জীবনে যে কাজটা কখনোই করতে পারলামনা তা হলো সকাল করে ঘুম থেকে ওঠা। তবে অবস্থার বাঁটে পড়ে জীবন, যখন যেখানে যেমন-এর গ্যাড়াকলে ব্যারাছ্যারা হয়ে আমাকেও পঁ্যাদিয়ে উঠিয়ে দেয় "ময়ূর-ডাকা ভোরে" প্রশান্তির স্বপ্ন ভঙের ঘুম থেকে। হায়রে নিয়তি!
এমনি এক ভোরে (!), এই দেশের অন্য সবার কাছে যখন দিন তাঁর "সকাল" বিশেষনের সতীত্ব হারাচ্ছে ধীরে ধীরে, সারা রাত জিরিয়ে নেয়া ট্রামের লক্কর ঝক্কর শব্দের তালে তালে, জানালার পাশের কোন এক কোনায় বসে আমি দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছি গন্তব্যে। পথিমধ্যে কত লোক উঠছে, কতজন নামছে কাউকেই চোখ তুলে দেখছি না। এমনকি স্বল্পবসনা ললনাদেরও না, হুমমম ভালো হয়ে গেছি মনে হয়!
হঠাৎ ট্রামের বুকে ঘটঘট পা ফেলে কেউ একজন পেছন থেকে সামনে আসার কথা রিলে করলো আমার ইন্দ্রীয়। নাহ্, আমি তাকাবো না তার দিকে, কখনোই না। সে স্বয়ং মাধুরী হলেও না। কানের মধ্যে সনি'র বীন সদৃশ ছোট্ট এমপি3 প্লেয়ারের ইয়ারফোনটা কানে ঠাসা দিয়ে ধরে বাইরের সৌন্দর্য উপভোগে মন দিলাম। কিন্ত কী আশ্চর্য, ট্রাম জুড়ে এতো জায়গা থাকতে ঘটঘটা মূর্তিটা এসে ঠিক আমার পাশের সিটটাতেই কিনা নিজের আসন গাড়লো!
মনে মনে বিরক্ততো হয়েছিই, ইচ্ছে করছিলো বেশ চটাং একটা ভাব নিয়ে বলি, "আফা অইন্য দিকে বহেন, আমার সিট টারে একলা থাকতে দ্যান, পীলিজ"। কিন্ত কথা কইতে গেলেই তো তার দিকে তাকাতে হবে, আর তাকালেই আরো কথা হবে, আরো কথা হলেই প্রেম হবে, প্রেম হলেই বিচ্ছেদ হবে, বিচ্ছেদ হলেই রবিবাবু আমার পিছনে কাদেরী কিবরিয়া কিংবা সাদি মোহাম্মদকে লেলিয়ে দিবে, আর এইদুজন আমার পিছনে লাগলে আমার নেংটি তুলে পালানো ছাড়া কোন গত্যান্তর থাকবে না...। আমি আজকে পণ করেছি নো মোর ললনা টুডে, নো মোর তাকাতাকি....!
একটা মিষ্টি গন্ধ আমার গন্ধপ্রজা নাক কে খালি ঐদিকে ডাইভার্ট করতে চাইছে। চক্ষুদ্্বয় ট্রামের বাতায়ন গলে দূরের মাঠে সরষেক্ষেতের অস্তিত্ব অনুসন্ধানে ব্যস্ত হলেও বাকি চার ইন্দ্রীয় মহাসমারোহে, একযোগে পাশর্্ববর্তীনির পানে ডাইভার্টেড হতে সচেষ্ট। চলন্ত যানবাহনে কোন সুন্দরী ললনা সফরসঙ্গী হলে তার দিকে তাকানো ব্যাকরণ সিদ্ধ না। তার চেয়ে বরং বাইরের রূপ সৌন্দর্যের দিকে হাবলা কান্তের মতো হা করে তাকিয়ে থাকতে হয়, প্রকৃতি সুন্দর না লাগলে কোন বাদাম বিক্রেতা, ডাব বিক্রেতা, অষুধ বিক্রেতা কিংবা নিদেন পক্ষে গাড়ির হেলপারের ছন্দময় ভঙির "ওস্তাদ সামনে পেলাশটিক আছে... ডাইনে লইয়া আগে বাড়ান..."-এর দিকে মনোনিবেশ করতে হয়, শাস্ত্র অন্তত: তাই বলে!
