somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আস্তিকতা, নাস্তিকতা ও একটি মৃত্যুর গল্প

০৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বন্ধু রাশেদের (ছদ্দ নাম) পরিবারের প্রায় সব পুরুষ সদস্যই অ্যাথিস্ট ধরনের। মহিলাদের ব্যাপারে যানা নেই।
রাশেদরা তিন ভাই। সেলিম ও জহির ভাই বড়। রাশেদ সবার ছোট

সেলিম ভাই চারুকলায় পড়েন। লম্বা ঝাকড়া চুল। কানে দুল। টাইট জিন্সের প্যান্ট পরেন যার হাটুর কাছে একটু ছেড়া। এটাই নাকি ডিজাইন।

জহির ভাই ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে পড়েন। দেখতে সুন্দর । লম্বা চুল বেণী করে রাখেন। খুব জোরে ইয়ামাহা হোন্ডা চালান। তার একটা ছোট ব্যান্ডের দল আছে।

এই সদস্যদের ভেতরে রাশেদের বাবা সবচেয়ে কট্টর নাস্তিক। ধর্মীয় কথা একদম সহ্য করতে পারেন না। সুযোগ পেলেই নসীহত করেন একদিন বললেন- আল্লাহ মানুষকে বানায় নি, মানুষ আল্লাহকে বানিয়েছে। আল্লাহ নামের এই কল্পিত সত্ত্বাকে যারা সবচেয়ে ক্ষমতাধর ভাবে, তাদের প্রতি আমার করুনাই হয়।

আরেকদিনের কথা,রাশেদদের ড্রইং রুমে বসে আছি। কলিংবেল বেজে উঠল। রাশেদের বাবা উঠে দরজা খুলে দিলেন।

আসসালাআআআমুআলাইকুম, শুদ্ধ উচ্চারনে লম্বা সালাম। বুঝতে বাকি রইল না – মসজিদ থেকে তাবলীগের লোক-জন এসেছে দাওয়াত দেবার জন্য।

–আপনারা কি চান?

–আমরা মসজিদ থেকে এসেছি একটু কথা বলবার জন্য

–কি কথা ?

– দু-এক মিনিট কথা বলে তাবলীগের লোকটি বললেন– তা ভাই চলেন একটু মসজিদে যাই

–মসজিদে কেন যাব?

–মসজিদ আল্লাহর ঘর, সেখানে গিয়ে কিছু কথা শুনলে ঈমান বাড়বে।

–কে বলেছে মসজিদ আল্লাহর ঘর? মসজিদ কি আল্লাহ বানিয়েছেন? না, এলাকার লোকজন চাদা তুলে বানিয়েছে? আল্লাহ নিজের হাতে যে ঘর বানিয়েছেন সেটাই আল্লাহর ঘর। তা, এরকম কোন ঘর আছে না কি?

– তাবলীগের লোকটি একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল-না, তাতো নেই।

– যে আল্লাহর ঘর দুনিয়াতে মানুষকে বানিয়ে দিতে হয় , সে আল্লাহর এবাদত আমি করি না, আপনারা চলে যান।

এই হচ্ছে রাশেদের বাবা।

এর প্রায় দু-বছর পরের ঘটনা। হঠাৎ রাশেদের ফোন– এই তুই একটি তাড়াতাড়ি আয়, বাবাকে হাসপাতালে নিতে হবে। বাবার তল পেটে খুব ব্যথা, পেশাব আটকে গেছে।
আমি দ্রুত চলে এলাম। দেখলাম রাশেদের বাবা প্রচন্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছেন। দ্রুত তাকে মিরপুরের এক হাসপাতালে ভর্তি করা হল।

হাসপাতালে প্রথমেই তার শিশ্ন দিয়ে একটি লম্বা রাবারের ক্যাথেটার ঢুকিয়ে পেশাব করান হল। দেখলাম পেশাবের সাথে কিছুটা রক্তও বেরিয়ে এসেছে। ডাক্তার বললেন- ভর্তি করিয়ে কিছু পারীক্ষা-নিরীক্ষা করাবার জন্য। আলট্রাসনোগ্রাম, রক্ত পরীক্ষা করা হল। ডাক্তার বললেন– প্রস্টেট বড় হয়েছে , তাই পেশাব আটকে আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে প্রস্টেটের চেহারা ভাল নয়, তাই বাইপসি করিয়ে নিশ্চিত হতে হবে খারাপ কোন কিছু কিনা।

