শ্যামা'র জন্য আমার সবগুলো বিয়েই ভেঙ্গে যায়। এমনিতে আমি দেখতে শুনতে যথেষ্ট ভালো। আমার যে সাত বছর বয়সী একটা বাচ্চা আছে তা শরীরের গড়ন দেখে কেউই বিশ্বাস করবে না।
এক একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে। আর এতো বড় মেয়ে শুনে ভেঙ্গে যায়। আমারও যে খারাপ লাগে না, তা না। ভাইয়ের সংসারে আশ্রিতা বোন হয়ে ঝুলে আছি গত তিনটি বছর ধরে। হ্যাঁ, বছর তিনেক আগেই শ্যামার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিল। অন্য কারো সাথে। আরো একটু বেশি সুখের আশায়। আমার পড়াশুনা দশম শ্রেণী পাশ। বাম পা পোলিও-তে নস্ট। ভাইয়ের বাড়ির ভাত রাঁধা ছাড়া আমার আসলেই আর কোন উপায় নেই।
এতদিন তাও ভাবী কোনরকম সহ্য করতো আমাদের। কিন্তু গতবছর থেকে শ্যামা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। ওর পিছনে ভাইজান টাকা খরচ করছেন অথবা আমি ওকে পড়তে বসিয়ে সময় নষ্ট করছি এ কাজগুলো ভাবীর একদম পছন্দ না।
ওর স্কুলের বেতন কিন্তু খুব বেশী না। মাত্র পঞ্চাশ টাকা। ভাইজানের মেয়ের স্কুলের বেতনতো হাজার টাকা। তবু ভাবী রাগ করেন খুব।
আমার শ্যামা দেখতে একটু ময়লা ঠিকই। কিন্তু ওর ডাগর ডাগর চোখ আর হাসি দেখলে যে কারও কলিজা ঠান্ডা হয়ে যাবে। শুধু ভাবীর হয়না। এইতো কাল রাতেই ওকে কি মারটা মারলো!
রাতে বুকের কাছে নিয়ে ওর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে জিজ্ঞেস করলাম "খুব লেগেছে রে শ্যামা?"
ও মুখ টিপে হেসে বললো, "না মামনি, একদম না। তোমাকে যখন কেউ জোরে কিল দিবে পিঠে, তুমি জোরে জোরে দম নিবা। দেখবা, কোন ব্যাথা নাই।"
ইশ্! আমারে আর শ্যামারে যদি কেউ এখান থেকে নিয়ে যেত!
এইসব স্বপ্ন দেখতে দেখতে আরো দুইটি বিয়ের প্রস্তাব ভেস্তে গেল। ভাইজান এখন আর একটু নিচে নেমে পাত্র খোঁজেন। তবু যদি কিছু মিলে যায়।
মিললোও কিছু একটা। পাত্রের নাম আমীর হোসেন। অবস্থা সম্পত্তি বেশ ভালো। শম্ভুগঞ্জ আর কালিয়াচাপড়ায় দুইটা মাছের আড়ৎ। বয়সে আমার থেকে বছর দশেক বড়। উনার আগের বউ রোগে ভুগে মরেছেন। উনার নাকি পত্নী বিয়োগের রাশি। এগুলো অবশ্য শোনা কথা। আমার বিশ্বাস উনি ফেরেশতার মতোন মানুষ। নয়তো আমাকে বিয়ে করতে রাজী হবেন কেন?
বলতে লজ্জা লাগছে না যে আনন্দে আমার বুক ঢিব ঢিব করছে। যাক্। অবশেষে আমাদের গতি হলো!
কাবিন হওয়ার কথা সন্ধ্যা ছয়টায়। তারা এলো আরো একটু দেরী করে। আমি গতকাল রাতেই আমার আর শ্যামার কাপড় চোপড় গুছিয়ে রেখেছি। উনি যদি রাতেই চলে যেতে চান, আমাদের জন্য যেন দেরি না হয়।
হলোও তাই। বিয়ে পড়ানোর পর পরই উনি যাবার জন্য তাড়া দিতে লাগলেন।
আমি যখন শ্যামার ব্যাগ নিতে আমাদের রুমে ঢুকলাম। ভাইজান আমার পিছে পিছে আসলেন। আস্তে করে বললেন, "রুনু তুই শ্যামা কে নিয়ে ভাবিস না। ওকে আমি দেখে রাখবো।"
হটাৎ করেই পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল!
"কেন বলেন এসব ভাইজান? শ্যামা আমার সাথে যাবে তো!"
