somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ "কুয়াশা রবে না আর....."

২৪ শে জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[ গল্পটা প্রাপ্তবয়স্ক ও প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ]
==========================
শোভা যখন আমাকে ওর ভয়ংকর সংগ্রহশালাটাকে দেখালো, তখন ওর সাথে আমার পরিচয়ের তিন বছর চলছে। ও মানুষকে ধরে ধরে তাঁদের যৌনাঙ্গ কেটে ফেলতো, তারপর সেগুলোকে সংরক্ষণ করতো ফরমালিনে ডুবিয়ে..

অথচ যৌবন তাঁর সমস্ত সৌন্দর্য নিয়ে বিকশিত হওয়ার সময়ে থেকেই শোভাকে আমি চিনতাম। অত্যন্ত অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে ছিলো ও। শহরের অভিজাত এলাকায় ওদের ফ্ল্যাট হলেও মেয়েটা বাস করতো গাজিপুরের বিশাল রিসোর্টটাতে। শুনেছি রবীন্দ্রনাথের বাবা নাকি ছেলেকে স্কুলে না পাঠিয়ে বাসায় শিক্ষাদীক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। শোভার পিতাও এক অর্থে এই সময়ের জমিদার ছিলেন, সুতরাং আমার মত দু' চারজন শিক্ষককে কিনে নেয়া তাঁর জন্য ডালভাত বললেও কম বলা হতো। বিশেষত আমরা যারা দারিদ্র্যের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েও পড়ালেখা চালাতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলাম, যাদের নিজেদের ব্যক্তিগত খরচ যোগানোর পাশাপাশি ঐ বয়েসেই বাড়িতে টাকা পাঠানোর মত দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে হয়েছিলো সময়ের আগেই, তাঁদের জন্য শোভার মত দু'একজন ছাত্র পেয়ে যাওয়াটা আশীর্বাদ ছাড়া ভিন্ন কিছু ছিলো না তখন। এটা ঠিক- ওদের পরিবারের অনেক কিছুই আমার নিকটে খুব অস্বাভাবিক বলে মনে হতো , কিন্তু প্রশ্ন করতাম না টিউশনি চলে যাওয়ার ভয়ে। তাছাড়া যে আমি এক অতি নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে এসেছিলাম, তাঁর কাছে এরকম উচ্চবিত্তদের কর্মকান্ড রহস্যময় মনে হওয়াটাই তো স্বাভাবিক - এ যুক্তিতে শোভার ব্যাপারে, শোভার পরিবারের ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ করে দিলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যায়ের এক কিংবা সর্বোচ্চ দু'টো বিষয় পড়ানোর বিনিময়ে মাসে পনেরো হাজার টাকা পেয়ে যাওয়টা সামান্য বিষয় ছিলো না আমার জন্য, তাই যে কোনো মূল্যে চাকরিটুকু টিকিয়ে রাখাই মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে উঠেছিলো আমার কাছে ....

অবশ্য শোভার পরিবার বলতেও তেমন কেউ ছিলো না আসলে। মেয়েটা তার গৃহকর্ত্রীর কাছে মানুষ। মা মারা গেছিলো একদম ছোটবেলায়। মেয়ের অযত্ন হবে ভেবে শোভার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন নি। আপনারা অন্য কিছু ভাববেন না তাই বলে, শোভার বাবা খুব উন্নত চরিত্রের এক মানুষ বলে সুনাম ছিলো সবার মাঝে। ওদের গ্রামেও বাসিন্দারা একবাক্যে ভদ্রলোকের প্রশংসা করতো। তাঁর সাথে আমার জীবনে মাত্র কয়েকবার দেখা হয়েছে বলে ওসব কথার সত্যতা যাচাই করতে পারি নি, তবে যদি কেউ সন্তানকে দেখে তাঁর পিতার চরিত্রটুকু আঁচ করতে বলে, তবে আমি নিঃসন্দেহে শোভার বাবাকে হায়েস্ট গ্রেড দিতাম, কেননা ওর সেই ভয়ংকর সংগ্রহশালাটা দেখানোর আগ পর্যন্ত শোভাও আমার কাছে ছিলো অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, জ্ঞানী আর ভাবুক একটা মেয়ে। শোভাকে আমার কাছে টলটলে কোনো দীঘি বলেই মনে হতো, যার স্থির নিভৃতি দীঘিটাকে আয়নার সৌন্দর্য দিয়েছিলো....

