কাল দুপুরে মাত্র ৩ দিনের ঈদের ছুটি শেষে মন খারাপ করে বাড়ি থেকে ফিরছিলাম। দু’চোখ ভরে ধীর গতির ব্যস্ততা দেখতে দেখতে আসছিলাম। কখনো সেভাবে চোখ মেলে দেখার তো ফুরসত পাইনা যান্ত্রিক জীবনে। বাসের জানালা দিয়ে বুভূক্ষের মত তাকিয়ে ছিলাম বাইরে। যেন যা আসবে সামনে সব সৌন্দর্য্য গিলে খাবো। ভিষন রকম তৃষ্ণার্ত আমি, যেন দেখা হয়নাই চক্ষু মেলিয়া, ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া...
দেখলাম ৩-৪ জন কিশোরীর রং-বেরঙ্গের শাড়ি- জামা পড়ে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছে। আমার বাসেই উঠলো। কম দামি ঝলমলে ড্রেস আর মাল্টিকালারের বড় বড় গয়না, দু’হাত ভরে কনুই পর্যন্ত যেন-তেন ভাবে দেয়া মেহেদী। কিন্তু মুখগুলোয় যেন অপার্থিব খুশির ঝিলিক!! যেখানে আমাদের মেয়েরা হাজার বারোশ টাকা খরচ করে পার্লারে যায় শুধু মেহেদী দিতে, তাদের মুখেও এমন হাসি আমি কোনদিন দেখিনি।
লোকাল বাস হওয়ায় পুরো রাস্তা থেমে থেমে এগোচ্ছিল। একটু পরেই দেখলাম ১ পরিবার গাড়িতে উঠল। মায়ের কোলে ১ শিশু, হাতে ভারী ব্যাগ সহ বাচ্চাকে আকড়ে আছেন। আর ১ হাতে আরেক ব্যাগ। লোকটার মাথায় বিশাল বস্তা। মনে হয় গ্রাম থেকে চাল নিয়ে এসেছেন। আর বড় ১ টা বাজার করার প্লাস্টিকের ব্যাগ ঠাসা কাপড়। তার সাথেও ১ টা বাচ্চা!! কি অদ্ভুত সারল্য মাখা মুখগুলো...। খেটে খাওয়া ওদের জীবনের ঈদ আমার কোনদিন দেখা হয়নি শহুরে লেবাসের কারনে। কোনদিন বই ছাড়া গন্ড-গ্রামের অস্তিত্ব পাইনি। ওদের ভাষা শুনে অবাক হচ্ছিলাম, ১ টা বর্ণও বুঝতে না পেরে...।
রাস্তার পাশের ডোবাগুলো কানায় কানায় ভরে উঠছে। পানিতে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার টুপ টাপ শব্দ, বাজার থেকে ছোট মাছ আর বেগুন কিনে ফেরা মানুষের কাঁদা-পানি মাড়িয়ে হেঁটে যাওয়া, অলস বসে থেকে চায়ের দোকানের ধুমায়িত গরম চা আর আড্ডা, ছিটে বৃষ্টিতে ভেজা বালিতে বসে পিচ্চিদের প্রাসাদ বানানো, স-মিলের ভেজা কাঠের গন্ধ, বৃষ্টিস্নাত গাছের সজিবতা...যেন চোখ ভরে দেখেও মনের আশ মিটছিল না।
এক চাচী উঠলেন মাঝ রাস্তায়। বগলে বড় ডাঁটের আদ্যিকালের বিশাল কালো ছাতা আর ১ টা পোটলা নিয়ে। বেশ মজা পেলাম দেখে। উনি বাসে উঠার সাথে সাথে বাস ভরে গেল শুটকির গন্ধে!! বুঝলাম না ১ পোটলায় তিনি কিভাবে কাপড় আর শুটকি নিয়ে নিলেন!! কিন্তু চাচী নির্বিকার...!!
