somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বুনো ফুল এবং অপরাধের ঘ্রাণ

১২ ই ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৪:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মেঠোপথে বা পরিত্যক্ত প্রান্তরে এক ধরনের ঝোপগাছে সাদা সাদা বুনোফুল ফোটে । ফুলগুলো মুখে দিলে মধুবিন্দুর তৃষ্ণাবর্ধক আস্বাদ পাওয়া যায় । সে ছিল সেই ফুলপরীদের একজন । অভিভাবকদের অনুপস্থিতিতে আমাদের বাগানের এক তরুন বৃক্ষের শিকড়ে সে মধু বিলোতে আসত । মাঝে মাঝে এসে বসত আমি নামক এই কৌতূহলী ছটফটে নবীন গাছটির কাছে । ছোট ছোট বাক্য, দৃষ্টির ইশারা আর নানারকম অধরভঙ্গি দিয়ে সে কথা বলত । কণ্ঠে ছিল সার্বক্ষণিক অপরিচিত বিষণ্ণতা । কি এক মুগ্ধতায় তার কথা শুনতাম আর ভাবতাম আমি কবে পরী হব ।

আমি জানতাম সে কেন আসত ; হয়ত জানতাম তার হাসি ছিল কান্নার ছায়া । তারপরও উদগ্র নিষিদ্ধ কৌতূহলে একদিন জিজ্ঞেস করে বসলাম, সে তার সাথে কি করে ?
কি করি ? সে মিটমিট করে হাসল, বললে বুঝবি তুই !
আমি অনেক কিছু বুঝি .. , কণ্ঠ দৃঢ় করে বোঝাতে চাইলাম আমি তেমন অজ্ঞ নই ।
মুখে বলে বোঝাতে পারব না তবে তুই চাইলে উদাহরন দেখাতে পারি, ঠোঁটে বিরল উচ্ছল হাসি ফুটিয়ে তুলল সে ।

সামান্য কিশোরী হলেও ততদিনে মানুষের চোখের ভাষা ঠিকই চিনি । কিন্তু তার চোখে যে ভাষা ঝলমলিয়ে উঠল সে ভাষা আমি কখনই দেখিনি । দেবীরা কি এই ভাষায় কথা বলে, দৃষ্টি একইসময়ে এত নরম, স্নেহময় এবং পুজার আকাঙ্ক্ষী হয় কেমন করে । আমাকে অবাক আর বিহ্বল করে, আমার চোখে ডুবল সেই দৃষ্টির জাল । দক্ষ শিকারির মুগ্ধতা শিকারকে মোহাবিষ্ট করে ফেলে । অনুভব করলাম নিজের উপর কোন নিয়ন্ত্রন নেই আর । সে যা চাইবে তাই পাবে, যা ঘটাবে তাই ঘটবে । কিছুক্ষনের জন্য মনে হল অন্ধ হলেই ভালো, কেননা অন্ধকার আলোর জন্মদাত্রী ; এক সুগন্ধি ঘোর নেমে এল, আমার অনস্তিত্ব তখন তার নিঃশ্বাসের অস্তিত্ব ।

সময় স্থির থেকে ধাবমান হয় । হৃদয়ে রক্তের বদলে বয়ে চলে দিকহারা নদীর ভাঙন । উচ্ছলতা রুপান্তরিত হয় অস্থিরতায় । ঘুমের মাঝে চোখের সামনে অপার্থিব একজোড়া চাহনি দেখি । কেউ যেন গালে হাত ছুঁইয়েই সরিয়ে নেয় আর আমি ধড়ফড় করে জেগে উঠি । ঘরময় অন্ধকার আগে ভয় জাগাতো .. এখন একাকীত্ব জাগায় । বিছানায় ভুতের মত বসে অলৌকিক কোনও স্পর্শকে দুহাত বাড়িয়ে খুঁজি । কারও জন্যে নয় .. স্পর্শের তীব্র পিপাসায় নিজেকে পাপদগ্ধ নরকবাসি মনে হয় । রাত জাগে অথবা আমিই জাগি । আপনমনে বিড়বিড় করি .. কেন .. কেন বুঝতে চাইলি !

