somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কবি আল মাহমুদের একটি সাক্ষাৎকার এবং এর প্রতিক্রিয়ায় নব্বইয়ের তিন কবি

২৯ শে জুন, ২০০৮ বিকাল ৪:৫৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


দশক বিচারে পঞ্চাশের দশকের কবি আল মাহমুদ। তিরিশের দুর্দণ্ড প্রতাপ ও প্রভাব মাথার উপর থাকা সত্ত্বেও `সোনালী কাবিন' কাব্যগ্রন্থ লিখেই বাংলা কাব্যাঙ্গনে আলোচনায় চলে আসেন তিনি। এরপর অসংখ্য কবিতা, ছড়া, গল্প, গদ্য, উপন্যাস প্রভৃতি লিখেছেন এবং লিখে যাচ্ছেন এখনো। বাংলা কবিতার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘবাসের অভিজ্ঞতা। ফলে উত্তরপ্রজন্ম তাঁর কাছ থেকে কবিতা বিষয়ক `মূল্যবান' অনেককিছুই শুনতে চাইবে, এবং নিজেদের কবিতা ভাবনার আলোকে গ্রহণ কিংবা বর্জন করবে, এটাই স্বাভাবিক, এটাই তারুণ্যের রীতি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকের কাগজের সুবর্ণরেখার ১২ জুলাই ২০০৭ সংখ্যায় আল মাহমুদের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সাক্ষাৎকারে তিনি সমকালীন কবিতা বিষয়ে বেশ কিছু মতামত প্রকাশ করেন। তাঁর এই মতামত তরুণ কবিরা কীভাবে দেখছেন, উত্তরে তাঁরা কী বলছেন, এর জন্য মুখোমুখি হয়েছিলাম নব্বইয়ের তিন কবি মজনু শাহ, চঞ্চল আশরাফ ও সাখাওয়াত টিপু'র। এবং এই তিন কবির প্রতিক্রিয়াগুলোও সুবর্ণরেখার ১৯ জুলাই ২০০৭ সংখ্যায় ছাপা হয়।
-[স. ফ]



আল মাহমুদের সাক্ষাৎকার
`কবির পক্ষে শেষ পর্যন্ত থাকে তার কবিতা'

