মেয়েদের কলেজটার পাশেই বাসাটা। মহাসড়ক থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরে। তুহিন এসে দেখে দরোজায় তালা দেওয়া। পাশের ঘরের দরোজাটা অবশ্য ভেজানো। ডাক দিতে গিয়েও দিল না। এ সময়ে কাউকে বিরক্ত করা বোধহয় ঠিক হবে না।
গতকালও এসেছিল সে। আজ দ্বিতীয় দিন। এ সময়েই আসার কথা তার। মোবাইল বের করে ফোন দেওয়ার কথা ভাবল। হঠাৎ মনে হলো, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে ক্ষতি কী?
ছেলেটার নাম আলিফ। পাইলট স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে সে। ছাত্র হিসেবে ভালো। তবে, কিছুটা অমনোযোগী -এই যা সমস্যা।
টিউশনটা দিয়েছেন নাজমা ম্যাডাম। মেয়েদের কলেজের অফিসিয়াল স্টাফ তিনি। মাঠ পর্যায়ে বীমার চাকরিও করেন তিনি, পাশাপাশি একটা কোচিং সেন্টারও দাঁড় করিয়েছেন। তুহিন সেখানে ইংরেজি পড়ায়। ডিসেম্বরে সব স্কুলে পরীক্ষা শুরু হওয়ায় কোচিংটা আপাতত বন্ধ আছে। ফেব্রুয়ারিতে পুনরায় শুরু হওয়ার কথা।
কোচিং করিয়ে ঠিক চলত না। মাস শেষে যে টাকাটা আসত, সে টাকায় কোনোমতে বাসা ভাড়াটা চলত। খাওয়ার টাকার জন্য বন্ধুদের কাছে হাত পাততে হতো; এরই মধ্যে এ কয়েকমাসে বিশ হাজার টাকা ঋণ হয়ে গেছে।
গতমাসের সেপ্টেম্বরের শেষদিকে সে শহরে আসে। এতদিনে চলার জন্য দু-চারটে টিউশনও জুটাতে পারেনি। ডিসেম্বরে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী একজনের পড়তে আসার কথা ছিল, সে আর আসে নি।
পাশের ঘরের যে ছেলেটাকে তুহিন পড়ায়, তার মা সারামাসে মাত্র পাঁচশো টাকা দেন। কিছু বলাও যায় না, যদি এটাও চলে যায়। কম শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর। মানুষের বিচার দেখে সে পাথর হয়ে গেছে।
বাড়ি থেকে এসেছে গতকাল। তাকে আর্থিক সমর্থন দেওয়ার সাধ্য পরিবারের নেই। বাবা অসুস্থ, মা-ও ঠিকমতো চলতে-ফিরতে পারেন না। তাঁদের চিকিৎসা দরকার। ছোটবোনটা ডিগ্রিতে পড়ে। তারও অনেক খরচ। এত টাকা কোথা থেকে আসবে?
জমি থেকে যে ফসল আসে, তাতে কোনোমতে চলে যায়। ওটাকে বড়জোর টিকে থাকা বলে, বেঁচে থাকা বলা যায় না। মোটামুটিরকম বেঁচে থাকতে হলেও ন্যূনতম কিছু অবদান রাখা প্রয়োজন। নিজেই যেখানে চলা যায় না, আর অবদান রাখা!
পাশের ঘরের দরোজাটা খুলে বৃদ্ধা মতন একজন বেরিয়ে এলেন। তুহিনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কাকে চাও?’
‘আলিফকে পড়াতে এসেছি’, বলল তুহিন।
‘তারা তো বাসায় নেই।’
‘কোথায় গেছে?’
‘বেড়াতে। তোমাকে কিছু জানায়নি? কী আশ্চর্য!’
তুহিন একটু অবাক হলো। বৃদ্ধা তার দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তুহিন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অপমানে লাল হয়ে গেছে সে। কী করবে ঠিক বুঝতে পারছে না।
বৃদ্ধা তার অবস্থাটা আঁচ করতে পারলেন মনে হলো। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী ভাবছো? আলিফের মাকে একটা ফোন দিতে পারো।’
এ-ই বলে তিনি কোথাও চলে গেলেন।
দুঃসময়ে অপমান গায়ে মাখতে নেই। তুহিন ফোন দিল আলিফের মাকে। দু’বার বাজল, তিনবারের সময় ধরলেন। তুহিন কিছু বলার আগেই মহিলা বলা শুরু করলেন, ‘স্যার, কিছু মনে করবেন না। তাড়াহুড়ো করে চলে আসায় আপনাকে কিছু জানানো হয়নি। আলিফ তার এক স্যারের কাছে পড়া শুরু করেছে। আপনি তো মাত্র একদিন পড়িয়েছেন। আর আসতে হবে না।’
‘ঠিক আছে’ বলে তুহিন মোবাইল রেখে দিল। একটা দীর্ঘশ্বাস কি বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে এল? অলক্ষে কেউ একজন ব্যাপারটা লক্ষ্য করলেন বোধহয়।
৮ মাঘ ১৪২৪ বঙ্গাব্দ
গাজীপুর।