somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কল্পিত গল্পঃ করোনা কালে প্রকাশনা রঙ্গ

২৮ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


হঠাৎ মাস খানেক আগে এক বাল্যবন্ধু, যে কিনা এই কালের ফেসবুকময় দুনিয়ার উঠতি সেলেব্রেটি কবি, তার একটা স্ট্যাটাস চোখে পড়ল। ভাঙা ভাঙা সাধু চলিত শব্দ মিশিয়ে সে লিখেছে- “অদ্য হইতে গদ্য লিখিব; কবিতা তোমায় দিলাম ছুটি!” নীচে কমেন্টবক্সে যথারীতি ঝড়, কারো হা-হুতাশ! কারো সান্তনা, কারো ভুলভাল বাংলিশে বিঘত সাইজের উপদেশনামা। কৌতুহল খুবই বেহায়া অনুভূতি, এসে গেলে আর থামেনা। তো কৌতূহলে পড়ে বহুকাল পরে ইনবক্সে দিয়েই দিলাম গুঁতো- বন্ধু কি খবর বল? কাব্যলক্ষীর সাথে ছাড়াছাড়ি করার ইচ্ছা জাগলো কেন এতোকাল পর? বন্ধু কিছুক্ষণ উত্তর দেয়না, তারপর কিছুক্ষণ কয়েক সার স্যাড ইমোশন দিয়ে বলল- “প্রকাশনীর রঙ্গলীলায় বন্ধু কাব্যলক্ষীর প্রাণ যায়!” বুঝলাম তার পান্ডুলিপি নিশ্চয়ই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। তা হতেই পারে! আজকাল বাংলা ভাষাভাষী কবিরা ফেসবুকেই তাদের কথামালা বিসর্জন দেন আর তাদের অনুসারীরা সেখানেই আগডুম বাগডুম করেন। এই জামানায় গল্প উপন্যাস এর জনপ্রিয় বইগুলোই বিকোতে চায়না বাজারে, সেখানে কবিতার ভাত পেতে সমস্যা হবেই, সেটা কেনা জানে! তাকে সে কথা বলতেই, বেচারা আবার আধাঘন্টা স্তব্ধ হয়ে মৌনব্রতে গেলো। তারপর বলল- “পান্ডুলিপি প্রত্যাখ্যান হতেই পারে, তবে আজকাল অনেক প্রকাশনা সংস্থা কবি লেখকদের নিয়ে পাশা খেলায় বসে। এখন শকুনি মামার ইঁদুর বারবার গুটি চুরি করবে আর দূর্যোধন জিতবে এটা জেনেও পান্ডবরা খেলতে যায়, যথারীতি ফলাফল কৌরবদের ঘরে! মানে রাজ্য দখলে আছে যার, জয়ীর মঞ্চে নাম যাবে তার! পান্ডব কবি-লেখকদের ঝুলিতে জমা খুদ মেশানো অভিমান। তারপর পুনরায় আবার কোন একটা প্রকাশনীর রমরমা পান্ডুলিপি প্রতিযোগিতার আয়োজন, তারপর আবার একই ফলাফল, দিনান্তে আবেগী ফেসবুক স্ট্যাটাস। নবীনেরা ঘুরতেই থাকে এভাবে।"

