পিঁপড়া অতি ক্ষুদ্র একটি প্রাণী হতে পারে, কিন্তু তাদের কাছ থেকে আমাদের বিস্তর শেখার আছে। যেমন—তারা নিজেদের মধ্যে চুলোচুলি করার বদলে সবাই একাট্টা হয়ে নিজেদের ঘর সামলায়। আফ্রিকার ইকুয়েটেরিয়াল গিনিতে এবং এশিয়ার কোনো কোনো দেশে পিঁপড়া যে রীতিমতো দর্শনীয় কলোনি গড়ে তোলে, তার পেছনে আছে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম—সবার, নারী-পুরুষ সব ধরনের পিঁপড়ার। কেউ যদি তাদের সেই কলোনি দখলের চেষ্টা করে, তারা সবাই মিলেই তা রক্ষা করে।
আমার বানানো গল্প নয়, এসব কথা আমি জেনেছি জীববিজ্ঞানী এডওয়ার্ড উইলসনের কাছ থেকে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নামজাদা এ বিজ্ঞানী তাঁর নতুন বই দি সোশ্যাল কনকুয়েস্ট অব দি আর্থ-এ লিখেছেন পিঁপড়ারা যে প্রতিকূল পরিবেশে থাকতে পারে, তার প্রধান কারণ একে অপরের সঙ্গে সহযোগিতা। নিজেদের মধ্যে যদি কোনো বিভেদ থাকে, দলাদলি থাকে, স্বার্থপর কোনো উদ্দেশ্য থাকে, সে সব সরিয়ে রেখে একযোগে কাজ করা এদের অভ্যাস। টিকে থাকার মতো কঠিন সমস্যা যখন তাদের সামনে মাথা তুলে দাঁড়ায়, পিঁপড়ারা তখন এক হয় সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশের সামনে এখন টিকে থাকার মস্ত লড়াই। অ্যাকশন এইড নামের একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা তিনটি সমস্যা চিহ্নিত করেছে। যার ফলাফলের ওপর নির্ভর করছে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের বাঁচা-মরা। সমস্যা তিনটি হলো উষ্ণতা বৃদ্ধি, সম্পদের অপ্রতুলতা ও খাদ্যসংকট। বিশ্বের অধিকাংশ উন্নয়নশীল দেশই এই ত্রি-সংকট মোকাবিলায় অপ্রস্তুত। তবে সবচেয়ে অপ্রস্তুত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ হলো পাঁচ নম্বরে। ক্রমানুসারে এই ১০টি দেশ হলো গণপ্রজাতন্ত্রী কঙ্গো, বুরুন্ডি, দক্ষিণ আফ্রিকা, হাইতি, বাংলাদেশ, জাম্বিয়া, ভারত, সিয়েরা লিয়ন, ইথিওপিয়া ও রুয়ান্ডা।
অ্যাকশন এইড যে তিনটি সমস্যা চিহ্নিত করেছে তার পাশে আমি চতুর্থ একটি সমস্যা যোগ করতে চাই, আর্সেনিক। আর্সেনিকের সোজা বাংলা হলো বিষ। জলে বিষ রয়েছে, আর সে পানি পান করছে—বাংলাদেশে এমন লোকের সংখ্যা প্রায় দুই কোটি। গত সপ্তাহে এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে প্রথম আলো জানিয়েছে, দেশের কম করে হলেও সাত কোটি লোক আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে।
আর্সেনিক যে একটা বড় সমস্যা সে কথা নতুন নয়। ২০০৫ সালের ১৭ জুলাই নিউইয়র্ক টাইমস প্রায় পুরো এক পাতার এক প্রতিবেদনে সাবধান করে দিয়েছিল, অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে পুরো বাংলাদেশই এক মহা দুর্যোগে নিক্ষিপ্ত হবে। দেশের উত্তরাঞ্চলে নানা গ্রাম ঘুরে, সরেজমিনে তদন্ত শেষে ডেভিড রোড লিখেছিলেন, দুই কোটি মানুষ রোজ আর্সেনিকযুক্ত পানি পান করছে। দুজন বিশেষজ্ঞের উদ্ধৃতি দিয়ে সে প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, অবস্থা এতটাই সংকটাপন্ন যে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে চেরনোবিল বা ভুপালের চেয়েও ভয়াবহ পরিস্থিতি দাঁড়াতে পারে। ডেভিড তাঁর প্রতিবেদনের নাম দিয়েছিলেন, ‘বাংলাদেশের মৃত্যুকূপ।’
এত বড় সমস্যা, অথচ এ নিয়ে কর্তাব্যক্তিদের উদ্বেগ আছে বলে মনে হয় না। সরকার নামকাওয়াস্তে একটি কমিটি করে রেখেছে, কিন্তু সে কমিটি কার্যত নিষ্ক্রিয়। প্রথম আলো জানিয়েছে, আর্সেনিক সরকারের অগ্রাধিকার তালিকাতে নেই, এ নিয়ে নেই কোনো বড় প্রকল্প বা কর্মসূচি। কোনো মন্ত্রী বা রাজনৈতিক নেতা—তা সরকারের হোক বা বিরোধী দলের, ভুলেও এ নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেন না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে আর্সেনিক সমস্যা সমাধানে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু আরও দেড়-দুই ডজন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির মতো সেটিও কেবল বাত-কা-বাত। আর বিরোধী দলের কথা বলা তো নিরর্থক। তাদের জন্য ক্ষমতায় যাওয়া—তা যেনতেন যে প্রকারেই হোক— এখন ‘টপ প্রায়োরিটি।’
