somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ "সায়ান একজন লেখক হতে চেয়েছিলো..."

০৫ ই জুলাই, ২০২১ রাত ৯:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সায়ান মনে প্রাণে একজন লেখক হতে চেয়েছিলো, কিন্তু ওর মা'র আত্মহত্যার ঘটনাটা ছিলো বোধহয় ওর জীবনের একটা টার্নিং পয়েন্ট …

ভার্সিটিতে ভর্তি হবার শুরুর কয়েকটা বছর ক্যারিয়ার নিয়ে অত চিন্তা ভাবনা থাকে না কারো। সময়টা তখন আড্ডা, আনন্দ আর রঙিন জীবনের, কিন্তু তখনও সায়ানকে দেখতাম গল্পের খোঁজে খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কখনো কার্জন হলের ডাবওয়ালার পাশে গিয়ে বসে থাকতো, কখনো শুনতে চাইতো ভেলপুরিওয়ালার জীবন কাহিনী...... আমরা যখন ক্লাস ফাঁকি দিয়ে আড্ডা দেয়ার জন্য টিএসসি চলে যেতাম, তখন সায়ানকে দেখতাম- সেখানকার কোনো এক পাগলী অথবা রোকেয়া হলের সামনে চুড়িওয়ালির সাথে বসে গল্প করছে। কি আশ্চর্য লাগতো আমার ! সত্যিই এখনকার ফেসবুক-টিকটকের যুগেও এমন পাঁড় লেখক সত্তা আছে তাহলে !

আমি অবশ্য ওর এসব আচরণে অবাক হলেও অসন্তুষ্ট ছিলাম না কখনো, কারণ সামাজিক চাপের কারণে বিজ্ঞানের একটা বিষয়ে ভর্তি হলেও আমার আগ্রহের কেন্দ্রে ছিলো সাহিত্য। সেই ছোটবেলা থেকেই। সায়ানেরও তাই। এ কারণেই ওর সাথে আমার একটা অন্যরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। সায়ানও খুব এপ্রিসিয়েট করতো আমার এ ব্যাপারটা। প্রায়ই ওর লেখা গল্প, নয়তো কবিগুলো পড়তে দিতো আমাকে। আমি সেগুলো পড়তাম আর অবাক হতাম। অসম্ভব আনন্দের সাথে দেখছিলাম আমার চোখের সামনেই তিলে তিলে কিভাবে একজন সাহিত্যিকের জন্ম হচ্ছে ! সে মন-ভরে-যাওয়ার অনুভূতি ঠিক বলে বোঝানো যাবে না।

সায়ান অবশ্য প্রায়ই বলতো- "গল্প লেখাটা সহজ, কিন্তু একজন সাহিত্যিকের বোধ ধারণ করে জীবন কাটানোটা কঠিন। খুবই কঠিন !"
"মানে?"
"মানে, টিএসসির ঐদিকে যে পাগলিটা থাকে- ওর ব্যাপারটাই ধর্ ! এই পাগলীকে নিয়ে একটা গল্প লেখা সহজ। মেয়েটা কিভাবে পাগল হলো, পাগল হওয়ার আগে তাঁর জীবন কেমন ছিলো, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলার পর যে তাঁর পরিবার, সমাজ তাঁকে পরিত্যাগ করলো- এসব মিলিয়ে মিশিয়ে একটা কাহিনী তৈরি করা, তারপর সেটাকে সাজিয়ে-গুছিয়ে লিখে ফেলা- ব্যস ! কিন্তু একজন প্রকৃত লেখক শুধু পাগলীর কাহিনীই লিখবেন না, বরং তাঁর ঐ জীবনটাকে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করবেন। পাগলীর দুঃখে দুঃখিত হবেন, তাঁর আনন্দে আনন্দিত...... সহজ কথায়- তোকেও ঐ পাগলীর জীবনটা যাপন করতে হবে। যদি সত্যি সত্যিই সেটা কেউ পারে, তাহলেই সে হয়ে উঠবে একজন প্রকৃত সাহিত্যিক…..." সায়ান বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের মত করে বোঝাতো। ততক্ষণে কলাপাতা সবুজ পাঞ্জাবির এলোচুলের ছেলেটাকে দেখতে দেখতে আমি কখন ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছি ! ওর সব কথা বোধহয় কানেও ঢুকতো না আমার।

"কি রে আলো, শুনছিস ?! হা করে আছিস কেনো?"- হাসিমুখে সায়ানের ঐ কথা শুনে আমার চমক ভাংতো। হঠাতই লজ্জা পেয়ে যেতাম খুব। সে গাঢ় গলায় বলতো তখন- "তোকে লজ্জা পেলে একটু বেশিই সুন্দর লাগে রে। গোধূলির সূর্যের মতন !"

