পাঞ্জাবীটি গায়ে কড়কড় করছিলো।
যদিও সিল্কের পাঞ্জাবী কড়কড় করার কথা নয় একদম। ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে থাকা পাঞ্জাবীর তো কড়কড় করার প্রশ্নই ওঠে না। তবুও নীলের অস্বস্তি হচ্ছিল। মেজাজ খারাপ বলেই হয়তো!
পাঁচ ঘন্টা কোনো কাজী অফিসের সামনে অপেক্ষা করতে করতে একজন পুরুষের যতটা মেজাজ খারাপ হবার কথা, ততটা অবশ্য হয়নি। মন খারাপ হয়েছে। ভী-ষ-ণ।
মৌ-দের বাড়িটা চেনে নীল। ফোন নম্বর তো কণ্ঠস্থ। তবু ইচ্ছা হয় না ফোন করতে। কিংবা যেতে। নিদারুন অভিমানে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে থাকে হৃদয়।
রাগ নয়, অভিমান।
মৌ-য়ের ওপর রাগ করা তার পক্ষে কোনদিনই সম্ভব হয় না। এবং গ্রীষ্মের দুপুরে পাঁচ ঘন্টা রাস্তায় অপেক্ষা করার পর যতখানি অপমান বোধ করার কথা, ততখানি অপমান বোধও জাগছে না মনে।
ঠিক পাঁচ ঘন্টা হতেই হাঁটতে শুরু করে নীল। বিকাল হয়ে এসেছে। অসহ্য গরমের কারণটাও বেশ বোঝা যাচ্ছে এখন। দারুন একটা ঝুম বৃষ্টির আগে বিধাতা সব সময় ধরনীকে প্রখর রৌদ্রে ঝলসে নেন।
আকাশ ছেয়ে যেতে শুরু করেছে ধূসর-অন্ধকার মেঘে। স্তরে স্তুরে এত সুন্দর করে মেঘমালা বিন্যস্ত, যেন দীর্ঘ সময়ের অবসরে সাজিয়েছে কেউ। ধূসর অন্ধকারে রাজ্যে মাঝে মাঝেই ঝলসে উঠছে বিদ্যুতের রূপালী চমক।
ঠান্ডা হাওয়াটা আশ্চর্য শীতলতা বয়ে আনে। শুধু শরীরের নয়, মনেও। বর্ষনের পূর্ব সংকেত! অনেকটা সময় রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে থাকে নীল। ধানমন্ডির রাস্তায় ভগ্ন হৃদয় কোনো প্রেমিকের দিকে কটাক্ষ নিয়ে তাকায় না কেউ। বরং সবার দৃষ্টিতেই থাকে অদ্ভুত এক রকমের সহানুভূতি।
ঠায় দাঁড়িয়েই থাকে নীল। বর্ষনের প্রতীক্ষায়।
যে বর্ষনে ধুয়ে ধুয়ে যাবে পৃথিবীর বুকের সমস্ত কষ্ট। ভিজতে ভিজতে বাড়ির পথে হাঁটা ধরবে সে। শরীর চুইয়ে বৃষ্টি ধারা এক সময় স্পর্শ করবে অন্তরকে। ঝুম বর্ষনে ভিজতে ভিজতে যাবে তার অন্তর।
কিন্তু পকেটের মোবাইল ফোন ?
নষ্ট হলে হোক আজ। মৌ-য়ের দেয়া মোবাইল ফোন আজ ভিজে যাক বৃষ্টিতে। ডুবে যাক বৃষ্টিতে... ... ...
বাজতে শুরু করেছে ফোনটা। বিশেষ একটা ধ্বনিতে। না, মৌ- নয়। অন্য কেউ। অতীতের পৃষ্ঠা থেকে আচমকা উঠে আসা এমন একজন, যাকে নিজের অতীত থেকে মুছে ফেলতে পারলে স্বস্তি পেতো নীল।
এত বছর বাদেও মেয়েটা কেন বারবার বিরক্ত করে তাকে? কেন বোঝে না যে নীলের ভালোবাসা সে আর ফিরে পাবে না কখনও? নীল তাকে কোনদিন ভালোবাসেনি। কোনদিনও না।
এক দিনের জন্যে না, এক মুর্হুতের জন্যেও না। সদ্য তারুন্যের প্রেমকে কি ভালোবাসা বলা যায়?