কিছু মুহূর্ত সময়ের মাত্রাকে হাতের মুঠোয় দিয়ে নির্মমভাবে আবার ছিনিয়ে নেয় । ভবিষ্যতের নিয়ন্ত্রন তুলে দেয় অতীতে পর্যবসিত বর্তমানকে । নিয়ন্ত্রন .. হ্যা সেটা আসলেই আমার প্রয়োজন । নিজেদেরকে পরিশীলিত জ্ঞানবৃক্ষে পরিণত করতে আমাদেরকে প্রায়ই বিদ্যালয়ে হাজিরা দিতে হয় । সেখানে রুটিন বেঁধে আমরা জ্ঞান গলাধঃকরণ করি অতঃপর উগড়ে দেই । এইসব বমন কেচ্ছার শিডিউল এখন নিয়ন্ত্রনহীন । মন বসে না .. মনের ঘরের ছোট চড়ুই পাখি রুপালি চাঁদের পিছনে আঁধারের রুপ দেখে ফেলেছে । মনের সাথে তাল মিলিয়ে চারপাশে জ্ঞানবৃক্ষের পরিবর্তে রুপবৃক্ষদের হেটে যেতে দেখি । বৃক্ষ মানেই কুসুম সম্ভার । এই বৃক্ষদের হৃদয়ে ভালোবাসার পুস্প আর বাহিরে কামজ কুসুম । সৌন্দর্য সবসময়েই দৃষ্টিকামনার ওপর নির্ভর করে, প্রবল তৃষ্ণায় নষ্টনদীর জল হয়ে ওঠে অমৃত । কীটের চোখে দুই পাপড়ির ওষ্ঠপুস্পে মধুগন্ধী ছায়া দেখি , নষ্টনদীর জোয়ারে ডুবিয়ে দিতে চাই দুই চরণ । নির্লজ্জের মত ভাবি যা ভাবিনি আগে কখনও ।

কালো রঙের মোহের বিজ্ঞাপন - এক কৃষ্ণনয়না কৃষ্ণসুন্দরী প্রায়ই পাশে বসে । আমার অন্যমনস্কতা অথবা দৃষ্টির বিশৃঙ্খলা সে হয়ত খেয়াল করে থাকবে । একদিন যেমন আমি জানতে চেয়েছিলাম সেও জানতে চাইল আমার সমস্যাটা কি ?

'কোন সমস্যা নেই তো !' আমি নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে চাইলাম যদিও জানি না আসলে কি লুকাতে চাই ।

- মিথ্যে বলনা, তুমি সবসময় ছটফট কর, কি যেন খোঁজো ।

'তুমি কেমন করে জানো ?' আমি ওর পর্যবেক্ষণশক্তি বুঝতে চাইলাম ।

- আমি জানি কারন এই মুহূর্তে তুমি আমার এমন কিছু দেখছ যা তোমার দেখার কথা নয় ।

সত্যিই আমি ওর রক্তাভ ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে আছি । লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলাম ।

মৃদু হাসির শব্দ পেলাম । আমি নিচের দিকে তাকিয়ে পায়ের বুড়ো আঙুল মাটিতে খুঁটছি । ও চিবুক ধরে আমার মাথা উঁচু করল, ফিসফিস করে গাইলো আমার মত দিগভ্রান্ত পাখির গান, ' আমারে বলবা তুমি কি দ্যাখো !'

'আমি জানি না আমি কি দেখি, আমার শুধু কিছু একটা করতে ইচ্ছে করে ।'

- কি করতে ইচ্ছে করে ?

'বলতে পারব না ।' ভীষণ অসহায় মনে হল নিজেকে ।

- ছুটির পর তুমি আমার সাথে যাবে । আজ আমি দেখবই তোমার কি করতে ইচ্ছে করে ।

খুব বুঝতে পারছি এটা ভুল ধরনের জেদ । ওর কোন ধারনাই নেই আমি কি করতে পারি ; সত্যি বলতে কি আমারও জানা নেই । হতে পারে যেকোনো ভুল আবেগের বলি হব দুজনেই । তারপরেও দুয়ারে করা নাড়ে অবধারিত প্রতীক্ষা ।

হয়ত চাই তোমার হৃদয় পদদলিত করুক যে কেউ ...
হয়ত চাই শোবার ঘরে নগ্নপদে হাটুক যে কেউ ...