সায়ান আমাকে কেনো এতো ভালোবাসতো, সেটা আমি ঠিক জানি না। সেটা কি আমিও ওকে অসম্ভব ভালোবাসতাম বলে, নাকি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতাম- এ জন্য? কিন্তু এ কথা তো পৃথিবীর তাবত প্রেমিক-প্রেমিকার বেলাতেই প্রযোজ্য। বিশ্বাস না থাকলে আবার ভালোবাসা হয় কেমন করে !

ওর প্রতি অন্ধের মত বিশ্বাস ছিলো দেখেই সায়ানের পতিতালয়ে যাবার ব্যাপারটাতেও আমি মনক্ষুণ্ণ হই নি। সায়ান আমাকে বলেছিলো- ও জীবনকে আরো গভীরভাবে বুঝতে চায়। হাসপাতাল কিংবা প্রকৃতির মত পতিতালয়ও নাকি মানুষের অনেক বড় শিক্ষক। আমাদের মধ্যে বোঝাপড়া এতোটাই ভালো ছিলো যে- সায়ানের কখনো আমাকে মুখফুটে বলতে হয় নি, কিন্তু আমি নিশ্চিত ছিলাম যে ও কখনো আমার বিশ্বাসের অমর্যাদা করবে না। ঠিক, হয়েছিলোও তাই। ফার্মগেটের যে পাড়াটায় সায়ান প্রতি শনিবারে যেতো, ওখানকার একটা মেয়েকে ও নিয়ে এসেছিলো একদিন। টিএসসিতে আমার ঐ মেয়ের সাথে পরিচয় হলো……

মেয়েটার নাম ছিলো বেলি। বিদায় নেয়ার আগে আমার সাথে একান্তে বেলি কয়েকটা কথা বললো। সম্ভবত কথাগুলো চরিত্রগতভাবে শুদ্ধ যে কোনো পুরুষের বেলাতেই প্রযোজ্য। মেয়েটা বলেছিলো-"আমাগোর ঐহানে অনেক ব্যাডামানুষ যায়, কিন্তু ভাইজানের মত এমন লোক আর দেহি নাই। আপনের কথা অনেক গল্প করছেন উনি আমার সাথে। আর আমারে ভোগ করা তো দূরের কথা, শরীলের দিকে খারাপ নজরেও চায় নাই কখনো। খালি আমার গল্প হুনতে চাইতো, বুঝলেন ! প্রথমদিন আমি ভাবছিলাম পাগল......" বেলি হাসতে হাসতে বললো। আমি দেখলাম- হাসির মধ্যেই ওর চোখে পানি।

মেয়েরা অনেক কিছু বুঝতে পারে। আমিও বুঝেছিলাম। বুঝেছিলাম- বেলি মিথ্যা করে কিছু বলে নি। সত্যিই সায়ান অমনই ছিলো। একটু পাগলাটে, কিন্তু অসম্ভব চরিত্রবান !

বেলি চলে যাবার পরও আমি আর সায়ান অনেকক্ষণ টিএসসিতে বসে রইলাম। দেশ থেকে কূপির বাতি প্রায় উঠে গেলেও ওখানকার কিছু ক্ষুদ্র দোকানি এখনো কূপির আলোয় সিদ্ধ ডিম, চা-সিগারেট আর বাদামবুট বিক্রি করে। কি রহস্যময় লাগে ছোট্ট একটু জায়গা কূপির বাতির লালচে লালচে আলোয় ! ওদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে খুব আনমনা হয়ে উঠেছিলো সায়ান। আমি ওর কাঁধে আলতোভাবে হাত রাখার পর বললো- "জীবনটাকে আমরা আসলে প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে দেখি। যেমন বেলি মেয়েটার কাছে জীবনের যে রূপ, আমার কাছে তা নয়। একইভাবে টিএসসির ঐ চুড়িওয়ালির কাছে জীবনের সংজ্ঞা আর তোর কাছে জীবনের সংজ্ঞা- দু'টো এক হবে না কখনো ! অথচ মৌলিকভাবে আমরা সবাই একটা জীবনই যাপন করছি আসলে। ক্ষুধা, ভালোবাসা, সঙ্গম আর মৃত্যুময়। কি অদ্ভুত না ব্যাপারটা !"

