somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাত্রির যীশু

০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৭:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(১)
রাত ঘন হচ্ছে। শহীদবাগ মোড়ে বাতিগুলো নিভছে আর জ্বলছে। অনেকটা সার্কাসের শেষ শোয়ের বাজিগরের খেলার মতো! বাতাসেরও আজ ঠিক ঠিকানা নেই। এই দুম করে সব উড়িয়ে নিতে চাচ্ছে তো আবার খানিক পরেই স্তব্ধ হয়ে যাচ্ছে! বৃষ্টি হতে পারে, হয়তো সাথে ঝড়ও! কিন্তু তাতে সুমনের কিছুই যায় আসেনা। কোন মেঘে ঝড় আসে আর কোন মেঘে শহরের বুকে বান ডাকা বৃষ্টি আসে সেটা সে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা। তবে বৃষ্টি আসলে খুব সমস্যায় পড়ে যায়, কোথাকার ময়লা যে কোথায় ভেসে যায়, তার কোন হদিস পাওয়া যায়না! ওহ! সুমনের পরিচয়টা দেয়া যাক। খুব বেশি পরিচয় ওর নেই আপাতত; হয়তো কোন এককালে ছিলো; কে জানে! এখন কোন জন্ম নিবন্ধন বা আদমশুমারীর লিস্টে ওকে কেউ খুঁজে পাওয়া যাবেনা এটা নিশ্চিত। তাতে কি! এই মস্ত অগোছালো শহরের বুকে সে এসবের হিসাব ছাড়াই দিব্যি বেঁচে আছে। আরো তার মতো অনেকেই এভাবে বাঁচে! বছর বারো বয়সের সুমন সারাদিন মানুষের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকের বোতল কুড়ায় আর কাঁধে ঝুলানো বস্তায় জমায়। বস্তার রংটা যে কি তা বলা কঠিন, বহুদিনের ময়লার পরতে সেটাকে কালো দেখায়। যেমন কালো দেখায় সুমনের শরীরের জমা ছোপ ছোপ ময়লার দাগগুলি! প্রতিদিন রাত দশটার দিকে জমানো প্লাস্টিক গুলো সে বেঁচে দিয়ে আসে মগবাজারের সালু ভাইয়ের দোকানে। দর বড্ড কম, দশ টাকা কেজি। প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে কেজিখানেক ওজন জোগাড় করতে প্রায়ই অর্ধেকদিন পার হয়। লোকে বলে এই শহরে নাকি সবকিছুরই খুব দাম বেশি। ওরা নিশ্চয়ই এসব হিসাব না জেনেই বলে! সুমন যখন আরো ছোট ছিলো তখন মাঝে মাঝে মনে প্রশ্ন জাগতো, এইসব ফেলে দেওয়া বোতলে হয় কি! এখন আর জাগেনা, আদার ব্যাপারী জাহাজের খবর রাখেনা, এই প্রবাদ বইয়ে মুখস্থ না করলেও ভাবার্থ সে জানে! তাই সে প্রশ্ন করেনা আর। শুধু পাগলের মতো ফেলে দেওয়া বোতল খুঁজে বেড়ায়, আর সামনে কাউকে দেখলেই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে-‘টাকা দেন, এট্টু খামু!” এটাও এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে। কথায় বলে চর্চায় কি না হয়!
আজকের সমস্যাটা বেশ গুরুতর। বৃষ্টির আভাস পেয়েই সম্ভবত বাড়ি চলে গিয়েছে সালু মিয়া। তা সে যেতেই পারে, কিন্তু সুমনের পেটে দুপুর থেকে দানা পানি পড়েনি। আশায় ছিলো প্লাস্টিকের বোঝা বেঁচতে পারলে অন্তত পেটে কিছু জুটবে হয়তো। কিন্তু সেই আশায় গুড়েবালি। এমন হবে সে আন্দাজ করতে পারেনি একটুও! বিকালে সোহরাওয়ার্দীর মাঠে যখন মিটিং জমেছিলো, সেখানে গিয়ে বসেছিলো একটা প্যাকেটের আশায়। কিন্তু কপাল খারাপ। আজকাল রাজনৈতিক দলগুলোও বড় হিসেবি হয়ে গিয়েছে, লিস্ট ধরে ধরে প্যাকেট দেয়; সাথে আসা লোকগুলোও গোগ্রাসে গিলতে থাকে, সুমনদের ভাগ্যে বিড়ালের শিকা ছিঁড়ে না। পুরো বিকালটা জনসভার আশেপাশে ঘুরেও একটা প্যাকেট জোগাড় হয়নি তার আজ। অথচ কুকুরেরা ঠিকই খাবার জোগাড় করে ফেলেছিলো, সেও তাদের সাথেই ছিলো, কিন্তু লাভ হলো কই! কত মানুষেরা খাবার নষ্টও করলো। অর্ধেক প্যাকেট ভরা খাবার গুলো কুকুরের দল টেনে নিয়ে গেলো এখানে সেখানে! ঐ যে লাল রঙের দুর্বল কুকুরের ছানাটা সেও খাবার জোগাড় করে ফেলেছিলো, শুধু তারই খাওয়া হলোনা!