তবে সময়ের সাথে সাথেই শোভা আরো চুপচাপ হয়ে গেছিলো হঠাৎ । ওর কোনো বন্ধুবান্ধব আছে বলেও শুনি নি, অথচ এতো সুন্দর এক মেয়ের পেছনে ছেলেদের লাইন লেগে যাওয়ার কথা। টানা চোখ আর চিকন থুতনির শোভাকে কিছুটা প্রাচ্যদেশীয় নারীদের মত দেখাতো। মাঝে মাঝে মনে হতো- যেনো চীনদেশীয় কোনো অতীত, অভিজাত রাজকন্যার পুনরুত্থান ঘটেছে শোভার মধ্য দিয়ে। গোলাপি মধুমালতীর মত ঠোঁটের নীচে বামপাশে একটা তিল ছিলো ওর, দেখে ভ্রান্তি জন্মাতো যেনো কালো ভ্রমর এক ফুলের বাগান ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষা করছে অনন্তকাল ধরে। তবে মানুষের চেহারা কখনোই দীর্ঘমেয়াদে অন্যের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে না, তাঁর নাগাল বড়জোড় মানুষের ইন্দ্রিয় অবধি। বরং মন জয় করে গল্প। শোভাও তাঁর ভালোবাসা, তাঁর স্বপ্ন-সাধ-প্রেম এসবের কাহিনী বলে আমার মন জয় করে নিয়েছিলো.... আমরা প্রতি সপ্তাহে এক দিন গল্প করার জন্য রাখতাম, সেদিন পড়াশোনা বাদ দিয়ে শোভাদের বিশাল এস্টেটের মত বাড়ি, বাগান, বন ঘুরে বেড়াতাম গল্প করতে করতে। ক্লান্ত হয়ে মাঝে মাঝে বসতাম ওদের ওয়াক-ওয়ের পাশে মার্বেল পাথরে বাধানো বেঞ্চের ওপর দু'জন। পাশাপাশি....

শোভার জীবনে প্রথম ভালোবাসা ছিলো ওর মা। শুনেছিলাম, ওর মা-ও নাকি নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা। শোভা বারবার ওর বাবা আর মায়ের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে বলতো। খুব নাকি ভালোবাসাময় আর উথালপাথাল প্রেম ছিলো ওদের। "ছেলেমেয়েরা নাকি তাঁর বাবামায়ের স্বভাব পায়, আমি বোধহয় ভালোবাসার ক্ষমতাটুকু পেয়েছি ওদের কাছ থেকে। বিভূতিভূষণের একটা কথা আছে জানেন স্যার, তীব্র ভালোবাসা নাকি একদমই সহজলভ্য কোনো বস্তু নয়। গভীরভাবে ভালোবাসার জন্যও নাকি প্রতিভা থাকা লাগে..."- শোভা পবিত্র চোখ আর শিশুদের মত দৃষ্টি উজাড় করে করে শোনাতো !

সত্যি ওর সে প্রতিভা ছিলো। একটু বেশিমাত্রাতেই বলা যায়। টিনেজ বয়সে ও নাকি একজনকে ভালোবেসেছিলো সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে। তখন এম্নিতেই মানুষের আবেগ অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তবে শোভা যে কেবল ঝোঁকের বশেই এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো, এ আমি নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি না। ঝোঁকের বশে সিদ্ধান্ত নেয়া হলে এতো বছর পর এসেও ঐ মানুষের কথা বলার সময় তাঁর গলার স্বর কেঁপে কেঁপে উঠতো না, চোখ ভিজতো না জলে। ভেজা চোখের শোভাকে আমার বড় অসহায় লাগতো দেখতে। মনে হতো- জবুথবু বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় এই শহরের বিষণ্ণ, নির্জন কোনো পথ বুঝি ও...

আমি বুঝতাম না কেনো একজন ছেলেকে শোভার মত অমন শান্ত, মায়ামায়া এক সঙ্গিনীকে ছেড়ে যেতে হবে ?! অবাকই হয়েছিলাম প্রথম প্রথম ঐ গল্প শুনে। তবে পরক্ষণেই মনে হলো- শোভার অনুভূতি হয়তো কৈশোরের ভেসে যাওয়া আবেগ না হতে পারে, কিন্তু তাঁর ভালোবাসার মানুষের বেলায় ব্যাপারটা হয়তো ভিন্ন। ঐ ছেলে হয়তো সাময়িক আবেগের বশেই শোভাকে ভালোবেসেছিলো। শত হলেও ১৪/১৫ বছরের একজন মানুষ ভালোবাসার বা বোঝেই কি?