সায়ানের মন খারাপ দেখলে আমারও মন ভীষণ খারাপ হয়ে যেতো। আমি ওকে নীচু গলায় বললাম- "একদিন বেলি মেয়েটার পুরো গল্প আমাকে বলবি !"

"আমার খুব ভয় লাগে, আলো! মনে হয়- বাবার অত্যাচারে আমার বোনটাও যদি কোনোদিন বাসা থেকে পালিয়ে এরকম একটা বেশ্যালয়ে গিয়ে ওঠে !"

আমার ডাকনাম ছিলো নূর, কিন্তু সায়ান আমাকে আলো নামে ডাকতো। বলতো- "আমার জীবনে অনেক অন্ধকার, জানিস! বহুদিন পর তোর মত এমন একটা আলোর সন্ধান পেয়েছি !"

সায়ান ওর জীবনের যে অন্ধকারের কথা বলতো, তারই বোধহয় এক চূড়ান্ত রূপের দেখা পেয়েছিলো সেবার শ্রাবণে। ঐদিন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ৩য় বর্ষের শেষ দিকে সায়ানের মা আত্মহত্যা করলো। যে ছেলেটা দিনের পর দিন জীবনঘনিষ্ঠ গল্পের খোঁজে ঘুরে বেড়াতো, সেদিন তাঁর ঘরেই জন্ম হলো এক রূঢ়-কঠিন গল্পের। আমি অবশ্য আগে থেকেই জানতাম সায়ানের বাবা ওর মাকে খুব অত্যাচার করে। ততদিনে আমি ছেলেটার অন্যরকম ঘনিষ্ট একজন হয়ে উঠেছিলাম। সায়ান আমার সাথে সবই শেয়ার করতো- ওর এবিউসিভ বাবা, দুঃখী মা আর একমাত্র বড় বোনের কথা...... মাঝে মাঝে দেখতাম সে অসম্ভব মন খারাপ করে বসে আছে। আমিই তখন খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জানতে চাইতাম ওর কাছে- "কি রে, মন খারাপ?"

সায়ান কিছু বলতো না। আমি নরম গলায় বলতাম- "আমার সাথে শেয়ার করা যাবে?"

সায়ান আমাকে নিয়ে শহীদুল্লাহ হলের পুকুর পাড়ে চলে যেতো তখন। পুকুরে ঢিল মারতে মারতে শোনাতো কাল রাতে কিভাবে ওর বাবা মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছে। কিভাবে ওর মায়ের গায়ে হাত তুলেছে ক্রমাগত......অন্যসময় যে পুকুর আর তাঁর চারপাশের নারকেল গাছের ঝিরঝিরি সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতাম আমরা, সায়ানের গল্প শুনতে শুনতে ঐ পুকুরেরই সবুজ ঢেউগুলোকে কালচে লাগতো আমার। মনে হতো যেনো অশুভ। যেনো সায়ানের মনের অস্থিরতাই তরঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে……

"আমি হয়তো কোনোদিন আমার বাপকে খুন করে ফেলবো......"- সায়ান পুকুরে ঢিল ছুড়তে ছুড়তে বললো। আমি দেখতাম ও খুব সাবধানে ওর চোখের পানি লুকাচ্ছে।

সে সময়গুলোতে কি যে হতো আমার ! খুব ইচ্ছে করতো সায়ানকে জড়িয়ে ধরি। পারতাম না শুধু সামাজিক কারণে। আমাদের দেশে এখনো একটা মেয়ে একটা ছেলেকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরতে পারে না। জনসমক্ষে তো নয়ই। আমারো তাই মন খারাপ হয়ে যেতো তখন, সেটা কি সায়ানের দুঃখে কাতর হয়ে নাকি ছেলেটাকে উপযুক্ত সান্ত্বনা দিতে না পারার বেদনায়- সেটা ঠিক জানি না! "তোর বোনের জন্য যে বিয়ের একটা সম্বন্ধ এসেছিলো,তার কি হলো?"- আমি প্রসঙ্গ ঘোরাবার চেষ্টা করতাম।

