somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আম্মু

০২ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৭:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রতিবছর ডিসেম্বরের ছুটি শেষে যখন স্কুলে ফিরতাম, তখন ক্লাসের আর সবার ছুটির গল্পের সাথে আমার আর অন্তুর গল্পগুলো মিলতো না। অন্তু আর আমার বয়সের গ্যাপ দেড় বছরের মতো। এরকম ভাই বোনদের নাকি খুব খুনসুটি হয়। আমাদের অবশ্য একদমই হতো না।
আমাদের শীতের ছুটিগুলো অসম্ভব মন খারাপ করা হতো। অনেকবার ভেবেছি আম্মুকে বলবো যে এমন ছুটি চাই না। কিন্তু পারিনি।
বার্ষিক পরীক্ষা শেষ হলেই আব্বু আমাদের দু ভাইনবোনকে আম্মুর সাথে কুড়িগ্রামের বাসে তুলে দিতেন। সে কি দীর্ঘ পথ, যেন ফুড়োতেই চাইতো না। আমি আর অন্তু বিমর্ষ বদনে বসে থাকতাম। অন্তুটা বমি করতে করতে একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যেত। আমার বিষণ্ণতার আর ছুটি হতো না। একমাত্র আম্মুর চোখ খুশিতে চকচক করতো। কি যে আনন্দ থাকতো তার সেই অপেক্ষায়! সত্যি বলতে আম্মুকে শুধুমাত্র এইসময়টাতেই এরকম আনন্দিত হতে দেখতাম।
এভাবে দীর্ঘ যাত্রা শেষে আমরা গিয়ে নানুবাড়ি পৌছাতাম। নানুনবাড়ি না বলে বরং মৃত্যুপুরী বলা ভালো।
নানাজান নাকি মারা গিয়েছিলেন আম্মু অনেক ছোট থাকতেই। প্রকান্ড সেই জমিদার টাইপ বাড়িতে আমার নানুমনি একাই থাকতেন। আর থাকতেন ‘হনুফার মা’। এই বিশাল বাড়ি মূল গ্রাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে। সন্ধ্যা নামলেই বাড়িটাকে অসহ্য লাগতো আমার। আসলে আমি তখন খুব ছোট ছিলাম তো তাই বোধহয় ছোট মাথায় এতো চাপ নিতে পারিনি।
ব্যাপারটা নানুমনিকে নিয়ে। নানুমনি প্রচন্ড ভায়োলেন্ট টাইপ মানসিক রোগী ছিলেন। উনাকে দোতালার একদম কোনার ঘরে শেকল দিয়ে আটকে রাখা হতো। সারাক্ষন সেই ঘর থেকে ভয়ংকর রকম আওয়াজ আসতো। হনুফার মা যখনি খাবার নিয়ে যেতেন সেই চিৎকার আরো কয়েকগুন বেড়ে যেত। আম্মু যখন প্রথম প্রথম যেত নানুর কাছে, নানু তখনো একইভাবে চিৎকার করতো। কিন্তু দু তিন দিন ঘুড়তে না ঘুড়তেই নানু বোধহয় আম্মুকে চিনে ফেলতেন। শিশুর মতোন শান্ত হয়ে যেতেন আম্মু নানুর ঘরে গেলেই।
এভাবে আমি আর অন্তু দাঁতে দাঁত চেপে রাতগুলো পার করতাম। একদিন তো খুব সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিল!
অন্তুর গায়ে চায়ের কাপ ছুড়ে মেরেছিলেন নানু। অল্পের জন্য অন্তুর কপাল ফাটেনি। আম্মু সেদিন যে কি লজ্জিত হয়েছিলেন। বারবার অনুরোধ করছিলেন যাতে আমরা আব্বুকে বা অন্যকাউকে না বলি এসব। আমরা বলিনি। আমরা আম্মুর দীর্ঘশ্বাস হতে চাইনি কখনো।
আমরা দুভাইবোন বনে বাদারে ঘুরে বেড়াতাম। বাজারে গিয়ে এটা ওটা কিনে খেতাম। আর নানুমনিকে যখন গোসল করাতে নিচে নিয়ে যেত, তখন আমি আর অন্তু মাঝে সাঝে ওই ঘরে ঢুকতাম। বড্ড রহস্যময় ছিল রুমটার অবয়ব। বিশাল উচু সিলিং আর তাতে ধবধবে সাদা চাদোয়া টাঙ্গানো। কুচকুচে কালো কাঠের উচু একটা পালঙ আর তাতেও ধবধবে সাদা চাদর। পালঙ্গের পা দানির কাছে পড়ে থাকতে লম্বা শেকল। আর ছিলো দেয়ালে টাঙ্গানো বড় করে বাধাই করা একটা ছবি। সেই ছবিতে আম্মু দু বেনি করে নানুমনিকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আর নানুমনি কোলের মাঝে জড়িয়ে রেখেছেন সদ্যগোফ ওঠা একজন কিশোরকে। ইনিই আমাদের সেই শিকাগোতে থাকা মামা যাকে আমরা কোনদিন দেখিনি।
