২০০৩ সাল। সবে মাত্র এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। রেজাল্ট বের হবে তিন মাস পরে। কয়েক বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম চট্রগ্রাম গিয়ে এই তিন মাস গার্মেন্টসে চাকুরী করব। যেই কথা সেই কাজ। চট্রগ্রাম চলে গেলাম। রাজশাহী থেকে চট্রগ্রাম যে কতদূর তা প্রথমবারের মত টের পেয়েছিলাম। কিন্তু চাকরী কে দিবে? আমাদের এলাকার কিছু লোক বহদ্দারহাট থাকতো। তাদের কাছে গিয়ে উঠলাম। আমাদের তিনজনের একটা ফ্যাক্টরিতে চাকরী হল। একজন টেবিল চেয়ারে বসে সারাদিন লেখালেখি করবে। আরেকজন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সারাদিন গার্মেন্টসের কোয়ালিটি চেক করবে। আর আমি অধম!!!! প্রথমে চেয়ারে বসে কিছু নাম্বার লিখতে দিল, ঘন্টা খানেক লেখার পরে একজন এসে ডেকে নিয়ে গেল। তিন তলা থেকে নিচে নেমে পাশের তিনতলা বিল্ডিং এ উঠলাম। এবার আমার মাথায় একটা বস্তা উঠিয়ে দিল। বস্তা মাথায় নিয়ে তিন তলা থেকে নেমে এই বিল্ডিং এর তিন তলায় উঠলাম। এত ভারি বস্তা, আর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠা নামা যে কি কষ্ট, তার একটা তিক্ত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় হল। চট্রগ্রাম আসছি যখন তিন মাস থাকতেই হবে। কিচ্ছু করার নেই। পরদিন যথা সময়ে অফিস গেলাম। তার পরদিন লাঞ্চে বাসায় এসে মন আর শরীর দুটোই অবশ হয়ে গেল। দুইদিন বাসায় বিশ্রাম নিয়ে আবার সেই ফ্যাক্টরিতেই কোয়ালিটিতে জয়েন করলাম। সারাদিন দাড়িয়ে থাকতে থাকতে পা ব্যাথায় ফুলে গেল। এর মধ্যে সুপারভাইজার এসে ইচ্ছেমত গালিগালাজ। গার্মেন্টসে চাকুরীর সাধ মিটে গেল। কচি মনে কিযে কষ্ট পেয়েছিলাম তা বলে বোঝানো যাবেনা। এবার আবার তিনদিন ডিউটি করে অফিস যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। এরপরে কয়েকদিন এদিক সেদিক ভালমত ঘুরাঘুরি করে তের দিন পরে আমরা তিনজন বাড়ী ফিরে এলাম। তারপর থেকে গার্মেন্টসের চাকুরীকে খুব নিম্নমানের এবং ঘৃনার চোখে দেখতাম।
পূর্বের এই ছোট্ট কাহিনীর সাথে পরবর্তী জীবনের একটি ঘটনার দারুন যোগসুত্র রয়েছে। সেটাই বলব আপনাদেরকে।
দীর্ঘ ৮ বছর পেরিয়ে গেল। ২০১১ সালে অনার্স পাশ করার পর চট্রগ্রাম ইপিজেডে এক গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে জুনিয়র এক্সিকিউটিভ হিসেবে চাকুরী হয়। যে গার্মেন্টস কে এত ঘৃনার চোখে দেখতাম, সেই গার্মেন্টসই হয় আমার শেষ ঠিকানা। ২০১৩ সালের শেষের দিকে ফ্যাক্টরি চেঞ্জ করে অন্য একটাতে জয়েন করি। আমার নতুন ফ্যাক্টরির এমডি স্যার আমাকে দারুন লাইক করত। একবার আমাদের ফ্যাক্টরিতে প্রচুর কাজের অর্ডার হয়। কিন্তু এত কাজ টাইম মত শিপমেন্ট করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলনা। তাই কিছু কাজ সাব-কন্টাক্টে শহরের কয়েকটা ফ্যাক্টরিতে দেওয়া হল। প্রতিদিন ১১-১২ টার দিকে এমডি স্যার আমাকে নিয়ে তার গাড়ীতে করে বিভিন্ন ফ্যাক্টরি ভিজিট করতে যেত। একদিন স্যারের সংগে গাড়িতে যাচ্ছি, গাড়ী বহদ্দারহাট ঢুকতেই আমার সেই ২০০৩ সালের কথা মনে পড়ে গেল। আশ্চর্যজনকভাবে গাড়ীটা আমার সেই স্মৃতি বিজড়িত বস্তা টানা ফ্যাক্টরির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এক মেনেজার এসে গেট থেকে আমাদের রিসিভ করে সেই ফ্যাক্টরির এমডির রুমে নিয়ে গেল। এমডির রুম ছিল তিন তলায়। যে তিনতলায় আমি ১০ বছর আগে বস্তা মাথায় করে উপরে উঠেছিলাম। এমডি স্যারের রুমে বসার পরে আমাদেরকে চা- নাস্তা দেওয়া হল। আমি এমডির ওয়াশরুমে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে আসলাম, সুযোগ যখন পেয়েছি এমডির ওয়াশরুম টা ইউজ করার লোভটা মনে হয় সামলাতে পারছিলাম না। এমডির রুমে বসে নাস্তা করছি আর চিন্তা করছি, হায়রে বিধি এ তোমার কেমন খেলা। এ ফ্যাক্টরিতে একদিন বস্তা মাথায় নিয়েছিলাম, সুপারভাইজারের গালিগালাজ শুনেছিলাম। আজ সেই ফ্যাক্টরির এমডির রুমে বসে তার সাথে নাস্তা করছি। এটা আমার কাছে অনেক বড় পাওয়া বলে মনে হল। শরীরটা শিউরে উঠল। নিজেকে খুব গর্বিত মনে হল। খুশিতে বুকটা ভরে গেল। বিধাতা মনে হয় কষ্টের প্রতিদান এভাবেই দিয়ে থাকে।