somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্প: "চিরায়ত"

২৬ শে মে, ২০২১ সন্ধ্যা ৬:৪৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"বাঁধন" ওল্ড হোমের সাথে আমাদের থিয়েটারের একটা চুক্তির মত হয়েছিলো। চুক্তি অনুযায়ী- আমরা প্রতি শুক্রবার বিকেলে ওল্ড হোমে নাটক মঞ্চস্থ করবো......

ওখানকার বাসিন্দা যারা আছেন, তাদেরই জীবনকাহিনীর ওপর ভিত্তি করে বানানো হবে নাটকগুলো। একেক সপ্তাহে একেকজনের গল্প বলা হবে। বয়স্ক মানুষগুলির জন্য বিনোদনের একটা ব্যবস্থা করা আর কি ! আমাদের জন্য শর্ত শুধু একটাই ছিলো- নাটকে কারো ফেলে আসা জীবনের গ্লানি, দুঃখ কিংবা অপমানকে জায়গা দেয়া যাবে না। শুধুমাত্র ওনাদের সুখস্মৃতির ওপর ভিত্তি করেই নাটকের স্ক্রিপ্ট বানাতে হবে।

এম্নিতে আমাদের থিয়েটারটা যে খুব নামীদামী, বড়সড় কোন প্ল্যাটফর্ম- এমনটা নয়। "বাঁধন" ওল্ড হোমের প্রতিষ্ঠাতা হুমায়ূন সাহেব আমাদের থিয়েটারের একজন প্রাক্তন সদস্য ছিলেন। সেই সূত্রেই তিনিই সানোয়ার ভাইকে প্রস্তাবটা দিলেন। থিয়েটারের পক্ষ থেকেও রাজি না হবারও কোনো কারণ ছিলো না। হুমায়ূন সাহেব এ প্রদর্শনীর জন্য বেশ ভালো এমাউন্টের একটা টাকা দিচ্ছেন। তাছাড়া ওখানে বাসিন্দা আছে সর্বমোট পঁচিশ জন, সে হিসেবে প্রায় ৬ মাসের জন্য নাটকের প্রদর্শনী করাতে হবে আমাদের। এই বিশাল সময়টা থিয়েটারের একাউন্টে নিয়মিত একটা উপার্জন ঢুকবে, এ-ই বা খারাপ কি ! ভার্চুয়াল মিডিয়ার দোর্দন্ড প্রতাপে এম্নিতেই মঞ্চনাটক এখন মৃতপ্রায়......

যাই হোক- প্রস্তাবটা পাওয়ার পরই আমরা খুব উৎসাহ নিয়ে লেগে গেছিলাম। এসব নাটক থিয়েটারের সাথে যারা যুক্ত থাকেন, তাঁরা অধিকাংশই মনের তাড়না থেকে এ লাইনে আসেন। তারপরো টাকাপয়সা একটা বড় বিষয়। নিজের শখ আর মনের টান থেকে ট্রাজেডি নাটকে অভিনয় করা ব্যক্তিটি নিশ্চই চাইবেন না তাঁর বাস্তব জীবনটাও ট্র্যাজেডি হয়ে উঠুক, তার উপর আমাদের থিয়েটারটার অধিকাংশ সদস্যই যেখানে নিম্ন-মধ্যবিত্ত/ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা..... এদের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র আমিই একটু অবস্থাসম্পন্ন ঘরের ছেলে ছিলাম। হুমায়ূন সাহেবের লোভনীয় সম্মানিটা তাই অধিকাংশের জন্য উপরি একটা প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিলো সে সময়। আমরা দিনরাত, নাওয়া-খাওয়া ভুলে কাজ করতাম। সানোয়ার ভাই প্রতি শনিবার বৃদ্ধাশ্রম থেকে যে কোনো একজনের জীবনকাহিনী শুনে আসতেন। সপ্তাহের বাকি দিনগুলো আমরা ঐ গল্প থেকে স্ক্রিপ্ট তৈরি, চরিত্র নির্ধারণ আর রিহার্সেলে নিবিষ্ট করতাম আনন্দমাখা ব্যস্ততায়। শুক্রবার দলবল নিয়ে বাঁধন ওল্ড হোমের খোলা মাঠে প্রদর্শনী হতো।

