somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা

০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৯:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দোর্দন্ড প্রতাপশালী আর দিগ্বিজয়ী বীর বাদশাহ সিকান্দর (Alexander the Great ) ( খ্রিষ্ট পূর্ব ৩৫৬ অব্দের ২০/২১ শে জুলাই থেকে খ্রিষ্ট পূর্ব ৩২৩ অব্দের ১০/১১ই জুন ) একের পর আর এক রাজ্য জয় করতে করতে ৩২৬ খ্রিঃ পূর্বাব্দে ভারতবর্ষের খাইবার গিরিপথের দোর গোরায় উপনীত হন। ভারত বর্ষে তখন সম্রাট পুরুর রাজত্বকাল। যুদ্ধে পরাভূত হন পুরু। তাকে হাজির করা হয় সিকান্দর বাদশাহর সামনে। সিকান্দার জিজ্ঞাসা করেন পরাভূত সম্রাট পুরুকে ‘ আমার কাছে আপনি কী রূপ ব্যবহার আশা করেন ?’ জবাবে পুরু বলেন ‘বীরের মত’। পুরুর সাথে সিকান্দর সম্মান জনক আচরণই করেছিলেন। সিকান্দরের সেনাপতি সেলুকাসের সাথে সম্রাট পুরু তার কন্যার বিবাহও দিয়েছিলেন। এবার সিকান্দর ভারতবর্ষের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত বাংলা জয়ের দিকে মন দিলেন। খোঁজ নিয়ে জানলেন এই বাংলায় বাস করে এক সুসভ্য জাতি। শৌর্য বীর্যে তারা অতুলনীয় এবং অপরাহত। তাদের আছে বিশাল হস্তী বাহিনী। এই তথ্য জানার পর বাদশাহ সিকান্দর সাহস করেননি বাংলার দিকে অগ্রসর হবার। বাংলা জয়ের আশা ত্যাগ করে তিনি নিজ দেশ গ্রীসের দিকে যাত্রা শুরু করেন। পথিমধ্যে তার মৃত্যু হয়। এই ঐতিহাসিক ঘটনা থেকেই প্রমানিত হয় যে বাঙালী জাতি ঐতিহাসিক কাল থেকেই বীরের জাতি।
বাঙালী জাতি অধ্যূষিত বাংলাভাষাভাষী ভূখন্ড ‘বাঙ্গালা’ বা ‘বাংলা’ নামে পরিচিত। এই অঞ্চলের প্রাচীন নাম ‘বঙ্গ’ বা ‘বাং’। প্রাচীন কালে বাংলার রাজারা দশ গজ উচুঁ ও বিশ গজ চওড়া প্রকান্ড ‘আল’ বা বাঁধ তৈরী করতেন । সম্ভবত প্রতিরক্ষার প্রয়োজনে তাঁরা ছোট ছোট পাহাড়ের ন্যায় দূর্গ প্রাচীর তৈরী করতেন। এইসব বাঁধের পাশের খাল বা নালায় যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করা হতো ‘সাঁকো’। এই কারণে ‘বঙ্গ’ ও ‘আল’ এই দু’টি শব্দের সংমিশ্রণে ‘বাঙ্গালা’ নামের উৎপত্তি হয়। সুলতান মুহম্মদ ইবনে তুঘলকের সময়ে ‘লক্ষ্মণাবতী’(গৌড়) ,‘বঙ্গ’(সোনারগাঁও) বা ‘বাঙ্গালা’ এবং ‘রাঢ়’(সপ্তগ্রাম) নামে তিনটি অঞ্চল ছিল। সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ এই তিনটি অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করেন এবং একীভূত করেন। অতঃপর তিনি ‘শাহ-ই-বাঙ্গালা’ এবং ‘সুলতান-ই-বাংলা’ উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি ১৩৪২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৩৫৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলার একচ্ছত্র সুলতান হিসাবে শাসন কার্য পরিচালনা করেন। সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ৮৯৯ হিজরি মোতাবেক ১৪৯৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলার মসনদে আরোহন করে ১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাতে সমাসীন ছিলেন। তাঁর আমলে বাংলাভাষা রাজদরবারে পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে। সুলতানী আমলের ‘বাঙ্গালা’ মুঘল আমলে ‘সুবা-ই-বাংলা’ নামে পরিচিত ছিল । ইতিহাসের কোন যুগেই বাংলা কারো বৈশ্যতা স্বীকার করে নাই। মোঘল সেনাপতি মানসিংহ বাংলার ‘বারো ভূঁইয়াদের বশে আনার জন্য অভিযান শুরু করেন। তিনি অপমানজনকভাবে পরাভূত হন ঈসা খানের কাছে। শুধু ঈসা খানের শৌর্য বীর্যই নয় তাঁর মহানুভবতার কাছেও পরাভূত হয়েছিলেন মোঘল বাদশাহ জালাল উদ্দিন মুহম্মদ আকবরের সেনাপতি মানসিংহ।
