সালটা ১৯৭৭।
ঝিগাতলার এই দোতালা ডুপ্লেক্স বাড়িটাই আমাদের একান্নবর্তী পরিবারের স্থায়ী ঠিকানা। যুদ্ধকালীন সময়ে দাদাজান পানির দরে একজন হিন্দু পুরোহিতের কাছ থেকে কিনেছিলেন। মা চাচীরা সবাই মিলে একসপ্তার মধ্যেই ব্রাহ্মনের বাড়িতে মুসল্লি পরিবেশ নিয়ে এলেন। ছাদের উপরে চিলেকোঠায় যেখানে পূজার ঘর ছিলো, সেখানে ছোট চাচা তার লাইব্রেরি বানালেন। ওঘরে আমাদের মতো পুচকা পুচকেদের ঢোকা নিষেধ। নিষেধের কারনটা বুঝতে বুঝতে আমারো সতেরো পেড়িয়েছিল। ততদিনে ছোটচাচা বন্ধুমানুষ। চিলেকোঠাটা টা আমাদের প্রথম প্রেমের মতো ছিল। খুব সযত্নে লুকিয়ে রাখা আর সুযোগ পেলেই তার কাছে ছুটে যাওয়া।
যাই হোক। যার গল্প বলতে যাচ্ছি তার নাম শৌমভ রায়। উনি আমার বড় চাচার বন্ধু বিশেষ।
সেক্টর দুই এ বড় চাচা আর উনি একসাথে যুদ্ধ করেছেন।
দাদীজানের মুখে শুনেছি যে উনার জন্যই নাকি বড়চাচা নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেচে ফিরেছিলেন। এভাবেই শৌমভ রায় দাদীজানের আরেকজন ছেলে ‘শম্ভু’ হয়ে উঠেছিলেন।
বাবা চাচাদের উনি ছিলেন শম্ভুদা আর আমাদের পুচকে দলের ছিলেন শম্ভুকাকা।
যেসময়কার কথা বলছি তখন শম্ভুকাকা চৌত্রিশ/পঁয়ত্রিশোর্ধ মানুষ। তামাটে গায়ের রঙ, মাথা ভর্তি ঝাঁকরা চুল আর পেটানো লম্বা ধাঁচের শরীর। সুপুরুষ বললে নিতান্তই কম বলা হয়।
বড় চাচা বিয়ে থা করে সংসারী হয়েছেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই। শম্ভুকাকা নিজেকে বাঁধেন নি। পুরদস্তুর ভবঘুরে হয়ে ছিলেন। আজ এখানে তো কাল সেখানে। হুট করে কোন এক সন্ধ্যায় টুক টুক করে কড়া নাড়তেন আমাদের বাড়ির মূল ফটকে।
সেদিন রাতে খুব জম্পেস ভোজ হতো। কোনদিন পাকা মোরগের ঝোল অথবা ঝাল ঝাল করে শর্ষে ইলিশ। আর চলতো গভীর রাত পর্যন্ত আড্ডা।
কত অদ্ভুতুরে গল্প যে শম্ভুকাকা শোনাতেন! পাহাড়ি আদিবাসীদের গল্প, আফ্রিকার গহীন বনের মধ্য দিয়ে বয়ে চলা খরস্রোতা নদীর গল্প অথবা আরব বেদুঈনদের গল্প।
এভাবেই যাচ্ছিলো দিনগুলো। ততদিন বেশ খানিকটা বেড়ে উঠেছি। শরীরে বয়ঃসন্ধির ছোয়া, বদলে যাওয়া কণ্ঠস্বর আর সরু গোঁফের ধারা নিয়ে কলেজে যাই তখন।
এক শীতের শুরুতে হঠাৎ করে শম্ভুকাকা এলেন। মুখ ভর্তি দাড়িগোঁফ আর সেই চকচকে হাসি।
মশলা দেয়া পাহাড়ি চায়ে চুমুক দিতে দিতে গল্প শুনছিলাম। বিশেষ এই চা কেবল কাকা এলেই তৈরি হতো।
সেদিন শুনেছিলাম ‘সন্ধ্যাবতীর’ কথা। শৌমভরায়ের প্রথম প্রেমের গল্প। তার হারিয়ে যাওয়া ভালোবাসার গল্প। তার পরাজয়ের গল্প।
