somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টেবিল পাহাড় দো-টুয়াং

১৫ ই অক্টোবর, ২০১২ রাত ১১:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- দো-টুয়াং পাহাড়

তাজিংডং অথবা রামাক্রি যাওয়ার পথে মাঝে মাঝেই কিছু অদ্ভুত পাহাড় চোখে পড়ে যেগুলোর মাথাটা সমান করে কাটা। খুব ইচ্ছা করতো ওগুলোর মাথায় উঠে বসে থাকতে। এই ধরনের পাহাড় গুলাকে টেবিল পাহাড় বলা হয়। ট্রাভেল গ্রুপ “ট্রাভেলারস অফ বাংলাদেশ” এর পিচ্চি ২ সদেস্যর পিড়াপিড়িতে গত মাসে ঠিক করলাম এমন একটা পাহাড়ে যাবো, স্থানিয় নাম দো – টুয়াং। রাহাত ভাই এর সাজেশন নিয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই রুট প্ল্যান করে ফেললাম সবাই মিলে, গুগল আর্থ থেকে দেখে নিলাম কোন পাড়া থেকে কোন পাড়া যেতে হবে। ফেরার সময় একই পথে না ফিরে ভিন্ন পথে ফিরবো ঠিক করলাম। যেহেতু বেশ কিছুদিন যাবত আমরা চেস্টা করে যাচ্ছিলাম যে সম্পুর্ন সনির্ভর ভাবে ব্যাকপ্যাকিং ট্রিপ করবো অর্থাত নিজেরা থাকা বা খাওয়ার জন্য কারো উপর নির্ভর করবো না বা লোকাল কমুনিটিতে কোন ইমপ্যাক্ট ফেলবো না, তাই সবাই আমরা নিজেদের তাবু, স্লিপিংব্যাগ, খাওয়াদাওয়ার রসদ ও ছোট্ট ক্যাম্পিং চুলা বানিয়ে সাথে নিয়ে নিয়েছি এইবার।


বৃহ:স্পতিবার রাতের বাসে ঢাকা থেকে বান্দরবন রওনা দিলাম ৬ জনের দল, এক ঘুমে রাত পার করে সকাল বেলা বান্দরবন থেকে একটা লক্কর ঝক্কর মার্কা ফোর হুইল এ সবাই চেপে বসলাম, গন্তব্য থানচি বাজার। আগেই ঠিক করা ছিল যে থানচি তে আমরা বেশি সময় থামবো না তাই চিম্বুকের কাছে বেলা ১০ টার দিকে পেট ভরে সবাই আর্মির ক্যান্টিনে না খিচুরি না পোলাও না বিরিয়ানি টাইপ এক বস্তু খেয়ে নিলাম, এটাই হবে শেয ভারি খাওয়া রাতের আগে। পথে খিদে পেলে শুকনা খাবার হিসাবে আছে খেজুর, বাদাম, আম শক্ত ও বিস্কুট টাইপের হাবিজাবি অনেক কিছু।


দুপুরের ঠিক আগে আগে থানচি পৌছেগেলাম, শুরু হলো ৬/৭ ঘন্টার ট্রেকিং এর প্রস্তুতি। কেউবা সেন্ডেল খুলে জুতা পড়লো, কেই আবার জুতা খুলে সেন্ডেল, যার যেটাতে হাঁটতে সুবিধা। সান্গু নদীথেকে সবই যার যার পানির বোতল ভরে নিয়ে ব্যাগের পকেটে রেখে হালকা কিছু খেয়ে রওনা দিলাম, আজকের গন্তব্য বোর্ডিং হেডম্যান পাড়া।


রানা ভাইয়ের এটাই প্রথম পাহাড়ে আসা, অবাক হয়ে উনি দেখতে থাকেন চারিদিকে আর বলেন – অপূর্ব। যেসব যায়গায় পাশে গভীর খাঁদ আর অনেক নিচে পর্যন্ত দেখা যায় সেসব যায়গায় উনার হাত পা কাঁপতে থাকে, আমরা বেশ উপভোগ করতে থাকি উনার এই মানসিক কষ্ট। উনাকে নিয়ে মজা করতে করতে চলতে থাকি পাহাড়ি পথ। পথের মাঝে অনেক স্থানীয় মানুষের সাথে দেখা হয়, কুশল বিনিময় হয়, পরিচয় বের হয়ে আসে, আগে কোন একসময় হয়তো ছিলাম তাদের বাসায়, কোনবার হয়তো উনি একটা গাছের পেঁপে খেতে দিয়েছিলেন। পাহাড়ের এই মানুষ গুলা অনেক আন্তরিক, তাদের জিবন যাত্রার মতোই সরল তাদের মন। বাংলার যেসব অচেনা দামাল ছেলে মেয়ে হঠাৎ হঠাৎ তাদের দেশে ঘুরতে চলে আসে তাদেরকে পরম মমতায় ঠায় দেয় মমতাময়ি কোন মা তার ঘরে, রেঁধে দেয় ভাত টা।