তবে সায়ান যেদিন এসে কাঁদতে কাঁদতে ওর মায়ের মৃত্যুসংবাদটা জানালো, সেদিন ঠিকই আমি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। ছেলেটা ক্লাসে আসছিলো না দুই-তিনদিন যাবত। আমি ফোন দিচ্ছিলাম বারবার, কিন্তু ধরে নি। আমার মনে আছে- বর্ষার খুব এক মন খারাপ করা বিকেল ছিলো সেটা। খুব দমবন্ধ দমবন্ধ লাগছিলো কেনো জানি। আমি ল্যাব শেষ করে একা একাই টিএসসির সড়দ্বীপের ওপর গিয়ে বসলাম। ওখানে প্রায় বিকেলে আমি আর সায়ান সাহিত্য নিয়ে কথা বলতাম। কখনো কাফকা, কখনো জীবনানন্দ…… সেদিন অবাক হয়ে দেখি, আমার আগেই সায়ান ওখানে গিয়ে বসে আছে। মাথা নীচু করে ছিলো তাই আমাকে দেখতে পায় নি। ওকে দেখেই আমার মনের সব মেঘ কেটে গেলো। তখনো জানতাম না যে- সায়ানের মা আত্মহত্যা করেছে, তাই দুষ্টু মেয়েদের মত ভাবছিলাম- চুপি চুপি ওর পেছনে গিয়ে ওকে ভয় দেখাই......

আমরা সেদিন অনেকক্ষণ ঐ একই জায়গাতে বসে ছিলাম। খুব কাঁদছিলো সায়ান। প্রথম সন্ধ্যায় বাতাস ভারী করে তুমুল বৃষ্টি নামলো। ছাত্রছাত্রীরা সব হৈ চৈ করতে করতে কেউ গিয়ে আশ্রয় নিলো টিএসসি ভবনে, কেউ বা ডাস এ। শুধু আমি আর সায়ান যেখানে ছিলাম, ওখানেই বসে রইলাম চুপচাপ। আমার কাছে একটা ছাতা ছিলো, কিন্তু ঘটনার আকস্মিকতায় সেটা খুলতে ভুলে গিয়েছিলাম আমি। সায়ান একসময় কাঁপা কাঁপা গলায় বললো- "আমার মায়ের কবরটা বোধহয় ভেসে যাচ্ছে......"

"মায়ের কবরের কাছে যেতে ইচ্ছা করছে ? চল্ আমি যাবো তোর সাথে……"

সেই তুমুল বর্ষণমুখর সন্ধ্যায় আমি আর সায়ান আজিমপুর গোরস্থানের দিকে রওনা হলাম। ওখানে পৌছুতে পৌছুতে অবশ্য বৃষ্টি থেমে গেছিলো ততক্ষণে। রাস্তার এলইডি আলোগুলো চকচক করছিলো নতুন ধোঁয়া পাতার মতন। সায়ান ওখানকার তত্বাবধায়কের সাথে কবরটাকে আরেকটু পোক্ত করার ব্যাপারে কথা বললো। কথা শেষে মায়ের মায়ের কবরটা জিয়ারত করে এলো ভেতরে গিয়ে। মেয়েদের কবরের কাছে যাবার নিয়ম নেই, তাই আমি দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম সেদিন। রিকশায় ফিরতে ফিরতে সায়ান পুরোটা রাস্তা আমার হাত ধরে ছিলো শক্ত করে। আমি একটু পরপর ওর পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলাম, যদিও জানতাম- ক্ষতটা ছিলো ওর মনে !

ততদিনে অবশ্য আমি নিজেই অন্যরকম একটা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার আব্বু খুব প্রভাবশালী আর টাকাওয়ালা একজন মানুষ ছিলেন। তিনি কোনোভাবে সায়ানের কথা জেনে গেলেন। কেউ তাঁকে বলেছিলো- আমি এমন একটা ছেলের সাথে মেলামেশা করছি, যে কি না পতিতালয়ে যায়। যার বাবা একজন মদ্যপ এবং পরোক্ষভাবে নিজের স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য দায়ী। একদিন তাই ডিনারের পর আমাকে ডেকে বললেন-
"মামণি, সায়ান ছেলেটার সাথে তোমার সম্পর্কটুকু যেনো স্রেফ বন্ধুত্বের পর্যায়েই থাকে। এর বেশি যেনো না যায়, কেমন !"

