somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

হামক

০৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাজিতপুর হোটেল এন্ড মিষ্টি ভাণ্ডারের যেই ছেলেটা চায়ের সাথে একটি সহজ শর্তের হাসি পরিবেশন করতো আমি ঠিক তার কথাই বলছি । অপরিচিত তুষ্ট লোকজন প্রায়ই বলেই ফেলত, নাম কী রে ? ছেলেটার হাসি তখন আরো বিস্তৃত হতো । নিজে বলার আগেই আশেপাশে থাকা মানুষগুলো প্রশ্নটা লুফে নিয়ে উচ্চকণ্ঠে বলতে থাকতো ,”হামক… হামক ! এর নাম হইলো গিয়া হামক” । প্রশ্নকর্তা যদিও বুঝত যে হামক কোন নাম হতে পারে না কিন্তু একটা বিচিত্র শব্দের রেশ মূল নামটার ভাবনা থেকে অনেক দূরে রাখতো । হয়তো ভাবিত হতো না ছেলেটা নিজেও । কাক-ডাকা নীরব দুপুরেও শব্দটা তার ঠোঁটে বা জিভে অল্প নড়াচড়া করতো কিনা জানা হয় নি ।
এইজন্যে অবশ্য কাউকে তেমন একটা দোষ দেয়া যেত না । সারাক্ষণ হাসতে থাকাতে তার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে সকলের মনেই একটা প্রশ্নবোধক অস্বস্তি জাগতো । উত্তর খুঁজে না পাওয়ার ক্ষোভ মেটাতে যে যার মত বেশ কয়েক দফা নামকরণ করে কিছুটা ক্ষান্ত হতে চাইতো । এ ক্ষেত্রে অগ্রগামী ছিল দোকানের মালিক জয়নাল মিয়া।
জয়নাল মিয়া চোখে কিছু কম দেখে। ভারি চশমার ঘোলাটে জগতেও ছেলেটার হাসি তার কাছে মোটা দাগের বাহুল্য আর অপচয় হয়ে ঠেকতো । এই চলতি দোকানের নানান ঝামেলায় সেই হাসি তার বিরক্তি যেই ক-প্রস্থ বাড়িয়ে দিত ঠিক ততো প্রস্থ জয়নাল তাকে আহাম্মক বলে- ডেকে আরাম নিতে চাইতো । আহাম্মক শব্দটি মানুষের অমনোযোগী শ্রবণে কখনো অন্য শব্দের আড়ালে চলে গিয়ে, কখনো উচ্চারণের জটিলতা ছেঁটে হয়ে গিয়েছিল হামক। হামকের তাতে সমস্যা হত না। সে মুখে নানান রেখা ফেলে, কালো গালের গভীরে স্পষ্ট টোল ফেলে হেসেই চলতো ।
সারাদিনের কাজ কর্মের ভুল ত্রুটিও সুযোগে খুব সহজেই হামকের ঘাড়ে ফেলে দিত তার সহকর্মী ছোট কাশেম আর গুজু। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিনোদনের মতোই চলতো হামককে নিয়ে নিত্য-নতুন কৌতুক। পিঠে গোটা কিল, চাপড় দিয়ে চলতে থাকত ছেঁটে যাওয়া নামের সহ-নামকরণ, “হালা বরহী । গরু কইলেও গরুর জাইত থাকতো না ,আলের বলদ”।
হালের বলদ নামকরণটা একরকম সার্থক করে হামক এসব কথা গায়ে মাখার কথা ভেবে দেখত না। কালচে লিকারে ঘন দুধ দিয়ে নাড়ার কৌশলকে শিল্পে পরিণত করার প্রক্রিয়ায় মত্ত থাকতো

২.

