন্তা করে এই নারীর বাবার কাছে তার কন্যার নগ্নতার দৃশ্যটি কি খুব উপভোগ্য হবে? এই নারীর সন্তানের কাছে তার মায়ের জনসম্মুখে উন্মুক্ততা কি উপভোগ্য? এই নারীর ভাইয়ের কাছে তার বোনের এই অবস্থা কি আনন্দদায়ক? এই নারীর স্বামীর নিকট তার স্ত্রীর এই অবস্থা কি সুখকর? নিশ্চয়ই নয়। তাহলে কিভাবে একজন ব্যক্তি পরনারীর সৌন্দর্য প্রদর্শনকে পছন্দ করতে পারে? এই পরনারী তো কারও কন্যা কিংবা কারও মা, কিংবা কারও বোন অথবা কারও স্ত্রী? এই লোকগুলোর কি পিতৃসুলভ অনুভূতি নেই, তারা কি সন্তানসুলভ আবেগশূন্য, তাদের বোনের প্রতি ভ্রাতৃসুলভ স্নেহশূন্য কিংবা স্ত্রীর প্রতি স্বামীসুলভ অনুভূতিহীন? নিশ্চয়ই নয়। বরং আপনি-আমি একজন পিতা, সন্তান, ভাই কিংবা স্বামী হিসেবে যে অনুভূতির অধিকারী, রাস্তার উন্মুক্ত নারীটির পরিবারও সেই একই অনুভূতির অধিকারী। তাহলে আমরা আমাদের কন্যা, মাতা, ভগ্নী কিংবা স্ত্রীদের জন্য যা চাই না, তা কিভাবে অন্যের কন্যা, মাতা, ভগ্নী কিংবা স্ত্রীদের জন্য কামনা করতে পারি? তবে কোন ব্যক্তি যদি দাবী করে যে সে নিজের কন্যা, মাতা, ভগ্নী বা স্ত্রীকেও পরপুরুষের যথেচ্ছ লালসার বস্তু হতে দেখে বিচলিত হয় না, তবে সে তো পশুতুল্য, নরাধম। বরং অধিকাংশেরই এধরনের সংবেদনশীলতা রয়েছে। তাই আমাদের উচিৎ অন্তর থেকে এই ব্যভিচারের চর্চাকে ঘৃণা করা। এই ব্যভিচার বিভিন্ন অঙ্গের দ্বারা হতে পারে, যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্ণনা করেছেন:“…চোখের যিনা হচ্ছে তাকানো, জিহ্বার যিনা হচ্ছে কথা বলা, অন্তর তা কামনা করে এবং পরিশেষে যৌনাঙ্গ একে বাস্তবায়ন করে অথবা প্রত্যাখ্যান করে।” [বুখারী:৬২৪৩; মুসলিম: ২৬৫৭]
দৃষ্টি, স্পর্শ, শোনা ও কথার দ্বারা সংঘটিত যিনাই মূল ব্যভিচার সংঘটিত হওয়াকে বাস্তব রূপ দান করে, তাই জাহান্নাম থেকে বাঁচার জন্য প্রতিটি মুসলিমের কর্তব্য সে সকল স্থান থেকে শতহস্ত দূরে থাকা, যে সকল স্থানে দৃষ্টি, স্পর্শ, শোনা ও কথার ব্যভিচারের সুযোগকে উন্মুক্ত করা হয়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বারংবার বলেছেন যে, “তিন ব্যক্তি আল্লাহ তাদের জন্য জান্নাত হারাম করেছেন, মাদকাসক্ত, পিতা-মাতার অবাধ্য এবং দাইউস, যে তার পরিবারের মধ্যে ব্যভিচারকে প্রশ্রয় দেয়” [মুসনাদে আহমাদ: ২/৬৯।]
‘‘যারা চায় যে, মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রচার ঘটুক তাদের জন্য দুনিয়া ও আখিরাতে রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি। আর আল্লাহ জানেন, তোমরা জান না।’’ [সূরা ২৪ নূর: ১৯ আয়াত]
সঙ্গীত ও বাদ্য:নববর্ষের বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকে সংগীত ও বাদ্য। ইসলামে নারীকন্ঠে সংগীত নিঃসন্দেহে নিষিদ্ধ – একথা পূর্বের আলোচনা থেকেই স্পষ্ট। সাধারণভাবে যেকোন বাদ্যযন্ত্রকেও ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে, বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া, যেমন বিশেষ কিছু উপলক্ষে দফ নামক বাদ্যযন্ত্র বাজানোর অনুমতি হাদীসে এসেছে। তাই যে সকল স্থানে এসব হারাম সংগীত উপস্থাপিত হয়, যেমন রমনার বটমূল, বৈশাখী মেলা এবং নববর্ষের অন্যান্য অনুষ্ঠানাদি, সে সকল স্থানে যাওয়া, এগুলোতে অংশ নেয়া, এগুলোতে কোন ধরনের সহায়তা করা কিংবা তা দেখা বা শোনা সকল মুসলিমের জন্য হারাম। কিন্তু কোন মুসলিম যদি এতে উপস্থিত থাকার ফলে সেখানে সংঘটিত এইসকল পাপাচারকে বন্ধ করতে সমর্থ হয়, তবে তার জন্য সেটা অনুমোদনযোগ্য। তাছাড়া অনর্থক কথা ও গল্প-কাহিনী যা মানুষকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখে, তা নিঃসন্দেহে মুসলিমের জন্য বর্জনীয়। অনর্থক কথা, বানোয়াট গল্প-কাহিনী এবং গান-বাজনা মানুষকে জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য শয়তানের পুরোনো কূটচালের একটি, আল্লাহ এ কথা কুরআনে স্পষ্ট করে দিয়েছেন: “এবং তাদের মধ্যে যাদেরকে পার পর্যায়ক্রমে বোকা বানাও তোমার গলার স্বরের সাহায্যে, … ” (সূরা আল ইসরা, ১৭:৬৪)
