শুভ মাহমুদ
কথা হয়েছে সংসদে। কথা বলেছেন সংসদ সদস্যরা। তারা কথা বলেছেন, গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে। সাংবাদিকদের সমালোচনা করেছেন তারা। সমালোচনা করেছেন একজন সম্পাদকেরও। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন ওই সম্পাদক আবারও ওয়ান-ইলেভেনের মতো আরেকটি দুর্যোগের পটভূমি তৈরি করছেন। বাংলা ভাষায় একটি প্রবাদ আছেÑ একবার চুন খেয়ে মুখ পোড়ালে নাকি দই দেখলেও ভয় লাগে। হয়তো তেমনই আশংকায় আতঙ্কিত সংসদ সদস্যরা। হয়তো একেবারেই অমূলক নয় এই ভীতি, কিন্তু এ ভীতির দাওয়াই কি? যে সম্পাদক একটা অসময়ে দম্ভ করে দাবি করেছিলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের সরকার আমরাই এনেছি...’ সেই ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের আমলেই ওই সম্পাদককে বায়তুল মোকাররমের খতিবের হাত ধরে তওবা করতে হয়েছে। অতি সম্প্রতি সেই সম্পাদক তার ভুল স্বীকার করেছেন স্বয়ং বর্তমান সরকার প্রধান প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার কাছেও। এখন তাকে ধরে এনে বিচার করার অর্থ তাকে গুরুত্ব প্রদান করা খামোখা। তাকে দুষতে গিয়ে সংসদ সদস্যরা দুষলেন ঢালাওভাবে গণমাধ্যমকে। সবকিছুর এরকম ঢালাও মূল্যায়ন এবং সবকিছু সম্পর্কে এ রকম ঢালাও সিদ্ধান্ত আমাদের নানা দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে। কিছু মানুষ চুরি করে, দুর্নীতি করে, অপরাধ করে তার অর্থ যদি আমরা সাধারণীকরণ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিÑ মানুষ মাত্রই চোর, দুর্নীতিবাজ, অপরাধী, সেটা কি ঠিক হবে? না সেটা সত্যের কাছাকাছি? একইভাবে কিছু গণমাধ্যম সংসদ সদস্যদের ত্র“টি-বিচ্যুতির কথা লিখছে এজন্য দেশের সব গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যম কর্মীরা খারাপ এমন সিদ্ধান্ত টানা দুর্ভাগ্যজনক এবং আÍঘাতী। জাতীয় সংসদের মতো একটি স্থানে সংসদ সদস্যদের আর যাই হোক পল্টন মাঠের মেঠো বক্তৃতা দেয়া মানায় না। এ কথার অর্থ এ নয় যে, আমি সংসদকে ধর্মীয় উপাসনালয় মসজিদ, মন্দির বা গির্জা বিবেচনা করছি। এ কথার অর্থ এই যে, বর্তমান সংসদ সদস্যদের ন্যূনতম প্রজ্ঞার ওপর আমাদের আস্থা আছে। যে যাই বলুক, যত হতাশাই প্রকাশ করুন না কেন তাদের ওপর আমি ব্যক্তিগতভাবে ১৯৯০, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৫ এবং বর্তমানে নির্বাচিত এ সংসদের সদস্যদের সত্যিকার অর্থে জনপ্রতিনিধি মনে করি। বাংলাদেশে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানোত্তর যে গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা, সেই রাজনীতির ধারাবাহিকতায় গঠিত এই সংসদ। এই সংসদের সদস্যদের আমি বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ গণতন্ত্র চর্চার প্রতিনিধি বলে মনে করি। তাই তাদের কাছে দায়িত্বশীলতার প্রত্যাশা খুব স্বাভাবিক। তারা তাদের সমকালীন সমাজ সম্পর্কে সচেতন থাকবেন এমনটাই কাম্য তাদের কাছে। কিছুদিন আগে একজন সংসদ সদস্য ও মন্ত্রী একটা মজার উক্তি করেছিলেন গণমাধ্যম সম্পর্কে। তিনি বলেছিলেন, ‘অবস্থা এমন হয়েছে যে, একজন আরেকজনকে বকা দেয়ার জন্য একটি পত্রিকা বের করছেন।’ এই যখন দেশের গণমাধ্যমের অবস্থা তখন গণমাধ্যম কতটা ‘গণ’ আছে আর কতটা তা ‘মালিক মাধ্যমে’ পরিণত হয়েছে সেকথা ভুলে গেলে চলবে কি?