কবিবরের কথা শুনে একটু হলেও হতাশ হলাম, তবে কৌতূহলটা বেড়ে গেলো। প্রকাশনী সংস্থা ( সবাই নয় কেউ কেউ) চাইলেই স্বনামধন্য লেখকদের লেখা প্রকাশ করতে পারে, অযথা কেন নতুনদের ইমোশন নিয়ে টানাটানি আর কেনই বা প্রতিযোগিতার আয়োজন করে তাহলে! ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে এ জামানার কবি সাহিত্যিকের অভাব নেই, তাদের দেখাদেখি প্রতিযোগিতা চলছে এমন কিছু পেজে যোগ দিয়ে দিলাম! বেশ একটা উৎসব উৎসব ভাব। একখানে দেখলাম তারা পাচটি সেরা বই আর পঞ্চাশটি নির্বাচিত বই বের করবে, আরেকখানে দেখলাম তারা মোটে পাঁচটা পান্ডুলিপি নির্বাচন করবে, আরেকটা প্রকাশনী বলছে তারা সেরা দশটা বই নির্বাচন করে বের করবে। বেশ একটা এলাহী কারবার! পাঁচ মিনিট পর পর ফেসবুকে নোটিফিকেশন। বন্ধুকে বুদ্ধি দিলাম, বহুবার তো নিজ নামে দিলে এবার ছদ্মনামে দাও, আর যারা বেশি পান্ডুলিপি নির্বাচন করবে ওইখানে দাও, পাইলেও পাইতে পারো কাঙ্ক্ষিত ফল। যেই কথা সেই কাজ! তো দেখতে দেখতে শেষ দিন চলে এলো, তারপর এক মাসের অপেক্ষা। মধ্যবর্তী মাসজুড়ে প্রকাশনীর পেজ ভরিয়ে রাখলো উচ্ছ্বল অংশগ্রহণকারীরা। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, বিজ্ঞাপনে দেয়াছিল নবীন লেখকের বই বের হবে! আর প্রকাশনীর ফেসবুক পেজও ভরে ছিল নবীনদের কলতানে! কিশোর-তরূন-যুবাদের উল্লাসে আর স্বরচিত গান কবিতায় ভরপুর প্রকাশনীর ফেসবুক পেজের অন্তঃপুর! এভাবেই একমাস গেলো, নির্ধারিত দিনে নাম ঘোষণা আর আসেনা। জনতা অধৈর্য! কোলাহল অবশ্যম্ভাবী! প্রকাশনীর ফেসবুক মুখপাত্রগণ উত্তর দেননা বেশি একটা। সব প্রশ্নেই একই উত্তর কপিপেস্ট- “ফলাফল আসবে শীঘ্রই!” শুভস্য শীঘ্রম! কিন্তু শুভ কাজ আর হয়না, বর কনে নাই, শুধু বরযাত্রীর হট্টগোল! হাল ছাড়লামনা, নজর রাখতে লাগলাম নিয়মিত। নির্ধারিত দিনের প্রায় একমাস পর তারা দুইশত জনের একটা লিস্ট বের করে জানালো তাদের নাকি কয়েক হাজার পান্ডুলিপি এসেছে তাই একেবারে পুরো বাছাই এখনো হয়নি! ছদ্মনামে আমার বন্ধুর নাম দেখলাম কবিতায় বেশ উপরের দিকে। যাক তাহলে মোটামুটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হচ্ছে। ওদিকে আমার বন্ধুতো ফেসবুকে সব ভুলে মাতোয়ারা। নাম গোপনের মিশন ভুলে দিনে দশ পনেরোবার সেই প্রকাশনীর লোগো সংবলিত স্ট্যাটাস শেয়ার দিয়ে যাচ্ছে আর লিখছে- “আলহামদুলিল্লাহ্‌! আমার নাম দশ নম্বরে এসেছে।" দিন দুয়েক পড়ে আবার প্রকাশনীর সতর্কীকরণ স্ট্যাটাস- “যে লিস্ট দেয়া হয়েছে সেটা প্রাথমিক বাছাইকরণ! এখানে কোন সিরিয়াল নেই। “চিন্তার বিষয়! সেটা তারা আগে বললেই পারতো। হয়তো ব্যস্ততায় ভুলে গিয়েছে! তা ভুলতেই পারে, অস্বাভাবিক নয়! তারপর আবার চূড়ান্ত ফলের অপেক্ষা। আবার এক মাস পার হলো, কোন খোঁজ নাই! আমরা তো আশা ছেড়েই দিলাম, এ যাত্রায় আর ফল আসবেনা। কিন্তু ফল এলো! একদিন সকালে আধো ঘুমে ফেসবুক স্ক্রল করতে গিয়ে দেখলাম, গহীন রাতে ফলাফল ঘোষিত হয়েছে- তবে শুধু পাঁচজন! নির্বাচিত পঞ্চাশ তারা রাখতে পারে নাই, কারণ মানসম্মত পান্ডুলিপি পায়নি। যদিও মাসখানেক আগেই তারা বলেছিলো, এতো বেশি ভালো ভালো পান্ডুলিপি, কোনটা ছাড়ি, কোনটা রাখি! আর যে পাঁচজন নির্বাচিত হয়েছে তারা মোটামুটি স্বনামধন্য লেখক। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তাদের বিশ ত্রিশটার উপর প্রকাশিত বই! উনারা বিখ্যাত তবে নবীন নন! এরপর আরকি, বন্ধু আবার স্ট্যাটাস লিখলো- “ধুর শালা, এদেশে বুড়োরাই কবি হোক!”