এসব ভাবতেই কখন পার হয়ে গেলো মেঘ! শহরের চত্বরে অর্ধেক চাঁদ চোরের মতো আবার উঁকি দিল। ঝড়ো বাতাস মাঝে মাঝে শরীর বুলিয়ে কোন দিকে যে হারাচ্ছিল কেওই জানেনা। দূরে ওভারব্রিজের উপর ঘুমিয়ে পড়েছিল অনেকে। তারও ঘুমানোর কথা ছিলো এতোক্ষণে। কিন্ত ক্ষুধার জ্বালায় পেট বিদ্রোহ করছে যেভাবে তাতে সারারাত ঘুমাতে পারবে কিনা তারই ঠিক নেই এখন। তীব্র একটা ব্যথা পেটের উপর থেকে পাক খেয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে একটু পর পর! মনে হচ্ছে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে, অজ্ঞান হয়ে যাবে, হলেই ভালো হতো! আজকের রাতটা যদি জ্ঞান হারিয়ে পার করা যেতো! পশ্চিমের গলিটার মাথায় যে ডাস্টবিন, ওইটা খুব নোংরা বলে টোকাইরাও খাবার খুটতে যায়না। কুকুরেরা অবশ্য যায়, ওদের কোন ঘেন্নার বালাই নেই! তবু যদি কিছু একটু পাওয়া যায়, এই ভেবে সেইদিকে পা চালালো সুমন। বাম পাশের ফুটপাথের ফুলের দোকান গুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল একটা পর একটা। রজনীগন্ধার তীব্র গন্ধে নাক চেপে আসছিল সুমনের! ফুলের গন্ধেও তার ক্ষুধা কমেনা, বরং বেড়ে যায়! হাত দিয়ে নাক চেপে পশ্চিমের রাস্তার দিকে দ্রুত আগালো। ফুল কবিকে পদ্যের লাইন যোগায়, কিন্তু ক্ষুধার্তকে কি দেয়! এটার উত্তর এই মুহূর্তে একমাত্র সুমন জানতো, তবে আমাদের সাথে কথা বলার মতো স্থিরতায় সে তখন ছিলোনা।
পশ্চিমের ডাস্টবিন ঘিরে কুকুরের দল তখন ভয়ংকর সংগ্রামে লিপ্ত। তাদের চোখের সামনে থেকে উচ্ছিষ্টের প্যাকেট সহ সব ময়লা পৌরসভার গাড়িতে তুলে নিচ্ছিল কর্পোরেশনের লোকেরা। পুরোদমে একটা অন্যায় হচ্ছিলো তাদের সাথে! ময়লার ট্রাকের ড্রাইভারের অবশ্য মজাই লাগছিল। সবগুলো দল বেঁধে ঘেউ ঘেউ করে কয়েক কদম আগাচ্ছে, আর ড্রাইভার ট্রাকের আলো জ্বালিয়ে, কষে স্টার্ট দিচ্ছে ইঞ্জিন! রাত্রির শুনশান নীরবতা ভেংগে জন্তুর মতো গর গর আওয়াজ করে উঠছে ভাঙ্গা ট্রাকটা, আর কুকুরের দল ভয় পেয়ে পাশের গলিতে লুকোচ্ছে। চোখের সামনে খাবার হাতছাড়া হচ্ছে দেখে, আবার রাস্তায় নামছে। খেলাটা চলছে বেশ কিছুক্ষণ হলো, হয়তো চলবে আরো! এই শহরে তো সবাই খেলছে, কে কার সাথে সেটাই বোঝা মুশকিল। আসলে প্রতিদিন সকালেই ময়লা পরিষ্কার করতে আসে এরা। আজ আকাশের অবস্থা দেখে রাতেই ময়লা সরাতে এসেছে, নাহলে বৃষ্টির পানিতে এইসব বিরিয়ানীর প্যাকেট সারা শহরে ভেসে বেড়াবে! তখন কেউ বৃষ্টির পানির দোষ দিবেনা, ভাবে করপোরেশনের লোকগুলো! একটা ক্যামেরা হাতে ময়লার প্যাকেটগুলো ফোকাস করে তাদের গুষ্টির তুষ্টি করবে সবগুলো চ্যানেল! তাই রাতেই সব সাফসুতোর করতে লেগেছে সবাই। কালো কাদার সাথে বাসি খাবারের গন্ধের ঘ্রাণ মিলে এক গাঁ গুলানো বাতাস জমে আছে ওখানের চারেপাশে। এই বাতাস সুমনের চেনা, এই ঘ্রাণেই সে বসবাস করে, এই ঘ্রাণ মেখেই সে এতোটা বড় হয়েছে! দূর থেকেই ট্রাকগুলোকে দেখে সে। এরকম তো হবার কথা নয়। ওরা তো এখন আসেনা, সকালে আসে! আসলে কপাল যখন খারাপ থাকে তখন কি আর নিয়মের ধার ধারে কিছু। ট্রাকগুলো থেকে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে পাশের দেয়ালের ধার ঘেঁষে দাঁড়ালো সুমন। আচ্ছা প্রচণ্ড ক্ষুধা পেলে মানুষের ষষ্ট ইন্দ্রিয় কি খুব বেশি কাজ করে! সুমন দেখলো কাদার মধ্যে মেশানো বিরিয়ানীর প্যাকেট, ফাঁকে দুই একটা মাংসের পিস ও দেখা যাচ্ছিল! ওই যে রসালো মুরগীর ঠ্যাংটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ট্রাকের উপরের দিক থেকে ঝুলে আছে কেমন! সে তাদের কাছে চাইলে তারা অবশ্যই দিবে। অন্তত এখনো মানুষ সম্ভবত এতো খারাপ হয়ে যায় নাই। সুমন চাইতেই পারতো, কিন্তু সে চায়না! সারাদিন না খেয়ে থেকে, এখন হারানোর ঝুঁকি নিতে রাজী নয় সে! কখনো কখনো মানুষের প্রবৃত্তি গুলো এতো তীব্র হয়ে উঠে যে যুক্তি খন্ডনের সময় থাকেনা! সুমন একটা ভোঁ দৌড় দেয় ট্রাকের উপর ঝুলে থাকা খাবারের প্যাকেট লক্ষ্য করে! লোকে বলে রাত্রির নাকি আলাদা স্বভাব থাকে, চেনা জিনিসও অচেনা লাগে, ভয় লাগে খুব সামান্যতেই! তাকে ঐভাবে দৌড়ে আসতে দেখে ভড়কে যায় ময়লা পরিষ্কার করতে আসা লোকগুলি। আত্মরক্ষার স্বাভাবিক প্রবণতা থেকেই তারা হাতের কোদাল গুলো নিয়ে মুখোমুখি তেড়ে যায় তার দিকে! সুমনের শরীরে বহমান ক্ষুধার স্রোত থামিয়ে নেমে আসে ভয়ের ঝটকা! এটা সে আশা করে নাই! ঝড়ের মেঘের ফাঁকে আধো ছায়ার চাঁদের আলোয় রূপালী কোদালের ফলা হাঁতে তেড়ে আসা মানুষগুলিকে দেখে সে বুঝতে পারেনা, এরা কেমন মানুষ! নাকি মানুষ নয় অন্য কিছু! এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে সটান পিছনে ঘুরে পাগলের মত দৌড় লাগায় বিপরীত দিকে! লোকগুলোর সম্ভিত ফিরে আসে, নিজেদের আচরণে হেসে দেয় কয়েকজন! আর কুকুরের পাল মানব জাতির প্রতি সকল সঞ্চিত ক্ষোভ উগড়ে দিতে তাড়া করে সুমনকে! তাদের কর্কশ চিৎকার রাতের কানের পর্দা পাঠিয়ে রাস্তায় মিশে যায়! শুধু কাঁদায় মাখানো মুরগীর রোস্টটা সুমনের খাওয়া হয়না!
