ফেসবুক ঘাঁটতে ঘাঁটতে হুমায়ুন আহমেদের একটা নাটকের (প্যাকেজ সংবাদ) দৃশ্য সামনে এল। ভগ্নিপতি সবাইকে নিয়ে সকালের নাশতা খেতে বসেছেন। কিন্তু তার শ্যালক (আবদুল কাদের) আর পুত্র (জাহিদ হাসান) আসতে দেরি করছে (আসলে তারা ঘুমোচ্ছে)। ভগ্নিপতি ঘরে উঁকি দিয়ে তাদের অবস্থা দেখে এলেন। কিন্তু তাদের নড়চড় নেই। একটু পর এসে শ্যালক নাটক বানানোর প্ল্যান নিয়ে কথা বলতে শুরু করল। তার আগে সবার কুশলাদি জিগ্যেস করছে। সবার প্রশংসা করছে। ভগ্নিপতি খুব বিরক্ত (কারণ, শ্যালক-ভাগ্নে কাজকর্ম কিছু করে না) অথচ বোন মুগ্ধ। বস্তুতঃ ভাই যা করে, তাতেই বোন মুগ্ধ। এই অংশটা দেখে আমার বড়বোনের কথা মনে পড়ল।
করোনার সময় আমি একটা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছিলাম এক বন্ধুর সঙ্গে। ভগ্নিপতির সমর্থন ছিল না, কিন্তু বোন-ভাগ্নির সমর্থন ছিল। যদিও ব্যবসার টাকা বোন-ভগ্নিপতি দু'জনই দিয়েছিলেন (প্রসঙ্গত, সে সময় ভগ্নিপতির অসুস্থতার দরুণ তার বাসায় থাকতাম আমি। তার ফার্মেসীতে বসতাম।)। এ ব্যবসা করতে গিয়ে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে আমার। দিনরাত খাটতে হয়েছে। হেন কাজ নেই যা করতে হয়নি। থালা-বাসন ধোয়া, চা-পান বিক্রি সবই করতে হয়েছে।
ব্যবসা থেকে কোনো টাকা নিতাম না। দেখা যেত অনেক সময় আমার পকেটে এক টাকাও থাকত না। কয়েক কিলোমিটার হেঁটে ব্যবসাস্থলে যেতাম। মাঝেমধ্যে খেয়াল করতাম আমার পকেটে ১০-২০ টাকা। আমি ভাবতাম হয়তো আমিই রেখেছি। একবার-দু'বার এমন হতে পারে, তাই বলে বারবার তো মনের ভুল হতে পারে না। কিন্তু আমি কাউকে জিগ্যেসও করতে পারতাম না যে কে টাকা রাখে। যদিও বিলক্ষণ বুঝতে পারতাম কে রাখতে পারে।
কয়েকমাস আগে বড়োবোনকে হঠাৎ জিগ্যেস করলাম, তুই কেমনে জানতি আমার কাছে টাকা থাকত না? সে বলে, আমি তোর শার্ট-প্যান্টের পকেট হাতাতাম।
আমার ব্যবসাটা চলেনি। ভগ্নিপতির টাকাটা আমার মা জোগাড় করে দিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু বোনের পাওনা টাকাটা এখনও দেওয়া হয়নি। ওকে মাঝেমধ্যে যখন বলি, তোর টাকাটা দেওয়া হলো না। বিপদে কোথায় বোনকে সাহায্য করব, উলটো বিপদে ফেলেছি। সে বলে, তোর নিজেরই চলে না। দিবি কী করে? দরকার নেই।
আমার বোনটার তেমন কিছু নেই। সংসার জীবনে অনেক কষ্ট করেছে সে। কিন্তু তার মধ্যে রাগ-ক্ষোভ বা লিপ্সা জাতীয় কিছু দেখিনি কখনও। আমার সঙ্গে এখনও দেখা হলে এমনভাবে আচরণ করে, মনে হয় আমি ছোটো বাচ্চা। এমনকি এখনও হাতে ১০০-২০০ টাকা গুঁজে দেয়। আগে নিতে চাইতাম না। এখন চেয়ে চেয়ে নিই। বলি, টাকা দিলি না? সে হাসে।
মাঝেমধ্যে তার সঙ্গে যোগাযোগ থাকে না। অনেকসময় আমি কল দিতে পারি না, কিন্তু সে হুটহাট কল দেয়। কোথাও দুর্ঘটনা ঘটল বা ভূমিকম্প হলো, সে সঙ্গে সঙ্গে ফোন দেবে। জিগ্যেস করবে, ঠিক আছি কি না। আমি বলি, ঠিক আছি। আমি কল দিতে পারি না বা তাদের কিছু দিতে না পারার অপারগতা প্রকাশ করলে সে বলে, তুই দিতে পারলে দিবি, না দিতে পারলে নাই। এসব নিয়ে ভাবার কিছু নেই। তাছাড়া তুই ছোটোভাই। তুই কী দিবি? আমাদেরই (বড় দুইবোন) তো তোরে দেওয়ার কথা।
ভগ্নিপতি যখন সুস্থ হয়ে গেলেন, আর আমি ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসছি; আমার বোন তখন ভাগ্নিকে বলছিল, তোর মামার জন্য পরাণ পুড়ছে রে। আমি তার মুখের দিকে একবার তাকানোর পর আর তাকাতে পারিনি। আমার বুক ফেটে কান্না আসছিল। কী করুণ তার চাহনি!
বোনের সঙ্গে ইদানীং কথা বেশি হয়। বুঝতে পারি সে খুব খুশি হয়। আমার প্রতি মুগ্ধতা তার এতটুকুও কমেনি। নাটকের সঙ্গে তার সাদৃশ্যের কথা তোলায় সে হেসে কুটিকুটি।
মাঝেমাঝে ব্যবসার কথা তুলে দুঃখ করি। সে বলে, তোর আসলে কোনো দোষ ছিল না। আমি সবসময়ই তোর ওপর আস্থা রাখতাম।
ভগ্নিপতি যদিও বলেছিলেন যার সাথে ব্যবসা করছি, তার সাথে সুবিধে হবে না। সে বড়োলোকের ছেলে। তার ব্যবসায় মন নেই। টাকা উড়াবে। তাও উনি সম্মতি দিয়েছিলেন।
আসলেই সে সময় আমার তেমন কিছু করার ছিল না। পড়ানোর সুযোগও ছিল না। নিরুপায় হয়ে ওই ব্যবসায় নেমেছিলাম। করোনার সময় যেখানে মানুষের খাওয়া-পরারই সমস্যা যাচ্ছে, তখন রেস্তোরাঁ-কফিশপ ব্যবসা ভালো যাবে না; এ উপলব্ধিটা আসেনি।
বিপদের দিনে খুব কম মানুষকেই কাছে পাওয়া যায়। ব্যর্থ হলে তো সবাই দূর দূর করে। জীবনের হিসেব কষে দেখি কে বা কারা পাশে ছিল বা আছে। কে বা কারা বটবৃক্ষের মতো ছায়া দেয়। আমার বড়োবোনটার নিষ্পাপ মুখচ্ছবি সবার আগে চোখের সামনে ভাসে।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:১৬