সুবর্ণরেখা: একটা বয়সে এসে কবিদের কবিতা লেখা থামিয়ে দেওয়া উচিত বলে অনেকেই মনে করেন। পৌনঃপুনিকতার আশঙ্কা থাকে বলেই এমন প্রশ্ন ওঠে। আপনার কি এরকম কিছু মনে হয়?
আল মাহমুদ: আমি অনেকদিন থেকেই কবিতা লিখছি। আধুনিক কবিতা সম্পর্কে আমারও ধারণা গড়ে উঠেছে। আমি সেই ধারণা থেকেই লিখছি। আমাদের কবিতা এই সময়ে এসে দিশেহারা একটা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কবিতা যেন একটা চরে আটকে গেছে। অধিকাংশ কবিতার বিষয়ই গতানুগতিক। বিষয় শুধু `আমি' আর `তুমি'! এই আমি-তুমির কোনও দেশ নেই, কাল নেই, কিছু নেই। এতে করে বাংলা কবিতার ধারা এক জায়গায় এসে পথ হারিয়ে ফেলেছে। কোনও বক্তব্য নেই। বক্তব্য না থাকলে তো আঙ্গিক দাঁড়ায় না। এ কারণেই বাংলা কবিতার এই দুর্গতি।
কিছুদিন আগে ‘তুমি তৃষ্ণা তুমি পিপাসার জল’ শিরোনামে আমার একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে। আমি সেখানে নতুনত্ব আনায়নের চেষ্টা করেছি।
সুবর্ণরেখা: একজন তরুণতম লিখিয়ের কাছেও আপনি অনেক ঈর্ষণীয় কবি ব্যক্তিত্ব। অনেক তরুণ কবি আপনাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, আপনি কি তরুণদেরকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন?
আল মাহমুদ: না, করি না। বয়সে তরুণ হলেই তিনি ভালো লিখবেন- এমন কোনও গ্যারান্টি নেই। তবে তরুণদের কাছে মানুষ আশা করে।
সুবর্ণরেখা: আপনি কী আশা করেন?
আল মাহমুদ: তরুণরা আঙ্গিক ভেঙ্গে বেরিয়ে আসবে, আমি-তুমির বৃত্ত ভেঙ্গে বেরিয়ে পড়বে, কবিতা পাঠকদের কাছে পৌঁছোবে।
সুবর্ণরেখা: বৈষ্ণব পদকারকার দেহাত্মা আর পরমাত্মার সংশ্লেষণ ঘটিয়েছিলেন তাদের কবিতায়। আপনার কবিতায় দেখি দেহাত্মা অর্থাৎ দেহজ প্রেমের আধুনিক রুপান্তর। আপনার কি মনে হয় না কবিতায় আপনিও একই বৃত্তে ঘুরপাক খাচ্ছেন?
আল মাহমুদ: দেহাত্মা, পরমাত্মা এসব আমার কবিতার বিষয় নয়। আমার কবিতার বিষয় নর-নারী, প্রেম, দেশ, বহমান জীবন এইসব।
সুবর্ণরেখা: দীর্ঘ একটা সময় ধরে আপনি ঢাকা শহরে বাস করছেন। নাগরিক সমস্ত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্ত একজন কবি আপনি। অথচ আপনার কবিতায় যে আল মাহমুদের সাক্ষাৎ আমরা পাই, তিনি গ্রাম্য, সরল, প্রকৃতির কাছাকাছি একজন প্রান্তিক মানুষ। তবে কি একজন ব্যক্তি আল মাহমুদ ও কবি আল মাহমুদ পৃথক কোনও সত্তা?
আল মাহমুদ: না । আমি গ্রাম থেকে আসা মানুষ। আমার মধ্যে আছে একই সাথে গ্রাম, একই সাথে শহর। এই দুটি বিষয়ে আমি অভিজ্ঞ। এই শহরের (ঢাকা শহরের) গড়ে ওঠা আমি দেখেছি, এর বৃদ্ধি দেখেছি। কিন্তু আজও আরবানিটি গড়ে উঠতে পারছে না। দেখবে, ঈদে কিংবা কোনও উৎসবে ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যায়। এই মানুষগুলো যায় কোথায়? এরা যায় শিকড়ের টানে। এই যে আরবান-মেন্টালিটি- তা গড়ে ওঠেনি। আমি যা কিছু লিখি, আমার অভিজ্ঞতা থেকেই লিখি।
সুবর্ণরেখা: একটা সময় কবি শামসুর রাহমান ও কবি আল মাহমুদের মধ্যে ‘প্রধান কবি’ কে- তা নিয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতা চলতো। যদি অভিযোগের সুরে বলি, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা প্রশ্রয় পেত আপনাদের কারণেই- তাহলে আপনার মন্তব্য কী হবে?
আল মাহমুদ: শামসুর রাহমান আমার থেকে বয়সে একটু বড় ছিলেন। আমি তাঁকে সবসময় সম্মান দিয়ে এসেছি। কোনও সময় তাঁকে ঘিরে ঈর্ষা কাজ করেনি। শেষের দিকে তাঁর কবিতায় পৌনঃপুনিকতা এসেছে। তিনি প্রচুর লিখতেন বা লিখতে বাধ্য হতেন। হয়তো তিনি সমবসময় পত্রিকায় সবার উপরে থাকতে চেয়েছেন। এতে তাঁর কোনও উপকার হয়নি। আমি কখনও হুকুম তামিল করতে গিয়ে কবিতা লিখিনি। আমার মনে কবিতা না আসলে আমি লিখিনি। আমার রাস্তা আলাদা, কবিতার বিষয়বস্তু আলাদা। আমার কাজ আমি করেছি। আমি কখনই তাঁর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করিনি। এর মধ্যে তিনি প্রবেশ করেছিলেন, আমি করিনি। কেউ যদি আমাকে প্রতিযোগিতার মধ্যে বিবেচনা করে সেটা তার বা তাদের ব্যাপার, আমার ব্যাপার নয়।
সুবর্ণরেখা: কিন্তু আপনাদেরকে ঘিরে যারা থাকতো বা যারা আপনাদের পরে লোক, এই বিরোধটাতো তাদেরই তৈরি! আপনিও আপনার পরে লোকদের নিয়ে প্রবন্ধ লিখেছেন...
আল মাহমুদ: আমি যাদের নিয়ে লিখেছি, দায়িত্ব নিয়েই লিখেছি। আমি তাদের নিয়ে পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ লিখেছি এবং লেখাটি আমার প্রবন্ধগ্রন্থেও নিয়েছি। তারা আমার পরে লোক বলে লিখেছি- তা নয়। কবির পে শেষ পর্যন্ত আসলে কেউ থাকে না। কবির পে শেষ পর্যন্ত থাকে তার কবিতা।