(২)
সুমন কোনদিকে দৌড়াচ্ছিলো তার সঠিক হিসাব তখন মাথায় ছিলোনা। যত দোষ নচ্ছার কুকুরগুলোর! রাতের বেলায় পাল ধরে তাড়া করলে কি কারো সাহসে কুলায় ওদের মুখোমুখি দাঁড়ানোর! শোধ নেবে সে, অবশ্যই দিনের বেলায় এর শোধ নেবে। বিশেষ করে যে পালের গোদা লেজকাটা কুকুরটা সামনে ছিলো, ওর চেহারা সে মুখস্থ করে ফেলেছে। পার্কের রাস্তার ফাঁকে যদি কোনদিন পেয়ে যায়, ভাঙ্গা ইট দিয়ে সেদিন ঠিক ওর মাথাটা থেঁতলে দিবে! হাঁটতে হাঁটতে এইসবই ভাবছিলো। ক্ষুধার্ত আর ক্লান্ত শরীর নিয়ে বেশিদূর দৌড়াতে পারেনি, কিন্তু রাস্তা হারিয়ে ফেলেছে। যে গলিটা দিয়ে হাঁটছিল তার দুপাশে ঘন আম গাছের সারি, আর ল্যম্পপোস্টের সংখ্যাও কম অনেক। মনে হচ্ছে বহু প্রাচীন কোন রাস্তা তার যৌবন হারিয়ে অন্ধকারে জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। সাধারণ লোকেরা সাধারণত রাত গভীর হলে এই রাস্তা মাড়ায় না। ছিনতাই বা চুরির ভয়ের চেয়েও অজানা কোন এক ভয় আছে সম্ভবত রাস্তাটাকে ঘিরে! রাস্তাটার একপাশে সিমেটেরি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তৈরী। এখন যদিও আর নতুন কোন সমাধি দেয়া হয়না, তবুও মানুষের গাঁ ছমছম করে। যোগ চিহ্নের মতো ক্রস গুলো প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে তাকিয়ে থাকে রাতের অন্ধকারের ফাঁকে ফাঁকে। এর ভিতরেই বেঁচে আছে শহরের শেষ শেয়ালগুলো। কি খেয়ে বাঁচে, তা কেউ জানেনা, তবে এখনো তারা আছে। এদের মধ্যেই কয়েকটা ডেকে উঠল কারণ ছাড়াই। কেঁপে উঠল সুমন। এমনিতে তার ভয় ডর কম! কম হবেই বা না কেন, অন্ধকারে যার বসবাস রাতকে তার আর ভয় কিসের! তবুও শেয়ালের ডাক শুনে কেঁপে উঠে সে। খুধা মানুষের মন শরীর সব দুর্বল করে দেয়, ক্ষুধা বেঈমান! সুমনেরও খাবার দরকার, তার পা আর চলছেইনা। মনে হচ্ছে পা দুটোকে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, এভাবে ঘষে ঘষে হাঁটতে শুরু করলো।
সিমেটেরির থেকে আর দুইশ মিটার সামনে শুরূ হয়েছে এই শহরের অভিজাত এলাকা হোসনীবাগ। বাকী শহর থেকে কাগজে কলমে আলাদা না হলেও অলিখিত নিয়মের বেড়া আছে এখানে। যে কেউ যখন তখন ঢুকতে পারেনা। একটা মার্বেল পাথরের গেট বাকী শহরে থেকে এর আলাদা অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলে সবসময়। খাকী পোশাক পড়া দুইজন করে গার্ড পালা করে দাঁড়িয়ে থাকে এখানে। এই এলাকা পার না হতে পারলে শহীদবাগ মোড়ে পৌঁছানো সম্ভব নয় কোনমতেই। কিন্তু এখানে টোকাইদের প্রবেশ নিষেধ, সে দিনে হোক কিংবা রাতে। সুমনের ভাগ্য সুপ্রসন্ন বলতে হবে, শীতল বাতাসের আবেশে এতো রাতে গার্ডরা চেয়ারে বসে ঢুলছে। রাজ্যের ঘুম ভর করেছে তাদের। এই শহরের ফাঁকফোকর আর গলিপথ দিয়ে ঘুরে বেড়ানো সুমন আর দেরী করেনা, বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়ে তাদের পেরিয়ে ঢুকে যায় হোসনীবাগের ভিতর। এখানে আগে কখনো তার আসা হয়নি, সত্যি বলতে ঢুকতেই দেয়া হয়নি। এরকম বাড়িঘর আগে সে দেখেনি কখনো! সাদা মার্বল পাথরের পিলার হালকা আলোয় ঝলমল করছে, কোন কোন বারান্দা থেকে লতারা নেমে এসেছে রাস্তায়, কোনটার পুরোটা দেয়াল কাঁচের তৈরী! সুমনের ছোট্ট জীবনে এমন জৌলুস কখনো দেখেনি। দূরে একটা বাগানের ফাঁকে ঝুলছে কয়েকটা দোলনা। সামনের মোড়ে এক উন্মুক্ত বক্ষা পাথরের রমণী হাতে পানির ঝরণা নিয়ে একমনে দাঁড়িয়ে আছে। বিদ্যুতের মতো তীব্র পানির ধারা দেখে সুমনের আবেশ কেটে যায়, হতচ্ছাড়া ক্ষুধাটা আবার পাক খেয়ে উঠে আসে পেটের ভিতর থেকে। মনে হয় নাড়িভুড়ি বের হয়ে আসবে, এইরকম একটা জঘণ্য অনুভূতি কাজ করে তার ভিতর। তাড়াতাড়ি আঁজলায় পানি ভরে নিয়ে মুখে দেয়। পানি খেলে ক্ষুধা কমে, এটা তার জানা। ক্ষুধা কিছুটা কমে কিন্তু ব্যাথা কমেনা। ফোয়ারটার ধারে নেতানো চারা গাছের মতো হেলান দিলো সে।
