somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সম্প্রদান

২১ শে মে, ২০১৯ ভোর ৪:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সালটা ১৯৭৭।
ঝিগাতলার এই দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়িটাই আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের স্থায়ী ঠিকানা। যুদ্ধকালীন সময়ে দাদাজান পানির দরে একজন হিন্দু পুরোহিতের কাছ থেকে কিনেছিলেন। মা চাচীরা সবাই মিলে একসপ্তার মধ্যেই ব্রাহ্মনের বাড়িতে মুসল্লি পরিবেশ নিয়ে এলেন। ছাদের উপরে চিলেকোঠায় যেখানে পূজার ঘর ছিলো, সেখানে ছোট চাচা তার লাইব্রেরি বানালেন। ওঘরে আমাদের মতো পুচকা পুচকেদের ঢোকা নিষেধ। নিষেধের কারনটা বুঝতে বুঝতে আমারো সতেরো পেড়িয়েছিল। ততদিনে ছোটচাচা বন্ধুমানুষ। চিলেকোঠাটা টা আমাদের প্রথম প্রেমের মতো ছিল। খুব সযত্নে লুকিয়ে রাখা আর সুযোগ পেলেই তার কাছে ছুটে যাওয়া।

যাই হোক। যার গল্প বলতে যাচ্ছি তার নাম শৌমভ রায়। উনি আমার বড় চাচার বন্ধু বিশেষ।
সেক্টর দুই এ বড় চাচা আর উনি একসাথে যুদ্ধ করেছেন।
দাদীজানের মুখে শুনেছি যে উনার জন্যই নাকি বড়চাচা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেচে ফিরেছিলেন। এভাবেই শৌমভ রায় দাদীজানের আরেকজন ছেলে ‘শম্ভু’ হয়ে উঠেছিলেন।
বাবা চাচাদের উনি ছিলেন শম্ভুদা আর আমাদের পুচকে দলের ছিলেন শম্ভুকাকা।

যেসময়কার কথা বলছি তখন শম্ভুকাকা চৌত্রিশ/পঁয়ত্রিশোর্ধ মানুষ। তামাটে গায়ের রঙ, মাথা ভর্তি ঝাঁকরা চুল আর পেটানো লম্বা ধাঁচের শরীর। সুপুরুষ বললে নিতান্তই কম বলা হয়।

বড় চাচা বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই। শম্ভুকাকা নিজেকে বাঁধেন নি। পুরদস্তুর ভবঘুরে হয়ে ছিলেন। আজ এখানে তো কাল সেখানে। হুট করে কোন এক সন্ধ্যায় টুক টুক করে কড়া নাড়তেন আমাদের বাড়ির মূল ফটকে।
সেদিন রাতে খুব জম্পেস ভোজ হতো। কোনদিন পাকা মোরগের ঝোল অথবা ঝাল ঝাল করে শর্ষে ইলিশ। আর চলতো গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা।
কত অদ্ভুতুরে গল্প যে শম্ভুকাকা শোনাতেন! পাহাড়ি আদিবাসীদের গল্প, আফ্রিকার গহীন বনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর গল্প অথবা আরব বেদুঈনদের গল্প।

এভাবেই যাচ্ছিলো দিনগুলো। ততদিন বেশ খানিকটা বেড়ে উঠেছি। শরীরে বয়ঃসন্ধির ছোয়া, বদলে যাওয়া কণ্ঠস্বর আর সরু গোঁফের ধারা নিয়ে কলেজে যাই তখন।
এক শীতের শুরুতে হঠাৎ করে শম্ভুকাকা এলেন। মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ আর সেই চকচকে হাসি।
মশলা দেয়া পাহাড়ি চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প শুনছিলাম। বিশেষ এই চা কেবল কাকা এলেই তৈরি হতো।
সেদিন শুনেছিলাম ‘সন্ধ্যাবতীর’ কথা। শৌমভরায়ের প্রথম প্রেমের গল্প। তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার গল্প। তার পরাজয়ের গল্প।

