শুরুটা হয়েছিল রোজার ঈদে খইয়াছড়া দিয়ে ,এক রাতের ট্যুর. তারপর সাহস করে প্ল্যান করলাম কেউকারাডং এর উপর উঠবো। কুরবানি ঈদের ছুটিতে দেখবো জাদিপাই ঝরনা । ছয় জন পার্টনার রেডি। হঠাৎ নতুন এক পার্টনার (৭ম জন) বললো প্ল্যান বদলিয়ে থানচি যেতে, সে মাইক্রোর ব্যবস্থা করতে পারবে, শুধু তেল গ্যাস খরচ দিলেই হবে।খুব করে ধরার পর আবার শুরু হলো নতুন প্ল্যান থানচি যাবো ,সেখান থেকে নাফাকুম। তার কথা অনুযায়ী কোন বাসের টিকিট কাটলাম না।ঠিক ঈদের পরের দিন রাতে রওনা দিব।এর মাঝে শুরু হলো সি এন জি স্টেশন বন্ধ ঘোষণা । প্ল্যান করলাম তেলেই যাবো, খরচ যাই লাগুক।এদিকে ট্যুর মেম্বার হয়ে গেছে ৮ জন ।শুরু হলো প্রথম বিপত্তি -যেই বন্ধু বলেছিল মাইক্রো ব্যবস্থা করবে সে গায়েব। মানে তার সাথে যোগাযোগ এর চেস্টা করা হলে,সে কোন ভাবেই আমদের ফোন ধরছিল না,ম্যাসেজের উত্তর দিচ্ছিল না, ফেসবুকেও রিপ্লাই নেই , সে গায়েব। গায়েব মানে গায়েবই ।কোন ভাবে সে আমাদের সাথে যোগাযোগ করছিল না।
মন মেজাজ ভয়ানক খারাপ। এরপর আরো দুই বন্ধু বললো তারাও যাবে তবে তাদের মধ্য একজন ৯০% কনফার্ম ,বাকি ১০% সকালে করবে। মোট পাটনার ৯ জন আমাদের সাথে বাকি একজন ৯০%কনফার্ম ।গন্তব্য নাফাকুম। কি আর করার কোন বাসের টিকিট নেই । প্ল্যান সব বাদ। কিন্তু একটা জিদ কাজ করছিল, যেভাবেই হোক আজ ঢাকা ছাড়তে হবে।পঞ্চগড় ,সাতক্ষিরা প্রয়োজনে কারো গ্রামের বাড়ি যেভাবেই হোক আজ ঢাকা ছাড়তেই হবে। আমার এক বন্ধু নাজমুল থাকে কল্যানপুরে তাকে পাঠালাম কল্যানপুর বাস স্টপেজ থেকে পঞ্চগড় এর টিকিট কাটানোর জন্য। আমাদের মাঝে শুরু হলো আরেক সমস্যা।
যেই দুই বন্ধু সবার শেষে জয়েন করেছে তাদের একজন বাকি সবাইকে আবার রাজী করালো বান্দরবান যাবার বিষয়ে ।ওদিকে ঈদের আড্ডায় এক বন্ধু স্বপন এসেছে সবার কথা শুনে সে বললো- হয়তো সে টিকিট ম্যানেজ করতে পারে ।শুধু কথা না কাজেও প্রমান করে দিল স্বপন ,সে পারে।১০ টা টিকিট সে ম্যানেজ করে দিল ।এসি গাড়ীর ।তখন রাত ১১ টা । পরের দিন ১০.৪৫ এ গাড়ী।সবার মনে ফুর্তি কিন্তু আবার নতুন ঝামেলা রাত ১২টায় যেই দুই বন্ধু সবার শেষে জয়েন করেছে ,তাদের একজন ও সবাইকে রাজী করিয়েছিল বান্দরবান যাবার বিষয়ে, রাতে আবার ফোন দিয়ে সে বললো তার টিকিট ক্যানসেল করতে।পুরোই প্যাকেজ নাটক।সাথে যে ৯০% কনফার্ম ছিল সেও যাবে না। কথা শুনে সবার মেজাজ এমন খারাপ হল ,কেউ আর তাদের জিজ্ঞাসা করলো না কেন তারা যাবে না ,বা কি সমস্যা ।