যা হোক , দু-দিন পরে ট্রান্সরেক্টাল (পায়ু পথ দিয়ে) বায়োপসি করা হল। ট্যিসু প্রিসার্ভ করে হিস্টোপ্যাথলজি করার জন্য পাঠান হল। এবার অপেক্ষার পালা। হিস্টোপ্যাথলজি রিপোর্ট আসতে ৩ থেকে ৪ দিন সময় লাগবে।

ইতিমধ্যে রাশেদের বাবার অবস্থা মোটামুটি ভালোর দিকে। পেটে ব্যাথা কমে গেছে। পেশাবের রাস্তায় এখনও ক্যাথেটার লাগান আছে। কিন্তু তার নতুন এক উপসর্গ হিসেবে শুরু হয়েছে কাশি। ডাক্তার বললেন- অনেক সময় হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের হসপিটাল অ্যাকুয়ার্ড নিউমনিয়া হতে পারে। তাই একটি ভাল অ্যান্টিবায়টিক দেয়া দরকার আর বুকের একটি এক্স-রে করান দরকার।

ইতিমধ্যে বায়োপসি রিপোর্ট ও এক্স-রে রিপোর্ট চলে এল। আমি, রাশেদ, সেলিম ভাই রিপোর্ট সহ ডাক্তারের চেম্বারে চলে গেলাম। সব রিপোর্ট দেখে ডাক্তার যা বললেন, তার সার সংক্ষেপ হচ্ছে– প্রসটেট ক্যান্সার উইথ লাঙ মেটাসটাসিস যার বাংলা মানে– প্রস্টেটের ক্যান্সার ফুসফুসে ছড়িয়ে পরেছে।কেমোথেরাপী-রেডিওথেরাপী দেয়া যেতে পারে কিন্তু তাতেও রোগী বেচে থাকার সম্ভাবনা ছয় থেকে আট মাস।

দেখলাম রাশেদ আর সেলিম ভাইয়ের মুখ একদম শুকিয়ে গেছে। ৫৭ বছর বয়সের একজন জ্বলজ্যান্ত মানুষ আজ নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে, বেচে থাকবেন সর্বোচ্চ আট মাস।

আমি রাশেদকে কি বলব বুষতে পারছিলাম না। এরকম পরিস্থিতিতে কখনো পরিনি। মন খারাপ করে দ্রুত হাসপাতাল থেকে চলে এলাম। ভাবছিলাম রাতে রাশেদকে ফোন করব। কিন্তু কি বলব ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই ইতস্ততঃ করে আর ফোন করা হল না।
দু-দিন পরে থাকতে না পেরে সোজা হাসপাতালে গিয়ে হাজির হলাম। কেবিনে ঢুকে দেখি রাশেদের বাবা একাই শুয়ে আছেন, সাথে কেউ নেই। তাকে সালাম দিয়ে পাশে গিয়ে বসলাম। মনে মনে ভাবলাম হয়ত তিনি তার ক্যান্সারের কথা যানেন না। তাই এ ব্যাপারে চুপচাপ থাকতে হবে।

–চাচা কেমন আছেন?

– এইতো আছি, মানুষ চাইলেও তো আর ভাল থাকতে পারে না।

– তুমি কি জান, আমার কি হয়েছে?

– আমি মিথ্যা করে বললাম, চাচা আপনার তেমন কিছুই হয় নি, ডাক্তার বলেছেন আপনার প্রস্টেট বড় হয়েছে, তাই সমস্যা হচ্ছে।

–তার মানে তুমি যান না , তাই না?

– আমি হকচকিয়ে বললাম, না তো আসলে আপনার তেমন সিরিসয়াস কিছু হয় নি।

– তুমি কি যান আমি আর মাত্র আট থেকে নয় মাস বেঁচে থাকব। এই সময়ের মধ্যে আমার মৃত্যু হবে।

– আমি চুপ করে থাকলাম। বুঝলাম তিনি সব জেনে গেছেন।

– তিনি বললেন-আচ্ছা মৃত্যুই কি সবকিছুর শেষ? বুদ্ধিমান এই মানবজাতি কি কেবল অল্প সময়ের জীবন-সংগ্রাম শেষ করে প্রাণহীন জড় মাটিতে পরিণত হবার জন্যই বেঁচে আছে? নাকি ধর্মবেত্তাদের কথা মত সত্যিই আল্লাহ নামের কেউ একজন আছেন?