কৃষ্ণবতীর ঘরটি তার রঙরুপের বিপরীত আভায় উদ্ভাসিত । ঘরে গোলাপি ছাড়া আর কোন রঙ চোখেই পড়ে না । দেয়াল, মেঝে, চাদর, আসবাব এমনকি সামান্য পেনসিল কলমগুলো পর্যন্ত ঐ রঙের । তাজা উষ্ণ রক্তের উজ্জ্বলতা আমাকে মুগ্ধ করে কিন্তু এ তো আমার চেয়েও বড় ম্যানিয়াক । আমাকে বিছানায় একা বসিয়ে রেখেছে ও অনেকক্ষণ । কিছুটা আড়ষ্ট বোধ করছি .. গাধী টা করে কি .. আর আমি এখানে কি ঘাস কাটছি ! অজান্তেই পা দুটো কাঁপছে .. রক্তে অজানা শিহরণ ।
স্বাভাবিক হওয়ার জন্য কোলবালিশের সমান পুতুলটাকে ঠোঁট ভেংচি দিতে যাব তখনি ও এল । হাতে একটা ক্যাডবেরি আর ঠোঁটে .. ডিপ পিঙ্ক গ্লস । উফফ আবারও .. এখন লিপস্টিক দেবার কি এমন প্রয়োজন পড়ল । আমি বলেই বসলাম, কালো মেয়েদের পিঙ্ক মানায় না ।
কালো বলে আমার শখ হয় না বুঝি, কাছ থেকে দেখে তারপর বলো সত্যি খারাপ লাগে নাকি, আমার নাক বরাবর তিন ইঞ্চি তফাতে মুখ এগিয়ে আনল ও । হৃদয় স্পন্দন মুহূর্তের তরে থেমে দাঁড়াল কি । পিঙ্ক শেডটা তো বেশ ।
ঢোক গিলে বলতে পারলাম, চকলেট কি আমার জন্য আনছ ?
হুম ..
একটা ক্যান ? তুমি খাবেনা ?
দুইজন মিলে শেয়ার করব .. এই নাও তোমার অর্ধেক ।
প্রায় শোনা যায় না এরকম চকলেট ভাঙার শব্দে হার্টবিট মিস আর আমার মুখের সামনে বাড়ানো হাত । দৃষ্টিবিভ্রম হচ্ছে বোধহয় .. আঙুল, চকলেট, অধর সব গুলিয়ে ফেলছি । দুহাত বাড়িয়ে কোনটিকে টেনে নিলাম নিজেও জানি না । অরণ্য বন্যতার মতই উন্মুক্ত । সেই অরন্যের উষ্ণ হ্রদে ডুবে যাচ্ছি । শুধু ডুবে যাবার অনুভুতি বাদে সমস্ত ইন্দ্রিয় অসার হয়ে আসছে ।
এই কি হচ্ছে এসব !
দুজনে ছিটকে লাফিয়ে উঠলাম । গাধী টা দরজা লক করতে ভুলে গেছে । খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে ওর হতবিহ্বল মা । আমি মাথা নিচু করে ছিলাম তারপরেও বুঝতে পারলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে বরফহিম গলায় বললেন, 'এই মেয়ে, বাড়ি যাও ।'
যন্ত্রচালিতের মত বেরিয়ে এলাম । চিন্তা কেমন জানি থম মেরে গেছে । নিজের ঘরে ঢুকে ভুতগ্রস্তের মত কাপড় পালটে বিছানায় উপুর হয়ে শুলাম । একজন মায়ের বিচারক চোখ আমাকে শাস্তি দিয়ে ফেলেছে । মাথার কাছে প্লেয়ার টা অন করে জাগিয়ে দিলাম ফিওনা অ্যাপলকে । কেউ মারেনি কেউ বকেনি তবু কান্নার ঢেউ ভাসিয়ে নিতে চাইছে । পাতলা কাঁথায় পুরো শরীর মুড়ে অশ্রুজলে জানতে শুরু করলাম জীবনের প্রথম অপরাধবোধ ।

What I need is a good defense 'Cause I'm feelin' like a criminal And I need to redeemed To the one I've sinned against.
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১২ বিকাল ৫:০৩
২০টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×