"আব্বু, আমি আসলে ওকে খুব পছন্দ করি। যদি কাউকে জীবনসঙ্গী করতে হয়, তবে আমি ওকেই......"- সম্ভবত সায়ানের প্রতি গভীর ভালোবাসা আমাকে তখন খুব বেশরম করে তুলেছিলো। আমি নির্দ্বিধায় আব্বুকে আমার মনের কথাটা বলে ফেললাম।

"দেখো নূর! তোমার মা মারা যাবার পর থেকে আমি খুব কষ্ট করে তোমাকে বড় করেছি। তোমার অযত্ন হবে, এই ভয়ে আরেকটা বিয়ে পর্যন্ত করি নি। অথচ আমার তো কোনোও অভাব ছিলো না। চাইলেই আমি সেটা করতে পারতাম !"

আমি ছলোছলো চোখে আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তিনি বলে চললেন- "পিতামাতা কখনো সন্তানের অমঙ্গল চায় না রে মা। তুমি যদি সায়ানকে বিয়ে করতে চাও, তাহলে জোর করে তো আর তোমাকে আমি আটকাতে পারবো না, কিন্তু মনে রেখো- এতে ভীষণ কষ্ট পাবো আমি। ভীষণ !"

আমি সায়ানকে ভালোবাসি সত্যি, কিন্তু সেই ভালোবাসা যে এভাবে আমার আব্বুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাবে- সেটা কখনো ভাবি নি। হ্যাঁ, আব্বুকে কষ্ট দেয়াটাও সম্ভব হবে না আমার পক্ষে। তো এখন তাহলে উপায় ! কাঁদতে কাঁদতে টানা দুই রাত আমার ঘুম হলো না।

আমাকে সেই জটিলতা থেকে অবশ্য মুক্তি দিয়েছিলো সায়ান নিজেই । লেখক হতে চাওয়া ছেলেটা হঠাতই একদিন খুনী হয়ে উঠলো। খুন করলো নিজের পিতাকে। অবশ্য হঠাৎ খুন- একথা বলাও বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। ক্ষোভটা আসলে অনেকদিন ধরেই জমে উঠছিলো ওর বুকের ভেতর। তারপরো যে সায়ান সত্যি সত্যি একদিন নিজের বাবাকে মেরে ফেলবে- তা ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করি নি......

ততদিনে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় পাশ করে বেরিয়ে গেছি। তারপরো সায়ানের সাথে আমার দেখা হতো প্রায়ই। শেষের দিকে সায়ান খুব আনমনা হয়ে উঠেছিলো, ঠিক ওর প্রিয় লেখক বিভূতিভূষনের মত।

"ইদানিং বাবা নতুন ঝামেলা শুরু করেছে বাসায়। আপাকে বুড়া ধামড়া এক লোকের কাছে বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছে......"

আমি কিছু বলার না পেয়ে চুপচাপ হাত রাখলাম ওর হাতের ওপর। অনেক সময় কথা না বলেও মানুষকে গভীরতর সান্ত্বনা দেয়া যায়।

"মনে হয়, বড় অংকের টাকা পেয়েছে লোকটার কাছ থেকে!"- কিছুক্ষণ চুপ থেকে সায়ান নিজেই আনমনে বলতো আবার।

আমি- "আজকাল কি লিখছিস? একটা উপন্যাস লেখার কাজে যে হাত দিয়েছিলি, ওটা......"- ইত্যাদি বলে বলে প্রসঙ্গ পাল্টাতাম।

সায়ান অবশ্য এ কথা শুনে নির্জীব চোখে কিছুক্ষণ তকিয়ে ছিলো আমার দিকে। তারপর হঠাৎ কেঁদে ফেললো অসহায়ের মত। কাঁদতে কাঁদতেই বললো- "আমি অনেকদিন কিছু লিখতে পারছি না আলো! অ-নে-কদিন। আমার রাতে ঘুম হয় না, জানিস !"