পলাশীর আমের বাগানে স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলার পরাজয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলেও স্বাধীনচেতা বাঙালী জাতি তাঁদের স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করতে লড়াই অব্যাহত রাখে। মীর মদন ও মোহনলালের রক্তের মিলিত স্রোতধারা প্রতিনিয়ত ইংরেজদেরকে ব্যতিব্যস্ত করতে থাকে। কাশিমবাজার কুঠিতে ষড়যন্ত্রকারীরা একের পর আরেক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে, পরক্ষণে পরস্পর সংঘাত করে কেউ প্রাণ ও ক্ষমতা হারিয়েছে আবার কেউ মসনদে বসেছে কিন্তু উপলব্ধি করেছে তার স্বাধীনস্বত্বা আর নাই। সেটা চলে গেছে ইংরেজদের হাতে। তাদের কাছ থেকে ভাতা নিয়ে দেনদরবার আর কাকুতি মিনতি করে টিকে থাকতেই এই মসনবীরা স্বাচ্ছন্দ বোধ করেছে। কিন্তু জনগণ তাঁদের স্বাধীনতা অর্জনের লড়াই থেকে নিবৃত্ত হয় নাই। ফকির মজনু শাহ, তীতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ, মঙ্গল পান্ডে, আলীজান, ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকী, মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ, সূর্য সেন, বাঘা যতিন, মুনশি মেহেরুল্লাহ প্রমুখের নেতৃত্বে যুগ থেকে যুগে চলতে থাকে স্বাধীনতা এবং জনগণের মুক্তির লড়াই। তাঁদের দেশপ্রেম আপোষহীন নেতৃত্ব আত্মত্যাগ গৌরবদীপ্ত শাহাদাত বরণ মুক্তির সংগ্রামের গতিধারাকে করে অপ্রতিরোধ্য ও বেগবান। মওলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজী, দীনবন্ধু মিত্র, মীর মোশাররফ হোসেন, মওলানা আকরাম খাঁ, কাজী নজরুল ইসলাম,সুকান্ত ভট্টাচার্যর লেখনি স্বাধীনতার চেতনাকে করে শানিত। বিশ্বকবি রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর, রজনীকান্ত সেন, কায়কোবাদ, অতুল প্রসাদ, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়(ডি এল রায়), মাইকেল মধুসূদন দত্ত, সত্যেন্দ্রনাথ রায়, প্রমথ চৌধুরী ,এস ওয়াজেদ আলী, এমদাদুল হক, মজিুবর রহমান খান, মওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী প্রমুখের লেখনি দ্বারা জনগণের মাঝে সামাজিক অনাচার অবিচার এবং বিদেশী শাসক ও স্বদেশী জমিদার মহাজনদের অত্যাচার নিপীড়ন জনগণকে করে তোলে সচেতন ও প্রতিবাদমুখর।এর প্রভাবেই জনগণের আত্মসচেতনবোধ স্বাজাত্যবোধ প্রখর থেকে প্রখরতর হয়। রাজনৈতিক অংগনে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, নেতাজী সুভাস চন্দ্র বসু, মজিবর রহমান, শরৎ বসু , আবুল হাশিম, কিরণ শংকর রায় প্রমুখের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীনতার আন্দোলন এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব উপমহাদেশের রাজনীতিতে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলে। উমহাদেশ বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি দেশ আত্মপ্রকাশ করে। বৃটেনের প্রত্যক্ষ শাসনের অবসান হয়। বিভক্ত হয় বাংলা ও আসাম। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে বাংলার অধিকার পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। এগিয়ে আসে ছাত্র সমাজ। বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, কাজী আরেফ আহমেদ ও আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে গড়ে উঠে গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’। মূলত এই নিউক্লিয়াসের মাধ্যমেই তরুন যুব সমাজ সংগঠিত হতে হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে এরাই পালন করে অগ্রপথিকের ভূমিকা। ঐতিহাসিক কাল থেকে শৌর্য বীর্যে অতুলনীয় বীরের জাতি বিজয়ীর হয় আরো একবার। গর্বিত জাতির উন্মুক্ত আকাশে উত্তোলিত হয় স্বাধীনতার পতাকা।