আমি ঠিক জানি না, প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হবার কারণেই শোভার মধ্যে নিষ্ঠুরতা জন্ম নিয়েছিলো কি না। তবে মেয়েটা ভীষণভাবে ভেঙ্গে পরলো। আগে থেকেই শান্তশিষ্ট চুপচাপ ধরণের মানুষ ছিলো সে, তখন কথাবার্তা বলা আরো কমিয়ে দিয়েছিলো নাকি ! শোভা বলতো- "ভাগ্য ভালো তখনই বাবা আপনাকে আমার টিচার হিসেবে নিয়োগ দিলেন। আমি কথা বলার একটা মানুষ পেয়েছিলাম তাই। সেটা না হলে বোধহয়... আমি জানি না স্যার, বোধহয়.... আত্মহত্যা করতাম।"

আগেই বলেছি, গল্প করতো শোভা আমার সাথে। ওর মায়ের গল্প। বাবার গল্প। মা নাকি প্রতি রাতে তাঁকে রূপকথা শুনিয়ে ঘুম পাড়াতো ছোটবেলায়। বাবা প্রতিদিন অফিস থেকে আসার পথে হাওয়াই মিঠাই কিনে আনতো, কেননা হাওয়াই মিঠাই খুব পছন্দ ছিলো মেয়েটার। তাঁর যখন সাত বছর বয়স তখন মায়ের ক্যান্সার ধরা পরলো। টাকাপয়সার অভাব ছিলো না শোভাদের, পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্যান্সার হাসপাতালেই ট্রিটমেন্ট হয়েছিলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। মাত্র এক বছরের মাথায় শোভার মা মারা গেলেন। জীবনে প্রথমবারের মত একাকীত্বের দেখা পেতে শুরু করলো মেয়েটা...

সে একাকীত্ব দূর করতে যে মানুষটা নিজের অজান্তেই ভূমিকা রেখেছিলো, সে-ই ছিলো শোভার প্রেমিকা। জ্বি, আমি ভুল লিখি নি ! শোভা আর মুক্তারা পাশাপাশি বিল্ডিং এ থাকতো। মুক্তার মা খুব আদর করতেন শোভাকে, অল্পবয়সে এতিম হওয়ার শোক ভোলাতে চাইতেন নিজের মাতৃত্বকে প্রসারিত করার মাধ্যমে। মুক্তাও ওর মা'র মত হয়েছিলো। ছোট্ট বুকেই বন্ধুর জন্য এক সাগর ভালোবাসা জমা করলো। প্রাকৃতিক নিয়মেই শৈশবের সে ভালোবাসা কৈশোরে পৌঁছে যৌনতার ছায়া ধারণ করতে থাকে দ্রুত, ভালোবাসা পালটে গেলো প্রেমে... তখনই শোভার জীবনে ২য় ধাক্কাটা আসতে থাকে কুৎসিত মাকড়সার মতন। বিরল এক মেডিক্যাল কন্ডিশনে ছেলে থেকে মেয়েতে রূপান্তর ঘটতে থাকে শোভার। শোভন নামের যে ছেলেটা জন্ম নিয়েছিলো মার্চের ১৭ তারিখে, সে সতেরো বছর এক মাসের মাথায় সম্পূর্ণ ছেলে থেকে মেয়েতে পালটে গেলো ..... শোভন হয়ে উঠলো শোভা!

"ঐ ঘটনার পরই মুক্তা আমাকে ছেড়ে চলে যায়। বলে- এমন একজন মানুষকে তাঁর বাবা-মা কিংবা সমাজ কেউই মেনে নেবে না। আমি অনেক বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম । বললাম- আজকাল প্রযুক্তি কত উন্নত হয়েছে ! এসবের অনেক থেরাপি বেরিয়েছে এখন। অপারেশনের মাধ্যমে আমি আবার ছেলেতে পালটে যেতে পারবো, কিন্তু মুক্তা সে সাহস আমার জন্য দেখাতে পারে নি। অবশ্য আমি ওকেও যে পুরোপুরি দোষ দেই- ব্যাপারটা এমন না। ক'জনই বা এমন পরিস্থিতিতে দৃঢ়তা দেখাতে পারবে স্যার, বলেন? ভাগ্যটাকে এমন একজন মানুষের সাথে জড়িয়ে জটিল করে ফেলার থেকে বরং সরে যাওয়া ভালো, বিশেষত পুরো একটা জীবন যেখানে সামনে পরে আছে..."