পরের দিন দুপুরে আড্ডায় –এই ট্যুরের সাথে জড়িত নয় এমন বন্ধুরা জিজ্ঞাসা করলো ট্যুর এর আপডেট কি?আমাদের কনফার্ম ৬ জনের মাঝে একজন যার মুখ খুব আলগা - তাদের একটা গল্প শোনালো : একটা মেয়ে ছিল ।স্বপ্ন দেখছিল অনেক ভালো কিছুর ,হঠাৎ কিছু বোঝার আগে এক কালপ্রিট তাকে রেপ করলো ।মেয়েটি রাস্তায় বসে বসে কান্না করছিল। তারমাঝে দুইজন ছেলে আসলো ।তাদের মাঝে একজন মেয়েটিকে খুব শান্তনা দিল ,জীবনে এমন তো হয়ই ,তুমি শক্ত হও । সামনে আগাও। তারপর মেয়েটা যখন সাহস করে সামনে আগাবে তখন যে খুব শান্তনা দিয়েছিল সে আবার তাকে আবার রেপ করলো। আর সাথের ছেলেটি মেয়েটিকে রেপ করলো না ঠিক, কিন্তু মজা নিতে কোন অংশে ছাড়লো না ।এই হলো আমাদের ট্যুরের আপডেট। রাগে দুঃখে ক্ষোভে এরচে ভালো কোন গল্প মনে আসছিল না ।এই গল্প শুনে- যেই বন্ধু টিকিট ক্যানসেল করতে বলেছে ও সাথে যে ৯০% কনফার্ম ছিল তাদের মুখ কালো হয়ে গেল। আড্ডা শেষ করতে করতে দুপুর ৩.৩০। গাড়ি ছাড়বে ১০.৪৫।
নাটক এখানেই শেষ নয় ৪ টা দিকে সেই দুইজন আবার কনফার্ম করলো ।তারা যাবে । আমরা বললাম ওয়েলকাম।আবার স্বপনকে অনুরোধ ,জানিনা কিভাবে সে টিকিট ম্যানেজ করে দিল। ভাড়া ৯৫০ করে।অবশেষে ১০ জন রওনা দিলাম নাফাকুমের উদ্দেশে ।
১০.৪৫ এর গাড়ি ছাড়ল ১১.০৫ এ । ড্রাইভার মাইকেল শুমেখার এর ফ্যান। ১২০-৩০ স্পীডে এ গাড়ি চালিয়ে বান্দরবান নামিয়ে দিল ভোর ৫ টায় । ফ্রেশ হয়ে বাস স্টপেজ জীপ গাড়ি পেলাম তাদের ভাড়া জিজ্ঞাসা করলাম ,তারা জানালো ৭০০০ টাকা ।গাড়ির প্ল্যান বাদ দিয়ে শুরু করলাম বাসে যাবার প্ল্যান। যাত্রা থানচি বাস স্টপের দিকে .প্রতি জন ১০ টাকা অটো ভাড়া দিয়ে গেলাম থানচি বাস স্ট্যান্ড।বাস ছাড়বে ৮.৩০ এ ।বাস ভাড়া ২২০ টাকা । বাসের জন্য দাঁড়ানোর পর আবার একটা জীপ পেলাম ,ভাড়া ৬০০০ টাকা ।আরো একটা ৫ জনের গ্রুপ বাস স্ট্যান্ড দাড়িয়ে ছিল থানাচির যাবে বলে ।তারাও আমাদের সাথে যোগ দিল। সকাল ৬ টার দিকে জীপ ছাড়ল ।চারিদিকের দৃশ্য নতুন করে বলার কিছু নেই ,বর্ণনাতীত সুন্দর ।পাহাড়ী উঁচুনিচু পথের বাঁক ঘুরলেই মায়াবী পাহাড়।আর নিচে সারি সারি মেঘ ।থানচি বাজার পৌছলাম সকাল ১০ টায়।মাঝের নাস্তা, কয়েকটি স্পটে ছবি তোলার সময় সহ। গাইড অফিস থানচি বাজারেই।