ভাইজান চোরের মত মিন মিন করে বললেন যে, শ্যামা কে ছেড়ে আমি একা যাবো এই শর্তেই বিয়ে করতে উনি রাজি হয়েছেন।
রাগে আমার গা থরথর করে কাপছে।
"আমারে আগে বলেন নাই ক্যান? এই বিয়ে তো আমি করতাম না তাইলে। বলেন, আগে বলেন নাই ক্যান?"
অপরাধীর মতো শ্যামাকে রেখে বের হয়ে এলাম। শ্যামার দিশেহারা চোখের দিকে তাকানোর আমার সাহস নাই। ভাবীর এই সংসারে আমাকে ছাড়া বাচ্চা মেয়েটা কিভাবে টিকে থাকবে সেটা চিন্তা করারও আমার সাহস নেই।
কোনরকম নিঃশ্বাসটা আটকে রেখে গাড়িতে উঠলাম। পুরা রাস্তায় উনি তার বন্ধু বান্ধবের সাথে গল্প করছিলেন। উনার বাড়িতে যখন পৌছালাম, তখন মধ্যরাত।
মফঃস্বল এলাকার দোচালা ঘরগুলো যেমন হয়। এরকম প্রকান্ড একটা বাড়ি। উঠান থেকে দোতলার ঘর পর্যন্ত যেতে যেতে আমার অনেক সময় লেগে গেল। এক পায়ে কি আর ওভাবে চলা যায়? তার উপরে অচেনা জায়গা।
শরীর, মন এতই অবসাদগ্রস্থ যে শ্যামার কথাও আর মনে হচ্ছিলো না। একটু ঘুম চাই আকুল ভাবে।
দেখতে দেখতে এই বাড়িতে দশ দিন পার হয়ে গেল। কিভাবে গেল, তাও জানিনা। এতো বিশাল বাড়ি, দুনিয়ার মানুষজন। সারাদিন রান্নাঘরেই কাটে। উনার আগের পক্ষের বাচ্চারা সব মিলিয়ে চারজন। দশ থেকে সতেরোর মধ্যেই সবার বয়স।
তারা খুব একটা আমার কাছে আসেনা। আর আমিও আগ বাড়িয়ে যাই না। সময়ও হয় না, মন ও টানে না। আহারে, আমার শ্যামাকে দেখি না কতদিন!
আরো প্রায় মাসখানেক পার হওয়ার পরে উনার আগের পক্ষের বাচ্চারা একটু একটু গা ঘেঁসতে শুরু করলো। সবচেয়ে যে ছোট জন, মিতুল, সে নিজ থেকেই মা ডাকতে লাগলো। আরে এই পুঁচকেটারওতো শ্যামার মতো ডাগর ডাগর চোখ। ওকে কোলে নিলেও যেন শ্যামার ঘ্রান পাই আমি।
আসলে ওদের জন্য মনটা নরম হতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে। এরা সবাই মা ছাড়া এতিম বাচ্চা। এদের বাবা ভয়ংকর রাগী মানুষ। তাই স্নেহের পরশ এদের কপালে জোটেনি।
কিভাবে কিভাবে যেন ওরা আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠলো। ওরা আমার কাছে শ্যামার গল্প জানতে চায়। আমিও মন ভরে গল্প করি। কখনো বুক ভেঙ্গে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। আমার চোখের কোনের জল ওদের চোখের পাতাও ভিজিয়ে দেয়।
ওদের বাবা ঘড়ি ধরে চলেন সবসময়। প্রতিটা জিনিস নিয়ম মতোন হতে হবে। উনাকে যেমন উনার ছেলে মেয়েরা এড়িয়ে চলে, আমিও চলি। মাঝে মাঝেই বলি, মিতুলের শরীরটা ভালো না, আজ রাতে ওর সাথে ঘুমাই? সে মৃদু স্বরে হুম বললেই আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি।
এক কালবৈশেখীর ঝড়ো সন্ধ্যায় আমি কাপড় তুলছিলাম ছাদ থেকে, এমন সময় ধুপধাপ আওয়াজ করে ছাদে এসে নাবিলা দাঁড়ালো। নাবিলা সবার বড় মেয়ে। ও তখনো হাঁপাচ্ছে।
"আম্মা, নিচে চলেন। এক্ষুনি চলেন।"
আমি একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, "কেন? কি হইছে?"