সুবর্ণরেখা: আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা ও একজন লেখক। কবিতার পাশাপাশি ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখছেন দীর্ঘদিন ধরে। আপনার একটি উপন্যাস মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক হলেও কবিতায় এদিকটি প্রায় অনুপস্থিত। কারণটা জানতে চাইছি।
আল মাহমুদ: তোমাকে আগে দেখতে হবে মুক্তিযুদ্ধে এদেশের কবি-লেখকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন কি-না। দু’একজন যারা করেছেন তাদের কথা আমরা জানি। এইজন্য মুক্তিযুদ্ধের ওপর কেউ যদি কাজ করে থাকে তা আমি-ই করেছি। আমার একটি বই আছে ‘উপমহাদেশ’। কবিতাতেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আচে। তবে সেটা হয়তো ততটা উচ্চকণ্ঠ নয়। কবিতা সে কাজও করে না। আগেই বলেছি, কবিতায় আমার বিষয় নর-নারী, দেশ, প্রেম, নদী, বহমান জীবন ইত্যাদি।
সুবর্ণরেখা: কিন্তু আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন ‘বন্দী শিবির থেকে’ নামক একটি বহুলপঠিত কাব্যগ্রন্থ। পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও এই বইটি যথেষ্ট গ্রহণযোগ্য।
আল মাহমুদ: দেখো, সাহিত্য হলো নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, অন্তরঙ্গতা থেকে সৃষ্ট হয়। কোনও নকল কিছু শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না। শামসুর রাহমান যখন ‘বন্দী শিবির থেকে’র পাণ্ডুলিপি কলকাতায় আবু সয়ীদ আইয়ুবের কাছে পাঠান আমি তখন সেখানে ছিলাম। শামসুর রাহমানের ‘বন্দী শিবির থেকে’ কাব্যগ্রন্থ পড়ে কখনও তো মনে হয়নি তিনি বন্দী শিবিরে ছিলেন! কথা হলো, শামসুর রাহমান এই বইয়ে এমন কী কাজ করেছেন যা পড়ে মনে হবে তিনি সত্যি বন্দী শিবিরে ছিলেন- যা আমাদের হৃদয়কে স্পর্শ করে? আমি শুধু বলছি, মুক্তিযুদ্ধের প্রত্য অভিজ্ঞতা আমার আছে। আমি দেখেছি, লড়েছি। যদি বলো পরবর্তী প্রজন্মের কথা; তবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম কি ভ্রান্তির মধ্যে থাকবে? তা থাকবে না।
আমার মনে হয় শামসুর রাহমানের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল। অনেক সমস্যায় ছিলেন তিনি। ফলে দেশত্যাগ করতে পারেননি। এজন্য তাঁকে দোষ দেওয়া যায় না।
সুবর্ণরেখা: বেশ ক’বছর আগে ‘সবাই ফিরে আসছে লিরিকে’ শিরোনামে আপনি কবিতা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। কিন্তু বলা হচ্ছে, এটি গদ্য কবিতার যুগ। আপনি কী বলেন?
আল মাহমুদ: আমাদের বাংলা কবিতা হলো গীতিপ্রবণ। আমি নিজেও মোটামুটি গীতিধর্মী কবিতা লিখতে চাই। আর কবিতাকে অ-কবিতা থেকে আলাদা রাখার জন্য ছন্দ, মিল, অনুপ্রাস এসবের ঝোক বানাতে হয়। এটা গদ্য কবিতার যুগ- কথাটা আমি স্বীকার করি না। তাছাড়া কবি হতে হলে তাকে অবশ্যই মাত্রাজ্ঞান থাকতে হবে। এই যে বিল্ডিংটা দেখছো, যে ঘরে বসে তুমি কথা বলছো- তা একটা চতুস্কোণ আকৃতির। এটা আঁকাবাঁকা হতে পারতো। মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো মিলের মধ্যে থাকা। স্থাপত্যরীতিতেও তাই আছে। সব জায়গায় এটা আছে।
তবে ছন্দহীন কবিতাও কবিতা হতে পারে। রবীন্দ্রনাথ শেষের দিকে অনেক ছন্দহীন কবিতা লিখেছেন। কবিতাকে কবিতা করে তুলতে হবে। যদি চন্দ না থাকে তবে ছন্দের অভাব অন্যকিছু দিয়ে পূরণ করতে হবে। নইলে মানুষ পড়বে না; শুধু তাকিয়ে দেখবে। আমাদের দেশে অনেকই তো গদ্যে কবিতা লিখছে কিন্তু কয়টা কবিতা মনে থাকে? অথচ কবি সমর সেনও গদ্যে কবিতা লিখেছেন, সেখান থেকে আমি অনেক কবিতা মুখস্থ বলতে পারবো।
সুবর্ণরেখা: আপনার ‘পাখির কাছে ফুলের কাছে’ একটি অসাধারণ কিশোর কবিতার বই। কিশোরদের জন্য এখন লিখছেন না কেন?
আল মাহমুদ: লিখি তো! মাঝে মধ্যে এখনও লিখি। এটা লিখতে আমার খুব ভালো লাগে। এই কবিতাগুলো লিখে আমি অতিদূর পাঠকের কাছে পৌঁছেছি। আমি অবশ্য কিশোর কবিতা বলে লিখি না, বাংলা কবিতা বলে লিখি। এটা আমাদের ভাষায় সুকুমার রায় লিখেছেন। অসাধারণ তাঁর লেখা। সেগুলো কিন্তু ছড়াটড়া নয়। সেসবের মধ্যে আধুনিক কবিতার কাজ আছে। আধুনিক কবিতার কাজ হচ্ছে ধ্বনি তরঙ্গ। সুকুমার রায়ের কবিতায় ধ্বনি তরঙ্গ আছে।
সুবর্ণরেখা: আপনার সা¤প্রতিক কবিতা ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই।
আল মাহমুদ: আমার সা¤প্রতিক কবিতা ভাবনা হচ্ছে, বাংলা কবিতার এখন যে দশা হয়েছে; আট লাইনে এসে কবিতা দাঁড়াচ্ছে, আর এগোতে পারছে না- এ থেকে মুক্তি। তাছাড়া এই যে ‘তুমি’ কবিতার বিষয়, এই তুমির একটা ব্যাখ্যা থাকতে হবে। তুমি কে? তুমি কোথায় বাস করো? তোমার অবস্থান? শুধু তুমি বললেই তো প্রেমের কবিতা সিদ্ধ হয় না! এজন্য কবিতা লেখা হচ্ছে ঠিকই কিন্তু হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। কেউ মনে রাখছে না।
সুবর্ণরেখা: আপনাকে ৭২ তম জন্মদিনের শুভেচ্ছা। আপনি শতায়ু হোন। এতণ সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আল মাহমুদ: ধন্যবাদ।