সন্ধার ঠিক আগে আগে পৌছেগেলাম বোর্ডিং পাড়ার পাশের ঝিরিতে, সামনে সুন্দর একটা মাঠ, এখানেই থাকবো তাবু ফেলে ঠিক করলাম। পিঠের বড় বড় ব্যাকপ্যাকগুলা নামিয়ে একটু জিরিয়ে নিয়ে শুরু করলাম তাবু খাটানো। এর মাঝে পাড়া থেকে কয়েকজন এসে জানালো আসে পাসে নাকি কি নিয়ে গন্ডগোল চলছে, আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে আমাদের কে পাড়ার ভেতরে স্কুল মাঠে তাবু করে থাকতে অনুরোধ করলো সবাই।
সেইরাতে আমরা পরিস্কার একটা স্কুলের উঠানে থাকলাম, রাতে রান্না করলাম ভাত, চিংড়ির সুটকি ভর্তা আর মাসরুমের ঝোল। উফ, সারাদিন হাঁটার পর মনে হলো এরথেকে ভালো খাবার জিবনে আর খাই নি কখনো। খাবার পরে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলাম ঝিরির ভেতরে বড় বড় পাথরের উপর বসে।


- শেরকর পাড়া


দ্বিতীয় দিন বেশ ভোর বেলা উঠে আগুন জালিয়ে কড়া করে একমগ কফি আর বিস্কিট খেয়ে রওনা দিলাম শেরকর পাড়ার দিকে, ইচ্ছা শেরকর পাড়া হয়ে দো-টুয়াং চলে যাব সন্ধার আগে আগে। দুপুরের ভেতর তাজিংডং এর কোল ঘেষে থাকা সুন্দর ছিমছাম শেরকর পাড়ায় পৌছে গেলাম, এই পাড়াটা আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দর, পরিস্কার এবং আন্তরিক পাড়া, এর আগেও অনেকবার এই পথে যাওয়ার সময় এখানে থেকেছি। হালকা কিছু খেয়ে রওনা দেয়ার কথা থাকলেও যারা আগে তাজিংডং যায়নি তারা গো ধোরলো যে তাজিংডংয়ের নিচ থেকে পিক সামিট না করে চলে গেলে অপমান করা হবে তাজিংডং কে, হিসাব নিকাশ করে দেখা গেলো একদিন বেশি লেগে গেলেও সম্ভব। সন্ধার দিকে ফিরে এলো ৪ জন পিক সামিট করে, বাকি ২ জন আমরা তখন খাবার রেডি করে বসে আছি। সনির্ভর ব্যাকপ্যাকিং এর খেতাপুরি বলে পাড়ার ১ টা মুরগি ততক্ষনে আমাদের প্লেটে চলে এসেছে।


- দো-টুয়াং পাড়া


পরদিন সকাল সকাল চিড়া গুড় আর কফি খেয়ে রওয়ানা দিলাম দো-টুয়াং পাড়ার পথে, সাথে আছে পথ দেখানোর জন্য লাল সিয়াম বম দাদার ছেলে। সেরকর পাড়া থেকে দো-টুয়াং এর কনো পথ নাই, আমাদের যেতে হলো অনেকগুলা ছোট ছোট পাহাড়, জঙ্গল আর ঝিরি পার হয়ে। এরি মাঝে সবাই কয়েকবার করে আছাড় খেয়ে হাত পায়ের ছাল তুলে ফেলেছি। দুপুরের আগে আগে পৌছালাম দো-টুয়াং পাহাড়ের নীচে দো-টুয়াং পাড়ায়। এখানে দুপুরের খাবার রান্না করে খেয়ে ব্যাগ গুলা রেখে আমরা উঠা শুরু করলাম দো-টুয়াং এ। ঘন্টা খানেকের মধ্যে পাহাড়ের উপর উঠে দেখি চারিদিকে লাল হয়ে আছে পাহাড়ের সমতল মাথাটা, চারিদিকে বড় বড় গাছ আর তার মাঝে চাষ করা হয়েছে টক জাতিও সব্জি লাল চুকর। বেশ কিছুক্ষন এদিক ওদিক ঘুরে জিপিএস রিসিভারে উচ্চতা মেপে নেমে এলাম পাড়াতে সন্ধার সময়।


