আমাদের সবার কাছেই হিটলারের নাম খুব পরিচিত। কেউ কেউ শুধু তাকে একজন নেতা হিসেবে চেনেন। আবার কেউ কেউ নাৎসি বাহিনীর প্রধান এবং হৃদয়হীন মানুষ হিসেবে জানেন। অনেকে হয়তোবা আরো বেশিই জানেন। আমি এখানে হিটলারের জীবনী কিংবা মৃত্যুদন্ড দেয়ার পদ্ধতি আলোচনা করতে বসিনি। আমার কথাগুলো খুব সাধারন। দ্বিমত পোষনকারী থাকতেই পারেন।
আমরা অনেকেই হিটলার ও তার নাৎসি বাহিনির শাস্তি বা মৃত্যুদন্ড প্রদানের পৈশাচিকতার কথা জানি। কিন্তু আমরা কি তার থেকে ভাল কিছু করছি? সামান্য ক্ষোভ কিংবা সন্দেহ আজ আমরা এতটা নারকীয় রূপে কিভাবে প্রকাশ করতে পারি? কেন যেন আজ নিজের দেশে ঘটে যাওয়া একের পর এক ঘটনায় বাধ্য হলাম কিছু লিখতে। কিছু ঘটনার তুলনা করব, পাঠকের উপর দায়িত্ব থাকল বিবেচনার।
১। লিথেল ইঞ্জেকশান প্রয়োগে মৃত্যুদন্ডঃ
১৯৪০ সালে জার্মানির নাৎসি বাহিনী এই পদ্ধতি প্রথম ব্যবহার করে।১৯৮২ সালে আমেরিকা এবং ৯৭ সালে চীনে রাস্ট্রীয়ভাবে এই পদ্ধতি অনুমোদন করা হয়। এই পদ্ধতিতে ইঞ্জেকশান প্রয়োগের পর অপরাধী ব্যক্তিটি প্রচন্ড ব্যথায় ছটফট করতে থাকে এবং দীর্ঘ সময় নেয় মৃত্যুবরন করার জন্য যা চোখে দেখে সহ্য করা যায়না। তাই এখন এই পদ্ধতিকে আধুনিকায়ন করা হয়েছে। ৩ ধাপে ইঞ্জেকশান প্রয়োগ করা হয় যেখানে প্রথমে ব্যক্তি কোমায় চলে যায়। ২য় ধাপে অংগ-প্রত্যংগ প্যারালাইজড হয়ে পড়ে এবং সব শেষে হঠাৎ হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ানক কষ্টটুকু বাহ্যিকভাবে দেখা যায়না।
অপর পক্ষে আমরা কি করছি? নিরপরাধ রাজনকে পেটাচ্ছি। সেই নির্যাতনের ভিডিও বানাচ্ছি ফেসবুকে দেয়ার জন্য। তার বাঁধা হাত-পা ছেড়ে দিয়ে হাটাচ্ছি হাড় ভাংতে পেরেছি কিনা যাচাই করতে। সে যখন মরন চিৎকারে পানি চাইছিল আমরা তখন উল্লাসে ফেঁটে পড়ছিলাম, তাকে ঘাম খেতে বলে। কারা বেশি নৃশংস বলতে পারেন?
২। গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে মৃত্যুদন্ডঃ
১৯২১ সালে নাভাদায় এই পদ্ধতি প্রথম প্রয়োগ হয়েছে। ১৯৪০ সালে নাৎসি বাহিনী এই ব্যবস্থ্যা ব্যাপকহারে ব্যবহার করে। ১ টি সিলিন্ডার আকৃতির এয়ার টাইট গ্যাস চেম্বারে অপরাধীকে ঢুকিয়ে দিয়ে ভেতরে সায়ানাইড গ্যাস প্রবেশ করানো হয়। শ্বাস নিতে না পারার তীব্র কষ্টে ব্যক্তিটি চিৎকার করতে থাকে। অক্সিজেনের অভাবে বুক ফুলে ওঠে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চায়, পাটাতনের উপর ভয়ানকভাবে শরীরটি আছড়াতে , মোচড়াতে থাকে। একসময় নিস্তেজ হয়ে যায়। এই পদ্ধতিটিও আধুনিকায়ন করে দৃষ্টিসহা করা হয়েছে। এখন ব্যক্তিকে শুইয়ে হাত-পা, মাথা-কোমর, হাঁটু বেধে ফেলা হয়। তার নড়াচড়ার উপায় থাকেনা। তাই কষ্টের তীব্রতাও শাস্তিদাতার দৃষ্টি ও হৃদয়কে পীড়া দেয়না।
অপরদিকে আমরা কি করছি? চাকুরী ছেড়ে চলে যাওয়ার সামান্য অপরাধে ১২ বছরের কিশোর রাকিবের পায়ুপথ দিয়ে কম্প্রেশার মেশিন দিয়ে বাতাস ঢুকিয়েছি। এতে ওর পেট ফুলে গেছে। তার মাগো মাগো চিৎকা্র আমাদের বধিরতা ঘুচায়নি। বাতাসের প্রচন্ড চাপে ওর নাড়ি-ভুড়ি ছিড়ে গেছে, ফুসফুস ফেটে গেছে। আমরা পেটে চাপ দিয়ে সেই বাতাস আবার বের করার চেষ্টা করেছি। কতটা অমানুষ আমরা হতে পারি?
প্রতিদিন নতুন নতুন পদ্ধতিতে আমরা মানুষ মারছি। অপরাধ, বয়স বিবেচনা করার সময় কোথায় আমাদের? পশুত্ব, নৃশংসতা, অমানবিকতা, নারকিয়তা যেখানে আমাদের লেবাস হয়ে যাচ্ছে সেখানে নিয়ত রাজন, রাকিব, রবিউলরা মরবেই। মাছ চুরির অপরাধে রবিউলের চোখ উপড়ে দিব, চোর সন্দেহে মনিরের মুখ পায়ে চেপে তার শ্বাস আটকে দিব, হাসপাতালের বিল দিতে না পেরে নিজের সন্তানকে ৭ তলার জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিব...। আমাদের অপরাধ মাত্রা ছাড়াবে...
এখনও আমাদের মনুষত্য মরে যায়নি। আমরা জোর গলায় প্রতিবাদ তো করছি, অপরাধী ধরতে সাহায্যও করছি। কিন্তু এত অপরাধের তোড়ে আগের ঘটনাগুলি তলিয়ে যাচ্ছে। তাই আসুন প্রতিবাদের ভাষা জোরালো করি, মজবুত করি দাবিগুলো। আইনী প্রয়োগের ক্ষেত্রে দরকারে দ্রুত বিচার ট্রাইবুনালের আওতায় আনার দাবি জানাই। শুধুমাত্র অপরাধী ধরাই নয়, সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তমুলক শাস্তির দাবি জানাই। যে শাস্তি হবে প্রকাশ্য এবং ভয়ানক, যেন আর কোন রাজন, রাকিবের গায়ে হাত তোলার আগে নরপশুরা ১০০ বার ভাবে, নিজের ভবিষ্যত চোখে ভেসে ওঠে। আমরাও যেন সন্তান হারিয়ে, অনাগত গুলিবিদ্ধ সন্তান বাঁচাতে রাজপথে না নামে সন্তান বুকে করে নিশ্চিন্তে রাজপথে হাঁটতে পারি। ওদের নিশ্চিৎ আলয় গড়ার দায়িত্ব যে আমাদেরই...
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ২:৪০