আসলে আমাদের নানুবাড়ির দিকের কোন আত্মীও স্বজনকেই কখনো আমাদের বাসায় আসতে দেখতাম না। আমি তো একদিন খাবার টেবিলে বোকার মতো জিজ্ঞেসই করে ফেলেছিলাম আম্মুকে যে কেন কেউ আসে না?
আম্মু অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন। আমি তার চেয়েও বেশি অপ্রস্তুত হয়েছিলাম যখন দাদী উত্তরে বলেছিলেন
‘লুকায়া মুকায়া পাগলের মেয়ে বিয়ে দিয়ে সবাই জানে বাঁচছে। এই বাড়িতে আসার মুখ আছে ওই বাটপারদের?’
আমি সেদিন না বুঝে আম্মুর দীর্ঘশ্বাস হয়েছিলাম।
এভাবেই চলছিল আমাদের জীবন। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত রুটিন জীবন। আর ডিসেম্বর মাসের সেই সফর।
দুর্বিষহ সেই সফর শেষ হয়ে যায় যেবছর আমি নাইনে উঠি। নানুমনি দোতালা থেকে ঝাপ দিয়ে পড়ে কোমড় ভাঙেন। প্রচণ্ড রকম ভুগে তিন মাস পরে মারা যান। আমরা তখনো আমাদের শিকাগোর মামাকে দেখতে পাইনি।
আমাদের সাথে যেহেতু দাদা দাদী ছিলেন তাই চাচাফুফুরা দল বেঁধে আসতেই থাকতেন। আম্মুর দিন রাত আথিতেয়তা করেই কাটতো।
আমার চুপচাপ পানির মতো শীতল আম্মু আরো ধীরস্থির হয়ে গেলেন। অনেক শোরগোলের মধ্যেও আমি টের পেতাম আম্মুর আনমনে হয়ে থাকাটা!
অন্তু ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন চলে গেল আর আমি একজন অস্ট্রেলিয়ান বাংলাদেশী ডাক্তারের বউ হয়ে উড়ে এলাম এখানে সংসার করতে।
কেটে গেল আরো তেরোটি বছর। পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী দুই রাজকন্যার মা আমি।
সবকিছুই স্বপ্নের মতো সুন্দর চলছিল।
হটাতই একদিন বাবাই ফোনে জানালেন আম্মুর অস্বাভাবিক আচরনের কথা। বুঝতে পারছিলাম আম্মু মেন্টাল্যি ইমব্যালেন্সড হয়ে পড়ছেন।
থেকে থেকে কুড়িগ্রামের সেই প্রকান্ড অট্টালিকা আর একজন নিষঙ্গ অসহায় অসুস্থ বৃদ্ধার কথা মনে পড়ছিল।
অন্তুকে বারবার ব্যাকুল হয়ে কল করছিলাম। ব্যস্ত অন্তু এক লাইনের ইমেইলে রিপ্লাই দিল ‘এতো ভাবিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে’।
তার সপ্তাহখানেক পরের এক সুন্দর বিকেলে বাগানে হাটতে হাটতে টের পেলাম, ‘আমি আম্মু না! আমি আম্মুর মেয়ে। আম্মুর থেকে আম্মুর মেয়ের মেরুদন্ড অনেক শক্ত’
শক্ত বলেই আমার কিশোরী দুই মেয়ে আর তাদের বাবাকে ডেকে বলতে পেরেছি যে ‘তোমাদের থেকে অন্য একজন মানুষের পাশে থাকা আমার জন্য এই মুহুর্তে অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট’।
ব্যাস আর কি? টিকেট করে উঠে পড়লাম! জানিনা কবে ফিরবো কিংবা ফিরলেও একা নাকি দোকা এইসব কনফিউশনে আর রিটার্ন কাটিনি।
ঝুপ করে চোখের পানি লুকিয়ে ফেলা যায় বলে ফ্লাইটের উইন্ডো সীটগুলো আমার বেশ প্রিয়। । কুড়িগ্রাম থেকে ফেরার পথে আম্মুও হয়তো এজন্যই জানালার পাশে বসতে চাইতেন। তবে আম্মুর সেই হৃদয় ভাঙ্গা কান্নার অনুভূতি কেমন তা আমার জানা নেই। আমি জানতেও চাইনা......