যুদ্ধে বিজয় আর সরকার গঠন করলেই কোন জাতির স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় না। করতে হয় স্বাধীন ও মুক্ত জনগণের উপযোগী উৎপাদন বন্টন ও শাসন ব্যবস্থা। ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলার শাসন ভার গ্রহণের পর তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থে গড়ে তোলে নতুন অর্থনৈতিক ও শাসন ব্যবস্থা। কৃষকেরা বাধ্য হয় নীল কুঠিয়ালদের স্বার্থে নীল চাষ করতে। বিশ্ববিখ্যাত মসলীন শাড়ির উৎপাদন বন্ধ করার জন্য তারা মুসলীন কারিগরদের বৃদ্ধ আংগুল কেটে দেয়। ভূমি ব্যবস্থায় পরিবর্তন সাধন করে। প্রথমে পাঁচসালা , তারপর দশসালা এবং সর্বশেষে কায়েম করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা। এর জন্য দেশীয় কৃষক প্রজা ও নাগরিকদের প্রতিবাদ প্রতিরোধের অধিকার ও সুযোগকে রহিত করে প্রবর্তন করে নতুন আইন। ফলে পলাশীর মাত্র ১২ বৎসরের মাথায় অর্থাৎ ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বাংলায় দেখা দেয় মন্বন্তর, যা ইতিহাসে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে খ্যাত। গ্রামে কে গ্রাম জনশূণ্য হয়ে যায় ক্ষুধাতুর প্রজাসাধারণের মৃত্যুর কারণে। কোম্পানীর কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা বৃটিশ রাজা নিলেও পরিস্থিতির কোন মৌলিক পরিবর্তন হয় নাই। ১৮৫৭ সালের স্বাধীনতার সংগ্রাম (তথাকথিত সিপাহী বিদ্রোহ)এর পর ইংরেজ শাসকেরা ১৮৩৬ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর তারিখে জেলা আইন(১৮৩৬ সালের ২১নং আইন), ১৮৫০ সালে ২২ শে মার্চ তারিখে Public Accounts Default Act (১৮৫০ সালের ১২ নং আইন), ১৮৬০ সালের ৬ই অক্টোবর তারিখে দন্ডবিধি (১৮৬০ সালের ৪৫ নং আইন), ১৮৬১ সালের ২২ শে মার্চ তারিখে পুলিশ আইন (১৮৬১ সালের ৫নং আইন)সহ একের পর আরেক আইন জারি করতে থাকে। এই সব আইন প্রণয়নের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজদের ব্যবসা বাণিজ্য অবাধে পরিচালনা করার কাজে যাতে স্থানীয় জনগণ কোন বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। সে লক্ষ্যেই তারা এলাকার পূনর্বিন্যাস করে নতুন জেলা সৃষ্টির আইন প্রণয়ন করে। সরকারী ঋণ পরিশোধে ব্যর্থদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আইন প্রণয়ন করে। অপরাধ দমন সংক্রান্ত বিষয়েও আইন প্রণয়ন করে। নবাবী আমলের আইন সমূহ বাতিল করে। সাক্ষ্য আইনেও পরিবর্তন এনে ১৮৭২ সালে ১নং আইন প্রবর্তন করে। নতুন আইনের ফলে ‘নগর কোতোয়ালে’র স্থান দখন করে পুলিশ। পার্থক্য হলো ‘নগর কোতোয়ালে’র দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল জন সাধারণের জান মাল ইজ্জতের হেফাজত করা , ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় তারা এই দায়িত্ব আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথেই পালন করতো। পুলিশ আইনের মাধ্যমে গঠিত পুলিশের দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা বিধান করা লিখিত থাকলেও তারা শাসক কূলের স্বার্থ রক্ষা করা এবং স্বাধীনতাকামী মানুষদের খুজে বের করে জেলে পাঠিয়েই তাদের কৃতিত্ব