শম্ভুকাকা আউটস্ট্যান্ডিং গল্প কথক ছিলেন। তবে সেদিনের গল্পে যেন কি একটা ছিল। তীব্র সেই হাহাকার আমাদের ছুয়ে গিয়েছিল খুব করে। আমার না হয় কচি বয়স ছিল, তাই বলে ছোট কাকাও অমন অস্থির হলেন? শুনশান নিরবতা ছিল সেদিন আর ছিল খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসা বুনোফুলের ঘ্রান।

এরপর অনেকদিন কাকার দেখা পাইনি। আমিও পড়াশোনা করতে ব্যাঙ্গালরে চলে যাই। একটু আধটু লেখালেখিও শুরু করি। আমার লেখালেখিতে যে শম্ভুকাকার গল্পের বেশ শক্ত প্রভাব ছিল তা বুঝতাম।

একগরমের ছুটিতে ‘সন্ধাবতীকে’ নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। লেখা যতই আগাচ্ছে আমি ততই অস্থির হচ্ছিলাম। কিভাবে কিভাবে যেন চোখের সামনে ভেসে আসছিলো সেই সময়ের দিনগুলো। রক্তের দুলুনিতে টের পাচ্ছিলাম আমার শৌমভ রায় হয়ে ওঠার ব্যাপার টা। সন্ধ্যাবতীর কথা ভেবে কখনো হতাশায় ডুবে যাচ্ছি আবার কখনো দেশের টানে সব জলাঞ্জলি দেয়ার উত্তেজনা। উফফ কি যে প্রচন্ড সে দোটানা!
জানিনা ওসব আমার নিছক কল্পনা ছিল কিনা। হয়তো শম্ভুকাকার গল্পে কোন একটা পথের ছায়া ছিল যেখানে আমার অবেচেতন মন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, লেখার ছলে, পথ ভুলিয়ে!
সে রাস্তার আর একটু গভীরে ঢুকতেই থমকে দাড়ালাম। নাহ, সন্ধ্যাবতী আর আবছায়া নয়। তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন। শান্ত শুভ্র এই নারীমূর্তি আমার ভীষন চেনা। তার শাড়ির আচলে পূজোর ফুল আর ধূপের ঘ্রাণ! খুব গভীর করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলে সেই ঘ্রানের তীব্রতা টের পাই।

পেরিয়ে যায় আরো কিছু সময়। নানাবিধ ব্যাস্ততায়, লেখালেখিতেও বাঁধা পরে।

তারো প্রায় বছর দুই পর খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে দেশে যেতে হয়, বেলী আপার বিয়ে উপলক্ষে। বেলীপা, বড় চাচার বড় মেয়ে, আমাদের বংশের প্রথম সন্তান।
বেশ ধুমধাম করেই বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সারারাত বিয়েবাড়ির কাজ করে ক্লান্ত ছিলাম প্রচন্ড। কি কারনে যেন বিয়ে পড়াতে দেরি হচ্ছিলো বলে এক কোনায় বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।
বড়চাচীকে দেখলাম অপ্রস্তুতভাবে তড়িঘড়ি করে বেলী আপার ঘরে ঢুকতে।
খুব আস্তে করে শুনতে পেলাম আপার গলা।
বড্ড অভিমানী স্বরে আপা বলেছিল ‘শম্ভু কাকা আসুক। কন্যাদান না হওয়া অব্দি কবুল পড়বো না মা’

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৯ ভোর ৬:১৩
১০টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। গানডুদের গল্প

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:২৮




তীব্র দাবদাহের কারণে দুবছর আগে আকাশে ড্রোন পাঠিয়ে চীন কৃত্রিম বৃষ্টি নামিয়েছিলো। চীনের খরা কবলিত শিচুয়ান প্রদেশে এই বৃষ্টিপাত চলেছিলো টানা ৪ ঘন্টাব্যাপী। চীনে কৃত্রিম বৃষ্টি নামানোর প্রক্রিয়া সেবারই প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতকে জানতে হবে কোথায় তার থামতে হবে

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৪৫


ইন্ডিয়াকে স্বপ্ন দেখানো ব্যাক্তিটি একজন মুসলমান এবং উদার চিন্তার ব্যাক্তি তিনি হলেন এপিজে আবুল কালাম। সেই স্বপ্নের উপর ভর করে দেশটি এত বেপরোয়া হবে কেউ চিন্তা করেনি। উনি দেখিয়েছেন ভারত... ...বাকিটুকু পড়ুন

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×