সর্বশেষ এডিট : ০২ রা মার্চ, ২০১৯ সকাল ৭:৪২
১০টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

রম্য: টিপ

লিখেছেন গিয়াস উদ্দিন লিটন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৫




ক্লাস থ্রীয়ে পড়ার সময় জীবনের প্রথম ক্লাস টু'এর এক রমনিকে টিপ দিয়েছিলাম। সলজ্জ হেসে সেই রমনি আমার টিপ গ্রহণ করলেও পরে তার সখীগণের প্ররোচনায় টিপ দেওয়ার কথা হেড স্যারকে জানিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। বৈশাখে ইলিশ

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৪০



এবার বেশ আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছে । বৈশাখ কে সামনে রেখে ইলিশের কথা মনে রাখিনি । একদিক দিয়ে ভাল হয়েছে যে ইলিশকে কিঞ্চিত হলেও ভুলতে পেরেছি । ইলিশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার প্রিয় কাকুর দেশে (ছবি ব্লগ) :#gt

লিখেছেন জুন, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৩



অনেক অনেক দিন পর ব্লগ লিখতে বসলাম। গতকাল আমার প্রিয় কাকুর দেশে এসে পৌছালাম। এখন আছি নিউইয়র্কে। এরপরের গন্তব্য ন্যাশভিল তারপর টরেন্টো তারপর সাস্কাচুয়ান, তারপর ইনশাআল্লাহ ঢাকা। এত লম্বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেরত

লিখেছেন রাসেল রুশো, ১৫ ই এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:০৬

এবারও তো হবে ইদ তোমাদের ছাড়া
অথচ আমার কানে বাজছে না নসিহত
কীভাবে কোন পথে গেলে নমাজ হবে পরিপাটি
কোন পায়ে বের হলে ফেরেশতা করবে সালাম
আমার নামতার খাতায় লিখে রেখেছি পুরোনো তালিম
দেখে দেখে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসরায়েল

লিখেছেন সাইফুলসাইফসাই, ১৬ ই এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮

ইসরায়েল
সাইফুল ইসলাম সাঈফ

এ মাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বাবাকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
নিরীহ শিশুদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এই বৃ্দ্ধ-বৃদ্ধাদের হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ ভাইক হত্যা করেছে ইসরায়েল
এ বোনকে হত্যা করেছে ইসরায়েল
তারা মানুষ, এরাও মানুষ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×