প্রদর্শন করতো। বিচার ব্যবস্থায় পূর্বের ধারা ব্যাহত হয়। ভূমি ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন এনে ১৮৮৫ সালে বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন প্রবর্তন করে। বাংলার যে কৃষকের ঘরে ছিল গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু , উঠোন ভরা হাঁস মুরগী , পুকুর ভরা মাছ তারা হয়ে গেলো ঋণ ও দাদনের ভারে জর্জরিত। যারা দুধ দিয়ে পান্তা ভাত খেতো তারা পড়লো ‘নুন আনতে পান্তা ফুরানো’র দশায়। খাজনা মামলা(Rent Suit)এ জর্জরিত হয়ে জমি জিরাত হারিয়ে তাঁরা পথের ভিখারীতে পরিণত হলো। এভাবে একের পর এক আইন প্রবর্তন করে ইংরেজরা বাংলার জনগণকে শোষণের জালে আষ্টে পৃষ্ঠে বেধে ফেলে। সেই সাথে এদেশে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি সংহত করার জন্য তারা নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করে। যার উদ্দেশ্য ছিল এমন একটি গোষ্ঠি তৈরী করা যারা চেহারা ও দৈহিক গঠনে হবেন দেশীয় (Native) কিন্তু রুচি চিন্তাধারা ও পোষাকে হবেন ইংরেজ। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ‘রায় বাহাদুর’ ‘খান বাহাদুর’ ‘নাইট’ খেতাব দিয়ে ইংরেজরা তাদের বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন নাগরিক সৃষ্টি করে। এসব করে তারা বাংলার জনগণের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রেখা টেনে দেয়। এই দেশীয় তাঁবেদারদের সুযোগ সুবিধা ও সীমিত কর্তৃত্ব দিয়ে ইংরেজরা তাদের শাসন শোষণ ও লুন্ঠন অপ্রতিহত গতিতে চালিয়ে যেতে থাকে।
তা সত্ত্বেও ব্যাপক জনগোষ্ঠির আন্দোলন সংগ্রামের মাঝে ইংরেজদেরকে ছাড়তে হয় এদেশ। কিন্তু তারা রেখে যায় তাদের ভাষা, কুষ্টি । বহাল থাকে তাদের প্রণীত আইন কানুন। শুধু বৃটিশ ভারতের জায়গায় পাকিস্তান শব্দটি প্রতিস্থাপন করে এবং বৃটিশ নাগরিকের স্থলে পাকিস্তানী নাগরিককে ক্ষমতায় বসিয়ে চালানো হয় শাসন ব্যবস্থা। সেই আইন কানুন , সেই হ্যাট বুট কোট টাই , সেই আমলা আর্দালী সবই বহাল থাকে। সেই বৃটিশ পোষাক ও আচরণ বিধি অনুসারেই চলতে থাকে অফিস আদালতের কার্যক্রম। খাজনা আদায় পদ্ধতি, সার্টিফিকেট জারি , ৭ধারার নোটিশ , নীলাম , প্রজা উচ্ছেদ কোন কিছুরই পরিবর্তন হলো না। এসব দেখে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগষ্টের পর পরই জনগণ উপলব্ধি করলো ‘ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়’। সংগ্রামী জনগণ আবার স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জ্বীবিত হয়ে উঠলো। ১৯৭১ সালে এই বাংলার জনগণের কাছে করুণভাবে পরাভ’ত হলো পৃথিবীর সেরা সেনাবাহিনী বলে খ্যাতিমান পাকিস্তানী সেনা বাহিনী। এবারও একই অবস্থা হলো সব কিছুই বহাল থাকলো শুধু মুসলীম লীগের জায়গায় ক্ষমতায় আসলো আওয়ামী মুসলীম লীগের নতুন সংস্করণ আওয়ামী লীগ। পাকিস্তান বা পূর্ব পাকিস্তানের স্থলে বাংলাদেশ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে সেই আইন কানুনই বহাল রাখা হলো। ব্যক্তির স্বার্থে আইনের রদ বদল হলেও জনগণের স্বার্খে একটি আইনও রদবদল বা প্রবর্তন করা হয় নাই। ১৮৮৫ সনের বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইনের উত্তরসূরী আইন ১৯৫০ সালের জমিদারী হুকুম দখল ও প্রজাস্বত্ব আইন এর পরিবার প্রতি সর্বোচ্চ জমি সংরক্ষণ ও অর্জনের সীমা রেখা সংক্রান্ত বিধান, নদী ভাঙনের কারণে শিখস্তি ও পয়স্তি জমির ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিধান অনেকবারই সংশোধন করা হয়েছে। তবে তা যতটুকু প্রজা সাধারণের স্বার্থে করা হয়েছে তার চেয়ে বেশী করা হয়েছে জোতদারদের স্বার্খে। আইনে পরিবার প্রতি জমি রাখার সীমা রেখা থাকলেও বাংলাদেশের বহু পরিবার এখনও শত শত বিঘা জমির মালিক হয়ে তা ভোগ দখল করছে। আইন প্রয়োগকারী কর্মকর্তা তথা ডেপুটি কমিশনার , কমিশনার এদের কাছে অসহায়। সাধারণ কৃষকেরা এতে লাভবান হয় নাই। তাদেরকে কৃষি কাজ ছেড়ে আসতে হয়েছে শহরে। সেখানে তাদের কেউ রিকশা / ভ্যান চালিয়ে, কেউ ফুটপাতে দোকানদারী করে জীবিকা নির্বাহ করে। এখানেও শান্তি নাই, মাঝে মাঝেই তিলোত্তমা রাজধানীর জন্য পুলিশ আর নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের দ্বারা উচ্ছেদ অভিযানের শিকার হয়ে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে থাকে অভূক্ত। তারা বাস করে বস্তিতে। সেখানেও তাদের উচ্ছেদ অভিযান বা অগ্নিকান্ডের শিকার হতে হয়। অফিস আদালতেও শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী সাধারণ মানুষের সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে প্রতিবিধান পাবার সুযোগ কার্যত নাই। কথায় আছে ‘ফুয়েল না দিলে ফাইল চলে না।’ উপজেলা ভূমি অফিস, সাব-রেজিট্রি অফিসে যাদের যাবার অভিজ্ঞতা আছে তারা বলতে পারবে ‘কাকের মাংস কাক খায়’ কিনা। এ সবই শাসন ব্যবস্থার ফল। কোন মানুষ কখনো অসৎ হতে চায় না। সবাই চায় সৎ উপার্জন দিয়ে সংসার চালাতে। কিন্তু পারিপার্শিক পরিবেশ পরিস্থিতিই মানুষকে বাধ্য করে অসৎ পন্থায় অর্থ উপার্জন করতে। এ সবই বৃটিশ প্রণীত আইনের ফল। তা এখনো বহাল থাকাতেই আমরা স্বাধীনতার সুফল ভোগ করতে পারছি না। এক দলকে বাদ দিয়ে অন্য দলকে, এক পরিবারকে বাদ দিয়ে আরেক পরিবারকে,এক ব্যক্তিকে বাদ দিয়ে আরেক ব্যক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণের ভাগ্যের কোনই পরিবর্তন আসবে না। জনগণের ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে হলে পরিবর্তন আনতে হবে রাষ্ট্রীয় কাঠামো এবং শাসনব্যবস্থায়। এই লক্ষ্যেই ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বাধীন ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) এর পক্ষ থেকে দাবী করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠিকে নিয়ে ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার’ গঠন করে দেশ গড়ার। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গড়ে উঠা জাতীয় ঐক্য এই সরকারের সফলতার ক্ষেত্রে রাখতো নিয়ামক ভূমিকা। এ লক্ষ্যে ১৫ দফা প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে। কিন্তু তা গ্রহণ না করে গঠন করা হয় দলীয় সরকার। ব্রিটিশ, ভারত ও পাকিস্তানী রাষ্ট্র-কাঠামোর অনুকরণে প্রণীত হয় শাসনতন্ত্র। শুরু হয় ঔপনিবেশিক আদলের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও এক ব্যক্তির সর্বময় কর্তৃত্বাধীন দলীয় শাসন ব্যবস্থার কার্যক্রম। চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি হানাদার বাহিনীর শ্রেষ্ঠ দোসরের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে আর দোয়া চাইতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক বাহক বলে দাবীকারীও দ্বিধা করে না। দিনের বেলায় রাজাকার বলে গালি দিয়ে বক্তৃতা করে রাতের অন্ধকারে আল বদর, আল শামস এর নেতাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হতেও কেউ কেউ দ্বিধা বা লজ্জাবোধ করে না। শুধু মাত্র একটিই