- দো-টুয়াং এর লাল পিক


পরদিন সকালে শুরু হলো ফেরার পালা, সাথে আছে জনি ত্রিপুরা নামের হাসি খুশি ত্রিপুরা বালক, ও আমাদের পৌছে দিবে রামাক্রি খাল এ, রামাক্রি খাল ধরে আমরা নেমে যাবো রামাক্রি বাজারে এটাই আমাদের ফেরার রুট।
জনির হাতে একটা গুলতি, ওটা দিয়ে পাখি আর কাঠবিড়ালি মেরে খায় ও, যদিও অনেক চেস্টা করে একটাও মারতে না পেরে শেষে আমাদের দেয়া নুডলস খেয়েই পেট ঠান্ডা করতে হলো ওকে ঐদিন দুপুরে। রামাক্রি খালে আমরা নামলাম অমিয়াকুম আর নাফাকুম এর মাঝামাঝি স্থানে। একটা কুম (কুম মানে পানিতে গভীর গর্ত) পার হতে হলো বাশের তৈরি ভেলায় করে।




- রামাক্রি খাল


ফেরার পথে ঐরাতে আমরা ক্যাম্প করলাম জিন্না পাড়া ও উল্লাউয়া পাড়ার মাঝামাঝি এক সুন্দর জায়গায় খালের পাড়ে। চারদিকে পাহাড় উঠে গেছে, পেছনে জঙ্গল আর সামনে বয়ে চলেছে রেমাক্রি খাল। সন্ধার পর কুয়াশার চাদর ঢেকে দিল আমাদের, আমরা কাঠকুটো কুড়িয়ে একটা বড় ক্যাম্পফায়ার করে বসে আছে, কেউ শুকাচ্ছে ভেজা কাপড়, কেউবা গরম করছে ঠান্ডা হয়ে জাওয়া কফি। ভোর বেলা শুনলাম হরিনের ডাক, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে মনে হয় পানি খেতে এসেছিল। পরদিন দুপুরে পথে পড়লো নাফাকুম, নাফাকুম এখনকার পর্যটকদের জন্য বেশ বিখ্যাত একটা জায়গা, সবাই দলে দলে আসে। নাফাকুমের পাড়ে লোকাল একজনের কাছ থেকে কিছু মাছ কিনে নিয়ে কঁচি বাঁশের ভেতর রান্না করে খেলাম ২টা আর পুড়ুয়ে খেলাম ৩ টা। বাঁশের টাই বেশি মজা পেলাম। সন্ধার পরে রামাক্রি বাজারে পৌছেগেলাম। সবার মন একটু খারাপ, কারন এত সুন্দর ট্রেকিং এর এখানেই শেষ। পরের দিন নৌকায় করে রামাক্রি থেকে থানচি হয়ে ঘরে ফেরার পালা।


- নাফাকুম ঝরনা


আমরা ট্রেকিং এর সময় আমাদের ব্যাবহৃত সবরকম পলেথিন ও প্লাস্টিকের বোতল নিজ দায়িত্তে ব্যাগএ করে ফিরিয়ে আনি অথবা পুড়িয়ে ফেলি। অনুরোধ আপনারাও দয়া করে পরিবেশের প্রতি সদয় থাকবেন, কোন ময়লা যা প্রাকৃতিক বা জৈবিক না তা ফেলে আসবেন না। ট্রিকিং এ ছোট গ্রুপ যাওয়া বান্চনিয়, ৫-৬ জন খুব বেশি হলে। বড় গ্রুপ হলে শব্দ দুষন বেড়ে যায়, ফলে আসে পাসের জ্বীবজন্তু দুরে সরে যায়, কিছুই দেখতে পাবেন না। যতটা পারুন সনির্ভরশীল ভাবে ট্রেকিং করুন, বড় গ্রুপ ঘুরতে যেয়ে পাড়ার সব মুরগি খেয়ে ফেললে ওখানকার বাচ্চারা কিন্তু আর ডিম পাবেনা সামনের কিছু দিন। যতটুকু সম্ভব কম জিনিস নিন পাড়া থেকে।


পূর্বে প্রকাশিত:
১. কালের কন্ঠ (ঢাকা, সোমবার ২৭ আগষ্ট ২০১২, ১২ ভাদ্র ১৪১৯, ৮ শাওয়াল ১৪৩৩)
২. আমার ব্যাক্তিগত ব্লগ সাইটে: http://www.s21rc.net/?p=740

লোকেশন:
Latitude: 21°47’58.28”N
Longitude: 92°32’26.92”E
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×