'__এক কাজ করো , তুমি লেখালিখি শুরু করে দাও । মুখ তো ভালই চলে । লেখাটাও খারাপ চলবেনা । মুখের কাজ হাতে কলমে করবে । মন্দ কী?'
'মুখের সব কাজ কি হাত দিয়ে করা যায়?'
‘সব সময় সব কথা ওদিকে টেনে নিয়ে যাও কেন বশির ?’
মালার মুখে এ নামে সম্বোধন আমার জন্য চপেটাঘাতস্বরূপ । বশির ছাড়া আরও একটি শব্দ আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেটে আমার নামের ঘরে । তামাম দুনিয়া আমায় সে নামে চিনলেও এক মালা-ই আমায় ডাকে বশির । তবে সবসময় না । যখন খুব অভিমানে ভেসে বেড়ায় । তবুও এক গাল হেসে প্রমাণ করি – আরে মজাইতো করছি । বাস্তবেতো যাইনি । অবশ্য গেলেও বা কী এমন মহা ভারত অশুদ্ধ হবে ? মেয়েরা পুরোপুরি বিশ্বাস স্থাপন না করে কোনো হাতে হাত রাখেনা ।
মালা চুপচাপ বসে আছে । দৃষ্টি সামনের সরু রাস্তায় ভেসে বেড়াচ্ছে । মনযোগ সহকারে দেখছে আমাদের বহনকারী রিকশার পাশ দিয়ে কিভাবে একটি মটর বাইক সাঁই করে চলে গেল । যার পেছনে এক নারী এক হাতে বাচ্চাকে, আরেক হাতে তার স্বামীকে আঁকড়ে ধরে আছে । স্বামীর মাথায় হেলমেট নেই । তার হেলমেট পেছনে বসা বাচ্চার মায়ের মাথায় । পরম মমতায় পেছন থেকে ডান হাতটা কোমরের ডান পাশ দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে স্বামীর ভুড়ি আগলে রেখেছে । বাইক দম্পতি সামনের বামের গলিতে অদৃশ্য হয়ে গেল ।
হঠাৎ ঝাঁকুনি । রাস্তার স্পিড ব্রেকারগুলো ওই ধবধবে শাদা বা কুচকুচে কালো গাড়িগুলোর জন্যই । এই রিকশার জন্য না । ঝাঁকুনিতে মালার বুক থেকে ওড়নাটা খসে গেল । যেন হঠাৎ বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে শাদার মাঝে গোলাপী ফুলের এ বস্ত্রটুকরো । অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সহিত ওড়না ধরে মাঝপথ থেকে আবার আগের গন্তব্যে ফিরিয়ে দিতে দিতে বলছে – ঢাকা শহরের রিকশা গুলো অনেক বড় , তিনজন নিয়ে টানতে না চাইলে এত বড় রিকশা নিয়ে কেন ঘোরেন মামা ?
চালক তার কথায় উত্তর না দিয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে একটু একটু করে । তার গালের ডান পাশ দিয়ে গোঁফের কিনারা দেখা যাচ্ছে । একটু পর আবার অদৃশ্য হয়ে গেছে । সামান্যতম কলহের আভাস বুঝতে পেরে চালক হাসি থামিয়ে আবার নীরব শ্রোতা হয়ে গেল । মাথার পেছনে রিজার্ভ চোখ থাকলে হয়তো নীরব দর্শকও হতে পারতো । কিন্তু মানবজাতির জন্য বিধাতা তা সমীচীন মনে করেননি ।
বড় রিকশাটাকে একটু ছোট করার চেষ্টা করলাম । এতেও মালার বিদ্রোহী সুর –
‘ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেবে নাকি ?’
মালার অভিমানের তীর আমায় স্পর্শ করেনা । নিশ্চুপ থাকি তার প্রতি দফা দাবি আদায়ের শ্লোগানে । শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয় তার প্রতিটি নেত্রপল্লব, কিঞ্চিৎ রক্তবর্ণ ধারণ করে চোখের শ্বেত অঞ্চল, কেঁপে ওঠে গলার স্বর। আন্দোলনে হামলা করলে সে আন্দোলনের সম্পূর্ণ বা আংশিক দাবি মেনে নিতে হয় । আমার পক্ষে দাবী আদায়ের ক্ষমতা থাকলেও সুযোগ নেই ।
মালার খোলা চুল উড়ে বেড়াচ্ছে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত নতুন কোনো দেশের পতাকার মতো । ফাগুনের শেষ দিকের খানিক বাতাস অস্বাভাবিক কিছু নয় । রিকিশার চাকার দ্রূত গতির ঘূর্ণন সে পতাকাকে আরও সগৌরবে ওড়ার স্বাধীনতা দিয়েছে । সে স্বাধীনতায় মালার চুল আমার ঠোঁটে গালে আলতো ছোঁয়া দিয়ে যাচ্ছে একটু একটু । সুড়সুড়ি লাগলেও সরানো যাচ্ছেনা আন্দোলন তীব্রতর হবে বলে ।
চুলে কী শ্যাম্পু মেখেছো মালা ? অনেক সুন্দর ঘ্রাণ ।