আমি চৌর ইন্দ্রীয়ের কাছে পরাজিত হতে হতে নিজের বশে থাকা একমাত্র চক্ষু দিয়ে প্রাণপণে একজন ডাব বিক্রেতাকে খুঁজে যাচ্ছি রাস্তার পরে। নিদেন পক্ষে একজন বাদাম বিক্রেতা, ঔষধের লেকচারার হলেও চলতো। কিন্ত সব শালা আজ একযোগে ধম্মঘট করেছে নাকি? কারো টিকিটি পর্যন্ত খুঁজে না পেয়ে যেইনা মুখ বাঁকিয়ে গালি দেবার জন্য নিজেকে তৈরী করছি, অমনি পাশের মুখটা খানিকটা ঝুঁকে আমার সামনে এসে বলে, "কী হে, চিনবার পারতাছ না আমারে, ভাব লও নাকি"?
আমিতো পেরেশান, মনের ভেতরে এক পলকেই "আমি চিনিগো চিনি তোমারে..." বেজে উঠলো। বেহ্নাজ, ইরাণি মেয়ে। রাইন টিভির জন্য এক বিজ্ঞাপন তৈরীর সময় বেহ্নাজ পড়েছিল "ব্রাউট ক্লাইডুং" বা ব্রাইডাল ড্রেস। সৌভাগ্য বা দূর্ভাগ্যক্রমে সেখানে হাজির ছিলাম আমিও, তবে দর্শক হিসেবে। বিজ্ঞাপন নির্মানের বিরতির এক পর্যায়ে চুপচাপ ব্রাইড বেহ্নাজ হঠাতই বলেছিল, "ধুসর, আমি আর কতোক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করবো! তুমি কি আমাকে বিয়ে করতে রাজী হবে"!
ঘটনার আকষ্মিকতায় আমার হাত থেকে কফির গেলাস পড়ে যাবার যোগার। ওতো এতোটা ওপেন মশকরা করার মেয়ে না, কাহিনী কি? কান লাল হয়ে গেলো টেকনিক্যাল ডিরেক্টর মিশায়েল এর কথায়। "কাম অন ম্যান, টেক দিজ অপূর্চুনিটি, ইট উয়্যোন্ট কাম এগেইন...."।
দিলাম ভাগা সেখান থেকে, কাজের অজুহাত দিয়ে।
একদিন কোলনের নিউমার্কেট এলাকায় ঘুরছি আপু-ভাইয়ার সাথে। আমার কাঁধে বসা ভাইগনাকে টাংকি মারা শিক্ষা দিচ্ছি হাতে কলমে। হঠাৎ শুনি আপুর গলা, "ঈশ মেয়েটা কী সুন্দররে!" তাকিয়ে দেখি বেহ্নাজ। কাছে গেলাম, কথা বললাম, পরিচয় করিয়ে দিলাম..., আপু থ, 'কীরে তুই চিনস ক্যামনে'?
অনেকদিনপর আবার সেদিন দেখা হলো, চলন্ত ট্রামে। বেহ্নাজ বারবার তার চুলে হাত বুলাচ্ছিলো। অনেক পরে আমাকে বললো, "তুমি কি কানা নি"?
আমি বলি, ক্যা?
: আমাকে দেখে কোন পরিবর্তন চোখে পড়ে না?
না সূচক মাথা নাড়ি আমি!
: আমার চুলে কালো রঙ করেছি! হিহিহি...
ওহ্ আচ্ছা তাইতো, বড়ই সৌন্দজ্জ হইছে! বলে একটা তালমিস্রি হাসি দিলাম। কথা হলো আরো অনেক্ষণ, গন্তব্য এসে যাওয়ায় বিদায় নিতে হলো একসময়। ভাবছিলাম সাত সকালে, ময়ূর ডাকা ভোরে ঘুম ভাঙলেও বিদঘুটে ট্রাম ভ্রমনটা নেহায়েৎই খারাপ যায় নি!
আজকে, হঠাৎ করেই খুব মনে পড়লো বেহ্নাজের কথা, কুটকুট করে কথা বলে চলা সেই সময়গুলোর কথা...!
কেন যেন কুমার বিশ্বজিতের গাওয়া গানটাকে উলটো করে গাইতে ইচ্ছে করছে খুব... "যারে বৈরাগী মন দিলা, তারে কেন ঘর, সংসারের স্বপন দেখাওরে"!
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে অক্টোবর, ২০০৬ সন্ধ্যা ৬:৪০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