‘বদলে যাও, বদলে দাও’Ñ এই চটকদারি স্লোগানের মুখোশে কেউ কেউ আলাদীনের চেরাগ খুঁজে পেয়েছেন একথা সত্যি। দেশীয় পুঁজির বিকাশ তাদের চক্ষুশূল! তারা সারাদেশ ভরে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ পিজাহাটের ফাস্টফুডে। বিদেশী পণ্য এনে এখানে জুড়ে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা করা, কমিশন এজেন্ট বনে যাওয়া অনেক সহজ। দেশে কলকারখানা স্থাপন করে মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি কিংবা উৎপাদন বৃদ্ধিÑ অপ্রয়োজনীয় তাদের কাছে। এরা যৌবনে সমাজ পরিবর্তনের কথা বলতেন, বলতেন সমাজ পরিবর্তন হলে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তিত হয়ে যাবেÑ সমাজের পরিবর্তন ঘটেনি। এরা এখন নিজেদের ‘বদলে দাও, বদলে যাও’ বলে বলছেন কিন্তু বিন্দুমাত্র বদলাননি নিজেরা না বাস্তবে, না চেতনায়। বদলাননি বলেই অগণতান্ত্রিক শক্তিকে ‘আমাদের’ বলে দম্ভোক্তি করেন। না চেতনায়, না বাস্তবে এরা কখনোই ‘গণমানুষের’ অংশ ছিলেন না, যতই তারা নিজেদের দাবি করুন না কেন ‘প্রলেতারিয়েত’দের মিত্র বলে। এরা কখনোই মিত্র ছিলেন না সাধারণ মানুষেরও। আজকে এরা পিজা সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে কি বদলে দিতে চায়? বাংলায় একটি মজার প্রবাদ আছেÑ পর্বতের মূষিক প্রসব। ‘বদলে দেয়া’র স্লোগান দিয়ে এরা যে হাস্য-তামাশার সূচনা করেছিল তা এদের অন্তসারশূন্যতাকে উলঙ্গ করে দিয়েছে; ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। খুবই হাস্যকর বালখিল্য এবং ইতরোচিত এদের বদলে দেয়ার দর্শন। এদের বদলে দেয়ার কয়েকটি কৌতুকপ্রদ ঘটনার উল্লেখ করা যায়। চট্টগ্রাম থেকে এক প্রবীণ লেখক নাকি লেখা দিতে গিয়েছিলেন ‘বদলে দেবার’ পত্রিকা অফিসে। তা সেই প্রবীণ লেখক ভদ্রলোককে পত্রিকাটির এক কনিষ্ঠ কর্মী উপদেশ প্রদান করে, ‘আপনার নামটি একজন কুখ্যাত রাজাকারের নামের সঙ্গে মিলে যায়, আপনার নামটি বদলে ফেলুন।’ শুনে প্রবীণ লেখক ভদ্রলোক রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নাকি বলেছিলেন, ‘তাহলে তো জনাব শুরু করতে হবে আপনার সম্পাদককে দিয়ে।’ হ্যাঁ, এই হচ্ছে এদের বদলে দেবার নমুনা এবং বদলে দেবার দর্শন। সেই দর্শনে এরা সাংঘাতিকভাবে ‘একীন’ সেটা বোঝা যাচ্ছে তাদের সাম্প্রতিক তৎপরতায়ও। তারা বদলে দিতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ তাদের এই ধনুর্ভঙ্গ প্রতিজ্ঞায় বিরক্ত কেউ কেউ তাদের অফিসের সামনে বিলবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছে ‘সব কিছু বদলাতে নেই, সত্য, সংবাদ, সম্পর্ক, সুন্দর’ কিন্তু কে শোনে কার কথা। তারা বদলাবেইÑ তারা লেখকদের ডাকনাম ছাপা বাদ দিয়েছে; ফলে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু হয়ে যাচ্ছেন আকিকা ছাড়াই আনোয়ার হোসেন, রাশেদ খান মেনন হয়ে যাচ্ছেন আকিকা ছাড়া রাশেদ খান, হাসানুল হক ইনু হয়ে যাচ্ছেন হাসানুল হক, শামসুল হক টুকু হয়ে যাচ্ছেন শামসুল হক। ফলে পাঠক অত্যাচারিত বোধ করছেন। অত্যাচারিত হচ্ছে সমকালÑ এখন এই বদলে দেবার উš§াদদের সেটা বোঝাবে কে! এই এক্সপেরিমেন্টাল গণমাধ্যম না ‘গণে’র না সুস্থ।
আমাদের ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কারও নাম বিকৃত করা নিষিদ্ধ এক প্রকার গুনাহ। নৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মানদণ্ডে নাম বিকৃতিকে এক ধরনের অপরাধ গণ্য করা যায়। একজন সম্পাদকের খেয়াল-খুশি, ইচ্ছামর্জি অনুযায়ী এটা ঘটা সেই সম্পাদকের মানসিক ভারসাম্য বিষয়ে প্রশ্নের জš§ দেয় খুব স্বাভাবিকভাবেই। ইচ্ছা হলেই কেউ কারও নামের বিয়োজন বা সংযোজন করতে পারে না। তাই যদি পারত তবে ওই সম্পাদকের নামের শেষে কেউ রাজাকার শ্রেষ্ঠ তার মিতার নাম যুক্ত করে তাকে ডাকতে পারত। তা যেমন কেউ করে না তেমনই কারও নাম কেটে হ্রাস করা যায় না। কিছুদিন আগে এই পত্রিকাতেই খবর ছাপা হয়েছে একই নামে পুলিশ কর্মকর্তা গৌতম হত্যার দু’জন আসামিকে নিয়ে র্যাব-পুলিশ বিপাকে। একই নামের আসামি নিয়ে যদি র্যাব-পুলিশ বিপাকে পড়ে তবে একই নামে সমাজের অনেক যশস্বী মানুষকে নিয়ে পাঠক কি বিপদে আছে তা কি ওই সাংস্কৃতিক নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী সম্পাদকের বোধে ঢুকবে, বদলে দেবার অর্থহীন পাগলামিতে মত্ত যিনি?
গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে সংসদ সদস্যরা বলেছেন নাকি যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে তারা বক্তব্য রেখেছেন? আমার মনে হয়, জনপ্রতিনিধিরা স্পিকার সাহেবের মতো ভালো কাজের উদাহরণ এবং তার বিপরীতে পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের নমুনা তুলে ধরে বক্তব্য রাখলে বিষয়টি খুব পরিষ্কার হয়ে যেত।
এই সংসদের সদস্যদের একথা স্মরণ রাখতে বলি, গণমাধ্যমকে আরও স্বাধীনতা দেয়া প্রয়োজন কিন্তু যথেচ্ছাচারের অধিকার নয়! তাদের সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদপত্র জনমত গঠন করবে তার বদলে জনমত বিভ্রান্ত করলে সেটা ঠেকাতে হবে। ‘আলো’র নামে ‘অন্ধকার’ ছড়ানো রোধ করতে হবে, ‘অন্ধকার’ বিপণন বন্ধ করতে হবে। সেটা সুনির্দিষ্ট এবং সুস্থ পথে, হুমকি-ধামকিতে নয়। গণমাধ্যম যে ব্যক্তির ইচ্ছা চরিতার্থ করার হাতিয়ার রূপে ব্যক্তি মাধ্যম হয়ে উঠছে সেটা খুব পরিষ্কারভাবে শনাক্ত করতে হবে। মস্কোতে বৃষ্টি হলে একদা অতীতে যারা বাংলাদেশে ছাতা খুলে বসে থাকতেন তারা এখন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির সূচক হাতে ফেরেশতা অনুসন্ধানে নেমে নিজেরাই হয়ে ওঠেন জিন থেকে ফেরেশতাদের সর্দার হওয়া সর্দার স্বয়ং! ছাতা তারা ধরবেনই কেননা ছাতা কোম্পানির স্লোগান ‘রোদ-বৃষ্টি সারা দিন/...এর ছাতা নিন।’ এবং বলাই বাহুল্য সেই ছাতা দেশী নয় বিদেশী। দেশের সব সমস্যা তারা গোলটেবিল বৈঠকে আর প্রজেক্ট প্রোফাইলের মাধ্যমে সমাধান করে দেয়ার এক সর্বরোগহর দাওয়াই আবিষ্কার করেছে। কিন্তু নিজেরাই যে রোগজীবাণুতে পরিণত হচ্ছে সেটা ঢাকা দেয়া আর সম্ভব হচ্ছে না। ডাবের পানিতে আর্সেনিক, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু, অ্যানথ্রাক্সের রকম নানা প্রজেক্ট প্রোফাইলে তাদের চেহারা উšে§াচিত হচ্ছে।
মহামতি গোয়েবলস্ একটা তত্ত্ব উপহার দিয়েছিলেন, ‘একটা মিথ্যা বার বার বললে সেটা সত্যে পরিণত হয়।’ গোবেলসের সেই তত্ত্বটি সত্য সন্দেহ নেই কিন্তু মিথ্যা যে কি রকম সত্যে পরিণত হয় তা তো আমরা জানি সেই ঈশপের গল্পের চালাক রাখালের জীবনের পরিণতি থেকেই। মিথ্যা যেদিন সত্যি হয়ে ওঠে সেদিন সে মিথ্যাকেই গিলে খেয়ে ফেলে।