শম্ভুকাকা আউটস্ট্যান্ডিং গল্প কথক ছিলেন। তবে সেদিনের গল্পে যেন কি একটা ছিল। তীব্র সেই হাহাকার আমাদের ছুয়ে গিয়েছিল খুব করে। আমার না হয় কচি বয়স ছিল, তাই বলে ছোট কাকাও অমন অস্থির হলেন? শুনশান নিরবতা ছিল সেদিন আর ছিল খোলা জানালা দিয়ে ভেসে আসা বুনোফুলের ঘ্রান।
এরপর অনেকদিন কাকার দেখা পাইনি। আমিও পড়াশোনা করতে ব্যাঙ্গালরে চলে যাই। একটু আধটু লেখালেখিও শুরু করি। আমার লেখালেখিতে যে শম্ভুকাকার গল্পের বেশ শক্ত প্রভাব ছিল তা বুঝতাম।
একগরমের ছুটিতে ‘সন্ধাবতীকে’ নিয়ে লিখতে শুরু করলাম। লেখা যতই আগাচ্ছে আমি ততই অস্থির হচ্ছিলাম। কিভাবে কিভাবে যেন চোখের সামনে ভেসে আসছিলো সেই সময়ের দিনগুলো। রক্তের দুলুনিতে টের পাচ্ছিলাম আমার শৌমভ রায় হয়ে ওঠার ব্যাপার টা। সন্ধ্যাবতীর কথা ভেবে কখনো হতাশায় ডুবে যাচ্ছি আবার কখনো দেশের টানে সব জলাঞ্জলি দেয়ার উত্তেজনা। উফফ কি যে প্রচন্ড সে দোটানা!
জানিনা ওসব আমার নিছক কল্পনা ছিল কিনা। হয়তো শম্ভুকাকার গল্পে কোন একটা পথের ছায়া ছিল যেখানে আমার অবেচেতন মন আমাকে নিয়ে গিয়েছিল, লেখার ছলে, পথ ভুলিয়ে!
সে রাস্তার আর একটু গভীরে ঢুকতেই থমকে দাড়ালাম। নাহ, সন্ধ্যাবতী আর আবছায়া নয়। তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি এখন। শান্ত শুভ্র এই নারীমূর্তি আমার ভীষন চেনা। তার শাড়ির আচলে পূজোর ফুল আর ধূপের ঘ্রাণ! খুব গভীর করে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলে সেই ঘ্রানের তীব্রতা টের পাই।
পেরিয়ে যায় আরো কিছু সময়। নানাবিধ ব্যাস্ততায়, লেখালেখিতেও বাঁধা পরে।
তারো প্রায় বছর দুই পর খুব স্বল্প সময়ের নোটিশে দেশে যেতে হয়, বেলী আপার বিয়ে উপলক্ষে। বেলীপা, বড় চাচার বড় মেয়ে, আমাদের বংশের প্রথম সন্তান।
বেশ ধুমধাম করেই বিয়ের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। সারারাত বিয়েবাড়ির কাজ করে ক্লান্ত ছিলাম প্রচন্ড। কি কারনে যেন বিয়ে পড়াতে দেরি হচ্ছিলো বলে এক কোনায় বসে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম।
বড়চাচীকে দেখলাম অপ্রস্তুতভাবে তড়িঘড়ি করে বেলী আপার ঘরে ঢুকতে।
খুব আস্তে করে শুনতে পেলাম আপার গলা।
বড্ড অভিমানী স্বরে আপা বলেছিল ‘শম্ভু কাকা আসুক। কন্যাদান না হওয়া অব্দি কবুল পড়বো না মা’
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০১৯ ভোর ৬:১৩