একটা অস্ফুট ফিসফিসানি শুনে কান খাঁড়া করে খরগোসের মতো। তার থেকে হাত বিশেক দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলছে দুইজন যুবক ও যুবতী! যুবকটির মাথায় ঘনচুল, ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়ি খুব যত্নে কাঁটা, হাতে একটা শক্ত কার্ডবোর্ডের প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে। প্যাকেটের উপরটা খোলা; ছেলেটার ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে। আর মেয়েটার মাথায় পনিকাট চুল, সিল্কি করে রাখা, দুধে আলতা গাঁয়ের রং! মেয়েটা প্যাকেটটা থেকে কিছু একটা খাবার খাচ্ছে খুব আগ্রহভরে। প্রচন্ড ক্ষুধায় আর আজন্ম অভ্যাস বশত স্থান কাল পাত্র ভুলে সেইদিকে হাত বাড়িয়ে এগিয়ে যায় সুমন! ‘ভাই এট্টূ খাবার দেন!’ শুনে ভুত দেখার মতো আঁতকে উঠে দুই যুবক-যুবতী। ভয় পাওয়ারই কথা, এদের এখানে কখনো দেখা যায়না, কিভাবে ঢুকলো! ‘গার্ড এই গার্ড’ বলে চিৎকার শুরু করতেই পরিস্থিতি ঠাওর করে ফেলে সুমন। টিকে থাকার প্রবৃত্তি তাকে সাহস যোগায়। বানরের মতো একলাফে কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার হাতে রাখা বাক্স থেকে একমুঠিতে যতোটুকু উঠে তার চেয়েও বেশি তুলে নেয়। বিস্ময়ে আর ক্ষোভে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে ছেলেটা; জেগে উঠে গার্ড, আশেপাশের কয়েক বাড়ির মানুষ! আবার দিকবিদিক ভুলে দৌড়ায় সুমন, এরমধ্যেই মুখে পুড়ে নেয় খাবারটূকু।
খাবারটা মুখে পুরতে গিয়ে সে আসলেই দিক ভুলে গিয়েছিলো! সোজা গিয়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গার্ডের উপর। একজোড়া শক্ত হাত তাকে তুলে ছুড়ে ফেলে রাস্তার উপর। পায়ের পাতাটা মনে হয় ফেটে গেলো এরকম ভাবে ব্যাথা শুরু হয়। দুই জোড়া হাত ছোট্ট শরীরটার ক্রমাগত চড় থাপড় চালাতে থাকে। ব্যাথায় কাতরাতে থাকে সুমন! মনে হয় শরীর জ্বলে যাচ্ছে, ছিঁড়ে যাচ্ছে চামড়া! হঠাত একটা ঘুষির ধাক্কা পড়ে পেটের উপর, আর সামলাতে পারেনা সে। যা খেয়েছিলো, তার সবটুকু বমি করে উগড়ে দেয়! আঁতকে উঠে সরে যায় গার্ড দুটো। এইখানে মরে গেলে তো সর্বনাশ হয়ে যাবে তাদের! দুইজনে তার দুই হাত পা ধরে নিস্তেজ শরীরটাকে ফেলে আসে হোসনীবাগের সীমানার বাইরে, সিমেটেরির পাশে!
(৩)
কবরস্থানের পাশে যেখানে কয়েকটা আম গাছের সাথে বেখাপ্পা ভাবে ভাবে দাঁড়িয়ে আছে একটা সেগুন গাছ, পাতা গুলো ছড়িয়ে থাকে ইতস্তত। সেখানে নামহীন এক মানুষের বাস। মাথার চুল জমে জট পেকে গিয়েছে, শরীরের গন্ধে আশেপাশে সভ্য মানুষেরা দাঁড়াতে পারেনা! সে সারাদিন বিড়বিড় করে, কার সাথে কথা বলে কে জানে! অন্তত এ জগতের কারো সাথে তো নয়ই! একাই হাসে, ঘুম পেলে সেখানেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর খাবার, সেটা কোন না কোনভাবে জুটেই যায়। নাহলে কি আর একই জায়গায় দশ বছর তাকে দেখতে পেতো শহরের মানুষেরা! তাকে দেখে কেউ ঘৃণা করে, কেউবা ভয় পায়! চঞ্চল ফড়িঙ্গের মতো উড়তে থাকা যুগলেরা তাকে দেখে আঁতকে উঠে। নিরাপদ দূরত্বে চলে যায়। তাদের মনে হয় কোন অশুভ সংকেত নিয়ে নেমে এলো নাকি এই পাগল! লোকটার তাতে কিছু আসে যায়না, একাই কথা বলে, একাই হাসে! তার মন আজ খুব ভালো ছিলো। বহুদিন পর পেট পুরে খেতে পেয়ে একা একাই হাসছিলো।
