somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চট্রগ্রামের ডায়েরি (২)- ওয়ার সিমেট্রি, চট্রগ্রাম

০৬ ই নভেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



সময়টা ১৯৩৩ সাল। সদ্য নির্বাচিত জার্মান চ্যান্সেলর এডলফ হিটলার ভীষণ ব্যস্ততায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন জার্মানির মাঠ-ঘাট, রাজপথে। এর আগে অভ্যুথান করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে জেল খেটেছেন। এবার তাই তিনি ভীষণ সতর্ক। উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব নেই, তবে গায়ের জোরে নয়, কথার জাদুতেই জার্মানদের ভোলালেন চ্যান্সেলর হিটলার। যুক্তি অকাট্য, যেহেতু জার্মানরা জাতি হিসেবে অন্যদের তুলনায় শ্রেষ্ঠ, সেহেতু বসবাসের জন্য তাদের আরো বেশি ভুমির ( Lebensraum) প্রয়োজন।

হিটলারের এমন আগ্রাসী মনোভাবের ফলশ্রুতিতেই কিনা উৎসাহী জার্মানরা পোল্যান্ড আক্রমণ করে বসলো। এরপর ১৯৪১ সালের ডিসেম্বরে জাপান আক্রমণ করলো পার্ল হারবার। মানচিত্রের অন্যান্য ভাগের হর্তাকর্তারা ভাবলেন- তারাই বা বসে থাকবেন কেন! তারা কি কারো চাইতে কম নাকি!

ব্যস, বেঁধে গেল বিশ্বযুদ্ধ। পার্ল হারবারের পর জাপানীরা মালয়-সিঙ্গাপুর দখল করে বার্মার (বর্তমান মায়ানমার) দিকে এগুতেই নড়ে বসলেন তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকরা। রেঙ্গুন পতনের পরপরই ব্রিটেনের ঘাঁটি উঠে আসে চট্রগ্রামে। অতপর অনেক শক্তিক্ষয়, ঘাত প্রতিঘাত আর রক্তক্ষরণের পর এল ১৯৪৫ এর এপ্রিল মাস। বিখ্যাত রেড আর্মি ক্রমশ ঘিরে ফেলেছে বার্লিন। ৩০ শে এপ্রিল সকালে জেনারেল হেলমুট ওয়েলডিং এসে হিটলারকে জানালেন যে সোভিয়েত বাহিনী তাদের বাঙ্কারের প্রায় ৫০০ মিটারের মধ্যে এসে পড়েছে, গোলা বারুদ যা আছে, তা দিয়ে চব্বিশ ঘণ্টাও ঠিকঠাক টেকা যাবেনা।

আতংকিত জেনারেল ওয়েলডিং আরো কিছুক্ষণ দাড়িয়ে রইলেন জবাবের জন্য, তারপর ফিরে গেলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। বলাবাহুল্য, ওয়েলডিং বেচারাকে নির্দেশনা দেবার জন্য কোন পটভূমি হিটলারের কাছে আর অবশিষ্ট ছিল না।
এ ঘটনার প্রায় ছয় ঘণ্টা পর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করলেন এডলফ হিটলার, পাশেই সায়েনাইড খেয়ে পড়ে রইলেন তার নব পরিণীতা স্ত্রী ইভা ব্রাউন। আর সাথে সাথে পর্দা পড়ে গেল ইতিহাসের সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষটির উপর। এরপর পার হয়ে গেছে আরো প্রায় ৬৮টি বছর। পর্দার ওপাশের দগদগে ক্ষত, রক্ত আর ধ্বংসচিহ্ন মোচনের দায়িত্ব নিয়েছে সময়।

ধ্বংসপাহাড়ের উপর করে নির্মিত হয়েছে নতুন সভ্যতা আর নিচের মৃতদেহগুলো মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছে মাটিতেই। তবে পুরোপুরি বোধহয় মিলিয়ে যায়নি। নতুন সময়, নতুন দেশের মানুষেরা বিভিন্ন স্থানে ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনগুলো অবিকৃত রেখে দিয়েছে, গড়ে তুলেছে স্মৃতিসৌধ আর সমাধিক্ষেত্র। চট্রগ্রামে অবস্থিত কমনওয়েলথ ওয়ার সিমেট্রি ও এমন একটি স্থান যা আজো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষত আর নির্মমতার কিছু চিহ্ন ধারন করে আছে।

বাংলাদেশ থেকে শত সহস্র মাইল দূরে কোথাকার কোন সম্রাট রণহুংকার দিলেন আর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেধে গেল এখানটায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তৎকালীন ভারতীয় উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ রাজশক্তির অধীনে। যে কারনে তৎকালীন ভারতীয় সেনাবাহিনীসহ মিত্রবাহিনীর অজস্র সৈন্যকে অংশ নিতে হয়েছিল অহেতুক এই যুদ্ধে।

ক্ষমতালোলুপ সম্রাটদের বাসনা চরিতার্থ কিংবা প্রতিরোধ করার জন্য দলে দলে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সৈন্যরা এসে জড়ো হয়েছিল এখানটায়, যাদের বেশিরভাগেরই আর ফিরে যাওয়া হয়নি, চিরকালের মত স্থান হয়ে গেছে এই বাংলাদেশের মাটিতে।