নব্বইয়ের তিন কবির প্রতিক্রিয়া


মজনু শাহ
যখন প্রলয়, যখন অন্ধত্ব

সত্য যে, কবি আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’ যখন প্রকাশিত হলো, সেটা একটা দিক-নির্ণয়ী ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আজকের বাংলা কবিতার প্রেক্ষিতেও ঐ কাব্যের জন্য তিনি সর্বাধিক নন্দিত হন। পাঠক তাঁকে অল্পকিছু কবিতা দিয়েই চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন সেদিন। তারপর অনেক কবিতাই লিখেছেন তিনি, অনেক রকম, কিন্তু সোনালী কাবিনের সাফল্যকে পেরিয়ে যাবার মতো কবিতা আমরা আর তাঁর কাছ থেকে পাইনি।
সোনালী কাবিন কোলকাতা থেকে যখন মিনিবুক আকারে মুদ্রিত হলো, শোনা যায়, কোনো কোনো পাঠিকা তাদের ব্লাউজের ভেতর রেখে, মাঝে মাঝে বের করে পড়তো! সত্য মিথ্যা কতকিছুই তো ঘটে। কিছু সত্যকে ফ্যান্টাসির মতো মনে হয়।

২.
কিন্তু তারপর?
ভালো কবিতা তারপরও তিনি লিখেছেন, সেটা হাতেগোনা। অজস্র কবিতার ভেতর দিয়ে পাঠককে নিয়ে গেলেন, কিন্তু তেমন রসোত্তীর্ণ কবিতা আর কি তিনি লিখতে পেরেছেন? কবিতায় আধুনিক চিন্তার যে পরিসর, তার ভেতর তিনি বেড়ে উঠতে দিয়েছেন নিজেকে, নির্বিচারে। আধুনিক মনের সৃষ্টিশীলতা, আজ তো আমরা ফিরে দেখছি যে, তা কত বড় একটা বদ্ধতা, কত বড় একটা ফাঁদের বিষয়।
আধুনিকতার মধ্যে যে খণ্ডবাদী মানসিকতা কাজ করে, তা আজ স্পষ্ট। কোজ এন্ডেড আখ্যানের মধ্যে খানিকটা প্রেম, কাম, খানিকটা ইতিহাস-ঐতিহ্যের চূর্ণ মিশিয়ে যা দাঁড়ায়, যা দাঁড়াচ্ছে আল মাহমুদের কবিতায়, তা কবিতার ভঙ্গি করে মাত্র। বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই, সেসব কবিতা নয়। যৌনতা নিয়ে বেশ হাঁসফাঁস ল করা যায় তাঁর কবিতার এখানে-সেখানে। সেটাকে উত্তীর্ণ কিছু মনে হয় না, মনে হয় এত বয়সে এসে ভীমরতি ধরল! কিছু যৌন চটকানি পেলে গড়পড়তা পাঠক আঁঠার মতো লেগে পড়বে তাতে, এতে আর সন্দেহ কী! সেকারণেই এখনো অনেককে আহা উহু করতে শুনি।
আজ তরুণদের লেখার মান নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। তা তরুণ বলতে কী বোঝেন তিনি? বিটিভির একটা অনুষ্ঠানে ‘আল মাহমুদের কবি’ নামে অদ্ভুত হাস্যকর জিনিস পরিবেশিত হতে দেখি। অথর্বদের যতই প্রশংসা করা হোক না কেন- তারা যে অথর্বই থাকে শেষপর্যন্ত, এটুকু যদি তিনি নিজের কাব্যবিবেচনা দিয়ে না বোঝেন, কিম্বা বুঝেও, না-বোঝার ভান করে কিছু তরুণ স্তাবকদের দিনের পর দিন মূল্যায়ন করতে থাকেন নিজের আত্মতৃপ্তির জন্যে- সেটা তবে একটা জাতীয় কাব্যিক-ট্র্যাজেডি হয়ে দাঁড়ায়।
তিনি আন্তরিকভাবে চাইলে, আমরা কিছু তরুণের এমন কিছু কাব্যগ্রন্থের খোঁজ দিতে পারি, যা তাঁর (বোধ করি) ধারণা পরিবর্তনে সহায়ক হবে। এই কাব্যগ্রন্থগুলো, গত ২০/২৫ বছরে প্রকাশিত হয়েছে, যা গদগদ আবেগের নয়, শুধু ‘আমি-তুমি’র কিশে নয়।