আমাদের মাঝে সব থেকে ভালো অভিনয় করতো কাজল। নাটিকার কেন্দ্রীয় চরিত্র মেয়ে হলে অবধারিতভাবে তাকেই সেটা করতে হতো। আর তখন ওর স্বামীর ভূমিকায় অভিনয় করতাম আমি। এভাবে আমার আর ওর মধ্যে একটা অসাধারণ বোঝাপড়া তৈরি হয়ে গেছিলো। তাছাড়া "বাঁধন" ওল্ড হোমের অধিকাংশই যেহেতু যেহেতু প্রবীণ নারী ছিলেন, মেয়েটার ওপরো তাই প্রেশার যেতো খুব। মাঝে মাঝে কাজল কোনো কারণে আসতে না পারলে ওর জায়গায় সুরাইয়া পার্টটাকে টেনে নিতো।

সত্যি বলতে বয়স্ক মানুষদের জীবনের সাথে আমার আগে তেমন যোগ ছিলো না। দাদা-দাদী, নানা-নানী মারা গেছেন জন্মের অনেক আগেই। “বাঁধনে” কাজ করার সময়টাতে খুব ঘনিষ্ঠভাবে তাই উনাদের জীবনটাকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। অভিনয় করতে গেলে এম্নিতেও চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম হতে হয়, তারপরো খুব অবাক লাগতো ভেবে- এই লোলচর্ম্মসার বৃদ্ধ-বৃদ্ধা- এরাও একসময় ঠিক আমাদেরই মত যুবক যুবতী ছিলো। তাঁদের জীবনেও প্রেম, কাম আর মায়া এসেছিলো আমাদের জীবনের মত !

নূরজাহান বেগম নামে একজন ছিলেন। খুব সম্ভবত ২য় বা ৩য় সপ্তাহে উনার নাটকটা তুলেছিলাম আমরা। মঞ্চ ছিলো “বাঁধনের” উন্মুক্ত, খোলা মাঠ। কাজল নূরজাহান বেগমের পার্ট করলো। আর আমি করলাম উনার মৃত স্বামী জনাব এমদাদ হোসেনের। নূরজাহান বেগমের শাশুড়ি খুব রাগী আর জাঁদরেল মহিলা ছিলেন। উনার কঠিন নিষেধ স্বত্বেও এমদাদ হোসেন কিভাবে স্ত্রীকে নিয়ে লুকিয়ে কাৎলাহার বিলের মেলায় গিয়েছিলেন- সেই গল্প ! সুরাইয়া নূরজাহান বেগমের শাশুড়ির অভিনয় করে সবাইকে হাসিয়ে মারলো। সত্যি, খুব মজা পেয়েছিলো সবাই সুরাইয়ার অভিনয় দেখে......

নূরজাহান বেগম নাকি পায়ে আলতা দিতে খুব পছন্দ করতেন। আর ভালোবাসতেন ফুল। এমদাদ হোসেন প্রতি হাটবার বাজার থেকে বউয়ের জন্য পায়ের আলতা কিনে আনছেন, সারা রাত শিশিরে ভিজছেন পোয়াতী বউটার জন্য প্রথম ঝরে পড়া এক মুঠ শিউলি কুড়িয়ে আনবেন বলে- এগুলো দেখে দেখে দীর্ঘদিন পর ভদ্রমহিলা আনন্দের কান্না কাঁদলেন। দুঃখের কান্না সে ওল্ড হোমের সবাই প্রতি রাতেই কাঁদে। আমরা আমাদের নাটিকা, আমাদের ছোট ছোট অভিনয়ের দৃশ্য দেখিয়ে ওনাদের জন্য আনন্দের কান্নার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। সেদিনের নাটক শেষ হবার পর আমাকে আর কাজলকে আলাদা করে ডেকে নিয়েছিলেন নূরজাহান বেগম, তারপর তাঁর মলিন পুটলিটা থেকে খুলে পাঁচশ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন- "তোমরা বেবাকতে মিল্যা ভালোমন্দ নাস্তা খাইয়ো একদিন......"

