ক্ষমতা কি না পারে! রাতকে দিন, দিনকে রাত। সব, সব পারে। সব সম্ভবের দেশ, এই দেশ। সবকিছুই এখানে সম্ভব। অসম্ভব বলে কিছু নেই। কি যৌক্তিক, কি অযৌক্তিক, কি বাস্তব, কি পরাবাস্তব। এটিকে পরাবাস্তব কিংবা যাদুবাস্তব বলাই বোধকরি ভালো। যদিও বহুদিন আগে থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডের সীমারেখায় এমন সব ঘটনা ঘটে চলেছে, যা বাস্তবত ভেবে বিস্মিত হওয়ার মতোও আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
বরাবরই রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত `প্রভুরা' এদেশের মেহনতি মানুষের অধিকার নিয়ে শুধু খেলাই করেনি, করেছে ধর্ম ও অর্থনীতির নিরিখে বিভেদরেখার নির্মাণও। সম্প্রতি লালনের ভাস্কর্য ভাঙার বিষয়টিও এর বাইরের নয়। এটিও নতুন ঘটনা নয়, এর আগে পাকিস্তান সরকার এদেশে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার পর্যন্ত ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছিল। দুটো ঘটনার বাস্তবতা ভিন্ন হলেও মূলগত সাদৃশ্য আছে। সাম্রাজ্যবাদী আশীর্বাদপুষ্ট, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে জারিত, বেড়ালস্বভাবী `সুশীল' জ্ঞানপাপী পরিবেষ্টিত এইসব রাষ্ট্রযন্ত্রের কাছ থেকে এর থেকে ভালো আর কি আশা করার আছে! এরা যে শহীদ মিনার ভাঙবে, লালনের ভাস্কর্য ভাঙবে, প্রগতিশীলতার পথে কাঁটা বিছিয়ে দেবে, অসাম্প্রদায়িক চিন্তার গলা চেপে ধরবে, এটাই স্বাভাবিক। কেননা এরা প্রগতিশীলতাকে ভয় পায়, এদের মেরুদণ্ডের জোর কম, তথাপি এরা ক্ষমতার লোভ ত্যাগ করতে পারে না। যদিও গণআন্দোলনের মুখে সবসময়ই এদের পট পরিবর্তন ল্ক্ষ্য করা যায়, কিন্তু এদের প্রেতাত্মারাই আবার সেই স্থান দখল করে রাখে। ভবিষ্যতেও হয়তো তাই ঘটতে থাকবে! ৪৭ এর পর থেকে দেখলেও দেখা যায়, এদেশের গণমানুষের দাবিকে, মুক্তচিন্তা ও অসাম্প্রদায়িকতার পথকে রুদ্ধ করতে `ক্ষমতাসীন যন্ত্র' দানবের মতো এগিয়ে এসেছে বারবার। তারই উদাহরণস্বরূপ ৫২তে প্রথম শহীদ মিনার ভেঙে দেয় সরকারের পুলিশ বাহিনী আর ২০০৮ সালে অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী বাউল লালন শাহের স্মরণে নির্মিতব্য ভাস্কর্য ভেঙে দিল কয়েকজন মাদ্রাসা ছাত্র ও ধর্মীয় মৌলবাদী ব্যক্তি! অথচ রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা সরকারের নিয়ন্ত্রণে। এই `মৌলবাদী বাহিনী' তাহলে কার শক্তিতে শক্তিমান? সরকারের? নাকি বিদেশি কোনো শক্তির? এখানেই মূল প্রশ্ন দানা বাঁধে, লালনের ভাস্কর্য ভাঙল তবে কে? মৌলবাদী বাহিনী? নাকি সরকার? নাকি বিদেশি কোনো শক্তি?