একনাগাড়ে বেঝেই চলছে ফোন। বিরক্ত হয়ে এক সময় নীলকে সাড়া দিতেই হয় আফসানার ডাকে। আফসানা... ... ...সেই বোকা মেয়েটার নাম !
"কী চাই তোর ?"
"কী আবার চাইব?"যেন আকাশ থেকে পড়ে ওপাশের কণ্ঠস্বর। "কী আছে তোর কাছে যা আমি চাইতে পারি ?"
"কিছু নেই যখন, তাহলে বেহায়ার মত বারবার ফোন কেন করিস ?"
" কেন, ফোন করার যাবে না ?"
"তোর মত বেহায়ার সাথে কথা বলার কোনো আগ্রহ নেই আমার !"
"ঠিক আছে, তাহলে আর ধরিস না আমার কল।"
"কল না রিসিভ করলে তো এস. এম. এস পাঠাবি?"
" হ্যাঁ,পাঠাবো। এক কালের প্রেমিককে কি করে একা ছেড়ে দেই, বল?"
" সব কথা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই একটা জায়গায় কেন নিয়ে আসিস?"এবার সত্যিই ভীষণ রেগে ওঠে নীল। "তোর সাথে আমার এমন আহামরি কোনো প্রেম ছিল না যে ঢাক ঢোল পিটিয়ে দুনিয়ার মানুষকে জানাতে হবে। অমন প্রেম মানুষ জীবনে ৫০টা করে।"
" তাই ? জানতাম না!"
" আমার চাইতে বেশি ভালো তোর জানার কথা। প্রেমিকের তো অভাব নেই তোর ।"
"হ্যাঁ , তা নেই।" নির্বিকার নারী কণ্ঠটা।
"মানুষ নিয়ে খেলতে খুব ভালো লাগে, না? আজকে এক ছেলে, দুদিন পর আরেকজন ... ... ..."
"হুঁ,একদম ঠিক। আর কিছু বলবি ?"
"I HATE YOU!!"
" আমি জানি।"
"তবে? ফোনটা এখনও কেন ধরে আছিস?"
" আর থাকবো না। তুই রেগে গেছিস, তার মানে মন খারাপ কেটে গেছে। আমার কাজ শেষ। এবার আমি রাখবো।"
"মানে কি এই সবের ? নিজেকে মহামানবী প্রমান করতে চাস ?"
পাহাড়ী ঝর্নার মত কলকল শব্দ তুলে হাসে আফসানা," আমার সাথে অযথা রাগারাগি না করে মৌ-কে ফোন কর। আসেনি বলে খুব একটা ঝাড়ি দে! সে হুরপরী মানলাম, কিন্তু তার মানে কি তোকেও অবহেলা করবে ?"
" আসেনি মানে? কোথায় আসবে ?"
"কেন ? আপনাকে বিয়ে করতে! বেচারা আপনি সিল্কের পাঞ্জাবীতে ঘামছেন।"
"কে বলেছে তোকে এইসব হাবিজাবি ?"
বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় অপর প্রান্তের সাথে সংযোগ। আপনা থেকেই, নাকি মেয়েটা কেটে দেয়- বুঝতে পারে না নীল।
এবং বৃষ্টি নামে... ... ...আকাশ ভেঙ্গে নামে।
ঠিক সেই মুর্হুতে !
ভেজার ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও নীলের আর ভেজা হয় না।স্পর্শ পাওয়া হয় না কাঙ্খিত জলকণার।দৌড়ে উঠে আসে এক দোকানের আশ্রয়ে। কেননা ফোনটাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। যে কোনো মূল্যে।
মৌ-য়ের ফোন যে আসবে। আসবেই!
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে ডিসেম্বর, ২০০৮ রাত ৩:০৪