এরপর থেকেই সেক্স আইডেন্টিটির ব্যাপারে শোভার একটা গভীর বিদ্বেষভাব চলে আসে। তাঁর ধারণা হলো- মানব-মানবীর মাঝে যে সম্পর্ক তৈরি হয়, সেখানে ভালোবাসাটা কেবল উপলক্ষ্য মাত্র, যৌনতাই আসল। সময়ের সাথে কুৎসিত বিকারে আচ্ছন্ন হলো ওর মন, নিজের ভেতরকার ঝড় ভয়ংকর এক দানবের রূপ ধরে বেরিয়ে এসেছিলো একসময়। ছেলেদেরকে প্রেমের আর মেয়েদের চাকরির লোভ দেখিয়ে টেনে নিয়ে আসতো ও তাদের রাজত্বের মত রিসোর্টে। সেখানেই মাত্র চার বছরের ব্যবধানে পাঁচ-পাঁচটা হত্যাকান্ড ঘটিয়েছিলো শোভা। তারপর ভিক্টিমের যৌনাঙ্গ কেটে সংরক্ষণ করলো গোপনে। আমাকে হিসহিস করে বলেছিলো একদিন- "ওগুলো আমি কুকুরকে দিয়ে খাওয়াবো..."

আমি ঠিক নিশ্চিত না- শোভা কেন আমার কাছে এসব প্রকাশ করে দিলো। সম্ভবত ও আমাকে চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতো। অবশ্য শোভার এক বড় নির্ভরতার জায়গা ছিলো ওর বাবার প্রতিপত্তি। আমি ঘটনা ফাঁস করে দিলেও শোভার কিছুই হতো না আসলে, টাকাওয়ালারা সব যুগে, সব স্থানেই নিরাপদ। তবে আমি এ সব শুনে ওদের বাসায় যাওয়াটা পুরোপুরি বন্ধ করে দিলাম। আমার জায়গাতে অন্য যে কেউ হলেও অবশ্য তা-ই করতো। তাছাড়া ততদিনে আমারও একটা স্কলারশিপের অফার চলে এসেছে। শুধু ফ্লাইটের দিন শোভাকে একটা ফোন দিলাম বিদায় নেয়ার জন্য। কেন যে দিয়েছিলাম ঠিক জানি না যদিও, মানুষের মন বড় জটিল ! ওর অচিন্ত্যনীয় নৃশংসতার কথা শুনে, নিজ চোখে ওর বিকারগ্রস্ততার নমুনা দেখার পর মেয়েটার ব্যাপারে ঘৃণা ছাড়া অন্য কোন অনুভূতি ছিলো না আমার, তারপরো দিলাম। শোভা ফোন রিসিভ করে নি যদিও.... একটু খুঁতখুঁত ভাব নিয়েই দেশ থেকে আমেরিকায় উড়াল দিয়েছিলাম সেদিন। কেমন একটা অনুভূতি যেনো হচ্ছিলো, দীর্ঘদিনের পুরনো বাতাস একটা ঘরে আটকে থাকলে যেমন হয়, ওরকম.... শুধু মনে হচ্ছিলো- শোভা মেয়েটাকে আদর দিয়ে ভালোবাসা দিয়ে সুস্থ করে তোলা দরকার। ওর মানসিক বিকার সারিয়ে তোলার জন্য আসলে এমন একজনকে খুব প্রয়োজন, যে শোভাকে বুকে টেনে নেবে আকাশের উদারতায়...

