ম্যাচিউরিটি
অল্পবয়সে রবীন্দ্রনাথ যে লেখাগুলো লিখেছিলেন, পরিণত বয়সে ঐ লেখাগুলো নিজেই বাতিল করে দিয়েছিলেন। নিজের লেখা বলে পরিচয় দিতেই লজ্জাবোধ করতেন।
জীবনানন্দ দাশ জীবদ্দশায় অনেক লেখাই প্রকাশ করেন নি। দেশ ও প্রকৃতি বিষয়ক লেখা নিয়ে উনি প্রায়ই হীনম্মন্যতায় ভুগতেন। জসীম উদদীনকে অনুকরণ করছেন এমন অপবাদের আশঙ্কা করতেন। ঝামেলা হতে পারে অথবা মানসম্মত হয় নি এই অজুহাতে আত্মজৈবনিক লেখা প্রকাশ করেন নি। যদিও পরবর্তীতে দেখা গেছে লেখাগুলো কালোত্তীর্ণ হয়েছে।
মীর শওকত আলী তাঁর 'প্রদোষে প্রাকৃতজন' লিখতে দীর্ঘসময় নিয়েছিলেন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁর চিলেকোঠার সেপাই' ও 'খোয়াবনামা' লিখতে রীতিমতো সাধনা করেছেন। শওকত ওসমান সহ প্রথিতযশা আরও অনেক সাহিত্যিকই যা লিখেছেন সময় নিয়ে লিখেছেন। হুটহাট কিছু লিখেন নি। পরিমাণের চেয়ে মানটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এখানে রফিক আজাদের কথা বলা যায়। ভদ্রলোক সারাজীবনে দু'শোর বেশি কবিতা লিখেন নি। তারপরও বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি তিনি। অথচ অনেকেই আছেন হাজার হাজার কবিতা লিখে ফেলেন। কালস্রোতে সব অবশ্য ভেসেও যায়।
অল্পবয়সে যে লেখাগুলো লেখা হয়, তাতে চিন্তা-ভাবনার খোরাক কম থাকে। কৈশোরে আমরা যে অনুভূতি লালন করি, যৌবনে নিশ্চয়ই একই অনুভূতি থাকে না? চিন্তা-ভাবনায় পরিণতি আসে। আপনি যখন কোন গ্রন্থ রচনা করবেন, নিশ্চয়ই সর্বজনীন করেই লিখবেন। সেটা নিশ্চয়ই বাগাড়ম্বর পূর্ণ হবে না? ওখানে নিশ্চয়ই একটা বার্তা থাকবে, যেটা সবসময়ের জন্যই প্রযোজ্য হবে। একসময় যদি নিজের কাছেই বিরক্তিকর ঠেকে পাঠক কীভাবে নেবে? এ জন্য চিন্তা-ভাবনার পরিণতি জরুরি। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান এবং সে বিষয়ে কথা বলতে পাঠকের মুখোমুখি হওয়ার সক্ষমতা থাকতে হবে।
গ্রহণযোগ্যতা
হুট করে একটা বই লিখে ফেললে হবে না, দেখতে হবে আপনার পাঠকশ্রেণি কেমন। আপনার গ্রহণযোগ্যতা কেমন।
ফেসবুকে সামান্য ক'টা লাইক অথবা অতি উৎসাহী কিছু মানুষের কথায় বই করে ফেললে বিপদে পড়তে হবে। কারণ, এই অতি উৎসাহী শ্রেণি আপনার বই কিনবে না। শুধু শুভ কামনা জানিয়েই দায় সারবে। অথবা সৌজন্য কপির জন্য মুখিয়ে থাকবে। অদৃষ্ট বেশি মন্দ হলে আবার এমনও হতে পারে, আপনি কাউকে বই উপহার দিলে সে এমন ভাব দেখাবে যেন তাকে বই দিতে পেরে আপনিই ধন্য হয়েছেন।
এ জগৎটা বড় কঠিন, ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। নতুনেরা দুঃখে সারাজীবনের মতো সাহিত্যসাধনার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।
গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর জন্য জাতীয় দৈনিক, পাক্ষিক বা মাসিক সাময়িকী, বিশেষ সংখ্যাগুলোতে লেখা দিতে পারেন। একটা পাঠকশ্রেণি তৈরি করুন। অথবা ব্লগ বা ফেসবুকে দল গঠন করে সাহিত্যচর্চা করতে পারেন। এতে আখেরে লাভ হবে। আপনার পরিচিতি বাড়বে, লেখার মান বাড়বে (ভুল হলে নিজেকে শুধরে নেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে।)।
ত্যাগী মনোভাব
লেখালেখিকে পেশা হিসেবে নেওয়ার চিন্তা করবেন না। আগে রুটি-রুজির ব্যবস্থা করুন। মনে রাখবেন, কালজয়ী কোন সাহিত্যিকই লেখালেখি করে জীবন চালাতে পারেন নি। জমিদারপুত্র হওয়ায় রবীন্দ্রনাথের রক্ষে। নজরুল, জীবনানন্দ, মধুসূদনও অর্থের অভাবে ধুঁকে ধঁকে মরেছেন। মানিক বন্দোপাধ্যায়ের দুরবস্থার কথা তো বলাই বাহুল্য।
লেখালেখি করবেন অবশ্যই ত্যাগী মনোভাব নিয়ে, কিছু পাওয়ার আশা না করে। বৈষয়িক কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা থাকলে সাধনা হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৯