৩.
আল মাহমুদ যে আজ তরুণদের ভালো কবিতা খুঁজে পাচ্ছেন না, তার কারণ শুধু বার্ধক্য নয়, তিনি আসলে মিডিয়া আর আত্মপ্রতিষ্ঠার চক্করের মধ্যে পড়েছেন। বা এমন হতে পারে, তিনি সত্যটাই বলেছেন, কেননা স্তাবকদল আর পত্রিকার সম্পাদক ছাড়া অন্যদের সংস্পর্শ তিনি তো পাচ্ছেন না!
অথবা, বাংলা কবিতা আধুনিক যুগ পেরিয়ে পোস্টমর্ডান যুগে প্রবেশ করে নতুন আর অভিনব হয়ে উঠছে ক্রমে, সেই ভাষা, সেই পরিবর্তিত মননের নাগাল পাচ্ছেন না তিনি। সেটা পাবার সম্ভাবনাও দেখছি না, কেননা পুরোনো এক ধরনের কাব্যচিন্তা ও ভালত্বের মধ্যে তিনি আটকে পড়েছেন। নতুনে অবগাহন করা তাঁর পে বোধকরি আমৃত্যু দুঃসাধ্যই থেকে যাবে।



চঞ্চল আশরাফ
চর্বিত-চর্বণ বলতে আমরা যা বুঝি, তিনি তা-ই করে যাচ্ছেন

সুবর্ণরেখার গত সংখ্যায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটিতে আল মাহমুদ বলেছেন, ‘আমাদের কবিতা এই সময়ে এসে একটা দিশেহারা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে’। আমি বলতে চাই, আমাদের প্রতিষ্ঠিত কবিরা মূর্খ-পরিবেষ্টিত থাকতেই ভালোবাসেন এবং তাদের মূর্খতা দিয়েই সমকালীন কবিতার বিচার করেন। সমকালীন কবিতা নিয়ে তাঁর এমন মন্তব্য আসলে তাঁর সমস্যা নয়, তাঁর আশপাশে যারা লিখে বেড়াচ্ছেন, তাদের সমস্যা। এতে আরও মনে হয়, সমকালীন কবিদের খোঁজ তিনি রাখেন না। আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে একটা রেওয়াজ দাঁড়িয়েছে যে, প্রতিষ্ঠিত কবিরা পরবর্তী কবিদের উপোর চোখে দেখেন, আল মাহমুদও এর ঊর্ধ্বে উঠতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদিও আল মাহমুদ কেন, কোনো কবির কোনো উক্তিই শেষপর্যন্ত সাহিত্যের কাজে আসে না। তিনি নিজেকে একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন, এটাই তাঁর জন্য যথেষ্ট নয় কি? এটা নিয়ে চুপচাপ থাকাই ছিল সঙ্গত। অবশ্য তাঁর কবিতা পড়ে তাঁকে যথেষ্ট শিতি মনে হয় না।
তিনি অভিযোগ করেছেন সমকালীন কবিতায় কেবল ‘তুমি’ ‘আমি’ লেখা হচ্ছে। এেেত্র সত্য হলো যে, তিনি নিজেই তাঁর সময়ে ‘আমি-তুমি’ নিয়ে বেশি লিখেছেন। হয়তো এই ‘তুমি’কে তিনি আধ্যাত্মিক বলে দাবি করবেন। বলা বহুল্য নয় যে, আধ্যাত্মিকতা বাংলা কবিতার একটা বহুল ব্যবহৃত ও বাতিল বিষয় হয়ে গেছে।
আঙ্গিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন। কিন্তু সত্য হলো, তাঁর কবিতা পড়ে মনে হয় না তিনি আঙ্গিক নিয়ে সচেতন। তাঁর সময়ে, তিনিই আঙ্গিক বিষয়ে সবচেয়ে বেশি অসচেতন ছিলেন, তাঁর কবিতা তা-ই প্রমাণ করে। চর্বিত-চর্বণ বলতে আমরা যা বুঝি, তিনি তা-ই করে যাচ্ছেন। আঙ্গিক নিয়ে বরং তাঁর সময়ে সৈয়দ শামসুল হক ভালো কিছু কাজ করেছেন।