নিজে পরিবার-পরিজনহীণ বলেই হয়তো মানুষের বিবেচনা বোধে আমার আস্থা বরাবর কম । অন্যের একটি গুণকেও এরা ত্রুটি হিসাবে ধরে নিতে পারে আর নিজদের ত্রুটিকে গুণ । তাই সকলের বিবেচনার বাইরে দাঁড়িয়ে আমি হামককে বিচার করতে চাইতাম । তার মনোজগৎ আমার কাছে কৌতুকের না হয়ে ছিল কৌতূহলের।
যতবার নানা বাড়িতে ছুটিতে গিয়ে বাজিতপুর বাজারে ভাই-বন্ধুদের সাথে বসেছি, আমার দৃষ্টি থাকতো হামকের উপর । কিন্তু চা নিয়ে এগিয়ে এলে দু -একটা প্রশ্ন করার আগেই তার সহকর্মী-দুটো কেন জানি যেন দুপাশ থেকে চেপে নিজেদের উপস্থিতি প্রবল করে তুলে তাকে সরিয়ে দিতো । ফিরে যেতে যেতে হামকের চোখে দেখতাম কিছু বলার ইচ্ছা আর আমার মনের বাড়ন্ত কৌতূহলের সলতেতে জ্বলতো শিখা ।
সকলের চোখে মূর্খ এই ছেলেটির হাসিতে আমি কখনোই নির্বুদ্ধিতা নয় বরং শক্তি টের পেতাম । কিন্তু শুধু নিজস্ব একটা অনুভূতিতে জগতে কিছু প্রমাণ হয় না । প্রমাণ হতো না হামক আদতে আহম্মক নয় । তাই একটা কিছু প্রমাণের চেষ্টা হামককে দেখলেই আমার জেগে উঠতো । আফসোস হতো মানুষের মন ও বুদ্ধিমত্তা যদি অনুধাবনের না হয়ে দৃশ্যমান হতো তাহলে তা ব্যবচ্ছেদ করে দেখানো যেত; আমার ধারণা সত্য। সুখ দুঃখের এই জীবনের সমগ্রতাকে সহজভাবে নেবার প্রচণ্ড ক্ষমতা যে খুব উচ্চ বুদ্ধিমত্তা এটা এই চতুর মানুষদের কিভাবে বুঝাবো!

তবে আমি নিরাশ ছিলাম না। প্রতি বার ঢাকা ফিরে এসে ভাবতাম এর পরের বার গেলে হামকের সাথে কিছু একান্তে সময় কাটাবো । খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তার অন্তর্গত তেজ কিছুটা বাইরে এনে দেখিয়ে দেব সবাইকে রেগে যাওয়া বা জেদ করা মানুষের জন্য সহজ। কিন্তু সকল পরিস্থিতি হাসতে পারা মানুষের জন্য কঠিন ।
গতবার কিশোরগঞ্জ গিয়েছি যখন তখন হলো দু একটা কথা । হামক চা নিয়ে আসতেই আমার আগে আমার বন্ধুরা হই হই করে উঠেছিল,
-খবর হুনছোনি আবিদ? আমগো হামইক্কার বউ আর এক বেডার লগে ফুড়ুৎ দিছে ।
হামককে সবাই প্রায় ঘিরে ধরেছিল কৌতুক আর মজা নিতে । তবে আমি বুঝতে চেয়েছিলাম এই স্পর্শকাতর বিষয়টাকে হামক কিভাবে নিচ্ছে । তার মুখের প্রতিটি রেখা আমি পড়ার চেষ্টা করেছিলাম । সেই রেখায় কোথাও কি বউ হারানোর বেদনা নেই? তন্ন তন্ন করে খোঁজার আগে আমি সবাইকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম ।
-হাছাই হামক?
হামক সলজ্জ হেসে বলেছিল ,
-হ ।
আমার বন্ধুরা আরো মজা নিয়ে বলেছিল,
-লইজ্জা তুই ফাছ কেরে । লইজ্জা পাইবো ঐ …।
নোংরা শব্দটা শুনতেই হামক জিভ কেটেছিল । আমি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম -
-কষ্ট পাইছছ?
কষ্টের কোন চিহ্ন নয় বরং হামকের আরো’কটা দাঁত দেখা গিয়েছিল ।
-না। কষ্ট পামু কেরে? যে যেহানে শান্তি পায়।
সেই নির্ভার উত্তরে সকলের কৌতুকীয় হাসি একটু চাপা পড়ে গিয়েছিল । তখনো আমি হন্যে হয়ে তার হাসির আড়ালে খুজছিলাম কষ্ট। কিন্তু একটা সহজাত সাবলীলতা ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়েনি সেদিন।

