অ্যালার্জির সমস্যা অনেক আগে থেকেই, তবে দু'বছর ধরে ভোগান্তিটা বাড়তি। কয়েকমাস ধরে একেবারে লাগামছাড়া। বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে ডাক্তার দেখিয়েছি বটে, কাজের কাজ কিছু হয়নি। গত পরশু আবারও গেলাম। টিকিট কেটে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে গিয়ে দেখি বিশাল লাইন। কিছু করার নেই। ঘণ্টাখানেক লাইনে দাঁড়াতেই হবে।
দাঁড়িয়ে আছি, আর চারপাশে নজর রাখছি। লোকে লোকারণ্য। ঢাকায় এত লোকের চর্মরোগ ভেবে খুব অবাক হলাম। যদিও সব বিভাগেই লোকজন আছে অনেক।
যাহোক, মোটামুটি ২৭-২৮ বছর বয়সি এক লোক তার বয়স্ক মা-বাবাকে নিয়ে এসেছেন ডাক্তার দেখাতে। তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। তার বাবা কিছুক্ষণ পরপর বলছেন, 'বাবা, তুমি বসো। আমি দাঁড়াই।'
ভদ্রলোক বসেন না। বাবা উসখুস করছেন। বলছেন, 'আমার ছেলেটার পায়ে সমস্যা। এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে না।'
আমি দেখলাম, আসলেই ছেলের পায়ে সমস্যা। একটা বড় ক্ষত তৈরি হয়ে গেছে।
পুরোটা সময় উনি দাঁড়িয়ে রইলেন। তার বাবা বারবার চেষ্টা করছিলেন ছেলেকে বসাতে কিন্তু ছেলে বসবেন না। মাঝেমধ্যে বাবাকে ধমক দিয়ে বসে থাকতে বলছেন। বাবার মন বলে কথা। ছেলেকে ভয় পাচ্ছেন, তবুও ছেলের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বারবার তাকে বসতে বলছেন।
দু'জনের কাজকর্ম দেখে মনে হচ্ছে বাবাই ছেলে আর ছেলেই বাবা। এমন ঘটনা আজকাল চোখেই পড়ে না।
একই রকম ঘটনা আরেকটা ঘটল। এখনকার ছেলেটার বয়স ২১-২২ হবে। বাবার বয়স ৫০-৫৫। ছেলে লাইনে দাঁড়িয়ে আর বাবা বেঞ্চে বসে। বাবা বারবার বলছেন, 'আব্বু, তুমি বসো। আমি দাঁড়াই।' ছেলে রাজি হয় না। এদিকে বাবা বসে থেকে স্বস্তি পাচ্ছেন না।
বাবারা সচরাচর সন্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল হন; এটা স্বাভাবিক। কিন্তু সন্তান বাবা হয়ে যাবে; এমন ঘটনা ইদানীং ঘটে না৷সন্তান কর্তৃক বাবাকে মারধর করা, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, জমি দখলে নেওয়ার ঘটনা তো অহরহই ঘটছে।
২
কয়েকজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল বাড়িতে ফোন দেওয়া নিয়ে। সবাই বলছিল, মায়ের সাথেই বেশি কথা হয়। বাবার সাথে কম। কেন কম হয় জানতে চাইলে বলল, 'ছেলেদের সম্পর্ক তো মায়েদের সাথেই বেশি হয়। তাছাড়া বাবাকে ভয় পেতাম।'
এ কথা সত্যি যে, ছেলেদের সম্পর্ক মায়ের সাথেই বেশি হয়। বাবার সাথে দূরত্ব থাকে একটু। আর মেয়েদের সম্পর্ক বাবার সাথেই বেশি। আমার পরিবারের কথাই বলি। আমার মায়ের প্রতি যে টান, অতটা কি বাবার প্রতি হয়েছে কখনও? মনে হয় না। আমার বোনদের আবার বাবার প্রতি টান অনেক। ছোট বোন তো বাবাকে গত ২০ বছর যাবত গোসল করিয়ে দিচ্ছে। দু'বছর হলো ওর বিয়ে হয়েছে। এখন সপ্তাহে একবার করে হলেও আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসে। বাবার দাড়ি-গোঁফ সাফ করে দিয়ে যায়, যে ক'দিন থাকে গোসল করায়; খাইয়ে দেয়। মনে হয়, সে তার নিজের বাচ্চার সেবাযত্ন করছে। এ কথা কেন বলছি। সে আসলে বাবাকে ধমকায়ও, শাসনও করে। বাবা একটু একরোখা টাইপ। কারও কথা শোনেন না। বোন তাকে ধমকে নিয়ন্ত্রণে রাখে।