কাজল ব্যস্তসমস্ত গলায় বললো- "টাকা লাগবে না দাদু, আপনি শুধু দোয়া করবেন আমাদের জন্য..."
নূরজাহান বেগম উত্তরে কিছু না বলে জলভরা, ঘোলা চোখে তাঁর প্রাচীন হাতটা রেখেছিলেন কাজলের মাথার ওপর।

এম্নিতেও আমরা শো শেষ হবার পর সবাই আবার পুরানা পল্টনে, আমাদের থিয়েটারের অফিসে ফেরত আসতাম। সেদিনও এসেছিলাম। আমি, কাজল, সুমাইয়া, জাভেদ, সোহান, সানোয়ার ভাই…… অনিয়মিত আরো দশজনের মত ছিলো। নূরজাহান দাদুর দেয়া টাকায় সবাই মিলে চা সিঙ্গাড়া খেলাম সেদিন। পরবর্তী করণীয় জেনে বাড়ি ফেরার পথ ধরতে ধরতে সন্ধ্যা।

আমার আর কাজলের বাসা ছিলো পাশাপাশি এলাকায়। প্রায় প্রতিদিনই থিয়েটারের অফিস থেকে ফেরার সময় আমি কাজলকে নামিয়ে দিতাম। ওদিন দেখলাম ওর মনটা একটু খারাপ......

"আসলে মানুষের জীবনটা কেমন, না ! আমরাও হয়তো নূরজাহান দাদুদের মত এরকম একা হয়ে যাবো একদিন"- বলে কাজল একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

বাসায় ফেরার পর কাজলের বলা কথাটা নিয়ে অনেক ভেবেছিলাম আমি। গভীর রেখাপাত করলো কথাটা আমার মনের উপর। এম্নিতেই কাজলের ব্যাপারে আমি অবচেতনভাবে দুর্বল ছিলাম অনেকদিন থেকে। জানতাম ওর একজন প্রেমিক আছে, তবুও। রাজু নামের একটা ছেলেকে কাজল খুব পছন্দ করতো। প্রায় বছর ছয়েকের একটা সম্পর্ক চলছিলো ওদের। সব জেনেবুঝেও সেদিনকার ওর অসহায়ের মত কথাটা শুনে সারারাত ঘুম হলো না আমার।

পরদিন থিয়েটারে আমাকে দেখে কাজল উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করলো- "তোকে এমন লাগছে কেনো ফরহাদ। মনে হচ্ছে সারারাত ধরে ঘুমাস নি......"

"কিছু না...... সানোয়ার ভাই নতুন স্ক্রিপ্ট লিখেছে?" আমি প্রসঙ্গটা এড়িয়ে গেলাম।

কাজল খুব ভালো বুঝতো আমাকে। ও ঠিকই আঁচ করলো কিছু একটা। সেদিন দুপুরে দেখলাম বলছে- "চল, আজ মোরগ পোলাও খাওয়াবো তোকে।"

মোরগ পোলাও আমার খুব প্রিয় ছিলো। কাজল সেটা জানতো। থিয়েটার থেকে একটু আগে আগে ছুটি নিয়ে সেদিন আমি আর ও বের হয়ে পড়েছিলাম। আরমানিটোলায় নান্নার যে আসল দোকানটা আছে, ওখানকার মোরগ পোলাও খেয়ে আহসান মঞ্জিলের দিকে গেছিলাম একটু। অট্টালিকার সিঁড়িতে বসে বুড়িগঙ্গার ওপর বিকেল নামা দেখলাম। কাজলের হঠাৎ কি মনে হলো কে জানে- সম্ভবত দীর্ঘদিন বয়স্কদের সথে থাকতে থাকতে ওর মাথায় এখন ওসব ভাবনাই ঘোরে সারাদিন- আনমনা গলায় বলে উঠলো- "মানুষ আমরা বুড়ো হই, অথচ এই নদী কখনো বৃদ্ধ হবে না। কি আশ্চর্য না ব্যাপারটা ! নাম বুড়িগঙ্গা হয়েও কত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সে আগের মতই যুবতী !"