লক্ষ্য ক্ষমতায় আসীন হওয়া। মুক্তিযোদ্ধাদের উন্নয়ন ও শাসনব্যবস্থায় সম্পৃক্ত না করে তাদেরকে ভাতা ( যা জীবন ধারনের জন্য অত্যন্ত প্রতুল) প্রদান করে, আর কয়েকজনকে সরকারী চাকুরীর মেয়াদ বাড়িয়ে তাদেরকে খুশী করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে ভূয়া সনদ ব্যবহারের প্রবনতা বেড়ে গেছে। এরূপ ভূয়া সনদধারীদের সন্ধান খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতর ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়েও পাওয়া গেছে। এসব ঘটনাবলী দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে ১৯৭২ সালে ‘নিউক্লিয়াস’ (স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ) এর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করার মধ্য দিয়ে জনগণের আশা আকাংখা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতি হানা হয়েছিল প্রবল আঘাত। তা করা হয়েছিল বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলের রাষ্ট্রীয় সুবিধাভোগী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠির স্বার্থে। জনগণ হয়েছিল উপেক্ষিত। এই ধারা এখনও চলছে । জনগণের দুঃখ দুর্দশা দূর করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের মূল ধারাকেই অনুসরণ করতে হবে। সে জন্যই ‘ফেডারেল’ পদ্ধতির কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা, ‘দুই কক্ষ’ বিশিষ্ট আইন সভা, ‘জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার’, সাত(৭) বা নয়(৯)টি প্রদেশ গঠন করে প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ, সংসদের ‘উচ্চ কক্ষ’ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং স্বাধীন নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। সেই সাথে গঠন করতে হবে ‘জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল’, ‘সাংবিধানিক আদালত’, ‘জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল’ এবং স্থায়ী বিচার বিভাগীয় কাউন্সিল’। দেশের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদী অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ‘উপ-আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট’ গঠন করতে হবে। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে প্রণীত ও প্রবর্তিত সকল আইন শ্রমজীবী কর্মজীবী ও পেশাজীবী জনগণের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে প্রয়োনীয় ক্ষেত্রে রদ সংশোধন সংযোজন করতে হবে। প্রয়োজন বলে বিবেচিত হলে উক্ত লক্ষ্যকে প্রাধান্য দিয়ে নতুন আইন প্রবর্তন করতে হবে।এভাবে রাষ্ট্র কাঠামো গঠন ও শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করতে পারলেই সম্ভব হবে জনগণকে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করা। এই মুক্তির লক্ষ্যেই জনগণ নিরন্তর লড়াই করে যাচ্ছে । শ্রমজীবী কর্মজীবী পেশাজীবী জনগণের মুক্তির লড়াই কখনো পঞ্জিকার দিন গণনার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায় না , তা চলতে থাকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে , যুগ থেকে যুগে অব্যাহত গতিতে, নিরন্তর ভাবে।
লেখক: সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। বর্তমানে এ্যাডভোকেট বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনের অধ্যাপক।
[email protected]
৩টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×