এশিয়ায় ফের ভয়াবহভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে করোনা সংক্রমণ। যখন আমেরিকা, ইউরোপের দেশগুলোয় সংক্রমণের গ্রাফ ছিল ঊর্ধ্বমুখী, তখন ভিয়েতনাম, জাপান, থাইল্যান্ডসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ছিল। এবার এসব দেশেই জেঁকে বসেছে করোনা। বাড়ছে মৃত্যুর হারও। এ অবস্থায় কড়া বিধিনিষেধ জারি করছে বিভিন্ন দেশ। এশিয়ায় যেমন সংক্রমণ বাড়ছে, সেই তুলনায় করোনার টিকা দেওয়ার হার কম। ফলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, এ পর্যন্ত যেসব ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে, তার মধ্যে ভারতে শনাক্ত ভ্যারিয়েন্টটি সবচেয়ে দ্রুত ছড়ায়।
ভারত
ভারত ছাড়াও যে কয়েকটি প্রতিবেশী দেশে এই ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া বাকি তিন দেশে সংক্রমণ কমতে শুরু করেছে। এই তিন দেশের মধ্যে সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল নেপালে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় দেশটির স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঝুঁকির মুখে পড়েছিল।
আফগানিস্তান
ভারতের পার্শ্ববর্তী আরেক দেশ আফগানিস্তানে সংক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করে গত জুনে। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ৬০ শতাংশ করোনাভাইরাসের সংক্রমণের জন্য দায়ী ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট।
ইন্দোনেশিয়া
দৈনিক মৃত্যুতে শীর্ষে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ডব্লিউএইচও জানিয়েছে, এই ভ্যারিয়েন্টের কারণে ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড ও মঙ্গোলিয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে। ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, গত তিন সপ্তাহের নমুনা থেকে জানা যাচ্ছে, করোনা রোগীদের মধ্যে ৬০ শতাংশ ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে সংক্রমিত। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় দেশটিতে টিকাদান কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। তবে খুব বেশি যে অগ্রগতি হয়েছে, এমনটা নয়। এ পর্যন্ত ৫ শতাংশ নাগরিককে টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে ইন্দোনেশিয়ায়।
বাংলাদেশ :
বাংলাদেশেও করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বাড়ছে। এই পরিস্থিতি কেমন তা বোঝা যায় সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য থেকে। আইইডিসিআর বলছে, দেশে গত মাসে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৭৮ শতাংশের দেহে ভারতে শনাক্ত হওয়া ‘ডেলটা’ ধরন পাওয়া গেছে। ‘বাংলাদেশে করোনার ভ্যারিয়েন্টের (ধরন) সর্বশেষ তথ্য’ শিরোনামে এক প্রতিবেদনে আইইডিসিআর বলেছে, এখন দেশে করোনার এই ধরনের সুস্পষ্ট প্রাধান্য দেখা যাচ্ছে। এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ডেলটা ধরন শনাক্ত হওয়ার পর এর হার বাড়তে শুরু করে। মে মাসে এ ধরন ৪৫ শতাংশ এবং জুন মাসে ৭৮ শতাংশ নমুনা শনাক্ত হয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় আইসিইউ এর জন্য হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছোটাছুটি করছেন রোগীর স্বজনরা। কোথাও খালি নেই আইসিইউ । প্রতি দশ মিনিট পর একটি করে এ্যাম্বুলেন্স এসে থামছে হাসপাতালের সামনে। শুধু ঢাকা থেকে নয়। বাইরের জেলা থেকেও অনেকে আসছেন। ৩৬ জেলায় কোনো আইসিইউ সুবিধা নেই। গত বছরের জুনে প্রধানমন্ত্রী সব জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেটা কার্যকর হয়নি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের সামনে রোগীরা আইসিইউ এর জন্য রীতিমতো আহাজারি করছেন। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের দাপটে রীতিমতো কাঁপছে বাংলাদেশ। সংক্রমণ বাড়ছে পাল্লা দিয়ে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন ১১ হাজারেরও বেশি মানুষ। আগের দিন শনাক্ত হয়েছিলেন আট হাজার ৪৮৯ জন। মৃত্যুও বেড়েছে আগের দিনের তুলনায়। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন ২২৫ জন। আগের দিন মারা যান ২০৪ জন।
থাইল্যান্ড :
থাইল্যান্ডের স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, দেশটিতে করোনার ডেলটা ভ্যারিয়েন্টের প্রভাবে সংক্রমণ বাড়ছে। চলতি সপ্তাহেই তারা বলেছে, রাজধানী ব্যাংককে সংক্রমিত রোগীর ২৬ শতাংশ ডেলটা ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত। কিন্তু এরপরও পর্যটকদের স্বাগত জানাচ্ছে থাইল্যান্ড। এই দেশটি প্রথম পর্যটকদের কোয়ারেন্টাইন ছাড়া ভ্রমণের সুযোগ দিয়েছিল। যদিও দেশটিতে টিকাদানের হার কম। এ পর্যন্ত দুই ডোজ টিকা পেয়েছেন এমন নাগরিকের সংখ্যা ৪ শতাংশ।
মঙ্গোলিয়া :
এশিয়ায় যে দেশগুলো টিকাদানে এগিয়ে রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম মঙ্গোলিয়া। দেশটির এ পর্যন্ত ৫০ শতাংশ মানুষকে পুরোপুরি টিকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। এসব টিকার অধিকাংশই চীনের সিনোফার্মের তৈরি। তবে দেশটিতে সম্প্রতি করোনার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পর কিছু কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চীনের টিকা কার্যকর না হওয়ায় সংক্রমণ বাড়ছে। যদিও এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা হয়।
জাপান
গত কয়েক মাস জাপানে করোনা একেবারেই নিয়ন্ত্রণে ছিল। কিন্তু অলিম্পিক শুরু হওয়ার পর থেকে ফের মাথাচাড়া দিয়েছে সংক্রমণ। এখন একে রুখতে কড়া বিধি জারি করেছে জাপান। বলা হয়েছে, অলিম্পিক খেলতে আসা অ্যাথলেটরা কোথাও ঘুরতে যেতে পারবে না। থাকতে হবে ভিলেজেই। কভিড বিধি ভঙ্গের জন্য ৬ জন অ্যাথলেটকে নির্বাসনও দিয়েছে জাপান। সরকার ৪০৫৮টি নতুন সংক্রমণের খবর দিয়েছে, প্রথমবারের মতো এই সংক্রমণের সংখ্যা ৪ হাজারের ওপরে উঠেছে। নতুন এই রেকর্ড হওয়ার এক দিন আগে জাপান টোকিওতে জরুরি অবস্থা জারির মেয়াদ আগস্ট মাসের শেষ পর্যন্ত বর্ধিত করেছে, যাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়। পাবলিক ব্রডকাস্ট সংস্থা এনকেএইচ ১২,৩৪১টি নতুন সংক্রমণের কথা জানিয়েছে, যা আগের দিনের তুলনায় ১৫ শতাংশ বেশি।
গত অক্টোবরে ভারতে প্রথম ধরা পরে করোনার ডেল্টা প্রজাতি। মনে করা হয়, দ্বিতীয় ঢেউয়ের কারণও এই প্রজাতি। ভারতে মহারাষ্ট্র থেকে দেশের উত্তর, মধ্য ও পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এই প্রজাতি। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পর সর্বোচ্চ আক্রান্ত শীর্ষ তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে ভারতের নাম। মৃত্যুতেও বিশ্বে এখন ভারত তৃতীয়।
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা আগস্ট, ২০২১ সকাল ১০:০৫