গার্ড দুটো ধরাধরি করে এনে ধুপ করে ফেলে দিলো সুমনের শরীরটা তার পাশেই। তারপর যে গতিতে এসেছিলো তার চেয়েও বেশি দ্রুত গতিতে হারিয়ে গেলো হোসনীবাগের দিকটায়। সুমন মটকা মেরে পড়েছিল এতোক্ষণ। খুব ছোটবেলাতেই সে শিখে নিয়েছে যখন পালানোর উপায় নেই, মাইর খাওয়া অবশ্যম্ভাবী, তখন দাঁতে দাঁত চেপে এভাবেই পড়ে থাকতে হয়। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটা একবার তাকিয়ে দেখলো সুমনের দিকে। কোন এক অদ্ভুত চিন্তা অজানা জগত থেকে তাকে নাড়া দিলো হয়তো। সুমন টলতে টলতে উঠে দাঁড়াতেই তার ডান হাতটা চেপে ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো মানসিক ভারসাম্যহীন লোকটা! সে ছাড়া পাওয়ার জন্য চেষ্টা করলো, কিন্তু দুর্বল হাত পায়ে শক্তি যোগাড় করতে পারলো না তেমন। তার শরীর অনেক ঠান্ডায় যেমন কাঁপে, তেমন অনিয়ন্ত্রিত ভাবে কাঁপতে শুরু করলো। তাকে টানতে থাকা লোকটা এতে কোন ভ্রুক্ষেপ করলোনা, শুধু অদ্ভুতভাবে হলুদ দাঁতের পাটি বের করে আকর্ণবিস্তৃত হাসি মুখে মেখে হাঁটতেই থাকলো! কবরস্থানের অন্ধকার গলি ঘুপচির ঝিঁঝিঁ পোকা গুলো কান ঝালাপালা করে দিচ্ছিলো! একটা প্যাঁচা বিনা কারণে শব্দ করে উঠলো। সামনে কয়েকটা পশু ঝট করে পার হয়ে গেলো একপাশ থেকে আরেকপাশে। সুমনের ঘোর তখনো পুরোটা কাটেনি। এরমধ্যেই লোকটা তাকে নিয়ে গেলো গোরস্থানের অপর পাশের রাস্তায়। এই পাশে স্ট্রিটল্যাম্প গুলো অনেক বেশি উজ্জ্বল, রাস্তা গুলো সদ্য পানিতে ধোঁয়া কাঁচের মতো ঝকমকে। মৃদু সঙ্গীতের সুর কোথাও থেকে ভেসে আসছে। সুমনকে এক ধাক্কায় উঁচু একটা দালানের সিঁড়িতে বসিয়ে, যেদিক থেকে এসেছিলো সেদিকেই হাওয়া হয়ে গেলো সেই উন্মাদ। মধ্যযুগীয় লাল ইটের দালানটার সিঁড়িতে, চাঁদের আলো শরীরে মেখে আরো কিছুক্ষণ ঘোরের মধ্যে থাকলো সুমন। পুরোটা শরীর ব্যাথায় জ্বলছে, দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও নেই।
রোজারিও গির্জাটা অষ্টাদশ শতাব্দীর। পুরাতন পর্তুগীজ ঢঙ্গের স্থাপত্যশৈলী। ধর্মযাজক আলবার্ট কস্তা খুব শান্ত পায়ে আনমনে অনেক কিছু ভাবতে ভাবতে নামছিলেন সিড়ি দিয়ে। ওই মুহূর্তে তার নামার ভঙ্গী স্লো মোশনে চালানো ভিডিওর মতো লাগছিলো, মাঝে মাঝে সিড়ির ধাপে থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন। অনেক কিছুই ভাবছিলেন তিনি। এই এলাকায় তার বসবাস বছর পনেরো। সাদা কালো মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করা আর চোখে খুব মোটা কালো ফ্রেমের চশমা, চেহারা দেখেই মনে হয় গভীর কোন বিষয়ের চিন্তায় চব্বিশঘণ্টা আচ্ছন্ন। তিনি কিছুটা বিরক্ত। প্রথমত বিশপের সাথে গির্জার সংস্কার নিয়ে টানাপোড়েন চলছে কয়েকদিন, তারউপর তাড়াহুড়ো করে এতো রাতে একটা বিয়ের শপথ পড়াতে হলো। আধুনিক কালের এক নব্য ধনী যুবক ও তার বাগদত্তা হঠাত এতো রাতে ঘুম জাগিয়ে তুলে এনেছে তাকে। ধর্মযাজকদের সহনশীল হতে হয়, তিনিও অত্যন্ত শান্ত থাকেন। কিন্তু তাই বলে এতো রাতে এতো হইচই করতে হবে! উপাসনার আসনগুলোতে খাবার ছড়িয়ে ফেলেছে বর-কনের হইচই করা বন্ধুবান্ধব। এখানে খাবার প্যাকেট বয়ে আনার মানে কি বুঝতে পারছিলেননা তিনি! এখনো দুই তিনটা অক্ষত প্যাকেট পড়ে আছে। প্রভুর ঘর এরকম ময়লা হয়ে থাকবে কতোক্ষণ! ভাবতে ভাবতেই মাথা ধরে যাচ্ছে। আজ আর ঘুম হবেনা, সূর্য্য ওঠার আগেই সাফ করতে হবে সব। সব সদাপ্রভুর ইচ্ছা, ভেবে নিজেকে আবার শান্ত করলেন তিনি। ক্ষমা করতে হবে সবকিছুকে, ক্ষমাই শান্তি। তিনি মনে মনে ক্ষমা করে দিলেন! আকাশের চাঁদ ও হালকা বাতাস তার কাছে স্বর্গীয় মনে হতে লাগলো! সিঁড়ির শেষ মাথায় এসে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনে সম্বিৎ ফিরলো। কোন টিকটিকি কি দেয়ালে দৌড়ে নেমে গেলো! শব্দটা টানা আসছে, সাপখোপ নয়তো! সতর্ক হয়ে আশেপাশে নজর ফেরাতেই চোখে পড়লো সিঁড়ির শেষ ধাপে কুকড়ে বসে থাকা সুমনকে! সে কাঁদছে। এখানে গির্জার সামনের বাতি খুব উজ্জ্বল আলো দেয়। সেই আলোয় ছেলেটার দিকে এগিয়ে এলেন কালো আলখাল্লায় মোড়া ধর্মযাজক। ‘কি হয়েছে তোমার বাবু, কাঁদছ কেন? ভরাট গলার মানুষটির দিকে তাকিয়ে সুমন শুধু একটা কথাই আওড়াতে পারলো-‘এট্টু খামু, ক্ষিধা লাগছে!’