কষ্ট যে বুঝে না তাকে আপাতে পরিণত বলা যায় না । আর যে কষ্ট কে অস্বীকার করে বা অপ্রাপ্তিকে কষ্টের মোড়কে মুড়তে জানে না তাকে কি পরিণতই বলা যায় না? “যে যেহানে শান্তি পায়” কথাটাতে আমি অভিমান নয় জীবনের জটিলতার গিঁট খুলে দাঁড়ানো একজন মানুষকেই দেখেছিলাম । আমার অনুভবের সত্যতা নিজেকেই দেখিয়েছিলাম গাঢ় করে । আসলে আমরা মানুষেরা একে বুঝতে পারি না। বুঝতে পারিনা বলেই একে আলাদা একটি শ্রেণীতে ফেলে দেই অনায়াসে।

৩.
বাজিতপুর হোটেল ও মিষ্টান্ন ভাণ্ডার আজ হয়তো আমার মতো অনেকের কাছেই নিষ্প্রাণ লাগছে। আজো চায়ের কাপে এনামেলের চামচে টুং টাং শব্দ হচ্ছে তবে সেই হাসতে থাকা ছেলেটি হাসির সংক্রমণ আর নেই, নেই কৌতুকের পাত্রটি। শব্দে, আচরণে ত্রস্ততায় ব্যবসা এখানে প্রকট আকারে প্রকাশ পাচ্ছে । মানুষের মুখে ব্যস্ততা আর কষ্টের রেখা চাইলেই পড়া যাচ্ছে । তার জন্যে আমাকে আর কসরত করতে হচ্ছে না । হামক নেই প্রায় এক মাস হয়।

এত অনাত্মীয়ের জন্য এতটা শুন্যতা বোধ আমার হয়তো কখনোই হত না । কিছুক্ষণ একটা কষ্টের ভীষণ কষ্টের অস্বস্তিতে ডুবে থেকে হয়তো ভুলতে থাকতাম । যদি না হামকের মৃত্যুর ঘটনাতেও হামক আপাতে তার নির্বুদ্ধিতা প্রমাণ করে যেত মানুষের কাছে । যদি না এই কিছু একটা প্রমাণ করতে না পারাটা আমাকে ভীষণরকম ব্যর্থ করে তুলতো এখানে আসার পর থেকে।
আজ অনেকটা অভ্যাসেই আমি এখানে একা একা নিশ্চুপ বসে ছিলাম । হামকের প্রসঙ্গ আসায় আগ্রহ নিয়ে তাকালাম । ছোট কাশেম আর গুজু এসে একটু কাঁদছে
-কন? কেমুন বেহলের বেহল। যেয় তরে ফালায় থুইয়া এর এক বেডার লগে পথ দিয়া হালছে , হেরে বাছাইতে গিয়াই তুই মরবে? দুনিয়া বেহলের লেইজ্ঞা না। হামইক্কা রে…।। ওই হামইক্কা…।।
আমি মনে মনে হাসলাম । দুনিয়া বোকা, বুদ্ধিমান কারো জন্যেই নয়তো । দুনিয়া শুধু চতুর আর স্বার্থপরদের জন্যে ।
হামকের বিয়ে করা বউটি যখন তার আগের প্রেমিকের কাছে যেতে চাইলো হামক বাধা দেয় নি। কারণ তখন মেয়েটির অনুভূতির প্রতি সহানুভূতি হলো মানুষের চোখে নির্বুদ্ধিতা । মেয়েটি যখন বুঝতে পারলো যার হাত ধরে পালিয়েছে সে মূলত তার দেহ ব্যবসায়ী । সে পালিয়ে এসে হামকের কাছেই আশ্রয় নিয়েছিল । এক রাতে দুর্বৃত্তদের হাত থেকে মেয়েটিকে বাঁচাতেই হামকের মৃত্যু । আমাকে মানতেই হলো কাউকে বাঁচাতে সাহস দেখানো অবশ্যই এই পৃথিবীতে নির্বুদ্ধিতা । নিজের সিঁড়ি ঠিক করে তর তর করে উঠে যাওয়া শিখতে হয় এখানে । নিজের জন্যে ভাবতে শেখা মানে এখানে পৃথিবীতে চলতে শেখা ।
হামকের একজীবন সাহসকে আমি গভীর শ্রদ্ধা জানালাম , মানুষের সংজ্ঞায়িত করার অভ্যাসকে নিচু চোখে দেখলাম কিন্তু তার মহত্ত্বকে ধারণ করতে পারলাম না। কেননা আমি নিজেও যে আজন্ম শিখেছি কিভাবে জীবন নিজের জন্যে টিপে টিপে খরচ করতে হয় । মানবিকতা কে পাশ কাটিয়ে নিজের দেহের ও মনের দুটো পেট একসাথে কিভাবে চালাতে হয়। হামকের জন্যে আমার সেই কিছু একটা প্রমাণের চেষ্টাকে হঠাৎ নিরর্থক মনে হলো। নিজেকে আবিষ্কারের মতোই খেয়াল হলো আমি নিজেও যে চতুরদের সারিতেই দাঁড়িয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৩ দুপুর ১:৫৯
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নেতানিয়াহুও গনহত্যার দায়ে ঘৃণিত নায়ক হিসাবেই ইতিহাসে স্থান করে নিবে