আধুনিক কবিতা সম্পর্কে আল মাহমুদের ধারণা খুব অস্বচ্ছ, তাঁর কবিতাও এই অস্বচ্ছতার প্রমাণ দেয়। তিনি আসলে আধুনিক কবিতা লেখেননি। তিনি লিখেছেন, বাঙালি মধ্যবিত্তের আধা আধ্যাত্মিক ও আধা রোমান্টিক- এক ধরনের ভাবালুতা সর্বস্ব কবিতা। শুরুতে সেগুলোয় একটা মার্কসবাদী কোটিং ছিল। তাঁর শব্দ-রুচিও আধুনিক মনস্ক নয়। তিনি অনেক লোকজ শব্দ ব্যবহার করেছেন, তবে লোকজ শব্দের ব্যবহার প্রমাণ করে না যে তিনি আধুনিক। যদিও লোকজ শব্দ দিয়ে অনেকের পে আধুনিক কবিতা লেখা সম্ভব হয়েছে। তাঁর কবিতা সরল, কিন্তু আধুনিক কবিতার লণ এটা নয়। তাঁর কবিতার আখ্যানধর্মিতা বেশ উপভোগ্য কিন্তু আধুনিকতার পরিচয় এটা নয়। আধুনিকতার বহুল ব্যবহৃত সংজ্ঞা হলো, বিপর্যয়কারী বহুমুখী চিন্তার জটিল প্রকাশ। তাঁর কবিতায় যে চিন্তা এবং জীবন সম্পর্কে যে ধারণা আমরা পাই তা এই সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। তাঁর লিখিত ‘সোনালী কাবিন’ বিখ্যাত একটি কবিতা সংকলন। এই বইটিতে কবির যে দৃষ্টিভঙ্গি তা অনেকটা প্রথাগত। মার্কসবাদী একটা কোটিং এতে আছে, অথচ ভোগবাদী চিন্তায় যে তিনি একেবারে কম্পমান, তা প্রতিটি কবিতায়ই টের পাওয়া যায়। কিন্তু মার্কসবাদী চিন্তার সঙ্গে ভোগবাদিতার বিরোধ আছে। আল মাহমুদের এধরনের কবিতা প্রমাণ করে চিন্তার ক্ষেত্রে তিনি স্বচ্ছ নন, বরং স্ববিরোধিতায় ভরে আছে তাঁর রচনারাশি।
তিনি বলেছেন, ‘কবিতা যেন একটা চরে আটকে গেছে’। আমি বলতে চাই, গত শতাব্দীর শেষ দশক থেকে বাংলা কবিতা যে গতিময়তা অর্জন করেছে, তা এখনও আছে; এমনটি পঞ্চাশে তো নয়ই, ষাটের দশকেও ঘটেনি। অধিকন্তু এখনকার কবিরা আঙ্গিক সচেতন, দেশ-কাল সচেতন। তারা যেমন গ্রহণ করতে পারেন, তেমনি বর্জন করতেও পারেন।
তিনি বলেছেন, ‘বক্তব্য না থাকলে তো আঙ্গিক দাঁড়ায় না, এ কারণেই বাংলা কবিতার এই দুর্গতি’, এটা আসলে সমকালীন কবিতা সম্পর্কে তাঁর ধারণাহীনতারই পরিচয় বহন করেছে। আমি তাঁকে সমকালীন কবিতা ভালো করে পড়ে দেখার অনুরোধ করছি।
সবশেষে তিনি বলেছেন, ‘বাংলা কবিতার এখন যে দশা হয়েছে, আট লাইনে এসে কবিতা দাঁড়াচ্ছে, আর এগুতে পারছে না’- অর্থাৎ তরুণ কবিরা দীর্ঘ কবিতা লিখছেন না বা লিখতে পারছেন না- তাঁর এমন মন্তব্যও আপত্তিকর। আগেই বলেছি তাঁর আশপাশে যারা আছে, তারা অশিতি, পশ্চাৎপদ এবং বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের কবি। তাদের আট/দশ লাইনের জিকির-মার্কা কবিতা পড়ে মনে হতে পারে এখনকার কবিতা আট/দশ লাইনের বেশি হতে পারে না। তাঁর পাশে-থাকা কবিদের সনেটগুলোও তো আট-দশ লাইনের! বাস্তবতা হলো, আমাদের সময়ের কবিরা দীর্ঘ কবিতা যেমন লিখছেন, তেমনি ক্ষুদ্র কবিতাও লিখছেন। দীর্ঘ কবিতা থেকে ক্ষুদ্র কবিতা লেখা কম বাহাদুরীর ব্যাপার নয়। কেবল দীর্ঘ কবিতাই ভালো জিনিস- এমনটা ভাবা বোকামি, কারণ এতে থাকতে পারে বাচালতা, যা ক্ষুদ্রকবিতায় সচরাচর থাকে না। ক্ষুদ্র কবিতা কবির পরিমিতি বোধের পরিচয়ও বহন করে। অবশ্য আমাদের এখনকার কবিরা দীর্ঘ কবিতায়ও সেই পরিমিতিবোধ দেখাতে সম হয়েছেন। নিজের সময়ের প্রতি পপাতবশত আমি এসব-কথা বলছি না, এটা বাস্তবতা। এও বলতে পারি, এই উক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে নিজের সময়ের কাছে আমার পরাজয়ের আনন্দ।


