প্রতীক্ষা
রাতে ঘুম না এলে ইদানিং ঘড়ির দিকে তাকাতে পারিনা । পারতপক্ষে অন্ধকারে থাকি যেন টিকটিক করে আতঙ্ক উদ্রেককারী উপদ্রব তিনটির সাথে চোখাচোখি না হয়ে যায় । সঙ্গী মুঠোফোনটি সময় ঠিক করুন বলতে বলতে আমার মতোই অপেক্ষা করে চলে । ক্রমাগত বেড়ে চলা অস্থিরতা থেকে আমি বুঝি রাতের গভীরতা । অবশ্য কতটা গভীর তা জানার কোন কৌতূহল আমার হয় না । তার চেয়ে বরং নিকষ কালো রাত এবং আঁধারের সহবাস, গত-আগত রাতের তুলনামুলক বিশ্লেষণ নাড়াচাড়া করে আমার সময় কাটে অথবা কাটে না । ভাবি এই রাতের পূর্বের রাতটির বিশেষত্ব আজকের মতো ছিল কি! ভিন্ন স্মৃতি, অন্য গল্প আর অনাস্বাদিত স্বপ্ন নিয়ে আরেকটি রাত তবুও যেন অন্য কিছু । নিজস্ব ছায়া যেমন সবসময় অন্যরকম । চোখের ভাঁজে পুরনো বিষণ্ণতা, হৃদয় অথবা মস্তিষ্কে সেই তীব্র শুন্যতা । তারপরেও আগ্রহ আর আকুলতা চিরনতুন । আসলেই কি তাই! নাকি শরীরের মতো মনেরও আছে অভ্যস্ত জীবন! তা নাহলে এভাবে কেমন দিব্যি বেঁচে থাকি! তেলাপোকার মতো শুধু অস্তিত্ব নিয়ে .. নিজের সবচে বড় ভুলটিকে সঙ্গী করে, সেই ভুলটি আবার করার জন্য ..
উষ্ণ বিছানায় শুয়ে আমি তার হাসির কথা ভাবি, যে হাসি শুধু সে হাসতে পারে সদ্যফোঁটা গোলাপ আর প্রথম রুপকথার জল মিশিয়ে । তন্দ্রাচ্ছন্ন আমি এমন স্বপ্ন দেখি, যে স্বপ্ন শুধু দেখাতে পারে তৃষ্ণার্ত নিশীথিনী আর মায়াবিনী ডাইনীরা । আমি জাগরনে মৃতকে অনুভব করি, নিদ্রায় হয়ত মরেই যাই । বেঁচে থাকার অভিনয় করি তাকে ছাড়াই, কোনও একদিন যাকে নীরব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম .. আমি কেউ একজন হবো, কোথাও ফিরে আসার জন্য ..
যদিও দীর্ঘস্থায়ী অপেক্ষার চেয়ে ক্ষণস্থায়ী জীবন ভালো তারপরেও অপেক্ষাকে বেছে নিয়েছি । কারো জন্যে প্রতীক্ষা নামের অমর গোলাপের জন্য এই সামান্য মূল্য আমি পরিশোধ করতেই পারি । অবশ্য মাঝে মাঝে ভীষণ কান্না পায় আজকের মতো । অন্ধ রাগে সবকিছু ছিঁড়ে ফেলতে ইচ্ছে করে । সে কি জানে না ঘুম পাড়ানি গান না শুনলে আমার মস্তিস্ক শান্ত হয় না .. জেনেও কেন ভুলে যায় ? আমিই বা কেন মনে করিয়ে দেব ? আমি তো সম্মোহিত একজন । আমার কি কোন পছন্দ আছে ? রাতের ঘুম পাচ্ছে আর আঙুলগুলো মুঠোফোনে বারবার তার নাম্বার ছুঁয়ে দিচ্ছে । জানি আমার জন্য পরাজয়ের কোনও একটি মুহূর্ত অপেক্ষা করছে । নিঃশব্দেই একসময় বিনিসুতোর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ব .. তার জন্য ..