একদল মানুষ খাবারের প্যাকেট নিয়ে তার হিসাব ও রাখেনা, যত্রতত্র ছড়ায়, আর কিছু মানুষ না খেয়ে কাঁদতে থাকে! হায়, সদাপ্রভু, দুনিয়ায় এই বৈষম্য শেষ হবে কবে! ‘বাছা উঠে এসো আমার সাথে, এসো খাবে’ বলে ডাক দিলেন সুমনকে। কিছু ডাক অগ্রাহ্য করা মুশকিল, ক্ষুধার্তের কাছে অন্ন দেয়ার ডাক ঠিক এরকমই। যাজকের পিছন পিছন হাঁটতে থাকে সুমন। এরকম দালান সে আগে দেখে নি। উপরের খিলান দেয়া ছাদটা এতো উঁচুতে যে তাকাতে কষ্ট হয়। পাথরের পিলারগুলো গাম্ভীর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটা অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য জেঁকে বসে আছে করিডোরে। যাজক তাকে ডেকে নিয়ে বসালো একটা বড় দরোজার সামনে ছোট্ট টুলে। তাড়াতাড়ি ভিতর থেকে দুটো বড় খাবারের প্যাকেট এনে দিলো তার হাতে। ‘একটা খাও আর আরেকটা নিয়ে যাও’। না খেতে বললেও সুমন সম্ভবত খেয়ে ফেলতো। গোগ্রাসে খাওয়া শুরু করলো সে। তন্দুর রুটি, চিকেন, ভাত কোনটা কোনটার সাথে খেতে হয় সেটা সে জানতোনা। সে শুধু জানতো খেতে হয়, যা কিছু খাওয়া যায় সব! দশ মিনিটের আগেই প্যাকেট ফাঁকা করে, কৃতজ্ঞ চোখে তাকালো। তার খাওয়া নিবিষ্ট ভাবে দেখছিলো যাজক ভদ্রলোক। আরেকটা প্যাকেটও শেষ করতে পারতো সুমন। যাজক হেসে বললো, ওইটা পড়ে খেয়ো, একবারে এতো ভারী খাবার পেটে সহ্য হবেনা। লোকটা ভালো আছে, ভাবে সুমন, বুদ্ধিটা খারাপ দিচ্ছেনা। প্রথমবারের মতো দরোজা দিয়ে ভিতরে উঁকি দিল।
একজন মানুষ ঝুলে আছেন দুইটা আড়াআড়ি ভাবে জোড়া লাগানো কাঠের থামের উপর। চোখ থেকে অশ্রু নেমে আসছে, মাথাটা একপাশে কাঁত করা, বুক চিরে রক্ত পড়েছে। লোকটার চোখে এতো দুঃখ! শহরের রাস্তায় বহু মানুষকে মরতে দেখেছে সুমন। কিন্তু এখানে একটা চাপা খারাপ লাগা ভেসে বেড়াচ্ছে! এরকম ভাবে কষ্ট দেয়া, তার কাছে পুরোই নতুন! আর একটা ছবি ডান দিকের পুরো দেয়ালটা জুড়ে। রাফায়েলের আঁকানো ট্রান্সফিগারেশনের বিশাল প্রিন্ট, একটা মানুষ সব কিছু ছেড়ে উড়ে যাচ্ছে! কোথায় যাচ্ছে আর কেনই বা যাচ্ছে! অসংখ্য মানুষ তাকে ঘিরে কিসব আলোচনা করছে। ‘এরা কারা! উনি কে?’ যাজকের দিকে তাকিয়ে বলেই ফেললো সুমন। এরকম প্রশ্ন আসলে কথার ঝরণা থামাতে পারেনা যাজক! সে বলে চললো-‘উনার নাম জিসাস ক্রাইস্ট! আমাদের কষ্ট আর পাপের বোঝা কমানোর জন্য নিজে জীবন দিয়ে দিয়েছিলেন! উনি জিসাস অফ নাজারেথ………।’ এতোটুকু বলে নিজেকে সামলালো যাজক। ছেলেটা কোন ধর্মের, কোন গোত্রের কিছুই তো জানা নেই। এমন কিছু বলা যাবেনা, বড় ঝামেলা হতে পারে। তখন খাওয়ানোর উদ্দেশ্যও অন্যভাবে ব্যখ্যা করা হবে! নিজের আবেগকে সংযত করলেন দ্রুত। ‘বাবু এবার তবে যাওয়া যাক চলো’ বলে ধীরে ধীরে বের হয়ে আসলেন রাস্তায়। সুমনের মাথায় বিদায়ী ভঙ্গিতে হাত বুলিয়ে নিজের গন্তব্যের দিকে রওনা দিলো ধর্মযাজক।
(৪)
সুমনের পেটটা এখন ভরা ভরা লাগছে। পাগলটাকে খোঁজা দরকার মনে হলো তার। আবার আগের রাস্তায় সিমেটেরির বুক চিরে হাঁটা দিল। এখন আর আগের মতো ভয় লাগছেনা। মেজাজটাও খুব ফুরফুরে লাগছে। কবরের উপরের ক্রস চিহ্নগুলোকে এখন সে মেলাতে পারছে। খাবারের চাহিদা পুরণ হলে মাথা কাজ করে সম্ভবত বেশি। ক্রুশের মানুষটাকে তার খুব অনুকরণ করতে মন চাচ্ছে। সুমন রাস্তায় বেড়ে উঠা ছেলে, কি করা উচিত আর উচিত নয়, তা সে শিখেনি কারো কাছে। তার খুব ওই ক্রুশবিদ্ধ মানুষটার মতো দাঁড়াতে ইচ্ছা করে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেটা তার কাছে মজার খেলায় পরিণত হলো। দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে, এক পা আরেক পায়ের গোড়ালির উপর রেখে, শুধু এক পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে করতে একসময় শিখেও গেলো! পুরোটা রাস্তা সে কিছুদূর হেঁটে যাচ্ছিল আবার কিছুক্ষণ একপায়ে হাত ছড়িয়ে দাঁড়াচ্ছিল।
