ইহা ভাবিয়া ভালো লাগিতেছে যে সসম্মানেই ‘গাজীপুর শাইনিং পাথ হাইস্কুল’ হইতে প্রস্থান করিয়াছি। সসম্মানে বলিতে ইহা বোঝানো হইতেছে না যে, আমাকে ফুলেল সংবর্ধনা দেওয়া হইতেছে অথবা আমার জন্য কেহ অশ্রুপাত করিয়াছে। যে-ই ঘটনা হইতে আপাতত নিষ্কৃতি পাইয়াছি, তাহা উপর্যুক্ত সম্মাননা অপেক্ষা অধিক মূল্যবান।
আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হইয়াছে আমি অশ্লীল কথা বলি, কাহাওকে বলিয়াছি সে নাকি ধর্ষিতা হইতে পারে, আমি নাকি কাহাকে কুপ্রস্থাব দিয়াছি! অভিযোগ শুনিয়া আমি স্তম্ভিত, মর্মাহত। ইতিপূর্বে বহু অভিধায় অভিহিত হইয়াছি- কেহ নাস্তিক বলিয়াছে, কেহ মুরতাদ বলিয়াছে, কেহ ধর্মবিদ্বেষী বলিয়াছে, কেহ নারীবিদ্বেষী বলিয়াছে, কেহ ‘র’ এর এজেন্ট বলিয়াছে। কিন্তু কেহ ঘুণাক্ষরেও চরিত্র লইয়া প্রশ্ন তোলে নাই। এই ধরনের অভিযোগ এইবারই প্রথম।
বহুক্ষণ ভাবিলাম, আমার চরিত্র কি আসলেই কলুষিত? সত্যিই কি আমি দোষী? দোষী না হইলে সর্বসম্মুখে আমাকে কেন অপদস্থ করা হইল? আমি দোষী এমন কোনো ব্যাপার হৃদয়ঙ্গম হইল না। ইহা ভাবিয়া পীড়িত হইলাম আমাকে কেন কথা বলিতে দেওয়া হইল না! গত ছয় মাসে কাহারও সঙ্গে আমার বিবাদ হয় নাই, সবার সঙ্গে মৈত্রীভাব বজাইয়া রাখিতে চেষ্টা করিয়াছি- শত্রুতা করিয়া আমাকে কেহ ফাঁসাইবে এমনও তো হওয়ার কথা না।
সপ্তম শ্রেণির কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল বালিকা যে কারণে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করিয়াছে, দশম শ্রেণির ছাত্রীদিগের সঙ্গে যে ভাষায় কথা কহিয়াছি; সেইসব বিবেচনায় লইলে আমার তো ফাঁসি হওয়ার কথা! যদ্যাপি ভাষায় কোনো ত্রুটি খুঁজিয়া পাইতেছি না। সামান্য ভুল বোঝাবুঝি আর কী!
শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করিবে না, শ্রেণিকক্ষে গোল বাঁধাইবে; এমতাবস্থায় যদি ছাত্রদিগকে বলি- পড়ালেখা তো করো না, গার্মেন্টসে কাজ করিয়া খাইতে হইবে, ভালো বিবাহও করিতে পারিবে না, মা-বাবার অসুস্থতায় সুচিকিৎসার ব্যবস্থাও করিতে পারিবে না। এইসব কি মন্দ কথা?
অমনোযোগী ছাত্রীদিগকে যদি বলি- লক্ষ্য তো কেবল নবম-দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া, তারপর বিবাহ; লক্ষ্য বড়ো হইলে পড়ালেখা করিতে- এইসব বলা কি দোষের? সারা দিন মোবাইল লইয়া পড়িয়া থাকিলে আমি যদি দুই-চারিটি কুফলের দৃষ্টান্ত টানিয়া তাহাদিগকে সতর্ক করি - সেইটাও কি দোষের?
সমবয়সী সম্পর্ককে নিরুৎসাহিত করিয়া কোনো এক ক্লাসে ছাত্রদিগকে বলিয়াছিলাম, তোমরা যখন বিবাহ করিতে যাইবে, তখন দেখিবে তোমার বান্ধবীর সন্তান নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ে। কারণ, সবকিছু গোছগাছ করিতে ছেলেদের একটু সময় বেশিই লাগে। ছাত্রীদিগকে কহিয়াছিলাম, তোমাদের বিবাহ হইবে তোমাদের চাইতে কমপক্ষে আট হইতে দশ বৎসর বয়সের চাইতে বড়ো কাহারও সঙ্গে যে তোমার দায়দায়িত্ব লইতে পারিবে।
পুরুষানুভূতিতে আঘাত লাগিয়াছিল কি না জানি না, তবে বিলক্ষণ বুঝিতে পারি ত্রিশ-পয়ত্রিশ বৎসর বয়সি অবিবাহিত পুরুষদের জন্য মায়া হইয়াছিল। সেই কথা স্মরণপূর্বক মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, তোমার বাবা-মা’র বয়সের ব্যবধান কত? সে উত্তর দেয় নাই। পরবর্তীতে অভিযোগ করিয়াছিল আমি নাকি বলিয়াছি, বাবা কেন? আমি তো তোমার বরও হইতে পারি!
কাহাওকে আমার ভালো লাগে নাই এমন কথা কহিব না, যেহেতু পৌরুষ আছে কহিব, আলবৎ ভালো লাগিয়াছে। তাহাকে শুধু না, আরও অনেককেই ভালো লাগিয়াছে। ভালোকে ভালো লাগা প্রকৃতির বিধান; এইখানে দোষের কিছু নাই। পৃথিবীতে বহু নজির আছে নিজের হইতে তিন-চারিগুণ ছোটো কাহারও সঙ্গে কাহারও সম্পর্ক হইয়াছে। ইহাতে অস্বাভাবিকতা কিছু নাই। কিন্তু সেই ভালো লাগার প্রকাশ কেমন হওয়া উচিত?
আমি জানি না কেমন হওয়া উচিত। শুধু এই কথাটি বলিতে পারি, আমি কাহাওকে মন্দ কথা বলি নাই। প্রকৃতি আমায় ভালোবাসিতে শিখাইয়াছে, আমি ভালোবাসিয়াছি। প্রকৃতি আমায় গল্প বলাইতে, গান শোনাইতে শিখাইয়াছে; আমি গল্প বলিয়াছি, গান শুনাইয়াছি। আমি নির্দ্বিধায় বলিতে পারি, প্রকৃতি আমায় ধর্ষক বানায় নাই, প্রেমিক বানাইয়াছে বড়জোর।
২ ভাদ্র ১৩২৫ বঙ্গাব্দ
গাজীপুর।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৮