এম্নিতে আহসান মঞ্জিল আরো আগেই বন্ধ করে দেয়, কিন্তু সেদিন যেনো কি একটা বিশেষ অনুষ্ঠান ছিলো, তাই উন্মুক্ত রাখলো পর্যটকদের জন্য। আমি আর কাজলও সেই সুযোগটা নিয়ে একদম সূর্য ডোবা পর্যন্ত বসে ছিলাম । কোলাহলময় বুড়িগঙ্গার ওপর জাফরান রঙের গোধূলি মিলানোর পর সিড়ি থেকে উঠলাম দু'জনে। ফেরত আসার সময় মেয়েটা নাজিরাবাজার নেমে একটা আগুন পান খেলো। ওখানে সুপারির সাথে বিভিন্ন মসলা মিশিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। শিখাসুদ্ধ পানই তখন মুখে ঢোকাতে হয় ক্রেতাদের। কাজল আগুনসুদ্ধ পান খেয়ে বাচ্চাদের মত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলো। আমি হেসে ফেললাম ওর কান্ড দেখে। সারাদিনে ঐ একটু হাসলাম।
###
পরদিন থেকে আবার রিহার্সেল শুরু হলো আমাদের। আমি হাতে গোণা যে কয়েকটা নাটিকায় প্রধান চরিত্র হিসেবে অভিনয় করেছিলাম, তার মধ্যে এটার কথাই আজো আমার বিশেষভাবে মনে আছে। জনাব নুরূল্লাহ নামের একজন প্রবীণ বাসিন্দা ছিলেন বাঁধনের। ভদ্রলোক পেশায় গৃহস্থ হলেও যৌবনে বাউল গান গাইতেন। কিছু নিজেই লিখতেন, সুর করতেন আর গাইতেন দোতরা বাজিয়ে। থিয়েটারে অন্যদের মধ্যে গানের গলা খুব ভালো ছিলো আমার, তাই নুরুল্লাহ সাহেবের পার্টটাও আমাকে বেশ মানালো। উনার স্ত্রী কলি বেগমের পার্ট করেছিলো কাজল যথারীতি। ওটাকে অবশ্য নাটিকা না বলে গীতিনাটিকা বলাটাই সঙ্গত হবে। বৃদ্ধ নিজের হলুদ হয়ে যাওয়া ডায়রিটা দিয়েছিলেন আমাদের। ওখানে আঁকাবাঁকা হাতে লেখা অনেক গান তোলা ছিলো। আমরা বাছাই করে করে কয়েকটা নাটকে ঢুকিয়ে দিলাম......

কি শান্ত, কি ভরপুর ছিলো তখনকার প্রেম! অভিনয় করতে গিয়ে যতবার এটা অনুভব করেছি, ততবার অবাক হয়েছি। প্রতি দুপুরে ক্ষেতে কাজ করার সময় কলি বেগম স্বামীর জন্য ভাত নিয়ে আসতেন। তারপর দু'জন মিলে একসাথে খেতেন ছাতিম তলায় বসে। নুরুল্লাহ সাহেবই নাকি খাইয়ে দিতেন তাঁর বউকে...... খাওয়ার পর কখনো কখনো গান ধরতেন।

আমার নিজেরো ঘোর ঘোর লাগছিলো তখন। তেলে জবজব চুল আর সুরমা চোখের কাজলকে দেখে মনে হতো চিরায়ত বাংলার ছটফটে কোনো কিশোরী বধূই বুঝি ! ঢাকা শহরের মাঝখানে বসেও ফিরে যেতাম আজ থেকে চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর আগে, নরসিংদীর কোন অজপাড়াগায়ে। যেখানে দিগন্তবিস্তৃত দেশী ধানের খেতে কাস্তের মত বাকা হয়ে নুরুল্লাহ সাহেব কাজ করছেন। কখনো ছাতিম তলায় বসে তিনি আর কলি বেগম একসাথে খাচ্ছেন দুপুরে...... মাঝে মাঝে ভরপেট ভাত খাওয়ার সুখে নাকি কলি বেগমের চিকন চিকন শ্যামলা চেহারার প্রেমে মজে গিয়ে নুরুল্লাহ সাহেব গাইতেন-

"হাইলা লোকের লাঙ্গল বাঁকা
জনম বাঁকা চাঁদ রে, জনম বাঁকা চাঁদ
তাহার চাইতে অধিক বাঁকা
যারে দিছি প্রাণ রে
দুরন্ত পরবাসী......"

নুরুল্লাহ সাহেবের ভাষ্যমতে কলি বেগমের মাথায় নাকি একটু 'ছিট' ছিলো ! প্রায়ই বায়না ধরতেন চান্দের ভিটায় যাওয়ার জন্য......
"এহন কাম ফালাইয়া থুইয়া কেমনে যাই বউ? আর তুমি প্রেত্যেকদিন একখানে গিয়া কি মজা পাও, হেইডাও তো বুঝি না......"

