চলচ্চিত্রের প্রতি তুমুল আগ্রহ ছিল শৈশব থেকেই। তুমুল আগ্রহ ছিল নায়ক-নায়িকাদের প্রতিও। তাদের সৌন্দর্য যেমন আকর্ষণ করত, আকর্ষণ করত তাদের ব্যক্তিত্বও। জাফর ইকবাল, ইলিয়াস কাঞ্চন, সালমান শাহ, ওমর সানি, মান্নার চলচ্চিত্র মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখতাম। রাজ্জাক, আলমগীর, জসিমের চলচ্চিত্রও বাদ যেত না। নায়িকাদের মধ্যে বেশি ভালো লাগত, শাবনুর, শাবনাজের অভিনয়।
শুক্রবার ছাড়া তো সেসময় চলচ্চিত্র উপভোগের সুযোগ কম থাকত। সপ্তাহের এই একটা দিনের জন্য গভীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতাম। বৃহস্পতিবার হলেই ক্ষণগণনা শুরু হতো কখন শুক্রবার হবে।
প্রতিটা বিজ্ঞাপন মুখস্থ ছিল, কোন বিজ্ঞাপনের পর কোন বিজ্ঞাপন আসবে- সেসব একদমে বলে দিতে পারতাম। একটা বিজ্ঞাপন দেখাও বাদ দিতাম না। সে সময় শুক্রবার চলচ্চিত্রের ফাঁকে ফাঁকে পনেরো-বিশ মিনিট করে বিজ্ঞাপন চলত। ক্লান্তিহীনভাবে দেখে যেতাম। মৌ-নোবেলের বিজ্ঞাপন পছন্দের শীর্ষে ছিল।
যে নায়ক-নায়িকাদের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ ছিল, কৈশোর উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেসব আগ্রহ কেমনে যেন উবে গেল। একসময় বুঝতে শিখলাম নায়ক-নায়িকারাও আমাদের মতো মানুষ। তারাও খায়, তারাও ঘুমায়। এমনকি তারাও বাথরুমে যায়। রাগ হলে তারাও গালমন্দ করে।
ইদানীং অনেক নায়ক-নায়িকার কীর্তিকাণ্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল। সেসব দেখে ভাবি এদের একসময় কত পছন্দ করতাম! ওমর সানির কথাই বলা যাক। একসময় তার সেসময়কার লম্বা চুলের মতো করে চুল বড়ো করতাম। এখন তার কাজকর্ম দেখে মনে হয় সে কেবলই মৌসুমীর স্বামী। তার নিজস্বতা বলে কিছু নেই।
রিয়াজ, ফেরদৌসের কাজকর্ম দেখে মনেই হয় না এরা একসময় দুই দুয়ারি, হাজার বছর ধরে, শাস্তি, হঠাৎ বৃষ্টি, খাইরুন সুন্দরী, গেরিলার মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন। ভাগ্যিস জাফর ইকবাল, সালমান শাহ মারা গেছেন। তারাও কি বেঁচে থাকলে এদের মতো হয়ে যেতেন? আবার নাও হতে পারতেন। ইলিয়াস কাঞ্চন, আলমগীরের মতো ওজন হয়তো ধরে রাখতে পারতেন।
বইমেলায় এসে জীবনের প্রথম অটোগ্রাফ নিয়েছিলাম কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের। আগ্রহ নিয়ে তার সঙ্গে ছবিও তুলেছিলাম। এরপর আর কখনও আগ্রহ হয়নি। বইমেলায় কখনও বিদ্যাপ্রকাশের সামনে গেলে মিলন, অপি করিম বা আরও অনেককে সেখানে দেখি। কথা বলা হয় না, ছবি তোলা হয় না।
বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে একবার একা বসেছিলাম। হঠাৎ জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জাফর ইকবাল এসে আমার পাশে বসলেন। শূন্য জায়গাটা একসময় লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। সবাই অটোগ্রাফ নিচ্ছিল। ছবি তুলছিল। আমি চেয়ে দেখলাম। ছবি তোলা বা অটোগ্রাফ নেওয়ার কোনো আগ্রহই হয়নি আমার।
একজন ব্লগারের লেখা খুব পছন্দের ছিল। তিনি প্রায়ই আমার লেখায় মন্তব্য করতেন। হঠাৎ কোনো এক ঝামেলায় তিনি নিরুদ্দেশ হয়ে গেলেন। একবছর খোঁজে তার মোবাইল নাম্বার জোগাড় করে কল দিলাম। দুই মিনিট কথা বলে তিনি কল রেখে দিলেন। অনেকদিন পর ঢাকায় এসে হঠাৎ মনে হলো তার সঙ্গে দেখা করি। সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। শিডিউল পাওয়া যায় না। তাও তিনি একটা শিডিউল দিলেন। পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষার পর তার সঙ্গে দেখা হলো, কথাও হলো। একসঙ্গে রাতের খাবারও খেলাম। তাও একসময় মনে হলো তার সঙ্গে দেখা না হলেই ভালো হতো।
চাঁদ দূরে থেকেই সুন্দর। মর্ত্যলোকে নেমে এলে সে তার আকর্ষণ হারায়। সেলিব্রিটি বা আমাদের কল্পনায় বাস করা মানুষেরাও তেমনই। তাদের দূর থেকে ভালোবাসাই শোভা পায়, কাছে এলে তাদের প্রতি আমাদের যে প্রত্যাশা, তা অনেকসময় পূরণ হয় না।
এ সংক্রান্ত আরও একটি পোস্ট: দূরে বাধ্য মধুর শোনায় শূন্য হাওয়ায় সঞ্চরি (হুমায়ুন-গুলকেতিন প্রসঙ্গ)
ছবিসূত্র: এই সময়
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ৯:১৩