আর্সেনিকের ব্যাপারে আমাদের এই উপেক্ষা ও অনুৎসাহ কি এই কারণে, যারা আক্রান্ত তারা মূলত দেশের প্রান্তিক মানুষ, গরিব-গুর্বো গ্রামবাসী? শহুরে মানুষদের কুয়োর পানি খাবার প্রয়োজন নেই, তাদের জন্য তো বোতলের পরিষ্কার (!) পানি রয়েছেই। জলবায়ুর উষ্ণতার কারণে যারা সবার আগে আক্রান্ত হবে, তারাও মূলত দেশের প্রান্তিক মানুষ। জলবায়ুর উষ্ণতার কারণে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে তলিয়ে যেতে পারে, বিশেষজ্ঞরা সে কথা জানিয়েছেন। জলবায়ুর উষ্ণতা আমাদের সৃষ্টি না হলেও তার এই ফল ভোগ আমাদের করতে হবে পুরোপুরি। ভূভাগের উষ্ণতার প্রশ্নে আমাদের সরকার একদম যে মাথা ঘামায়নি তা নয়। বেসরকারি সংস্থা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠিত হয়েছে, আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বাংলাদেশের অবস্থান প্রশ্নে অভিন্ন প্ল্যাটফর্মও গঠিত হয়েছে। অতএব বলা যায়, এই সমস্যা মোকাবিলায় দেশের ভেতরে ও বাইরে একাট্টা হয়ে লড়াইয়ের কাজে কিছুটা হলেও অগ্রগতি হয়েছে। কোনো কোনো দুর্মুখ বলবেন, এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে বিদেশি অর্থ সাহায্যের একটা সম্ভাবনা রয়েছে। সম্ভবত আগ্রহটা সে কারণে। এ অবশ্য কেবল দুর্মুখদের কথা।
জলবায়ু নিয়ে আন্তর্জাতিক শলাপরামর্শে অগ্রগতি হলেও কাজ যেখানে খুব আগায়নি তা হলো জলবায়ুর উষ্ণতাজনিত কারণে খাদ্যসংকট মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ।
কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষাজনক, এ কথা বিশ্ব ব্যাংকসহ আরও অনেকেই বলেছেন। কিন্তু তাই বলে এ কথা ভাবার কোনো কারণ নেই জলবায়ুর উষ্ণতার সমস্যা যখন কাঁধের ওপর জুড়ে বসবে, অনায়াসে সে ভার ঝেড়ে ফেলতে পারব। এর জন্য যে প্রস্তুতি দরকার, আমাদের তা নেই। জলবায়ুর উষ্ণতার কারণে শুধু যে উপকূলীয় এলাকাগুলো আক্রান্ত হবে তাই নয়, উত্তরাঞ্চলের মরুপ্রবণ জেলাগুলোও সমস্যায় পড়বে। বাংলাদেশে এখনো এক-চতুর্থাংশ মানুষ খাদ্যাভাবজনিত কারণে অপুষ্টিতে ভোগে। মৌসুমি খাদ্যাভাবে দেশের উত্তরাঞ্চলে এখনো ব্যাপক খাদ্যাভাব ঘটে। অ্যাকশন এইড জানাচ্ছে, জলবায়ুর উষ্ণতার কারণে যে পাঁচটি দেশের খাদ্য সংকট দেখা দেবে সবচেয়ে বেশি, বাংলাদেশ তার একটি। সে সংকটের কিছু কিছু লক্ষণ ইতিমধ্যেই দেখা দেওয়া শুরু করেছে। যেমন, খাদ্যদ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি।
কৃষি খাতের ব্যাপারে আমরা কতটা ‘সিরিয়াস’ তা বোঝার একটা উপায় হলো মোট বাজেটের কী পরিমাণ আমরা এই খাতে বরাদ্দ রেখেছি, সে হিসাব দেখা। আমাদের জাতীয় বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ রয়েছে ৭ শতাংশের কিছু বেশি। ২০১২ সালের যে বাজেট পার্লামেন্টে গৃহীত হয়েছে তাতে দেখছি কৃষি খাতে মোট বরাদ্দের পরিমাণ বাড়ানোর বদলে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এই হ্রাসের পরিমাণ ৪ দশমিক ২ শতাংশ। শুনেছি বিদেশি দাতাদের চাপের মুখে এই পরিবর্তন। এদিকে জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় সারের দাম বেড়েছে। একই কারণে সেচের জন্য বরাদ্দ বিদ্যুতের পরিমাণও কমেছে। প্রথম আলোতেই দেখেছি পল্লী বিদ্যুতায়নের জন্য যে পরিমাণ বিদ্যুৎ বরাদ্দের কথা তার বেশির ভাগই মিলছে না। এসব কারণে এবং জলবায়ুর উষ্ণতার ফলে আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের খাদ্য উৎপাদন বছরে প্রায় ৪ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে অ্যাকশন এইড সাবধান করে দিয়েছে। খাদ্য উৎপাদন কমবে, কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়বে। তখন অবস্থা কী দাঁড়াবে ভাবতে পারেন?