আমি মনে মনে বললাম- "আমারো ঘুম হয় না। কিন্তু সেটা তোকে হারিয়ে ফেলবার ভয়ে।"

তবে শেষ যেদিন সায়ানের সাথে দেখা হয়েছিলো, ওকে খুব উৎফুল্ল লাগছিলো কেনো জানি। আমাকে ঝলমলে গলায় বললো- "কাল রাতে টানা লিখেছি অনেকক্ষণ। দোয়া করিস। উপন্যাসটা শেষ করতে পারলে খুব বড় একটা কাজ হবে!"

কি যে ভালো লাগছিলো আমার সেদিন! অনেকদিন পর টিএসসিতে আমরা আবার সাহিত্য নিয়ে গল্প করলাম। "খোয়াবনামার" জন্য আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে নোবেল না দিয়ে নোবেল কমিটি যে নিজেই বঞ্চিত হয়েছে, "শূণ্য" যে হুমায়ূনের খুব আন্ডাররেটেড একটা উপন্যাস, কিংবা সবাই বিভূতিভূষনের "পথের পাঁচালী" নিয়ে মাতামাতি করলেও "দৃষ্টি-প্রদীপের" মত একটা মাস্টারপিসও যে উনি লিখে গেছেন- এসব নানা কথা। একসময় বকবক করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লো ছেলেটা। আমরা দু'জনে দু'কাপ মরিচ চা খেলাম।
এর পরদিনই নাকি সায়ান বটি দিয়ে কুপিয়ে ওর মদ্যপ বাবাকে হত্যা করে।

আব্বুই প্রথমে দিয়েছিলো খবরটা। আমি আগেই বলেছি- আমার আব্বুর অসম্ভব ক্ষমতা। অবশ্য টাকাওয়ালা মানুষদের দুনিয়াজোড়াই প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি, আব্বুও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না আসলে। আব্বু আমাকে জরুরি ভিত্তিতে নিজের অফিসে ডেকে পাঠিয়েছিলো সেদিন। তারপর নীচু গলায় বললো- "সায়ান খুনটা রাগের মাথায় করেছে। ওর বাবা নাকি মোটা টাকা বিনিময়ে নিজের মেয়েকে একটা লম্পটের সাথে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছিলেন। আমি খবর নিয়ে দেখেছি, লোকটা আসলেই খারাপ। নারী পাচারকারী একটা দলের সাথেও যোগাযোগ আছে তার। সম্ভবত নিজের বোনের এমন পরিণতি সায়ান মেনে নিতে পারে নি। তাই......"

আমি শুধু শূণ্য চোখে আব্বুর কথাগুলো শুনছিলাম। মনে হচ্ছিলো- অনেক অ-নে-ক দূর থেকে আব্বু বুঝি আমার সাথে কথা বলছে ।

"তুমি কি আমার কথা শুনছ, নূর! সায়ানকে পুলিস খুঁজছে। আমি ওকে বর্ডার পার করে দিতে পারি, সেক্ষেত্রে ও বেঁচে যাবে। তবে একটা
শর্ত আছে আমার...... ছেলেটাকে তুমি ভুলে যাবে, এবং ওর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখা চলবে না। ওকে ? !"

আমি এবারও কিছু বললাম না। আব্বু অসহিষ্ণু গলায় বললো- "যা বলার তাড়াতাড়ি বলো। উই ডু নট হ্যাভ অল ডে।"

সত্যিই তো, অনন্তকাল সময় তো নেই আমার হাতে। যা বলবার তাড়াতাড়ি বলতে হবে! কিন্তু কি বলবো আমি ?! কি হবে সায়ানের? ইশ, আমার সায়ান ! বেচারা স্রেফ একজন লেখকই তো হতে চেয়েছিলো !!

[শেষ কথা]

আমি আব্বুকে দেয়া আমার কথা রেখেছিলাম। আর কখনো যোগাযোগ করার চেষ্টা করি নি সায়ানের সাথে। সবকিছু ছেড়ে ছুড়ে একবার বিদেশ চলে যাবো ভাবলাম, কিন্তু আব্বুর জন্য পারলাম না। বেচারার বয়স হয়েছে, আমি বাইরে চলে গেলে একদম একা হয়ে যাবে মানুষটা। তাই এখনো ঢাকাতেই আছি। বাচ্চাদের একটা স্কুলে চাকরি জুটিয়ে নিয়েছি। সময় বেশ কেটে যাচ্ছে এভাবে……