গাইড অফিসে যেয়ে গাইড ঠিক করলাম। হয়তো থানচির বাজে গাইডগুলোর একটা পড়েছিল আমাদের ভাগ্যতে।নাম জিয়া।মজার কথা হলো বাজারে যাকে জিজ্ঞাসা করি রেমাঙ্ক্রি যেতে কত সময় লাগবে ,কেউ বলে ২ ঘন্টা,২.৩০ ঘন্টা,৩ ঘন্টা,কেউ কেউ আবার ৩.৩০ ঘণ্টাও বলে ।বলে বুঝলাম সময় সেন্স এদের সিরাম ।বিজিবি চেক পোস্ট এ নাম এন্ট্রি করার পর দুই নৌকায় আমরা রওনা দিলাম ।কিছুদুর সামনে এসে দেখি আমাদের পিছের নৌকার কোন খবর নেই।এদিকে নৌকার মাঝিকে থামাতে বললে সে বলে আসবে । পিছে আছে ।আরো বেশ কিছু দূর যাবার যেসব নৌকা রেমাঙ্ক্রি থেকে আসছিল তারা সিগন্যাল দিচ্ছিল না যাবার জন্য ,কারন যা বোঝা গেল সামনে যাওয়া যাবে না।কেন ,কি কারন ,কিছুই বোঝা গেল না, এবার মাঝিও ভড়কে গেল।নৌকা এক পাশে রাখলো।
এরপর থানচি যারা যাবে এমন আরো গ্রুপের নৌকা ভিড়াতে আরম্ভ করলো।আমাদের পিছের নৌকাও চলে আসলো ।তারা শোনালো অন্য গল্প ,দেরি হবার । নৌকা ছাড়ার পর লাইফ জ্যাকেট না থাকার কারনে বিজিবি তাদের আটকে দিয়েছিল।পরে ক্যাম্পে গিয়ে পারমিশন আনতে হয়।আমাদের সাথের এক বন্ধু ছিল ,যে ছাত্র রাজনীতি করে,বেশ ভালো অবস্থানে আছে,দেশের এমন কোন প্রান্ত নেই যে তার লিঙ্ক নেই।সেখানেও একজন কে পেয়ে ম্যানেজ করে, পারমিশন নেয়। আর গাইড এর ভূমিকা ছিল আমি কিছু জানি না ,আপনাদের সমস্যা আপনারা বুঝুন, কিন্তু তার আগে বলেছিল- আরে লাইফ জ্যাকেট ম্যাকেট লাগে না। যাই হোক আবার নতুন বিপত্তি।
সামনে যাওয়া যাবে না।আর নৌকা ৪-৫ টি ভিড়ানোর পর সবাই ঠিক করলাম সামনে যাবোই ,যা হবে হোক।স্রোতের পানি বাড়ছিল ।প্রথম যেমন শান্তশিষ্ট নদীতে উঠেছিলাম ,যতই সামনে যাচ্ছি সে পুরোই পাগলী হয়ে যাচ্ছে ।আমাদের জানা ছিল না ।থানচি তে বড় পলিথিন এর ব্যাগ পাওয়া যায়,একটার মাঝে ২-৩ জনের ব্যাগ আটে। সবার ব্যাগ ভিজে চুপচুপা।গাইড এই বিষয়েও সাহায্য করতে পারতো।আল্লাহর নাম করে সামনে এগুচ্ছি সামনে কি আছে কে জানে? বেশ কিছুদূর যাবার পর এলো তিন্দু বাজার। বিজিবির চেক পোস্ট বসানো হয়েছে ,সামনে আর কাউকে যেতে দিবে না ।ভাবলাম আল্লাহ এত দূর নিয়ে এসে এমন !!! কারন বললো,তাদের একজন নিহত হয়েছিল পানিতে ডুবে। তার অস্ত্র খোঁজা হচ্ছে, সামনে যাওয়া যাবে না।কি করবো মাথায় আসছিল না ,আমাদের নাফাকুম দেখা কি হবে না ট্যুর শুরু হবার পর থেকে কুফা আর কুফা ।স্বপ্নের নাফাফুক মনে হয় স্বপ্নেই থেকে যাবে ।
চলবে