পাশের লোকটা নেমে যাওয়ায় এসে বসলেন ১ মা তার মেয়ে কোলে নিয়ে। ২ জনেরই হাত ভর্তি মেহেদি, কড়া মেক-আপ আর চুপচুপে করে দেয়া তেল মাথায়। এত কড়া গন্ধের কি তেল থাকতে পারে ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ জুঁই আর হাঁস মার্কা নারিকেল তেলের নাম মনে পড়ে গেল। আমাদের শহুরে মেয়েরা মাথায় বোধ হয় তেলই দেয়না!! কে জানে, হয়তো এখনো এই তেলগুলো গ্রামের মুদি দোকানে পাওয়া যায়...। ভাবতে ভাবতেই প্রায় ঢাকা পৌছে গেলাম।
একটা স্টপেজে থামতেই হুরমুর করে কিছু লোক নামল। দেখলাম প্রত্যেকটা মেয়ের চুল রঙ করা, একই রকম পোষাক পরা। প্রথমে ভাবলাম নাটক-যাত্রা করতে যাচ্ছে বুঝি। পরে বুঝলাম ঈদে বেড়াতে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত...ছোটবেলায় ভাইদের সাথে মিলিয়ে ড্রেস কেনা হতো, ভুলেই গিয়েছিলাম সেই স্মৃতি!! সাথে কিছু ছেলে ছিল। তারাও কিম্ভুত পোষাক পড়ে মহানন্দে যাচ্ছে। তাদেরও হাতে মেহেদির আলপনা!!! অবাক হলেও ভাল লাগল এই ভেবে যে ওরা এটলিস্ট “পাছে লোকে কিছু বলে” এই ভয়ে নিজেদের আনন্দ-উচ্ছাসকে ঢেকে রাখেনি।
ঢাকায় ঢুকলাম। মনটাই খারাপ হয়ে গেল। কোথায় সেই সবুজের সমারোহ আর কোথায় ভেজা মাটির সোঁদা গন্ধ!! কিছুই নেই। এখানে বৃষ্টি বিলাস করতে হয় ইট-কাঠের চত্তরে। তবু যেন একটু ভাললাগা খুঁজতে লাগলাম। পেলাম ও...
চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগলাম... হঠাৎ দেখি এক বাড়ির ছাদ থেকে পানি পড়ছে আর সেই পানিতে দাপাদাপি করছে কিছু বাচ্চা!! প্রায় ৬ তলার উপর থেকে পড়া পানি, হয়তো ওদের জীবনে এটাই ঝর্ণাধারা... দেখলাম দুরের কোন এক ছাদে একা ভিজতে থাকা কোন মেয়ে, কখনো বা বৃষ্টিতে ভিজে ওযু করতে বসা মুসুল্লি, কিংবা ইলেক্ট্রিক তারে বসে কাকভেজা হওয়া কোন সত্যিকারের কাক!! চশমার কাচে জমা পানিতে ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতেও মুগ্ধ হয়ে কাল প্রকৃতি দেখলাম। দেখলাম অন্য কোন বাসের জানালায় এলো-খোলা চুলের কোন স্নিগ্ধ তরুনীকে উদাস মুখে বসে থাকতে। তার গালে-কপালে বৃষ্টির ছাঁট!! আমাকেও যেন কবি হয়ে যেতে বাধ্য করা ভঙ্গি...
অবশেষে বাস থেকে নেমে বাসার পথে হাঁটা ধরলাম। তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো। আস্তে করে ছাতাটা গুটিয়ে নিয়ে হাটতে শুরু করলাম। হোক না আজ একটু নিয়ম ভাঙ্গা...আজ যে বড্ড ইচ্ছে করছে সমস্ত সত্তা দিয়ে বৃষ্টি বিলাস করতে। কদম না হয় নাই বা পেলাম, কিছু অপূর্ণতাও প্রাপ্তির স্বাদ বাড়ায়...
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:২২