শুধু মাঝে মাঝে যখন খুব অস্থির লাগে, তখন টিএসসিতে চলে যাই। একা একাই বসে ওখানকার তরুণ-তরুণীদের খুনসুটি দেখি। আচ্ছা, ওদের মধ্যে উষ্কখুষ্ক চুল, কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্ন চোখের এমন কোনো ছেলে কি আছে- যে কি না একজন লেখক হতে চায় ! যে তাঁর প্রেমিকাকে গল্প শুনিয়ে বেড়াচ্ছে কাফকা, ইলিয়াস অথবা বিভূতিভূষণের ...... কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে তাঁর ভালোবাসার মানুষটিকে বলছে- "লজ্জা পেলে তোকে অদ্ভুত সুন্দর লাগে, জানিস। গোধূলির সূর্যের মতন !" ?!

অঘ্রাণের বিকেল নীল নীল হয়ে আসে। ওদিকে মন্টু, সাদেক আর শাহজাহানরা নিজেদের বুট, ডিম আর চা-সিগারেটের ভ্রাম্যমান দোকানের মাথায় কূপির বাতি লটকে দিতে থাকে একের পর এক। আমি ওদের থেকে একটু আলো ধার নিয়ে সায়ানের প্রিয় উপন্যাসটা খুলে বসি। কূপির হলুদ-কমলা রঙ আমাকে রহস্যের জগতে নিয়ে যায় দ্রুতই। তবে একনাগাড়ে বইয়ের ভেতর ডুব দিয়ে থাকতে পারি না, শুধুই সায়ানের চেহারা ভাসতে থাকে আমার চোখে সামনে। মনে হয় বুঝি- ছেলেটা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে হাসছে।

আমি জোর করে আবার মনোযোগ বইয়ের ভেতরে আনার চেষ্টা করি। কাঁদতে কাঁদতেই উপন্যাসের বহুল পঠিত অংশটুকুই পড়ে যাই আবারো-

"......মালতীও চলে গিয়েছে কতদিন হ'ল, পৃথিবী ছেড়ে কোন প্রেমের লোকে, নক্ষত্রদের দেশে, নক্ষত্রদের মতই বয়সহীন হয়ে গিয়েছে।
কেবল মাঝে মাঝে গভীর ঘুমেরমধ্যে তার সঙ্গে দেখা হয়। সে যেন মাথার শিয়রে বসে থাকে। ঘুমের মধ্যেই শুনি, সে গাইছেঃ

"মুক্ত আমার প্রাণের মাঠে
ধেনু চরায় রাখাল কিশোর
প্রিয়জনে লয় সে হরি
ননী খায় সে ননীচোর।"

সেই আমার প্রিয় গানটা...... যা ওর মুখে শুনতে ভালোবাসতুম।

চোখাচোখি হ'লেই হাসি হাসি মুখে পুরনো দিনের মত তাঁর সেই ছেলেমানুষি ভঙ্গিতে ঘাড় দুলিয়ে বলছে- পালিয়ে এসে যে বড় লুকিয়ে আছো? আখড়ার কত কাজ বাকী আছে মনে নেই?

তখন আমার মনে হয় ওকে আমি খুব কাছে পেয়েছি। দ্বারবাসিনীর পুকুরপাড়ের কাঞ্চনফুল তলার দিনগুলোতে তাঁকে যেমনটি পেতুম, তার চেয়েও কাছে। গভীর সুষুপ্তির মধ্যেই তন্দ্রাঘোরে বলি- সব মনে আছে, ভুলি নি মালতী। তোমার ব্যথা দিয়ে, ব্যর্থতা দিয়ে তুমি আমাকে জয় করেছো। সে কি ভোলবার?"

***
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০২১ রাত ৯:৪৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার প্রফেশনাল জীবনের ত্যাক্ত কথন :(

লিখেছেন সোহানী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সকাল ৯:৫৪



আমার প্রফেশনাল জীবন বরাবরেই ভয়াবহ চ্যালেন্জর ছিল। প্রায় প্রতিটা চাকরীতে আমি রীতিমত যুদ্ধ করে গেছি। আমার সেই প্রফেশনাল জীবন নিয়ে বেশ কিছু লিখাও লিখেছিলাম। অনেকদিন পর আবারো এমন কিছু নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×