somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বই রিভিউঃ "খোয়াবনামা"

০৯ ই মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রোজায় বেশিরভাগ সময়েই আমি সেহেরি খেয়ে ঘুমাই। এমনই একদিন ঘুমানোর আগে বাতি নিভিয়ে মোবাইলে 'খোয়াবনামা' পড়া আরম্ভ করেছিলাম। ফজরের ঠিক পর থেকে ভোরের আলো ফুটবার আগ পর্যন্ত সময়টুকু অসম্ভব প্রশান্ত থাকে। শিশুদের মত আলস্যভরা ঘুমঘুম চোখ নিয়ে আমি লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প শোনা আরম্ভ করি তখন-

"অনেকদিন আগে, তখন তমিজের বাপ তো তমিজের বাপ, তাঁর বাপেরও জন্ম হয় নি, তাঁর দাদা বাঘাড় মাঝিরও তখনো দুনিয়ায় আসতে ঢের দেরি, বাঘাড় মাঝির দাদার বাপ না-কি দাদারও জন্ম হয়েছে কি হয় নি, হলেও বন-কেটে-বসত-করা বাড়ির নতুন মাটি ফেলা ভিটায় কেবল হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াচ্ছে......"

উপন্যাসের উৎপত্তিস্থল- উত্তরবঙ্গের এক সুপ্রাচীন দিঘী। কাৎলাহার বিল। একে কেন্দ্র করে ঐ অঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে যে রূপকথা-লোককথা প্রচলিত আছে, গল্পের শুরু তেমনই এক লোককথা দিয়ে। লেখক যেভাবে এই মিথটাকে গল্পে টেনে এনেছেন প্রায়ই, তাতে গোটা উপন্যাস জুড়েই এর একটা প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি অনুভব করা যায়। পূর্ববঙ্গের রহস্যময় মাটি আর জাদুগ্রস্ত কাৎলাহার বিলের এমন এক কাহিনী লেখক ফেঁদেছেন, তাতে কখনো কখনো কনফিউজড লাগছিলো এই ভেবে যে- আমি কি স্মার্টফোনে স্ক্রল করে কোনো আধুনিক উপন্যাস পড়ছি, নাকি হারিকেনের নিভু নিভু আলোয় উলটে যাচ্ছি প্রাচীন কোন পুঁথির পাতা !!

"খোয়াবে কান্দিলো বেটা না রাখে হদিস
সিথানে পড়িয়া থাকে কার্পাসের বালিশ......"


গল্প এগুনোর সাথে সাথে ফোকলোরকে সরিয়ে বাস্তবতা জায়গা করে নিলো অবশ্য। তখনো দেশভাগ হয় নি, তবে এর জোর প্রস্তুতি চলছে। পূর্ববঙ্গের মুসলমান কৃষকেরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে পাকিস্তান কায়েম হলে তাঁদের দুঃখ-কষ্ট ঘুচবে। তেভাগা আন্দোলনের মত, অথবা তার থেকেও উন্নত কোনো ব্যবস্থায় ফসলের একটা বড় অংশ পাবে কৃষক। সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে পূর্ববঙ্গের সো কলড 'চাষা'দের নিয়ে রচিত একটা মহাকাব্য এই খোয়াবনামা। যাদের গল্প কেউ বলে না, কেউ শুনতেও চায় না- সেই তমিজ, কুলসুম, ফুলজান কিংবা বৈকুন্ঠদের এই উপন্যাসে তুলে আনা হয়েছে গভীর যত্নে। কেমন করে এলাকার প্রভাবশালি জোতদার, ব্যবসায়ী কিংবা মহাজনদের ফাঁদে যুগ যুগ ধরে এঁরা আটকে আছে, তারই বাস্তবচিত্র বলা হয়েছে ......