সাখাওয়াত টিপু
একজন কবির পতন

আল মাহমুদের প্রকাশিত সাক্ষাৎকার একটা স্থুল-সাক্ষাৎকার। পড়িয়া দেখিলাম, যিনি প্রশ্ন করিতেছেন আর যিনি উত্তর দিতেছেন, দু’জনের মধ্যে যেভাবে যুক্তি-তর্ক হওয়ার কথা ছিল, সেভাবে হয় নাই। প্রশ্নের মধ্যে ভক্তি চলে না। আর উত্তরদাতার মধ্যে অভক্তি চলে না। সাক্ষাৎকারের একটা উদ্দেশ্য থাকে। যুক্তিপূর্ণ তর্ক থাকে। এই সাক্ষাৎকারে তাহা নাই। ইহা বড় সমস্যা বটে। প্রশ্নগুলা এভাবে করিলে দেখা মিলিবে, কে প্রশ্ন করিতেছেন, কীভাবে প্রশ্ন করিতেছেন- তাহার সুরাহা হওয়া প্রয়োজন। উত্তরদাতা কী উত্তর দিতেছেন, কীভাবে উত্তর দিতেছেন, তাঁহারও রাজনীতি আছে। তবে সাক্ষাৎকারে ভক্তিরই প্রতিফলন ঘটিয়াছে। প্রশ্নকর্তার স্তুতি আর উত্তরদাতার অভক্তি দুই-ই সমভাবে দৃশ্যমান। কারণ প্রশ্নের সঙ্গে উত্তরের যোগাযোগ না থাকিলে তাহা কিছু অকাট মন্তব্য বলিয়া বিবেচিত হয়। কেননা যুক্তিহীন যে কোনো মন্তব্যই ফেটিসভাষা।
আল মাহমুদ বলিয়াছেন, ‘কবিতা এই সময়ে এসে একটা দিশেহারা অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে’। উত্তরে কহিব, কবিতা কখনো দিশেহারা হয় না। কারণ কবি যখন নিজেই দিশেহারা হন তখন তাঁহার কাছে সবকিছুই দিশেহারা মনে হয়। প্রশ্ন হইতেছে, ‘এই সময়’ বলিতে আমরা কী বুঝিব? হালের কবিতা? হালের সাহিত্য? হালের চিন্তা? তাহার মানে সমসাময়িক সমাজ-বাস্তবতা, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি, অর্থনৈতিক চিন্তার কায়-কারবার। আল মাহমুদের অভিযোগ, ‘কবিতায় সমসাময়িক বিষয়বস্তুর প্রতিফলন নেই’। এবেলায় কথা হইল, চিন্তার কখনো বন্ধ্যাত্ব ঘটে না। ইহা মনোজগতের চলমান রূপ। ফলে যখন বলা হয়, কবিতার দিশেহারা অবস্থা তখন আসলে কবিতা দিশেহারা হয় না। হয় যিনি চিন্তা করেন বা চিন্তাকে কবিতাকারে যথাযথভাবে প্রকাশ করিতে পারেন না তাঁহার দিশেহারা অবস্থা। চিন্তা বলিতে আমরা ভাব ও ভাষাকে বোঝাইতেছি।
তথাকথিত আধুনিকতা এখন নানা প্রশ্নের সম্মুখীন। কারণ বাংলা ভাষা যদি বাংলা ভাষা আকারে বিকাশ লাভ করিত, তাহার ফল দাঁড়াইতো বিকাশমান ভাষার পর্যায়ে। ভাষার হাল-হকিকত পরখ করিলেই তাহা স্পষ্ট হয়। তথাকথিত আধুনিকতার পিছনে একটা ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি কাজ করিয়াছে। কী তাহার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি? কারণ ব্রিটিশ শাসনের ফলে বাংলায় যে ‘শুদ্ধ মধ্যবিত্ত’ তৈয়ার হইয়াছিল তাহা শিক্ষাগতভাবে অনুকার সৃষ্টিরই কারখানা ছিল। বিকাশমান মধ্যশ্রেণীর পশ্চিমের স্তবগান গাওয়া ছাড়া আর কোনো রাস্তাই ছিল না। ফলে এই শুদ্ধ মধ্যবিত্তের হাতে যে সাহিত্য সৃষ্টি হইয়াছে তাহা ব্রিটিশ শাসনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভাষার ফলাফল। কারণ বাংলা বাংলার মতো হয় নাই, হইয়াছে ব্রিটিশের ধাঁচে আধুনিক। বাঙালি বাবুয়ানা সাহেবদের ভাষা বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক জমিনে কী অর্থ ফলাইয়াছে তাহা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাইতেছে। তাহার দায় বহন করিবে কে বা কাহারা?
কবিতায় ‘আমি’ ‘তুমি’ প্রয়োগের বিষয়ে আল মাহমুদের কথা একঅর্থে ঠিক। কারণ তিনি নিজেই আমি-তুমির প্যারাডক্সে হাবুডুবু খাইতেছেন। তাঁহার একটা কবিতার বহির নাম তুমি তৃষ্ণা আমি পিপাসার জল- এইখানে নতুন কী আছে? তুমি তৃষ্ণা আমি পিপাসার জল বহিতে কোনো নতুনত্ব নাই। আছে শুধু কিছু বাক্য বা শব্দের প্রলাপ।