প্রথম `শহীদ মিনার' ভাঙার কাহিনী:
৫২'র ২১শে ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের যেসকল কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হন, তাঁদের স্মরণে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে একটি শহীদ স্মৃতিসৌধ বা শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। এটিই ছিল শহীদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম শহীদ মিনার। ভাষা শহীদদের লাশ সরকার পুলিশ কর্তৃক সরিয়ে গোপনে দাফন করার পর থেকে আওয়াজ উঠেছিলো `শহীদ স্মৃতি অমর হোক'। এই আওয়াজকে আরও নির্দিষ্ট রূপ দেওয়ার জন্য যে জায়গায় ছাত্রেরা গুলির আঘাতে প্রথম শহীদ হন সেখানে, সেই ১২ নং শেডের পাশে, মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা একটি শহীদ মিনার নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন এবং তাঁদেরই সক্রিয় উদ্যোগে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাত্রের মধ্যেই সেখানে শহীদ মিনারটি গড়ে ওঠে। এ বিষয়ে শহীদ মিনারের নকশা প্রণয়নকারী মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন ছাত্র সাঈদ হায়দার বলেন :
``এটাকে স্বতঃস্ফূর্ত একটা পরিকল্পনা বলা চলে। দলমত নির্বিশেষে সকল ছাত্র শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ২২ ফেব্রুয়ারির রাত থেকেই শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি থেকে শহীদ মিনার তৈরির কাজ শুরু হয়। ২৩ তারিখ বিকেল থেকে শুরু করে সারারাত সেখানে কাজ হয় (কার্ফু থাকা সত্ত্বেও)... ইট-বালির কোন অভাব ছিল না। মেডিক্যাল কলেজ সম্প্রসারণের জন্য প্রচুর ইট-বালি ছিল। ছাত্ররাই ইট বয়ে এনেছে। বালির সঙ্গে মিশিয়েছে। দুজন রাজমিস্ত্রী ছিল। তাদের নাম বলতে পারব না। আমাদের মেডিক্যাল হোস্টেলে প্রায় তিনশ ছাত্র ছিল। তাদের সকলেই সেদিন কোন না কোন কাজ করেছিল। আর শহীদ মিনারের নকশা তৈরি করেছিলাম আমি। শহীদ মিনারের কাজ শেষ হলে দড়ি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল এবং নকশাটি সেখানেই টাঙিয়ে দেয়া হয়েছিল।... শরফুদ্দীন (তাকে আমরা ইঞ্জিনিয়ার বলতাম। সে অঙ্ক ভালো জানতো...) শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে যথেষ্ট যত্ন নিয়েছিল। এছাড়া মাওলা, হাশেম, জাহেদ, আলিম, জিয়া আরও অনেকে শহীদ মিনার নির্মাণে প্রাণপাত পরিশ্রম করে। এছাড়া ছিল আমাদের অনেক বয়-বেয়ারা। এরাই ছিল সেদিনকার বড় কর্মী। নকশায় ৯ ফুটের পরিকল্পনা হয়েছিল, কিন্তু শেষ হওয়ার পর দেখা গেল মূল পরিকল্পনাকে তা ডিঙিয়ে গেছে। মিনারটি সম্ভবত ১১ ফুট তৈরি হয়েছিল। বদরুল আলমও মিনার নির্মাণে সাহায্য করেছিল। তার হাতের লেখা ছিল চমৎকার। কাগজে লিখে মিনারের গায়ে সেঁটে দিলে মর্মর পাথরের মতো দেখাতো। আজকের শহীদ মিনার যেখানে, প্রায় তার কাছাকাছি মিনারটি তৈরি করা হয়েছিল। ...শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে এনে ২৪ ফেব্রুয়ারি মিনারটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম।''
পরে পরিষদ সদস্যপদ থেকে ইস্তফাদানকারী তৎকালীন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক, আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে দিয়ে শহীদ মিনারটি দ্বিতীয়বার উদ্বোধন করা হয়। এবং একটি সমাবেশও অনুষ্ঠিত হয়।
কিন্তু সেই শহীদ মিনারটির আয়ু ছিল খুবই অল্প। তৎকালীন সরকার ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলের দিকে পুলিশ দিয়ে সেটি ভেঙে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। এরপর বর্তমান কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি ভাস্কর হামিদুর রহমানের দ্বারা নির্মিত হয়।
(তথ্যসহযোগিতা নেওয়া হয়েছে : পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি -বদরুদ্দীন উমর)