যে কোন আওয়াজ, যা আল্লাহর অবাধ্যতার দিকে আহবান জানায়, তার সবই এই আয়াতে বর্ণিত আওয়াজের অন্তর্ভুক্ত। (তফসীর ইবন কাসীর)
আল্লাহ আরও বলেন: “এবং মানুষের মাঝে এমন কিছু লোক আছে যারা আল্লাহর পথ থেকে [মানুষকে] বিচ্যুত করার জন্য কোন জ্ঞান ছাড়াই অনর্থক কথাকে ক্রয় করে, এবং একে ঠাট্টা হিসেবে গ্রহণ করে, এদের জন্য রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি।” (সূরা লুকমান, ৩১:৬)
রাসূলুল্লাহ(সা.) বলেছেন: “আমার উম্মাতের মধ্যে কিছু লোক হবে যারা ব্যভিচার, রেশমী বস্ত্র, মদ এবং বাদ্যযন্ত্রকে হালাল বলে জ্ঞান করবে।” [বুখারী:৫৫৯০]
আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, إِنَّ اللهَ تعالى حَرَّمَ الْخَمْرَ وَالْمَيْسِرَ وَالْكُوبَةَ وَقال : كُلُّ مُسْكِرٍ حَرَامٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মদ, জুয়া ও সব ধরনের বাদ্যযন্ত্র হারাম করেছেন’। [মিশকাত হা/৪৫০৩]
নাফে‘ (রাঃ) বলেন, একদিন ইবনু ওমর (রাঃ) বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনতে পেয়ে দুই কানে দুই আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে যান। অতঃপর তিনি আমাকে বললেন, নাফে‘ তুমি কিছু শুনতে পাচ্ছ কি? আমি বললাম, না। তখন তিনি তার দুই আঙ্গুল দুই কান হতে বের করে বললেন, একদিন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে ছিলাম তিনি বাদ্যযন্ত্রের শব্দ শুনে কানে আঙ্গুল ঢুকিয়ে রাস্তা থেকে সরে গিয়েছিলেন এবং আমাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, যেভাবে আজ তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করলাম। [আবূদাঊদ হা/৪৯২৪; সনদ ছহীহ]

এছাড়াও এ ধরনের অনর্থক ও পাপপূর্ণ অনুষ্ঠান সম্পর্কে বহু সতর্কবাণী এসেছে কুরআনের অন্যান্য আয়াতে এবং আল্লাহর রাসূলের হাদীসে। উপরন্তু নববর্ষ উপলক্ষে যে গানগুলো গাওয়া হয়, সেগুলোর কোন কোনটির কথাও শিরকপূর্ণ, যেমনটি আগেই বর্ণনা করা হয়েছে।
যেসকল মুসলিমের মধ্যে ঈমান এখনও অবশিষ্ট রয়েছে, তাদের উচিৎ এসবকিছুকে সর্বাত্মকভাবে পরিত্যাগ করা।
আমাদের করণীয়
সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলা নববর্ষ সংক্রান্ত যাবতীয় অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এজন্য যে এতে নিম্নোলিখিত চারটি শ্রেণীর ইসলাম বিরোধী বিষয় রয়েছে:
১. শিরকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি, চিন্তাধারা ও সংগীত
২. নগ্নতা, অশ্লীলতা, ব্যভিচারপূর্ণ অনুষ্ঠান
৩. গান ও বাদ্যপূর্ণ অনুষ্ঠান
৪. সময় অপচয়কারী অনর্থক ও বাজে কথা এবং কাজ
এ অবস্থায় প্রতিটি মুসলিমের দায়িত্ব হচ্ছে নিজে এগুলো থেকে সম্পূর্ণরূপে দূরে থাকা এবং বাঙালি মুসলিম সমাজ থেকে এই প্রথা উচ্ছেদের সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো নিজ নিজ সাধ্য ও অবস্থান অনুযায়ী। এ প্রসঙ্গে আমাদের করণীয় সম্পর্কে কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া যেতে পারে:
– এ বিষয়ে দেশের শাসকগোষ্ঠীর দায়িত্ব হবে আইন প্রয়োগের দ্বারা নববর্ষের যাবতীয় অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
– যেসব ব্যক্তি নিজ নিজ ক্ষেত্রে কিছুটা ক্ষমতার অধিকারী, তাদের কর্তব্য হবে অধীনস্থদেরকে এ কাজ থেকে বিরত রাখা। যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান এই নির্দেশ জারি করতে পারেন যে, তার প্রতিষ্ঠানে নববর্ষকে উপলক্ষ করে কোন ধরনের অনুষ্ঠান পালিত হবে না, নববর্ষ উপলক্ষে কেউ বিশেষ পোশাক পরিধান করতে পারবে না কিংবা শুভেচ্ছা বিনিময় করতে পারবে না।
– মসজিদের ইমামগণ এ বিষয়ে মুসল্লীদেরকে সচেতন করবেন ও বিরত থাকার উপদেশ দেবেন।
– পরিবারের প্রধান এ বিষয়টি নিশ্চিত করবেন যে তার পুত্র, কন্যা, স্ত্রী কিংবা অধীনস্থ অন্য কেউ যেন নববর্ষের কোন অনুষ্ঠানে যোগ না দেয়।
– এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকে তার বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন, সহপাঠী, সহকর্মী ও পরিবারের মানুষকে উপদেশ দেবেন এবং নববর্ষ পালনের সাথে কোনভাবে সম্পৃক্ত হওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবেন।
যে উৎসব পৌত্তলিক-খৃষ্টান সমাজ গ্রহণ করেছে তাকে কেন আমরা বর্জন করছি না? রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَشَبَّهَ بِقَوْمٍ فَهُوَ مِنْهُمْ ‘যে ব্যক্তি কোন সম্প্রদায়ের অনুসরণ করল, সে তাদের অন্তর্ভুক্ত হল’।[আহমাদ, আবূদাঊদ, মিশকাত হা/৪৩৪৭, সনদ হাসান]
আল্লাহ বলেছেন: ‘‘তোমরা নিজেরা জাহান্নাম থেকে আত্মরক্ষা কর এবং তোমাদের পরিবার-পরিজনকে জাহান্নাম থেকে রক্ষা কর। যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর; যার উপর নিয়োজিত রয়েছেন কঠোর হৃদয় সম্পন্ন ফিরিশতাগণ, তারা আল্লাহ যা নির্দেশ করেন তা বাস্তবায়নে অবাধ্য হোন না, আর তাদের যা নির্দেশ প্রদান করা হয়, তা-ই তামিল করে’’। [সূরা আত-তাহরীম: ৬]
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘‘তোমাদের প্রত্যেকেই দায়িত্বপ্রাপ্ত এবং তোমাদের প্রত্যেককেই তার দায়িত্বাধীনদের সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে, রাষ্ট্রনেতা তার প্রজাদের সম্পর্কে দায়িত্বশীল আর তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পুরুষ লোক তার পরিবারের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, তাকে তাদের পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন মহিলা তার স্বামীর ঘরের সার্বিক ব্যাপারে দায়িত্বশীলা, তাকে সেটার পরিচালনার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। একজন পরিচারক তার মালিকের সম্পদের সংরক্ষক, আর তাকে সেটার ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।” [বুখারী : ৮৯৩; মুসলিম: ১৮২৯]

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর আনুগত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার তাওফীক দান করুন, এবং কল্যাণ ও শান্তি বর্ষিত হোক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ওপর, তাঁর পরিবার ও সাহাবীগণের ওপর।
“আর তোমরা তোমাদের রবের ক্ষমা ও সেই জান্নাতের দিকে দ্রুত ধাবিত হও, যার পরিধি আসমান ও যমীনব্যাপী, যা প্রস্তুত করা হয়েছে আল্লাহভীরুদের জন্য।” (সূরা আলে-ইমরান, ৩:১৩৩)
http://i-onlinemedia.net/archives/5137
http://i-onlinemedia.net/archives/6155
http://i-onlinemedia.net/archives/5147
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই এপ্রিল, ২০১৬ সকাল ১১:৫২
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×