আরেকটু বিশদ করিলে হয়, আল মাহমুদ তাঁহার সোনালী কাবিনকে পরকালের লেখা দিয়া অতিক্রম করিতে পারেন নাই। ইহা একজন কবির জন্য পতন। তাঁহার কবিতার ভাষায় যে দেহ মিলে, তাহা মেদবহুল। কখনো কখনো লালায়িত পুরুষ। কারণ ভোগ পুরুষ নিয়ন্ত্রিত হইলে ফসলের বণ্টন অসম হইতে বাধ্য। এইখানে নারী পণ্য আকারে হাজির হয়। সোনালী কাবিনে শুধু ব্যক্তির তথাকথিত ভোগের আকাক্সাই প্রকাশিত। প্রচলিত সমাজের ধারণা- কার্ল মার্কসের চিন্তাপ্রসূত আল মাহমুদের সোনালী কাবিনের সৃষ্টি। এইকথা সর্বঅঙ্গে সত্য নহে। কারণ মার্কসের চিন্তার যে ব্যাপ্তি, যে সামাজিক মালিকানা বা পুঁজির কথা বলা হইয়াছে, তাহা এই বহিতে নাই। ইহা এক ধরনের উপর চালাকি। কথায় কহে- চকচক করিলে সোনা হয় না। সোনা হতে হইলে বস্তুগত ও ভাবগত গুণাগুণ প্রয়োজন। তদুপরি আল মাহমুদের রাজনৈতিক সুবিধাবাদই ইহার উদাহরণ।
আমি-তুমির রাজনীতি এই তিরিশের আধুনিকতারই অবয়ী রূপ। কেননা পুঁজিবাদী সমাজকাঠামো তথাকথিত ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার বিকাশমান ধারার চালচুলা ইহার ভিতরে বিদ্যমান। সা¤প্রতিক কবিতা সম্পর্কে আল মাহমুদের মতো তরল কথাবার্তা অনেকেই বলিয়াছেন। তাহা এখন দোকানীর দরশন। আর কবিতা তো জাহাজ নহে যে চরে আটকা পড়িবে। সা¤প্রতিক কবিতার আকার সম্পর্কে আল মাহমুদের যে বক্তব্য তাহাতে মনে হয় তাঁহার পাঠের ঘাটতি রহিয়াছে। সেই কারণেই তিনি মনে করিতেছেন আট লাইনের কবিতা খারাপ। থাই-সনেটও তো আট লাইনে লেখা হয়। এইরকম স্থুল বিচার আসলেই সাহিত্য সমালোচনার কোনো সত্য হাজির করে না। হালের কবিতার আঙ্গিক নিয়া তিনি কিছু প্রশ্ন তুলিয়াছেন। যাহা তাঁহার অজানা। হালের কবিতার পাঠ থাকিলে তিনি ইহা বলিতে পারেন না। চিন্তার ফসল হইল ভাব বা ভাষা। চিন্তার যখন বিকাশ ঘটে তখন ভাষা আপন আঙ্গিকেই দাঁড়াইয়া যায়। দাঁড়ানো মানে দাঁড়ানোই, শোয়া নহে। সমাজের চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দেয়া। কেননা মানুষ ভাব বা ভাষা দিয়া সমাজকে বদলাইতে পারে। আঙ্গিক হইতেছে ভাষার পরিবর্তন। চিন্তার পরিবর্তনের ফলে তাহা ভাষায় প্রতিফলিত হয়।
আল মাহমুদের কবিতায় নতুনত্ব কী আছে? তিরিশি আধুনিকতা বাদ দিলে আল মাহমুদের কবিতায় আর কী থাকে, তাহা তিনিই ভালো বলিতে পারিবেন। তাঁহার কবিতায় গ্রাম ও শহর দুই-ই আছে। একদম ঠিক কথা। একটা সমাজে বসবাস করিলে তাহার যদি গ্রাম থাকে, শহরও থাকিবে। কিন্তু প্রশ্ন হইতেছে, গ্রাম শহরকে গ্রাস করে কি-না, কিংবা শহর গ্রামকে গ্রাস করে কি-না? গোলকায়নের যুগে গ্রাম শহরে যায় না, শহর গ্রামে গিয়া হাজির হয়। এই উপলব্ধি হয়তো আল মাহমুদের নজর এড়াইয়া গেছে। ফলে তিনি লোকবলের গমনাগমন দিয়া আরবানিটির বিচার করিয়াছেন। ইহা বড় মুশকিল বটে।
শেষনাগাদ কহিব- কবি আল মাহমুদকে পরিচয় করাইয়া দিবার কিছু নাই। এই তর্ক তোলার উদ্দেশ্য- একজন কবিকে খাটো করার জন্য নহে। এক অগ্রজ কবির ভাবনারে নতুন ভাব দিয়া দেখা। কেননা ঔপনিবেশিক শাসনচক্রের ফল তথাকথিত আধুনিক বিচার আমরা কম দেখি নাই। মতা ও ভাষার অবয়ও দেখিয়াছি বিস্তর। তাইলে মীমাংসা কোন পথে? সাফ সাফ কথা- মানসিক মুক্তি ঘটিলে ভাষার মুক্তি ঘটিবে। কালো হরফ কালোই থাকিবে। সাদা চিন্তার আধুনিক বরফ গলিয়া গলিয়া পড়িবে একদিন না একদিন।


[নব্বইয়ের তিন কবির প্রতিক্রিয়া গ্রন্থনে সফেদ ফরাজী]






সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০০৯ বিকাল ৫:৫৭
১৫টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্মৃতিপুড়া ঘরে

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৩০



বাড়ির সামনে লম্বা বাঁধ
তবু চোখের কান্না থামেনি
বালিশ ভেজা নীরব রাত;
ওরা বুঝতেই পারেনি-
মা গো তোমার কথা, মনে পরেছে
এই কাঠফাটা বৈশাখে।

দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছে
মা গো এই সময়ের ঘরে
তালপাতার পাখাটাও আজ ভিন্নসুর
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×