প্রাপ্তি, প্রায়শ্চিত্ত অথবা প্রত্যাবর্তন
কালো কাঁচে মোড়ানো গাড়িগুলি দেখলেই মুখোশে ঢাকা মানুষদের কথা মনে পড়ে । মায়ের মৃত্যুর পর থেকে চারপাশে শুধু মুখোশধারীদেরই দেখেছি আমি । নতুন মা দিয়ে যার শুরু .. বাবা চলে যাবার পর বাবার বন্ধু, সমব্যাথি প্রতিবেশী, উদার হৃদয় প্রেমিক এরকম অনেক মুখোশের আড়াল ভেঙ্গে গেছে । জীবনের স্রোতে আমিও ভেঙ্গে গেছি, হয়েছি আরেকজন মুখোশধারিণী । আজও সম্ভাব্য সবচে সুন্দর মুখোশে সেজে দাড়িয়ে আছি । সামনের বিশাল কালো পাজেরোটিকে একটি অপরিচিত দানব মনে হচ্ছে । ভর সন্ধ্যায় ভরা রাস্তায় দাড়িয়েও কেন জানি ভয় লাগছে । আমাকে বলা হয়েছে কালো জানালায় পরপর দুটি টোকা দিতে হবে । কিন্তু দু পা কিছুতেই নড়াতে পারছি না । অজানা আতঙ্কের দেয়াল বাধা দিচ্ছে । অজানা অচেনা পরিস্থিতি আমার নিত্যসঙ্গী । তবে আজকের ব্যাপারটা কিছুতেই ভালো ঠেকছে না । আমাকে না জানিয়ে পরিকল্পনার পরিবর্তন মানে খদ্দেরদের নিশ্চয় কোন দুরভিসন্ধি আছে । এরা চাহিদার তুলনায় অনেক বেশী মূল্য পরিশোধ করছে, সেটাও সন্দেহজনক । মন চাইছে কাজটি না করি, আবার না করে উপায়ও নেই । মাসের প্রথম সপ্তাহ চলছে, এসময় এতগুলি টাকা ফিরিয়ে দেবার বিলাসিতা আমাকে মানায় না ।
আচ্ছন্ন অবস্থায় এগিয়ে গেলাম । ভিতর থেকে কেউ বোধহয় বাহিরে নজর রাখছিল । টোকা দেবার আগেই দরজা খুলে দুটো শক্ত হাত আমাকে মুরগি ধরার মতো খপ করে ধরল । হলুদ দাঁতের ফাক দিয়ে জিভ বের করে লোকটা ঠোঁট চাটল । পিছনে আরেকজন বিশ্রী ভঙ্গিতে বলে উঠল, ' শালিরে দেখতে দেখতে ক্ষুধা লাইগা গেল ।'
চটাস করে একটা চড়ের শব্দ হল । কথাটা যে বলছিল সে গালে হাত নিয়ে একপাশে ছিটকে পড়ল । দামী টিশার্ট জিনস পরিহিত তৃতীয় ব্যক্তিটির কণ্ঠে অস্বাভাবিক শীতলতা, ' আমার অনুমুতি ছাড়া কেউ ওর গায়ে হাত দিবি না, ডাবলু গাড়ি হাইওয়েতে নিয়ে চল ।'
অদৃশ্য নির্দেশে হলুদ দাঁতওলা আমাকে লোকটার পাশে বসিয়ে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল । চড় খাওয়া লোকটাও উঠে সামনে গেল । পাশে বসা আপাত ভদ্র চেহারার নিষ্ঠুর মানুষটিকে চিনতে আমার ভুল হয়নি । সে আমাকে নিয়ে কি করতে চায় এটা জানার জন্য প্রায় প্রশ্নের ছলে বললাম, ' শুধু একজনের কথা হয়েছিল .. '
জবাবে আমার মাথা দুপায়ের মাঝে চেপে ধরে হিসহিস করে উঠলো সাপ, ' আমি যা বলি সেটাই কথা । নাউ সাক মি বিচ ।'
বর্বরেরা জীবন্ত পশুকে আতঙ্কিত করে আমোদিত হতো । নিজেকে সেরকম একটি পশু ভাবতে বাধ্য হলাম । যেন কোন ছাগলের চামড়া ছিলে নেয়া হচ্ছে সেভাবে আমার কাপড় ছিঁড়ে নেয়া হল । প্রহারে প্রহারে নগ্ন নিতম্ব ছেয়ে গেল লালচে কষ্টে । আমি ফুসফুস বিদীর্ণ করে চিৎকার করতে চাইলাম । মুখে গুজে দেয়া মাংসপিণ্ডের কারনে শুধু গোঙানিই ধ্বনিত হতে পারল । এবং আমার কষ্টের বহিঃপ্রকাশ আমার জন্য আরও তীব্রতর কষ্টের জন্ম দিতে লাগল । সদ্য জবাই করা পশুর মত আমি হাত পা ছুড়ে নিষ্কৃতি চাইলাম । হাত পা বেঁধে সেটাও থামিয়ে দেয়া হল । ক্রমশ অনুভূতিহীন এক জগত আমাকে ঘিরে ধরতে শুরু করল । আমাকে নিয়ে কি করা হচ্ছে আমি ঠিক বুঝতেও পারছি না আর । ভীষণ ঘুম পাচ্ছে .. খুব প্রিয় কোন স্মৃতির মাঝে ডুবে যেতে ইচ্ছে করছে .. মায়ের মুখ মনে করার চেষ্টা করছি .. কিছুতেই মনে আসছে না .. মনে পড়ল কেউ একজন অপেক্ষা করছে গল্প শুনবে বলে .. যে সে গল্পে চলবে না .. রঙিন পরীদের হারানো দুনিয়ার গল্প .. কল্পনার নদীতে দুহাত চুবিয়ে গল্প খুঁজতে হবে .. মন ভোলানো .. ঘুম পাড়ানিয়া ..