চট্রগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে দাফন করা হয় মূলত আসামের লুসাই পাহাড়, কক্সবাজার, যশোর, খুলনা, রাঙ্গামাটি সহ বিভিন্ন স্থানের সমাধিক্ষেত্রে জড়ো হওয়া সৈন্যদের মৃতদেহগুলোকে। এতে আছে ব্রিটেন, কানাডা, অবিভক্ত ভারত, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড সহ বিভিন্ন দেশের ৭৫৫ জন সৈন্যের কবর। আছে সে সময়কার শত্রুপক্ষ জাপানের ১৯ জন সৈন্যর মৃতদেহ।

ব্রিটেনের রয়াল আর্টিলারির চব্বিশ বছর বয়সী গানার জে এফ হ্যালিডের কবরের ফলকে তার প্রেয়সী লিখেছিলেন- “Sleep in peace till we meet again”.



এরপর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলো দিন। আশা করা যায়, এতো দিনে হ্যালিডের প্রেয়সীর প্রতীক্ষার প্রহর শেষ হয়েছে। অনেক ঝড়ঝঞ্জা পেরিয়ে অবশেষে তাদের দেখা হয়েছে।



এখানেই পাশাপাশি শায়িত রয়েছেন পাঞ্জাব ২ রেজিমেন্টের দুই সৈনিক অমর সিং আর গুলাম মোহাম্মদ। একজনের সমাধিফলকে হিন্দি আর অন্যজনের জন্য উর্দুতে স্বজনরা জানিয়েছেন অন্তিম শুভেচ্ছা।



উপরের সমাধি ফলক দুটির ভিন্ন ভাষা আর ধর্ম অবশ্য নিচে শায়িত দুই বন্ধুর বন্ধুত্বে কোন তফাৎ গড়তে পারেনি। একই মাটির নিচে দুই বন্ধু পাশাপাশি ঘুমিয়ে আছেন ভীষণ নিশ্চিন্তে। অমর সিং আর গুলাম মোহাম্মদদের তো তাও পরিচয় জানা গেছে, অনেক সেনার কবর এখানে আছে যাদের কোন পরিচয়ই জানা যায়নি। তারা কে, কোথা থেকে এসেছেন- সেসব জানার কোন উপায় থাকেনি।



রয়াল এয়ার ফোর্সের ফ্লাইট সার্জেন্ট জি কুপারের আকাসে ওড়ার সাধ থেমে গিয়েছিল মাত্র বাইশ বছর বয়সেই। যুদ্ধের দিনগুলিতে আকাশ থেকে তিনি দেখেছিলেন নরক সদৃশ এক মর্ত্যর স্বরূপ। অন্তরীক্ষ থেকে তিনি দেখেছিলেন নিচের গুচ্ছ অগ্নিকুণ্ড, ধ্বংস আর ভয়াবহ সব ব্রহ্মাস্ত্রের ছায়া।
সেই নিকষ ছায়াই একদিন তার ব্যোমযানটিকে গ্রাস করে নেয়, মৃত্যুতেই তিনি যেন খুঁজে পেলেন মুক্তি। তার স্বজনরাও আশা করেছেন, আর যাই হোক, মৃত্যুর পর তিনি যেন অন্তত শান্তি খুঁজে পান-

‘Resting where no shadows fall,
In perfect peace he awaits us all’

জীবিত অবস্থায় এরা কখনো একে অপরের বন্ধু হতে পারেনি, তবে মৃত্যুর পর শত্রুর পাশাপাশি একই মাটিতে সমাহিত হতে এরা আর আপত্তি করেননি। রাষ্ট্রনায়কদের অহংবোধ, স্বার্থপরতা আর অনমনীয় আচরণের কারনে আজ থেকে ৬৮ বছর আগে যে ভীষণ জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল, অজস্র হত্যাকাণ্ড, ধ্বংস আর মৃত্যু পরবর্তী নিরবতাই শেষমেশ সে জটিল পরিস্থিতির অবসান ঘটাতে পেরেছে।

চট্রগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে আপনি সেই সুনসান নীরবতা আর ক্ষান্তভাবের কিছুটা অনুভব করতে পারবেন।
তবে নিরঙ্কুশ শান্তি আর সম্প্রীতি কি সম্পূর্ণ অর্জিত হয়েছে!অহেতুক যুদ্ধে মৃত সেনাদের রক্ত মাটিতে মিলিয়ে যেতে না যেতেই বারবার উঠে এসেছে স্বার্থ সিদ্ধির কথা। নতুন মানচিত্রের আকার আর ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে মানুষ নতুন করে মেতে উঠেছে ধ্বংসযজ্ঞে।

চট্রগ্রাম ওয়ার সিমেট্রিতে শায়িত প্রতিটি সেনার সমাধি ফলক যেন সেই সব ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে নীরব প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে। শুধু প্রতিবাদই নয়, এতে রয়েছে নিহত সৈন্যর পিতার আকুতি, প্রেয়সীর কান্না।

Published on priyo.com Thursday, 16 January 2014
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:০৫
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×