চোখ দুটোকে মার্বেলের মতো ঘুরিয়ে এক টানে চুল গুলো পিঠে চালান করে দিয়ে রিকশাটাকে আবার বড় করে দিয়ে কাকে যেন বলছে – ‘হিজাব ছাড়া কখনও বের হইনা । তোমার কথায় আজ খোলা চুলে বের হয়েছি । হলের বান্ধবীরা কেমন জানি আড়চোখে তাকাচ্ছিলো । আর কত দিন এভাবে লুকিয়ে বেড়াবো।‘
মাথায় কাপড় দিতে তো না করিনি ।
‘ঘোমটাতো ছিলো । রিকশায় বসে তুমিইতো বলেছিলে খোলা চুল দেখবে ।‘
দেখা হয়ে গেছে । তোমার হলের কাছাকাছি এসে গেছে রিকশা । আমি না হয় আগেই নেমে যাই ।
‘চলো আজ আমি তোমায় তোমার হলে নামিয়ে দিয়ে আসি । হলের একটু আগেই নেমে যেও । ভিসি চত্বরে । রিকশা ঘুরিয়ে আমি না হয় আবার ফজিলাতুন্নেসা হল আসবো ।‘
নারীজাগরণের এমন দৃষ্টান্তে বিমোহিত হয়ে চালককে বললাম পুনরায় দোয়েল চত্বরের দিক থেকে আরেকটু ঘুরিয়ে টি এস সির দিকে যেতে ।
‘আমি কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি , তোমার লেখার হাত ভাল । তুমি লেখালিখি চালিয়ে যেও । বার্ষিক ম্যাগাজিনে তোমার লেখা পড়ে রুমমেট রুমালী আমায় দেখিয়ে দেখিয়ে বলছে – আমাদের ডিপার্টমেন্টে একটা ছেলে আছে । নাম বশির রায়হান । নিরন্তরের এবারের সংখ্যায় তার চমৎকার একটি লেখা এসেছে । ব্যাচেলর স্বামী শিরোনামে । দ্যাখ, দ্যাখ...’
'কই দেখি? ও এটি ? এ আর এমন কী !' - এসব বলে আমি যখন তাদের উৎকণ্ঠার পারদকে শূণ্যের কোঠায় নামিয়ে আনি তুমি বুঝবেনা রায়হান আমি কত শত-সহস্র আয়তনের অনিবার্য ঈর্ষার অনলে পুড়ে মরি। জর্জরিত হই আপন অধিকার হতে বঞ্চণার দারুণ দ্রোহে । হিমালয়ের উচ্চতাসম হিংসা বাসা বাঁধে এ বুকে । এসব কী তোমার বোঝার সময় আছে ? তুমি আছো তোমার প্রতিষ্ঠিত হওয়া নিয়ে । এতই যখন প্রতিষ্ঠিত হতে চাইবে তাহলে কেন বিগত একটি বছর ধরে আমায় এমন অদৃশ্য অনলে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করছো ? মালা মুখ দিয়ে কথাগুলো বের করতে চাইলেও তার ঠোঁট দু’টি অবরোধ ডেকেছে আগামী অর্ধবেলার জন্য । অর্ধবেলা মালার ঠোঁটের কাঁপন দেখেই বুঝে নেওয়া যাবে সে কখন কী বলতে চাইছে, কিন্তু বলছেনা ।
টি এস সির কোলাহল আজ অনেক প্রাণবন্ত । মেলা বসেছে পথে প্রান্তরে । সে মেলায় কেউ বাদাম বিক্রেতা , কেউবা ক্রেতা । টি এস সি থেকে বাকী পথ হেঁটেই যাব । পাবলিক লাইব্রেরির সামনে জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে ঘণ্টাখানেক যাবৎ । তুমি বরং রিকশা ঘুরিয়ে নাও । সব কিছু আড়াল করে মাথাটা মালার কানের কাছে নিয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললাম । আজ দিনটি আমাদের জন্য একটু আলাদা হবার কথা । দু'জনেই তা জানি কিন্তু কেউই কাউকে মন করিয়ে দিচ্ছিনা । কারণ একটাই, আমার বেকারত্ব ।
জাহিদ আমায় নতুন চাকরির সুখবর দিবে । তা বুঝতে পেরেছি । মানুষের গলার স্বরে আহ্বানের কারণ বোঝা অত কোষ্ঠকঠিন কিছু নয় । গত মাসে একই তারিখে দু'টি সাক্ষাৎকার থাকায় দু’জন দু’জায়গায় সাক্ষাৎকার দিয়েছিলাম । দু’জনের নামেই চিঠি এসেছে । সকালে পিয়ন জালাল ভাই থেকে জাহিদ আমার চিঠিও নিয়ে নিয়েছে । সে আনন্দে মনটা কিঞ্চিৎ চনমনে থাকায় আজ মালার বিষাদে ভাগ বসাতে ইচ্ছে করছেনা । মাস দু’য়েকের মাঝেই একটা বিহিত হয়ে যাবে । রিকশা থেকে নেমেই হাটা শুরু করতে যাবো এমন সময় মালার ঠোঁট দুটো ধর্মঘট ভেঙ্গে নড়ে উঠলো । বেরিয়ে এলো এক কিন্নর কণ্ঠের আবেগী আবদার –
শোনো ! আজ আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী ছিলো । এটাও যে তোমার মনে নেই প্রতিষ্ঠিত হবার তাড়নায় । এ নিয়ে কিছু লিখো । অনেক বাহবা পাবে ।
২৩/০৩/২০১৭
ছবিঃ ইন্টারনেট