(শেষ কথা)
-----------
বিভূতিভূষণ শোভার পছন্দের লেখক ছিলো। ওর কাছ থেকেই বিভূতিভূষণের একটা পছন্দের উক্তি শুনেছিলাম। মানুষ নাকি অনেক সময় ব্যথা দিয়ে, ব্যর্থতা দিয়ে আরেকজন মানুষকে জয় করে। আমার বেলাতেও তাই হলো সম্ভবত। পিএইচডি করার মাঝামাঝি বিয়ে করার জন্য দেশে আসলাম একবার। এক তোড়া লালগোলাপ নিয়ে শোভাদের বাসায় গেলাম দেখা করবো বলে। এ দীর্ঘ দুই বছরে আমি ভীষণ, ভীষণ টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে কাটিয়েছি। একটা খুনীর ব্যাপারে দুর্বল হয়ে যাওয়াটাকে কোনোভাবেই মানতে পারছিলাম না, কিন্তু ঐ যে বললাম- মানুষের মন বড় জটিল। শোভা তাঁর ব্যথা দিয়ে, তাঁর ব্যর্থতা দিয়ে আমাকে জয় করেছিলো, কিন্তু নিজে থেকে গেলো ধরাছোঁয়ার বাইরে। আমি মেয়েটাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়ার জন্য গিয়ে জানতে পারলাম হরমোনাল জটিলতা সংক্রান্ত কি এক বিরল রোগে আক্রান্ত হয়ে নাকি মারা গেছিলো সে, আমি চলে যাওয়ার এক বছরের মধ্যেই... শোভাদের বাড়ির কেয়ারটেকার আমাকে ওর কবরের কাছে নিয়ে যেতে চাইলো....

আমি ভদ্রলোককে না করি। নিজেই এগিয়ে যাই ওদের বাগানবাড়ির শৈল্পিক, অভিজাত ওয়াক-ওয়ে ধরে। এ রাস্তার অন্যপ্রান্তে টলটলে পানির দীঘি আছে একটা- আমি জানি ! যার স্থির নিভৃতি দীঘিটাকে আয়নার সৌন্দর্য দিয়েছিলো একসময়। দীঘির পূর্ব পাশে শোভার কবরটুকু আমি নিজেই খুঁজে খুঁজে বের করলাম। কার্তিকের হিম হিম বিকেল তখন বুড়ো হয়ে এসেছে। ওদিককার আমবাগান, পেছনে দীঘির জল কিংবা দূর দিগন্তে গাজিপুর অরণ্যের হাতছানি- সবজায়গায় শুধু বিষন্নতা আর বিদায়ের সুর। আমার তখন অদ্ভুত একটা কথা মনে হলো- আচ্ছা, এই যে মেয়েটা আমার এতো কাছে শুয়ে আছে, কিন্তু তারপরো ধরাছোঁয়ার কি বাইরে ! আমি যেনো এক ভ্রমর হয়ে ফুলের বাগান ছোঁয়ার অপেক্ষায় আছি কত অনন্তকাল ! অতীতের বহু স্মৃতি ফ্ল্যাশ ফ্লাডের মত ভেসে আসতে থাকে হঠাৎই- শোভার সাথে ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটা, ওর গল্প বলার ভঙ্গি... আহা ! মেয়েটাকে আমি তবে আপন করে পেলাম না আর ! সে জানতে পারলো না- একজন মানুষ সত্যি সত্যি তাঁর অপেক্ষায় ছিলো কত আদরমাখা আন্তরিকতায় !

সেই দু'টো পবিত্র চোখ, শিশুসুলভ চাহনি আর মায়ামায়া শরীরের দৃশ্য ভেসে উঠতে থাকে অস্পষ্ট ছবির মতন, কেন জানি গভীর আবেগে চোখ দু'টো ভিজে আসে নিমিষে। কানে ফিসফিস করে বাজতে থাকে আনা ফ্র্যাংকের বিখ্যাত সেই উক্তি- "মৃত মানুষেরাই জীবিতদের চেয়ে ফুল উপহার পায় বেশি..."

আমি চোখ মুছতে মুছতে গাঢ় গলায় আবৃত্তি করলাম-

"...নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়,
জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয়
কী নিয়ে থাকিবে বলো; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা,
তারপর ঝরে গেছে; আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না
হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা
ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’
এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে
উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়ায়ে রইল হাঁটুভর।
হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছে, এলোমেলো অঘ্রাণের খড়
চারিদিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর;
চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;–

প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে
যেখানে রবো না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা,
কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে — বাসনার মতো ভালোবাসা
খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার।"
***
( সমাপ্ত )

** গল্পের সকল চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৫৬
৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×