আমি ভাবতে বসলাম! এতো নাটকীয়তার মানে কি! স্বনামধন্য লেখকের লেখা প্রকাশনী ছাপাবে সেটাই স্বাভাবিক! কিন্তু নবীন-নবীন খেলা কেন? খোলা চোখে বেশ কিছু অসঙ্গতি চোখে পড়লো। প্রথমত- এই এলাহী নির্বাচনের মধ্যবর্তী দুই মাসে প্রকাশনীটি থেকে প্রায় সাতটির মতো নতুন বই বের হয়েছে! আর পান্ডুলিপি পুরস্কার প্রত্যাশী নবীনরা ব্যাপকভাবে তার পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছে ফেসবুকে! আমার কবিবর বন্ধু সেইসব বইয়ের পক্ষে ফেসবুক প্রচারণা থেকে শুরু করে নিজেও কিনেছে প্রত্যেকটা বই! আর যারা অল্প বয়সী কিশোর তাদের তো কথাই নেই। ঐ বয়সে আবেগই সব। বিশেষ করে দুহাজার থেকে দুইশ নির্বাচিত হওয়ার পরবর্তী দিনগুলোতে অনেক নির্বাচিত কিশোর যেচে এসে বই বিক্রি করে দেয়ার দায়িত্ব ও নিয়েছে স্বেচ্ছায়, বাকীরা ফেসবুকে নজিরবিহীন পোস্ট দিয়ে প্রকাশনাকে পরিচিত করেছে তাদের নিজস্ব বৃত্তে! ব্যবসায়িক দিক দিয়ে ভাবতে গেলে খুবই সফল কৌশল! আর এজন্য সময়ক্ষেপণ ছিল অত্যন্ত জরুরী একটা কৌশলগত অংশ। দ্বিতীয়ত- প্রতিযোগিতা না হলেও বড় লেখকদের লেখাই তারা বইমেলায় ছাপতো। কিন্তু একটা প্রতিযোগিতার লেভেল এঁটে দেয়ায় প্রকাশ পূর্ববর্তী যে প্রচারণাটা হয়ে গেলো, তার যে বাণিজ্যিক মূল্য আছে সেটা বুঝতে অর্থনীতিবিদ হতে হয়না। তবে এভাবে হয়তো একটা বছর, বা একটা বইমেলায় প্রভূত লাভ করা যায়, তবে সরল অনুভূতিতে প্রতিযোগিতার আসা নবীন বিশেষত কিশোর লেখকদের একটা বড় অংশের বিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। তাদের লেখার হয়তো গুণগত উৎকর্ষতা এখনো আসেনি কিন্তু বুক ভরা স্বপ্ন আছে। স্বপ্নের সাথে ছলনা হলে নবীনের আত্মা-মন কষ্ট পায়। তাই তাদের অন্তত এই খেলাটার বাইরে রাখা উচিত!
এটা একটা মনস্তাত্ত্বিক খেলা। যেখানে একটা আশা দিয়ে একটা টার্গেট জনগোষ্ঠীর কাছে থেকে অপ্রত্যক্ষভাবে নিজের উদ্দেশ্য পূরণ করে নেয়া যায়। এটা দোষ বা গুণের বিষয় নয়, বরং বাণিজ্যিকীকরণের একটা অভিনভ পন্থা হয়তো। আর একটা সুন্দর বিষয় চোখে পড়লো, যাদের নাম মুল নির্বাচনে নির্বাচিত হলো, তাদের নাম প্রাথমিক নির্বাচনে শেষের দিকে রাখা ছিলো, যাতে করে নবীনেরা আশা না হারায়! অথবা অযথা তাদের নাম নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিও না করে! কি নিঃখুত কেমোফ্ল্যাজ! তবে আমি মনে মনে একটা বিষয়ে আশান্বিত হলাম- এদেশের মানুষ এখন গোঁয়ার ঝগড়াঝাঁটির বদলে মাথা খাটিয়ে কাজ করছে, মনোস্তাত্বিক কৌশল ব্যবহার করছে! এটা কিন্তু অবশ্যই একটা বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতিরই লক্ষণ।
(পুরো বিষয়টি একটি কল্পিত কাহিনী। পাঠকেরা এটাকে গল্প হিসেবেই পড়বেন এই অনুরোধ রাখছি।)