কাজল অথবা কলি- যে নামেই ডাকি না কেন- মেয়েটা তখন মুখে আঁচল চেপে হাসতো।

মুখে "না" করলেও চান্দের ভিটায় নুরুল্লাহ সাহেব স্ত্রীকে নিয়ে যেতেন। আশ্বিনের ঝলমল রোদে দু'জন মিলে হাত ধরাধরি করে হাঁটতেন প্রাচীন বাংলার নাম-না-জানা এক পুরাকীর্তির হৃদয়ের ওপর। চান্দের ভিটা সম্ভবত গুপ্ত যুগের কোনো একটা শহর হয়ে থাকবে, কালের বিবর্তনে যেটা ফসিল হয়ে গেছে......

কলি বেগম মারা গেছিলেন বিয়ের পনেরো বছরের মাথায়। নুরুল্লাহ সাহেব আর বিয়ে থা করেন নি। এখন শেষ জীবন পরিবার পরিজন ছাড়া এই ওল্ড হোমে কাটাচ্ছেন। নাটকের পর তিনিও অবিকল নূরজাহান দাদুর মত আমাকে আর কাজলকে ডেকে নিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক সম্ভবত খুব একটা শক্ত মানুষ নন, উনি কাজলের হাত ধরে বাচ্চাদের মত কাঁদছিলেন আর বলছিলেন- "কতদিন পর আবার আমার বউডারে দেখাইলা রে বইন... কয় বছর পর !!"

বিদায় নেয়ার আগে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন- "তোমার গলা বড় মিডা গো। গেরামের ঘ্রাণ পাইলাম তোমার গান শুইন্যা। গানের যত্ন নিও......"
[শেষ কথা]
প্রায় ছয়মাসের প্রজেক্টটা খুব ভালোভাবেই শেষ করেছিলাম আমরা। স্বীকৃতি হিসেবে এরপর আরো কয়েকটা ওল্ড হোম থেকে ডাক পেলেন সানোয়ার ভাই। ততদিনে অবশ্য আমি আর কাজল দু'জনই থিয়েটার করা ছেড়ে দিয়েছি। কাজল ছাড়লো ওর বিয়ে হয়ে যাবে তাই। আর আমি ছাড়লাম...... মনে হয় কাজলের জন্য !

শেষদিন আমরা দু'জন আবার আহসান মঞ্জিল গিয়েছিলাম বেড়াতে। তখনও কোন একটা বিশেষ দিবস উপলক্ষ্যে আহসান মঞ্জিল খোলা ছিলো রাত আটটা পর্যন্ত। আমি আর কাজল সেই আগের মত ওখানকার সিঁড়িতে বসে বুড়িগঙ্গার ওপর বিকেল নামা দেখলাম। তারপর সন্ধ্যা। শেষ বেলার জাফরান রঙের আকাশ থেকে একটু বিষণ্ণতা গলায় মেখে কাজল আমাকে নীচু গলায় বলেছিলো- "চল, আজকে উঠি !"

"থিয়েটার না করে থাকতে কষ্ট হবে না তোর !"- আমি হালকা গলায় অপ্রাসঙ্গিকভাবে জিজ্ঞাসা করলাম।
কাজল কিছু বললো না। আমি দেখি- ও চোখের পানি লুকাচ্ছে। মেয়েটা আমাকে খুব ভালো বুঝলেও আমিও তাঁকে কম বুঝতাম না। আমি স্পষ্ট অনুমান করলাম- ওর অভিনয় করার ব্যাপারটা হয়তো রাজু পছন্দ করছে না। প্রেমিকার অনেক কিছুই আমরা মেনে নিই, কিন্তু স্ত্রীর সবকিছু বোধহয় মেনে নেয়া যায় না।

"আগুন পান খাবি, কাজল ?"

"নাহ। বাসায় চলে যাবো। ভালো লাগছে না রে......"

সেদিন রিকশায় সারাটা পথ কাজল একটা কথাও বললো না। শুধু নেমে যাবার আগ মুহূর্তে অবিকল নুরূল্লাহ দাদার মত করে বলেছিলো- "গানের যত্ন নিস, ফরহাদ। তোর কন্ঠ আসলেই ভীষণ মিঠা......"
###
এরপর আরো কত বছর পার হয়ে গেছে ! নূরজাহান দাদী মারা গেছে শুনেছিলাম। নুরুল্লাহ দাদাও। ইন ফ্যাক্ট-আমরা যাদেরকে দেখে এসেছিলাম, তাঁদের অনেকেই গত হয়েছিলেন এর মধ্যে। আবার নতুন বাসিন্দা এসেছেন। হুমায়ূন সাহেব নাকি প্রতিষ্ঠানটার ক্যাপাসিটি আরো বাড়ানোর কথা ভাবছেন। মডেল একটা দাতব্য আর মানবিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলবেন তিনি বাঁধনকে। সেই লক্ষ্যেই কাজ চলছে......