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:৩৮

গত উইকেন্ডে খোদ ইজরাইলে হাজার হাজার ইজরাইলি জনতা নেতানিয়াহুর সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ করেছে।
দেখুন, https://www.youtube.com/shorts/HlFc6IxFeRA
ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর এই হত্যাযজ্ঞ ইজরায়েলকে কতটা নিরাপদ করবে জনসাধারণ আজ সন্দিহান। বরং এতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ০৭ ই মে, ২০২৪ রাত ২:৩১


আশেপাশের কেউই টের পাইনি
খুন হয়ে বসে আছি সেই কবে ।

প্রথমবার যখন খুন হলাম
সেই কি কষ্ট!
সেই কষ্ট একবারের জন্যও ভুলতে পারিনি এখনো।

ছয় বছর বয়সে মহল্লায় চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে প্রায় দ্বিগুন... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাম গাছ (জামুন কা পেড়)

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:০৩

মূল: কৃষণ চন্দর
অনুবাদ: কাজী সায়েমুজ্জামান

গত রাতে ভয়াবহ ঝড় হয়েছে। সেই ঝড়ে সচিবালয়ের লনে একটি জাম গাছ পড়ে গেছে। সকালে মালী দেখলো এক লোক গাছের নিচে চাপা পড়ে আছে।

... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনির্বাণ শিখা

লিখেছেন নীলসাধু, ০৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



রাত ন’টার মত বাজে। আমি কি যেন লিখছি হঠাৎ আমার মেজো মেয়ে ছুটতে ছুটতে এসে বলল, বাবা একজন খুব বিখ্যাত মানুষ তোমাকে টেলিফোন করেছেন।

আমি দেখলাম আমার মেয়ের মুখ উত্তেজনায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

=ইয়াম্মি খুব টেস্ট=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:১৪



©কাজী ফাতেমা ছবি
সবুজ আমের কুচি কুচি
কাঁচা লংকা সাথে
ঝালে ঝুলে, সাথে চিনি
কচলে নরম হাতে....

মিষ্টি ঝালের সংমিশ্রনে
ভর্তা কি কয় তারে!
খেলে পরে একবার, খেতে
ইচ্ছে বারে বারে।

ভর্তার আস্বাদ লাগলো জিভে
ইয়াম্মি খুব টেস্ট
গ্রীষ্মের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×