২০০৭ সালের কথা, গবেষনা করতে করতে বেরিয়ে এলো কোনো একটা পত্রিকার লেখা ও ছবি, নিঝুম দ্বীপ নিয়ে- হরিনের ছবি দেখে চোখ কপালে উঠে গেল। ঠিক করলাম পরের ছুটিতেই বেরিয়ে পড়বো। তখন ফেসবুকের ঘুরাঘুরি করা গ্রুপ "ভ্রমন বাংলাদেশ"এর খবর জানা ছিল না, বন্ধু বান্ধব দের তোষামুদি করতে লাগলাম সঙ্গি হওয়ার জন্য। খুব একটা আগ্রহ দেখালো না কেউ, হরিন এর গল্পও মনে হয় কেউ বিশ্বাস করলো না, যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমরা দুই বন্ধু (আমি আর সোহেল) বেরিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
কেউ ঠিকমতো বলতে পারে না কিভাবে যেতে হবে, খবর পেলাম লন্ঞ্চ এ যেতে হবে ঢাকা থেকে। যা আছে কপালে ভেবে দুইটা ছোট তাবু, একগাদা বিস্কুট, পাউরুটি, জ্যাম, ৩ইন১ কফি, গরম পানির ফ্লাক্স আর টিস্যু নিয়ে এক সন্ধায় উঠে বসলাম সদরঘাট থেকে হাতিয়া-র লন্ঞ্চ এ, নামতে হবে শেষ ঘাট তমিরুদ্দি তে।
গরম গরম মারাত্মক ঝাল রুই মাছ আর ভাত দিয়ে রাতের খাবার খেয়ে সারারাত পার করে সকাল বেলা পৌছালাম তমিরুদ্দি, ঘাটে নেমে তাড়াতাড়ি কলা, চা আর লাঠি বিস্কুট দিয়ে নাস্তা শেষে খোঁজ করতে লাগলাম কিভাবে যাওয়া যাবে নিজুম দ্বীপ। পরিচয় হলো আরেক গ্রুপ এর সাথে (তাদের কয়েকজনের টি-শার্ট আর ক্যাপ পরিচয় দিচ্ছে তারা গ্রামীনফোন এর গর্বিত কর্মী), ভিড়ে গেলাম তাদের সাথে নৌকা ভাড়া মুলামুলি করতে। ঠিক হলো নৌকাওয়ালা আমাদের পৌছে দিয়ে ২ দিন নিঝুমদ্বীপেই থাকবে, আর আমরা ঐ নৌকা নিয়েই ফিরে আসবো।
বিকালটা ভালই কাটলো ঘাস বনে হরিন আর পাখি দেখে, কিন্তু সন্ধা বেলা পড়লাম মহা বিপদে, আমাদের সঙ্গিরা কয়েক ঘন্টা ঘুরে ঠিক করলো পরদিন সকালে তারা ফিরে যাবে হাতিয়া সদরে, অথচ আমাদের প্ল্যান আরো ১টা পুরা দিন ঘুরে ঘুরে দেখা। তারা নৌকা নিয়ে গেলে আমরা কিভাবে যাবো কনো ঠিক নাই, আবার ঠিক সময়ে ঢাকা ফিরে অফিস ধরতে হবে.. যা আছে কপালে ভেবে বিদায় দিলাম উনাদের।
এখানে বনবিভাগ একসময় কিছু হরিন ছাড়ে, তাই বেড়ে বেড়ে হয়েছে অসংখ্য। আমরা উঠেছি বন বিভাগের বিট অফিস এ, একটা সুন্দর গেস্ট রুম (কোলবালিশ সহ) আছে বড়কর্তা দের জন্য, ওটাই জুটেছে কপালগুনে। পরদিন সকালে ঘাটে খোঁজ করতে গেলাম নৌকার, দুরে চরে যেতে হবে নৌকা নিয়ে ভালোভাবে হরিন দেখতে হলে। এরই মধ্যে ৮/১০ জনের একটা গ্রুপকে পেলাম, বন বিভাগের কোন কর্তার যেন গেস্ট, বনবিভাগের নৌকা নিয়ে যাবে চর এ ঘুরতে, আমরা যেতে চাই আনুরোধ করাতে খুব একটা খুশি হলেন না উনারা, হয়ত ভেবেছেন কোথাকার না কোথাকার পোলাপাইন, তাদের সঙ্গের "যে তো আমার চেহারা, নাম রেখেছে পেয়ারা" টাইপ মেয়েদের সাথে না আবার খাতির করার কনো চেষ্টা করি। আমাদের নৌকায় নেয় নি শুনে খুবই মন খারাপ করলো বনবিভাগের মালি খোকন ভাই, আসার পর থেকে উনিই আমাদের দেখাশুনা করছিলেন এই ২ দিন।
বন বিভাগের নৌকা আরো আছে, কিন্তু মাঝি একজন, যে কিনা পেয়ারা গ্রুপ নিয়ে চলে গেছে। বেশ কিছুক্ষন পর খোকন ভাই বাজার থেকে এক মাঝি নিয়ে হাজির, বল্লো চলেন স্যার রওয়ানা দেই। আমরা ২ জন, সাথে এক পিচ্চি (আমাদের সাথে সাথে ঘুরে ও, আমরা খুসি হয়ে ১০/২০ টাকা দেই, সেন্ট মার্টিনস এর মত "গাইড" কথাটা শেখেনি তখনো) আর খোকন ভাই রওনা দিলাম বিশাল নৌকা নিয়ে, নিজেদের কে বেশ নবাব নবাব মনে হচ্ছিল তখন। খোকন ভাই আমাদের বেশ অনেকগুলি চরে ঘুরালেন। রাজশাহী চিড়িয়াখানাই অনেক হরিন দেখেছিলাম ছোট বেলায়, কিন্তু এত হরিন কখন দেখবো কল্পনাও করিনি। এরি মাঝে আমরা পেয়ারা গ্রুপ কে নবাবি কায়দায় ওভারটেক করে এসেছি, ভাব ধরেছি "হু হু বাবা, আমাদের তো চেনো না...."