ওদিকে যুথী নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করে থিতু হয়েছিলাম আমি। কাজলের মত যুথীও অনেক ভালো বুঝতো আমাকে। আমার মুখে কাজলের গল্প শুনে একদিন হাসতে হাসতে বললো- "তুমি যে কাজলকে ভালোবাসো, সেটা কখনো ওকে জানাও নি কেন?"

চাকরির প্রয়োজনে রাঙ্গামাটি চলে আসলাম আমরা। আমি আর যুথী পাহাড়ের বুকের ভেতর অরণ্যগন্ধী এক ঘর বাঁধলাম। কাজলের সাথে আর কোনো যোগাযোগ ছিলো না আমার। শুনেছিলাম- ওর জামাই রাজু নাকি এডিক্টেড হয়ে গেছিলো পরে। স্বামীর অত্যাচার, দরিদ্রতা আর পারিবারিক অশান্তি- সব মিলে কাজল নিজেই নাকি সমাজ থেকে গুটিয়ে গেলো একসময়। বেচারী ! আর কেউ না জানুক, আমি তো জানতাম- ওর স্বপ্নগুলো কত অপূর্ব ছিলো আসলে! আর যার স্বপ্ন যত সুন্দর, স্বপ্নভঙ্গের বেদনাও তাঁর তত বেশি- এ কথা কে না বোঝে ! এসব কারণেই কাজলের জন্য আমার মায়া লাগতো মাঝে মাঝে, একসময় সেটাও ভোঁতা হয়ে এলো……অবশ্য এর পেছনে যুথীর অবদানই বেশি । ও ভালোবেসে আমার মনের ক্ষত দূর করেছিলো।

আজকাল তাই শুধু ওকে নিয়েই আছি। যদিও মেয়েটার মাথায় হালকা 'ছিট' আছে। আমার কোয়ার্টারের কাছেই রাইনুং-এর ভিটা নামে অদ্ভুত এক জায়গা আবিষ্কৃত হয়েছে। সম্ভবত পুরনো কোনো সভ্যতার প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ হয়ে থাকবে সেটা। সময়ে অসময়ে যুথীর সে ভিটায় যাওয়ার পোকা ওঠে। একদিন কার্তিকের পূর্ণিমায় সে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললো- "চলো !"

আমি বিরক্ত গলায় যুথীকে "একই জায়গায় বারবার গিয়ে যে কি মজা পাও"- বলতে বলতে চমকে উঠলাম। মনে হলো- কথাটা কোথায় যেনো শুনেছি ! আমার আগেও আরো কত অসংখ্যবার এই একই কথার পুনরাবৃত্তি হয়েছে পৃথিবীর বুক জুড়ে !

রূপালি জোছনায় আমি আর যুথী হাত ধরাধরি করে হাঁটি রাইনুং-এর ভিটায়। দূ......র বনভূমি থেকে উদাস হাওয়া নাম-না-জানা ফুলের গন্ধ ভাসিয়ে নিয়ে আসে। আশেপাশে ক্লান্তিহীন ডেকে যায় চেনা-অচেনা রাতজাগা পাখি আর পোকাদের দল। হঠাৎ করেই আমার কাছে মনে হয়- নুরুল্লাহ দাদা আর তাঁর স্ত্রী বুঝি দূর থেকে আমাদের দেখে হাসছেন। গা শিরশির করে আমার, যুথীকে মনে হয় কলি বেগম …… নাকি কাজল !

আমি গাঢ় গলায়, গভীর আবেগ নিয়ে বাংলার পুরনো এক লোকগানের সুরে টান দেই-

"হাইলা লোকের লাঙ্গল বাঁকা
জনম বাঁকা চাঁদ রে, জনম বাঁকা চাঁদ
তাহার চাইতে অধিক বাঁকা
যারে দিছি প্রাণ রে
দুরন্ত পরবাসী......

আমার হাড় কালা করলাম রে
দেহ কালার লাইগা রে
অন্তর কালা করলাম রে
দুরন্ত পরবাসী......"
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×