"আম্মা চলেন প্লীজ। আব্বা আসছেন। ডাকে আপনারে।"
আমি আরো অবাক হলাম। এই ভর সন্ধ্যায় উনি কখনোই ফেরেন না। কোন অঘটন ঘটেনি তো। তাড়াহুড়ো করে নামতে গিয়ে হোঁচটও খেলাম।
আমাদের বাড়ির খাবার ঘরটা অনেক বড়। বাড়ির সব ছেলে মেয়েরা সেখানে জড়ো হয়েছে। ওদের বাবা নিচুস্বরে যেন কি বলছিল আর তাতে সবাই কলকল করে হাসছিল।
নাহ, কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। এবাড়িতে এরকম দৃশ্য আগে কখনো দেখিনি তো।
বাচ্চা-পার্টিদের জটলার কাছে আরো একটু এগিয়ে যেতেই আমি বিষম খেলাম।
শ্যামা বসে আছে। আমার শ্যাম বর্ণ, ডাগর চোখের ময়না পাখিটা বসে আছে।
পিছন ফিরে দেখি নাবিলাও মুখ চেপে হাসছে।
এতদিন পর শ্যামাকে দেখে আমার খুশি হওয়ার কথা। কিন্তু জানিনা কি বিষণ্ণতায় আমার বুক ভেঙ্গে কান্না আসছিল। পাছে কেউ দেখে না ফেলে তাই আমার রুমে পালিয়ে এলাম।
উনি নিঃশব্দে আমার পিছনে এসে দাঁড়ালেন। বিছানায় বসে নিচু স্বরে বললেন, "রুনু, নিজের সন্তানকেতো সবাই ভালোবাসে। অন্যের সন্তানকে যারা ভালোবাসতে জানে তাদের মাঝেই সত্যিকার মায়ের ছবি থাকে। তোমাকে এই খারাপ সময়ের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে বলে আমি দুঃখিত। কিন্তু এটুকু প্রয়োজন ছিল। বিশ্বাস করো। তবে এই সময়টুকুতে যেন শ্যামার কষ্ট না হয়, আমি ঠিকই তার খোঁজ রেখেছি। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আবেগ আমার নেই বললেই চলে। তবে দায়িত্ববোধে আমি কখনো অবহেলা করিনা"।
আমি যাচ্ছেতাই বোকা মহিলাদের মতো হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে উনাকে প্রচন্ড বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলাম। উনি এই অবস্থা থেকে বাচার জন্য বোধহয় পড়িমরি করে উঠে দাঁড়ালেন।
"ইয়ে, আমি একটু মাস্টার সাহেবের বাসায় যাবো। নয়তো আবার বছরের মাঝখানে বলে শ্যামার ভর্তি নিয়ে ওরা ফ্যাকরা করবে। পড়াশোনা ছাড়া বেশিদিন থাকলে ছেলেমেয়েদের পাখা গজায়। ওকে কালকেই ভর্তি করে দিতে হবে, বুঝলে..."
এভাবে হুট করে রাশভারী মানুষটার মায়ায় জড়িয়ে যাবো ভাবতে পারিনি। কাল পর্যন্ত যে মানুষটাকে আমার নিষ্ঠুর একটা যন্ত্র মনে হতো, হটাৎ করেই মনে হচ্ছে তার সাথে কত না অপরাধ করা হয়েছে। কেউ একটু মায়ার বাঁধনে তাকে কখনো বাঁধেনি। না পরিবার, না তার ভাগ্য আর না আমি!
চিন্তায় বাঁধা দিয়ে নাবিলা ঢুকলো। তার চোখে এখনো দুষ্টু হাসি।
"অনেক খুশি হইছেন আম্মা?"
আমি চোখের পানি আড়াল করে বললাম, "হুম।"
"আব্বা মানুষটা খারাপ না আম্মা। একটু কাঠখোট্টা, কিন্তু খারাপ না।"
আমি চোখ মুছে হাসতে হাসতে বললাম, "তোমাদের আব্বা একজন নাটকবাজ মানুষ!"
নাবিলা খিলখিল করে হেসে দিলো।
পরিশিষ্টঃ ঝড় বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আমীর হোসেন বাড়ির উঠোনে পা দিয়ে দেখেন রুনু বাহিরের রান্নাঘরে চুলা জ্বালিয়েছি। খিচুরির সুঘ্রান, ছেলেমেয়েদের হাসির রিনঝিন আওয়াজ সব কিছু ছাড়িয়ে সবথেকে বেশি সৌন্দর্য দখল করে নিয়েই যেন রুনু বসে আছে মধ্যমণি হয়ে। মায়াবতী এই রমনীর জন্য তিনি দুর্বলতা অনুভব করছেন। অনেক বছর পর তার আবারো একটুখানি ভালোবাসার আদ্রতা পেতে ইচ্ছে হচ্ছে। কঠিন খোলসে নিজেকে ঢেকে রাখাটা কঠিন কাজ। খুবই কঠিন!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ৩:০৬