যতক্ষণে রাস্তার অন্য মাথায় পৌছালো, ততক্ষণে পাগলটা তার চিরাচরিত ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। সুমনের মনে হলো খাবারটা তাকে দিয়ে দেয়া উচিত! সব মানুষের মনের মাঝেই উদারতা থাকে, কখন কোন পরিস্থিতিতে তা সামনে আসবে বলা কঠিন। সুমন আস্তে করে খাবারের প্যাকেটটা তার মাথার কাছে রেখে দিলো। এই বয়সে অভ্যাস তৈরি হয় তাড়াতাড়ি। প্যাকেটটা রেখে, সেখানেই আবার ক্রুশবিদ্ধ মানুষটার মতো দাঁড়াতে চেষ্টা করলো। কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো তার ঠিক নেই। এরমধ্যেই একটা পাখি অকারণে মলত্যাগ করল উন্মাদ মানুষটির ঠিক চোখের উপর, দুম করে জেগে উঠলো সে! চোখ মুছে সামনে তাকাতেই চোখে পড়লো, একটা কালো মতোন ছায়া হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার একটা মাত্র পা! গোল চাঁদটা তার মাথার পিছনে আগুনের মতো জ্বলছে! উন্মাদ লোকটি কি বুঝলো কে জানে, ভয়ে গোঁ গোঁ শব্দ করতে করতে দৌড় দিল আরেকদিকের রাস্তায়। হতভম্ব হয়ে পড়লো সুমন।
এভাবে দাঁড়ালে কি ভয় তৈরি হয়! তাহলে কি সবাই ভয় পাবে, কেঁপে উঠবে। প্রতিশোধের একটা আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠলো তার মনে। সারা শরীরের ব্যথা গুলো তখনো কষ্ট দিচ্ছিলো। রাত যতো গভীর হয় মন ততো বদলায়। সুমনের মনে খানিকটা আদিম হিংস্রতা আসে। সিমেটেরির দেয়ালের একপাশে একটা রেলিঙ্গের রড ভেঙ্গে ঝুলে ছিলো! একটান দিয়ে সেটাকে খুলে ফেললো সে, মাথাটা চোখা চাকুর মতো! কাজে দিবে ভাবে সুমন। ময়লা বস্তাটাকে নিজের শরীরের সাথে পেচিয়ে নিল। সামান্য দূরে রাস্তার পাশে একটা গর্তের মতো জায়গায় পানি জমে ছিলো। দিনের বেলায় মাঝে মাঝেই পথচারী পিছলে পড়ে সেখানে। সুমন পানির গভীরে হাত ঢুকিয়ে কাঁদা তুলে আনলো দুই হাত ভরে। ইচ্ছেমতো মুখটাতে মাখল, চুলের মধ্যে মাখল! তারপর ঠায় বসে থাকলো আরো কিছুক্ষণ, যতক্ষণ না কাদা কিছুটা শুকায়। তারপর রওনা হলো হোসনীবাগের দিকে।
(৫)
হোসনীবাগে ঢোকার গেটের মুখের দুইজন গার্ডের মেজাজ সেদিন খুব চরে ছিলো। টোকাই ছেলেটা ফাঁক দিয়ে কিভাবে ঢুকল, তারা এখনো বুঝতে পারছেনা। চিৎকার চেঁচামেচিতে অনেক মানুষের ঘুম ভেঙ্গে গিয়েছিলো! কাল ঠিক মিটিং বসবে বাড়ির মালিকদের; চাকুরি টিকে থাকলে হয়। অন্যদিকে ছোকরাটাকে মার দেয়াও সম্ভবত বেশি হয়ে গিয়েছে, মরে না যায়! পেটের ভাত যোগাতে রাস্তা পাহারার কাজ করতে হয়! গরীব মানুষ তারা, ফাঁসালে তো তাদেরই ফাঁসানো হবে। পাজেরো হাঁকিয়ে, শহর কাঁপানো বড় সাহেবদের তো কিছুই হবেনা। ‘দেখে আসবে নাকি সিমেটেরির মোড়! ছেলেটা বেঁচে আছে না মরে গিয়েছে?’ বলে একজন গার্ড। অনিচ্ছা সত্ত্বেও অন্যজন আগায় রাস্তার দিকে। ওই দিকটাতে ল্যাম্পপোস্টের আলো বেশি নেই। সাবধান হয়ে টর্চের আলো জ্বালিয়ে নিল সে। রাস্তার বাঁক ঘুরতেই, হঠাত লক্ষ্য করলো, কিছু একটা নড়ছে। কুকুর পিছু নিয়েছে নাকি কোন, ভেবে টর্চের আলো ফেলল হাতের ডানে। আঁতকে উঠলো গার্ডটা! তার থেকে কয়েক হাত দূরে অদ্ভুত একটা কিছু দাঁড়িয়ে, উচ্চতা বেশি নয়, মাথা চোখ মুখ বোঝা যাচ্ছেনা, কাদায় ঢাকা, সমস্ত শরীর কালো কিছু একটায় মোড়ানো! দুই হাত দুই দিকে ছড়িয়ে এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে! প্রচণ্ড ভয়ে হাতের টর্চ লাইট পড়ে গেলো, কয়েকটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করে উঠলো দূরে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সম্বিৎ পেয়ে জোরে চিৎকার করে একবার তার সহকর্মীকে ডাকতে চেয়েছিলো। কিন্তু তার আগেই জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়লো মাটিতে! সুমনের তেমন কিছুই করতে হলোনা। একবার সে ভেবেছিল মাথাটা রড দিয়ে দুই ফাঁক করে দিবে কিনা। কিন্তু করলোনা, তার ক্ষমা করে দিতে ইচ্ছা হলো! চুপ করে বিড়ালের মতো নিঃস্তব্ধ পদক্ষেপে চলে গেলো ডানদিকের রাস্তায়। এই দিক দিয়ে শহরের কেন্দ্র শহীদবাগ। রাতে খেলাটা ওইখানে খেললে খুব মজা হবে!