শেষ করবো খোয়াবনামার অনন্য দিকটার কথা বলে। ভালো উপন্যাস অনেক আছে, কিন্তু 'খোয়াবনামা' সমগ্র বাংলা সাহিত্যে একটা আলাদা জায়গা করে নেবে সম্ভবত অন্য কারণে। এই উপন্যাসই- আমার মতে- পূর্ববঙ্গের সাহিত্যকে পশ্চিম বাংলার সাহিত্য থেকে আলাদা করেছে। এর প্রতি পাতায় পাতায় এখানকার মাটি, ধান আর মানুষের গায়ের গন্ধ। এর চরিত্রগুলোর ব্যথা, সংকীর্ণতা কিংবা গৌরবটুকুও পূর্ব-বাংলার একান্ত নিজের। তাই কাহিনীর প্রয়োজনে লেখক যখন বলেন- "খ্যাপশা বুড়া খাবার বস্যা খালি পাদে, গোন্দে প্যাট হামার খালি ঘাটিচ্ছে। বুড়াক তুমি সর‍্যা বসবার কও......" অথবা "বাঁশঝাড়ে বসে পায়খানা করছে কোন শালা ছোটলোকের বাচ্চা। আজ জেয়াফতে গোগ্রাসে গেলা এবং হজম-বদহজম- হওয়া খানা সে খালাস করছে মিহি ও মোটা নানারকম ধ্বনি তুলতে তুলতে......"- এসব পড়ে একদমই অকৃত্রিম কোনো কিছু মনে হয় না। রাতের অন্ধকারে দিঘীর ঢালে কৃষক তমিজ আর ফুলজানের মধ্যকার সঙ্গমটাকে মনে হয় 'রিয়েলিটি'; এমন আরো বহু উদাহরণ দেয়া যাবে চাইলে......

রাজা যায়, রাজা আসে, কিন্তু সাধারণ মানুষের দুর্দশার কোন পরিবর্তন হয় না। উপন্যাসে দেখি বৃটিশরা চলে গেলো, জমিদারী উচ্ছেদ হলো- কিন্তু আমজনতা রয়ে গেলো ঠিক আগের তিমিরেই। নিজেদের স্বার্থে প্রভাবশালীরা এদেরকে ব্যবহার করেছে শুধু যুগের পর যুগ ধরে। ভূ-খন্ড পাল্টেছে, পরিচয় পাল্টেছে, ঠিকানা পাল্টেছে, কিন্তু জীবন পাল্টায় নি এদের। যে বৈকুন্ঠরা সীমানার অন্য পাশে সংখ্যাগুরু, তারাই আবার সীমানার এ প্রান্তে মূল্যহীন হতভাগ্য ঘুটির মত জীবন খুইয়ে কাৎলাহার বিলের রূপকথা গল্পের মত গল্প হয়ে গেছে। তবে তাঁদের গল্প পাকুড়গাছের মুনশি, অথবা বিদ্রোহী ফকির-সন্ন্যাসীদের মত করে কেউ মনে রাখে নি। অসংখ্য সাধারণ মানুষের মত তাঁরাও জায়গা করে নিয়েছে বিস্মৃতির অতল সাগরে......

কি প্লট, কি চরিত্র-নির্মাণ, কি স্থানীয় বা প্রমিত ভাষার ব্যবহার বলুন অথবা গল্পে লোককথার প্রয়োগ- সব মিলে 'খোয়াবনামা' উচ্ছ্বসিত হওয়ার মত শক্তিশালী এক উপন্যাস। নোবেল কমিটির প্রতি সমবেদনা, যে তাঁরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের এই রচনাকে নোবেল দেওয়া থেকে বঞ্চিত হলো। আই ফিল পিটি ফর দেম। আই রিয়েলি ডু......

সকলকে ধন্যবাদ !

বইঃ "খোয়াবনামা"
লেখকঃ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস
ধরণঃ উপন্যাস
রেটিংঃ আমার রেটিং এ কিছু আসে যায় না, তারপরো- ১০০/১০।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৫৭
৫টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×