– আমি চুপ করে থাকলাম। বুঝলাম তার মন-জগতে বিরাট একটা পরিবর্তন এসেছে।

– আমার মাথার কাছেই ফাইলে সব রিপোর্ট রাখা ছিল। বায়োপসি রিপোর্ট দেখে মোবাইলের ব্রাউজারে সার্চ দিয়ে বুঝে ফেলেছি আমার কি হয়েছে। তারপর থেকেই আমার কাছে এই জীবন অন্যরকম মনে হতে লাগল। আমি অনেকগুলো দেশ ঘুরেছি, জীবনে অনেক থিসিস করেছি, পি এইচ ডি করেছি– কিন্তু আজকে সবকিছু সত্যিই খুব অর্থহীন লাগছে। সত্যিই কি আমরা বিবর্তিত উন্নত ধরনের পশু? যারা এই পৃথিবীকে উন্নত থেকে উন্নততর এক আয়েশী বাসস্থানে পরিনত করার সংগ্রামে লিপ্ত। নাকি মানুষের জীবনের আর কোন অর্থ আছে?

– আমি চুপ করে শুনতে থাকলাম।

–আচ্ছা সমস্ত জীবনের ফিরিস্তি নিয়ে কি সত্যিই মানুষকে আল্লাহ নামের কোন এক সত্ত্বার সামনে দাঁড়াতে হবে? যিনি ন্যায়-অন্যায়ের সব হিসেব নিবেন। আজকে এই শেষ সময়ে এসে সত্যিই জীবনকে একটা রঙ্গিন ফানুস মনে হচ্ছে। পরকালবিহীন মানুষের জন্য জড়-জীবন-জড় এই একটি চক্রের পূর্ণতাসাধন ছাড়া আর কোন অর্থ থাকতে পারে না। না কি বল?

– আমি চুপ করে থাকলাম, কিছুই বলতে পারলাম না। দেখলাম রাশেদের বাবার দু-চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।

ঘুরে-ফিরে মাথার মধ্যে একটি আয়াত কেবল প্রতিধ্বণিত হল–
أَفَحَسِبْتُمْ أَنَّمَا خَلَقْنَاكُمْ عَبَثًا وَأَنَّكُمْ إِلَيْنَا لَا تُرْجَعُونَ
তোমরা কি ধারণা কর যে, আমি তোমাদেরকে অনর্থক সৃষ্টি করেছি এবং তোমরা আমার কাছে ফিরে আসবে না? [সুরা মু’মিনুন: ১১৫]
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যেকোন বাংগালীর ইন্টারভিউর সময়, 'লাই-ডিটেক্টটর' যোগ করে ইন্টারভিউ নেয়ার দরকার।

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৫ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



আপনার এনলাকার এমপি, প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী কামাল সাহেব, যেকোন সেক্রেটারী, যেকোন মেয়র, বসুন্ধরা গ্রুপের চেয়ারম্যান, বিএনপি'র রিজভী, আওয়ামী লীগের ওয়ায়দুল কাদের, আপনার থানার ওসি, সীমান্তের একজন বিজিবি সদস্য, ঢাকার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সকলের দায়িত্ব।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩৮



এগুলো আমার একান্ত মতামত। এই ব্লগ কাউকে ছোট করার জন্য লেখি নাই। শুধু আমার মনে জমে থাকা দুঃখ প্রকাশ করলাম। এতে আপনারা কষ্ট পেয়ে থাকলে আমি দায়ী না। এখনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

এখনো নদীপারে ঝড় বয়ে যায় || নতুন গান

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:২০

এ গানের লিরিক আমাকে অনেক যন্ত্রণা দিয়েছে। ২৪ বা ২৫ এপ্রিল ২০২৪-এ সুর ও গানের প্রথম কয়েক লাইন তৈরি হয়ে যায়। এরপর ব্যস্ত হয়ে পড়ি অন্য একটা গান নিয়ে। সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফেতনার সময় জামায়াত বদ্ধ ইসলামী আন্দোলন ফরজ নয়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৮



সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৩। তোমরা একত্রে আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে ধর! আর বিচ্ছিন্ন হবে না। তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ স্মরণ কর।যখন তোমরা শত্রু ছিলে তখন তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×