ছবিঃ ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০২০ বিকাল ৩:০৮
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=বেনারসী রঙে সাজিয়ে দিলাম চায়ের আসর=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫২



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনে কি পড়ে সেই স্মৃতিময় সময়, সেই লাজুক লাজুক দিন,
যেদিন তুমি আমি ভেবেছিলাম এ আমাদের সুদিন,
আহা খয়েরী চা রঙা টিপ কপালে, বউ সাজানো ক্ষণ,
এমন রঙবাহারী আসর,সাজিয়েছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিজ্ঞানময় গ্রন্থ!

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪২

একটু আগে জনৈক ব্লগারের একটি পোস্টে কমেন্ট করেছিলাম, কমেন্ট করার পর দেখি বেশ বড় একটি কমেন্ট হয়ে গেছে, তাই ভাবলাম জনস্বার্থে কমেন্ট'টি পোস্ট আকারে শেয়ার করি :-P । তাছাড়া বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

অস্ট্রেলিয়ার গল্প ২০২৪-৪

লিখেছেন শায়মা, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:৪৫


চলে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছিলো। ফুরিয়ে আসছিলো ছুটি। ছোট থেকেই দুদিনের জন্য কোথাও গেলেও ফিরে আসার সময় মানে বিদায় বেলা আমার কাছে বড়ই বেদনাদায়ক। সেদিন চ্যাটসউডের স্ট্রিট ফুড... ...বাকিটুকু পড়ুন

আপনি কি বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, ঋগ্বেদ এর তত্ত্ব বিশ্বাস করেন?

লিখেছেন শেরজা তপন, ২২ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫২


ব্লগে কেন বারবার কোরআন ও ইসলামকে টেনে আনা হয়? আর এই ধর্ম বিশ্বাসকে নিয়েই তর্ক বিতর্কে জড়িয়ে পড়ে সবাই? অন্য ধর্ম কেন ব্লগে তেমন আলোচনা হয় না? আমাদের ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসের নায়িকাকে একদিন দেখতে গেলাম

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:২৫

যে মেয়েকে নিয়ে ‘অন্তরবাসিনী’ উপন্যাসটি লিখেছিলাম, তার নাম ভুলে গেছি। এ গল্প শেষ করার আগে তার নাম মনে পড়বে কিনা জানি না। গল্পের খাতিরে ওর নাম ‘অ’ ধরে নিচ্ছি।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

×