সারাদিন ঘুরে ফিরে সন্ধায় লোকাল বাজারে চক্কর দিলাম কিছুক্ষন। একটা সিনেমা হল আছে, সামনে পোষ্টার টাঙানো, ঢু মারলাম ভিতরে, দেখি অনেক গুলা কাঠের বেঞ্চি, একদম সামনে টিভি আর ভিসিডি প্লেয়ার রাখা, চলে ব্যাটারি তে। বেশ ভালো সিস্টেম। রাতে খোকন ভাই এর রান্না মুরগির ঝোল আর ভাত, বাইরে চাঁদের আলো তে হরিন এর জ্বলজলে চোখ....
ঘরের বারান্দা থেকে দেখা যায় হরিনের ঘাস পানি খাওয়া:
পরদিন সকালে ফেরত যাবে এমন আরেক টুরিস্ট গ্রুপের মাঝির সাথে আমাদের ভাও করে দিলেন খোকন ভাই। ভোরবেলা অন্ধকার থাকতে আমরা নৌকা ঘাটে এসে বসে আছি, যেনো আমাদের ফেলে চলে না যায় নৌকা। নৌকা মিস্ মানে লঞ্চ মিস্, আর লঞ্চ মিস্ করলে অফিসে খবর।
জোয়ার আসতে নৌকা রওয়ানা দিল, বেশ বড় টুরিস্ট গ্রুপ, দেখে মনে হচ্ছে রাজধানির হাওয়া লাগান মানুষ। সামনে পাটি বিছানো, সেখানে অভিজাতরা বসে, আমাদের স্হান হয়েছে পেছনে ইন্জিনের কাছাকাছি, শব্দ আর ধোয়ার মাঝে মাঝিদের সাথে। সবাই দেখি নাস্তা শুরু করেছে, পরাটা, পলেথিনে ডাল আর একটা করে কলা। টুরিষ্ট রা পেল, মাঝিরা পেল, আমরা কিন্তু পেলাম না নাস্তা। সোহেল কিন্তু খুব খুসি যে আমাদের নাস্তা অফার করেনি কেউ, ব্যাকপ্যাকের এপকেট ওপকেট খুজে ও বের করা শুরু করলো আমাদের সম্বল, কুপারস এর রুটি, টোভা জ্যাম এর বয়াম, প্রানের আমসত্ত্ব, ৩ইন১ কফির প্যাকেট- সামনে নৌকার পাটাতন তো না যেনো বাসার ডাইনিং টেবিল। সোহেল এরি মধ্যে মাঝিদের এক প্রস্হ রুটি বিতরন করে ফেলেছে সবাইকে লজ্জা দেয়ার জন্য, আমিতো ভয়েই ছিলাম ও না আবার অন্যদেরও অফার করে বসে। খাওয়া শেষে ২ মগে ৩ইন১ কফি ঢেলে পানি ঢেলে দেখি পানি একদম ঠান্ডা, গতরাতে ফ্লাস্কে রাখা পানি, সকালে আবার গরম পানি নিবো মনে ছিল না। আমি ফিসফিস করে পরামর্শ দিলাম পানি গরম এমন ভাব ধরতে, মান সম্মান এর ব্যাপার হাজার হলেও। দুইজন মিলে ঠান্ডা কফি চুমুক দিয়ে দিয়ে সময় নিয়ে শেষ করলাম
[লঞ্চে ঐ টুরিস্ট গ্রুপের একটি স্কুল পড়ুয়া ছেলে পরে আমাদের কাছে আসে গল্প করতে, তারা সবাই থাকে মিরপুর এ। আমাদের নিয়ে নাকি তারা অনেক আলাপ আলোচনা করেছে, বিশেষ করে আমাদের বিশাল ব্যাকপ্যাক ও নাস্তায় কফি খাওয়া তাদের বিশেষ ভাবে আলোড়িত করেছে, আমরাও সুজোগ পেয়ে তাকে অনেক রকম রাজা উজির হাতি ঘোড়া মারা গল্প দিলাম বিভিন্ন টুরের]।
নিচে কিছু ছবি:
ম্যানগ্রোভ বনে হরিন:
হরিনের পাল:
বন্য কুকুরের কামড়ে মৃত হরিন:
হরিনের পাল:
মহিষের পাল:
চিংড়ি পোনা সংগ্রহ:
শুটকি তৈরি:
নিঝুম দ্বীপের আরো ছবি দেখতে দেখুন আমার ফেসবুক পাবলিক এলবাম: NijhumDwip
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০০৯ দুপুর ১:২৯