অন্য যে বড় সংকট এ মুহূর্তে না হলেও ভবিষ্যতে ভয়াবহ আকার নিতে পারে তা হলো বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের ওপর আমাদের নির্ভরশীলতা। আমাদের অর্থনীতির ১০ শতাংশ আসে বিদেশে কর্মরত শ্রমিকদের পাঠানো অর্থ থেকে। অথচ এই খাতে উপার্জন অব্যাহত থাকবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। মধ্যপ্রাচ্যেই আমাদের অধিকাংশ শ্রমিক। এসব দেশের অর্থনীতির স্বাস্থ্য তেলের রপ্তানির ওপরই নির্ভর করে। আগামী ২৫-৩০ বছরে নতুন তেলকূপ আবিষ্কৃত না হলে তেলের সরবরাহ শুকিয়ে আসবে। সে সংকট জমাট বাঁধার আগেই মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে উন্নত দেশগুলো জ্বালানি তেলের বিকল্প খোঁজার অর্থবহ উদ্যোগ নেওয়া শুরু করেছে। তাতে ইতিমধ্যে কমবেশি সাফল্যও এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোও সে কথা জানে, আর জানে বলেই নিজেদের অর্থনীতি বহু খাতভিত্তিক করতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে। শুধু দুবাই বা কাতার নয়, সৌদি আরব ও কুয়েতও এখন সে পথে এগোচ্ছে। এসবের মোদ্দা অর্থ হলো এখন থেকে ২০ বা ২৫ বছর পর এসব দেশে বাংলাদেশের অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমবে। অন্যদিকে, অর্থনীতির বিশ্বায়ন ও শ্রমবাজারের গুণগত পরিবর্তনের কারণে দক্ষ ও শিক্ষিত শ্রমিকের চাহিদা বাড়বে। অথচ সে সুযোগ কাজে লাগাতে হলে যে সমন্বিত ও পরিকল্পিত উদ্যোগ চাই, বাংলাদেশে তার কোনো লক্ষণই নেই।
ওপরের প্রতিটি সমস্যাই বাংলাদেশের জন্য কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বাঁচা-মরার মতো সংকটাপন্ন অবস্থা যদি নাও হয়, এ কথায় কোনো ভুল নেই, সময় থাকতে ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আগামী দিনের জীবনযাত্রার মান নাটকীয়ভাবে হ্রাস পাবে। সমস্যা যেখানে এমন জটিল, বহুমুখী ও বিস্তৃত, তার মোকাবিলায় চাই সমপরিমাণ প্রস্তুতি, একাগ্রতা ও কাজের সমন্বয়। সঙ্গে সঙ্গে চাই রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি। একা কোনো দল বা কোনো নেতার পক্ষে এই কাজে সফল হওয়া অসম্ভব। এক বছরে বা এক দফা ক্ষমতায় থেকেও এসব সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এই সাধারণ কথাটা যদি আমাদের নেতা-নেত্রীরা বোঝেন তাহলে আমরা সত্যি বর্তে যাই। একে অপরের সঙ্গে চুলোচুলি করুন ক্ষতি নেই, আমরা শুধু বলি দেশের স্বার্থটা মাথায় রেখে সে কাজ করুন। রাজা-রানী হতে চান, কিন্তু দেশটাই যদি সমস্যার আবর্তে তলিয়ে যায়, তাহলে শুধু কেদারাখানা পেয়ে কী লাভ হবে?
সমস্যা উত্তরণের জন্য পথ খুঁজতে পত্রিকার কলাম পড়তে হবে না। মোটা বই ঘাঁটারও প্রয়োজন নেই। শুধু চোখ খুলে দেখুন অতি ক্ষুদ্র পিঁপড়া কীভাবে সবাই মিলে লড়াই করে বেঁচে আছে। পিঁপড়া যা পারে, আমরা তাও পারব না?