(৬)
ঘড়ির কাঁটায় রাত দুইটা তখন। দিনের আলোয় যে মোড়ে ভিড়ের ধাক্কায় হাঁটা যায়না, রাতের আলোয় সেই জায়গা কি অদ্ভুত সুনসান হয়ে থাকে। আশেপাশে কাওকে দেখা যাচ্ছিলনা। শুধু কয়েকটা কুকুর লাল নিয়নের আলোর নীচে অযথাই একে অপরের সাথে কামড়াকামড়ি করছিলো। ওইতো লেজকাটা দুষ্ট কুকুরটাকে দেখা যাচ্ছে। তবে ওর প্রতি রাগটা আর নেই সুমনের, ক্ষমা করে দিল কুকুরটাকে। আকাশ আবার কিছুটা মেঘলা হয়ে আসলো। মানুষের মনের মতন আকাশেরও রূপ বদলায়। চাঁদটা এই ঢাকা পড়ছে, এই বের হচ্ছে। এই মোড়েই দূর পাল্লার বাস থামে। অনেক রাতে দুই একজন যাত্রী ত্রস্ত চিত্তে হেঁটে যায় বাসার দিকে। সেরকমই একটা বাস এসে থামলো মাত্র। খেলাটা এখন আবার খেলার শখ জাগলো সুমনের। লোকটা হাঁটার ধরন ধারন দেখে মনে হচ্ছিলো রেল কলোনির দিকে যাবে। দোকানগুলোর পিছনের গলি দিয়ে এক দৌড়ে কলোনি রোডের মোটামুটি অন্ধকার জায়গায় দাঁড়ালো সুমন; এখানে ভাঙ্গা ট্রাকের আড়ালে অনেকখানি অন্ধকার। সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়লো। মুখের কাদা শুকিয়ে চরচর করছিলো। এবারের পর আর খেলবোনা ভাবলো ছোট্ট ছেলেটা। লোকটা এগিয়ে আসছে নিস্পৃহ ভাবে। মোটাসোটা চেহারায় ভয় নেই তেমন, হাতে সিগারেট আয়েশ করে ফুঁকছিল। অন্ধকার জায়গাটায় এসে চোখ রগড়ে তাকালো সে দুই হাত ছড়িয়ে এক পায়ে দাঁড়ানো ছেলেটার দিকে। কেউ মেরে ঝুলিয়ে রাখলো নাকি! লোকটা ভয় পেয়েছিলো এটা নিশ্চিত, কিন্তু কিছু মানুষ ভয় পেলেও দমেনা। সে সম্ভবত ওই দলের মানুষ। চারিদিকে তাকিয়ে চট করে হাতে রাখা মিনি টর্চটা জ্বালিয়ে মুখের উপর ফেললো। আলোর ঝলকানিতে পিটপিট করে নড়তে লাগল সুমনের দুই চোখের পাতা। ‘বাঁদরামি করা জন্মের মতো ভুলাই দিব, শালা ছোটলোক!’ বলে তেড়ে আসল সে। সুমন ছোট্ট হাতে ছুরি চালানোর মতো ভাঙ্গা লোহার শলাটা সামনের দিকে চালাতেই, আত্মরক্ষার তাগিদে সরে গেলো আগন্তুক। তারপর পড়িমরি করে দৌড় লাগালো কলোনির দিকে। খিলখিল করে হেসে উঠলো সুমন। সেই হাসির শব্দ অপার্থিব শোনালো রাতের স্তব্ধতার মাঝে। দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হলো কিছুক্ষণ।
সুমন ভেবেছিলো আর খেলাটা খেলবেনা, ওই দিনের মতো শেষ। কিন্তু পায়ের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিলো আবার। তাহলে এবারের টাই শেষবার, নিজেকে নিজেই বলল সে! আবার দুইহাত মেলে দাঁড়িয়ে পড়লো একই জায়গায়। বাম পাটা ভাজ করে ডান পায়ের গোড়ালির উপর দিয়ে রাখল। চাঁদ এখন ঠিক তার মাথার উপর, অনেক গুলো তারাও দেখা যাচ্ছে। পুলিশের হাবিলদার রইসুদ্দীন আর ইন্সপেক্টর জামিল বের হয়েছিলেন টহল দিতে। শহরের রাতগুলো খুব আজব হয়। কতো আজব চিড়িয়ার যে দেখা মেলে; তাদের অনেকেই আবার অত্যন্ত বিপদজনক! রাইফেলের ট্রিগারে আঙ্গুল শক্ত করে রেখে ভাবছিল হাবিলদার রইসুদ্দীন! তার চাকুরি শেষের দিকে, বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি। আজকাল বয়সের কারণে তার হাত প্রচন্ড রকম কাঁপাকাঁপি করে। চাকুরি টিকিয়ে রাখার ভয়ে কাওকে জানাননি। আর পুলিশের খুব বেশি গুলি চালাতেও হয়না। কলোনি রোডের অন্ধকার জায়গায় এসে হঠাত থমকে দাঁড়ালো ইন্সপেক্টর জামিল। ‘কে রে ওটা, সামনে আয়’ বলে চেঁচিয়ে উঠতেই সব গোলমাল পেকে গেলো রইসুদ্দীনের। ট্রিগারে রাখা হাতটা অযথাই কাঁপতে শুরু করলো। আর দুইটি বুলেট ফসকে বের হয়ে এলো রাইফেলের নল থেকে দুম দুম শব্দ করে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা হাত ছড়ানো ছেলেটার মুখ অন্ধকারে বোঝা যাচ্ছিলোনা। সেখানে থেকে ‘আও আও’ করে খুব জোরে চাপা শব্দ এলো কয়েকটা আর ছেলেটা ছিটকে পড়লো পাশের ড্রেনের উপর। শুধু কয়েকবার মোচড় দিল শরীরটা মাগুর মাছের মতো, তারপর চিরকালের মতো স্তব্ধ হয়ে গেলো!
রইসুদ্দীনের হাত পা কাঁপুনি আর বন্ধই হচ্ছিলোনা। রাইফেলটা তার কাছে থেকে কেড়ে নিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো জামিল-‘এখন কাঁপাকাঁপি করে কি লাভ! যা করার তাতো করেই ফেলছেন!’ পুলিশ জানতো লাশটা ওখানে ফেলে রাখা চলবেনা। সামনেই ভার্সিটি এলাকা, ছাত্ররা এখানে লাশ পেলে কি অবস্থা হবে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। লাশটা তারা ফেলে দিয়ে এসেছিল শহরের শেষ সীমায় নদীর ভিতর। সুমনের লাশটা ভাসছিলো কালো পানিতে, হাত দুটো অদ্ভুতভাবে ছড়ানো, কিন্তু পা দুটো চেপে রাখা একটার সাথে আরেকটা। মাথার উপরে শেষ রাতের চাঁদের প্রতিবিম্ব ঘিরেছিল। আর তীরে কয়েকটা শেয়াল অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়েছিল কখন লাশটা তীরে ঠেকবে সেই আশায়।
সমাপ্ত








সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ৮:১৮
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

×