৩
আমার বয়স যখন ৫-৬ বছর, তখন বাবা বিদেশে চলে যান। মায়ের মুখে শুনি আমি নাকি একসময় উনার জন্য পাগল ছিলাম। নাওয়া-খাওয়া সব উনার সাথেই চলত। নানার বাড়ি বেড়াতে গেলেও বাবার জন্য কান্না করতাম। বাবা থালায় দুধ-ভাত মেখে দিতেন, আমি নাকি হাতের কবজি না ডুবলে ভাত খেতাম না। আমি একবার হারিয়ে গিয়েছিলাম, আমার শোকে তিনি পাগলপ্রায় হয়ে গিয়েছিলেন।
আরও পড়ুনঃ অভিমান
একসময় যে আমি বাবা অন্তঃপ্রাণ ছিলাম, উনি বিদেশে চলে যাওয়ার পর একটা দূরত্ব তৈরি হলো। ৫ বছর পর উনি যখন দেশে ফিরলেন, উনার সাথে কথা বলতে অস্বস্তি লাগত। অথচ বোনেরা ঠিকই তার সাথে মিশে গিয়েছিল। যে আমি মা-বাবাকে তুই-তোকারি করে কথা বলতাম, বাবাকে হঠাৎ আপনি সম্বোধন শুরু করলাম। দরকার ছাড়া কথাই বলতাম না। যদিও মাকে তুই করে, নিজের সন্তানের প্রতি যেমন দরদ হয়; তেমনই অনুভব করি সবসময়।
স্কুল-কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর বাবার সাথে যোগাযোগ আরও কমে গেল। দেখা যেত, মাসের পর মাস বাবার সাথে দেখা হতো না, কথাও হতো না। আগের দূরত্বটা গোছানো সম্ভব হয়নি।
২০১২ সালের দিকে বাবাকে এক ঘটনায় একবার জেলে যেতে হয়েছিল। আমরা বুঝতে পারছিলাম না কী করতে হবে। আমাদের আইন-আদালত সম্পর্কে ধারণা ছিল না। আমার বাবা বিনা অপরাধে জেল খাটছেন; এটা মানতে কষ্ট হচ্ছিল। কিছুদিন পর অবশ্য মুক্তি পেলেন। সেদিন উনাকে জড়িয়ে ধরে জন্মের কান্না কেঁদেছিলাম।
আরও পড়ুনঃ আব্বা যখন জেলে ছিলেন
২০১৯ সালের শেষদিকে আমি গাজীপুরের কোনাবাড়িতে একটা স্কুলে পড়াতাম। তখন শুনি বাবা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। তড়িঘড়ি করে বাড়ি যাই, বাবাকে ময়মনসিংহ মেডিকেলে ভর্তি করাই। কয়েকদিন খুব গুরুতর অবস্থা ছিল। উনি বাঁচবেন বলে মনে হচ্ছিল না। যমে-মানুষে টানাটানি অবস্থা।
যাহোক, বাবা সে যাত্রায় বেঁচে যান। তবে আগের মতো আর থাকেননি। চলতে পারেন না, কারও সাথে কথাও বলতে পারেন না। চুপচাপ বসে থাকেন, শুয়ে থাকেন। আমাদের বাড়িটা একসময় বাবার কথাবার্তায় মুখরিত হয়ে থাকত; এখন সে বাড়ি নিঝ্ঝুম নিরালা। মনে হয় শ্মশান। মায়ের সাথে যখন কথা বলি, খুব আফসোস হয় বাবার সাথে যদি মন খুলে কথা বলতে পারতাম! চাইলেও তো আর সম্ভব না। খুব ইচ্ছে করে উনার সাথে অনেক কথা বলি। উনি ভালো হবেন কি না; সেটাও জানা নেই। মাথার উপর বটবৃক্ষ আছে; এটা ভেবেই সান্ত্বনা খুঁজি। কিন্তু মন তো আর সবসময় মানে না।
বাবাকে নিয়ে অল্প কথায় কিছু লেখা যায় না। তাকে নিয়ে কখনও তেমন কিছু লিখিওনি। মনে হয় লেখা উচিত ছিল, অনেক কথা বলা উচিত ছিল উনার সাথে। তাহলে হয়তো এত আফসোস হতো না। মায়ের সাথে একসময় কথা কম হলেও এখন অনেক কথা হয়। নিজেই তার বাবার ভূমিকায় অবতীর্ণ হই, অথচ বাবার সাথে তার বাবা হয়ে উঠতে পারি না।
ছবিঃ ইন্টারনেট