অনার্সে পড়ি তখন। একদিন বাড়ি যাচ্ছিলাম। পথিমধ্যে অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো। ধরতেই ওপাশ থেকে বলছে, “আমি অমুখ থানার ওসি বলছি।”
“জি বলুন।” আমি বললাম।
“আপনার নামে গুরুতর অভিযোগ আছে। আপনি নাকি মেয়েদের বিরক্ত করেন?”
থতমত খেয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম আসলেই কোনো মেয়েকে বিরক্ত করি কি না। নাহ, একদম মনে পড়ল না। এক-দু’জনকে একটু-আধটু ভালো লাগে বটে, তবে বিরক্ত করেছি বলে মনে হয় না। এলাকায় তো মেয়েদের দিকে চোখ তুলে তাকাতামই না। যাহোক, বললাম, “আপনি বোধহয় ভুল করেছেন। আমি কখনও কোনো মেয়েকে বিরক্ত করিনি।”
ওপাশ থেকে বললেন, “ঠিক আছে।” তারপর বললেন, “আমি ছোটন।”
চিনতে পারলাম তাকে। আমার স্কুল-কলেজ জীবনের সহপাঠী। কয়েক বছর যোগাযোগ না থাকায় তার কণ্ঠ ভুলে গেছি। কথা বলে জানলাম সে আসলেই পুলিশে চাকরি করে। সম্প্রতি যোগদান করেছে। শুনে খুব ভালো লাগল। আসলে ওর ইচ্ছেই ছিল পুলিশে চাকরি করার। ইচ্ছে পূরণও হয়েছে।
২
অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় বেশ ভুগছিলাম। আগে অল্প থাকলেও মাঝখানে বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। ডাক্তার দেখিয়েছি বটে, তবে অবস্থার অগ্রগতি তেমন হয়নি। যাহোক, এর মধ্যে দু-দু’বার মাথা ন্যাড়া করতে হলো। সর্বশেষ কাজটা করতে হলো বাসার পাশের এক সেলুনে। নরসুন্দর সাহেব খুব যত্ন করে মাথা ন্যাড়া করে দিলেন, দাঁড়িও চেঁছে দিলেন। তারপর বললেন, “এখন থেকে একটু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হবে।” আমি হ্যাঁ-হুঁ করলাম। এরপর উনি পরামর্শ দিলেন কুর্মিটোলা হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে। জানালাম, আগের ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে নিই। পরে অন্য জায়গায় যাব।
নরসুন্দর সাহেবের সাথে প্রতিদিন দেখা হয়। উনার সেলুনের সামনে দিয়েই যাতায়াত করি। সালাম দেন, কুশলাদি জিগ্যেস করেন। খেয়াল করি, উনি আমার দাড়ির দিকে তাকান। মাথায় টুপি থাকায় চুল দেখার সুযোগ নেই। উনি প্রতিদিন বলেন, “চুল-দাড়ি পরিষ্কার রাখবেন।” আমি বলি, “আচ্ছা।”
সেদিন নিজে নিজেই ক্ষৌরকর্ম করলাম। আমাকে দেখে উনি হতাশ হলেন। বললেন, “নিজেই শেভ করেছেন?”
“হ্যাঁ।” আমি বললাম। “ওহ” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। মনে মনে বললাম, “ভাগ্যিস নিজে নিজে করেছি। এটা একটু হলেও মানা যায়। যদি অন্য সেলুনে করতাম আর উনি সেটা জানতেন, তাহলে তো কান্না শুরু করতেন।”
৩
কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোতে বাচ্চা কালেকশনের একটা প্রক্রিয়া চালু আছে। সরকারি স্কুলে এই ঝামেলাটা মনে হয় নেই। সরকার যেহেতু একজন শিক্ষার্থী থাকলেও বেতন দেয়, তাই অনেক শিক্ষকের গা ছাড়া ভাব থাকে। গ্রামের স্কুলগুলোতে এমনই ব্যাপার প্রায়ই দেখি। অনেকসময় শিক্ষকদের স্বেচ্ছাচারিতায় অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়ে।
যাহোক, আমি অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছি। এবার যে প্রতিষ্ঠানটার কথা বলছি, এটা গাজীপুরের বারবৈকা এলাকায় অবস্থিত। স্কুলটার বয়স মোটামুটি বিশ বছর। এখানে এসে অনেকের সাথে আমাকেও বাচ্চা কালেকশনে বের হতে হয়।
একদিন পাঁচ-ছ’জন শিক্ষক মিলে বাচ্চা কালেকশনে বের হলাম, স্কুলের প্রতিষ্ঠাতাও আমাদের সাথে। এক বাড়ি, দু’বাড়ি ঘোরার পর এমন এক বাড়ি গেলাম, সেখানে কোনো বাচ্চা দেখা গেল না। জিগ্যেস করলাম, “এ বাড়িতে তো বাচ্চা নেই। এখানে কেন?”
প্রতিষ্ঠাতা বললেন, “এ বাড়িতে একজন গর্ভবতী মহিলা আছেন। বাচ্চা হলে উনি যেন আমাদের স্কুলে দেন; এটা বোঝাতে এসেছি।”
আমি হাঁ করে রইলাম। আমার অবাক হওয়া দেখে একসময় একজন বললেন, “উনি (প্রতিষ্ঠাতা) অপেক্ষায় থাকেন, মহিলাদের পেটের দিকে তাকিয়ে থাকেন কবে বাচ্চা হবে আর স্কুলে ভর্তি করাতে পারবেন।”
ছবিঃ অন্তর্জাল