দুর্ধর্ষ দশ সেনাসদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত এক মুক্তিযুদ্ধা টিমের নাম। যাঁরা পাক হানাদার মুক্ত করেছিলেন ফেনীর বিলোনিয়া আর পরশুরাম। মাধু মিয়া সেই টিমের একজন দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধা।
১৯৫৮ সালে ১৮ বছরের মাধু মিয়া পাকিস্থানী আর্মীতে যোগ দেন।
অংশ নেন ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে। ১৯৭১-এ তিনি চট্টগ্রামে সৈনিকদের প্রশিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চের বর্বর হত্যাকান্ডের পর পাকিস্থান সরকারের অধীন থাকার অবকাশ ছিলনা।ছুটে চলে যান জন্মস্থান নিলখী গ্রামে।
গ্রামের সবাইকে সতর্ক করে সংঘঠিত হতে চলে যান ভারত।একত্রিত হন ১০ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে।
অতপর ২নং সেক্টরে কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে ফেনী জেলায় বিলোনিয়া যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। বিলোনায়া মুক্ত করার পর মাধু মিয়া মুন্সিরহাট, রাণীর হাট, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় যুদ্ধ করেন।
পুরো নাম হাজী সুবেদার (অবঃ) মাধু মিয়া বীর প্রতীক, পিতা- আব্দুল আজিজ (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), গ্রাম- পূর্ব নিলখী, থানা ও উপজেলা-ফুলগাজী, জেলা-ফেনী। সহোদর সানু মিয়াও ই.পি.আর থেকে পালিয়ে পিরোজপুরে যুদ্ধে শরীক হন। মাধু মিয়া নিজ এলাকা মুক্তকারী স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরও দীর্ঘদিন তিনি সেনাবাহীনিতে দায়িত্ব পালন করেন এবং ১৯৮৮ সালে অবসর গ্রহন করেন। কর্মজীবনে 'বীর প্রতীক', 'রণ তারকা','জয় পদক','মুক্তি তারকা', 'সমর পদক', 'সংবিধান পদক' প্রভৃতি সম্মানে ভূষিত হন। ১৯৯৩ সালে মাধু মিয়া প্রবিত্র হজ্জ্বব্রত পালন করেন।পরবর্তী জীবনে তিনি 'তাবলীগ জামাত'-এর সাথে সম্পৃক্ত হয়ে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দ্বীন প্রচারে অবদান রাখেন।
২০০৯ থেকে মাধু মিয়া শারিরীকভাবে অসুস্থ হয়ে পরেন।২০১০-এর নভেম্বরের ২১ তারিখে কুমিল্লা সেনানিবাসে দুর্ধর্ষ দশের ৩৯তম বর্ষপূর্তি ও সশস্র বাহিনী দিবস অনুষ্ঠানের সংবর্ধনায় অংশ নিতে গিয়ে তিনি কুমিল্লা সি.এম.এইচে ভর্তি হন। শারিরীক অবস্থা অবনতির দিকে যাওয়ায় ২ ডিসেম্বর তাঁকে ঢাকা সি.এম.এইচে স্থানান্তর করা হয়। অবশেষে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৫ ডিসেম্বর ভোর ৩ টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। একই দিন বিকালে নিজ গ্রামের কবরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর লাশ দাফন করা হয়।পাশেই তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা সানু মিয়ার কবর।
বিলোনিয়া যুদ্ধ :
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাধু মিয়া মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে পাক হানাদার বাহীনির বিরুদ্ধে ফেনীর পরশুরামের ১ নং মির্জনগর ইউনিয়নে যুদ্ধ আরম্ভ করেন। কাউতলি চম্পক নগরে মুহুরী নদীর উপর তাঁরা ডিফেন্স তৈরী করেন। এরপর বিলোনিয়া রেলস্টেশন, দুগলাচান আর পরশুরাম ডাক বাংলো এবং বাজারের উপর বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে পাকবাহিনীর উপর গেরিলা হামলা চালান ।তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা মিলে ঐ হামলায় অনেক পাকিস্থানীকে হত্যা করেন এবং একজনকে জীবিত ধরে নিয়ে আসেন। সে সময় তার সহজ সরল বাবাকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করায় এবং দুই ছেলে মুক্তিযোদ্ধা শুনে পাকবাহিনী ধরে নিয়ে যায়। একই এলাকার সাজু, ভেন্ডু মেম্বার সহ তাঁকে ফুলগাজী পুরাতন ব্রীজের উপর থেকে গুলি করে নদীতে ফেলে দেয়।বহু খুঁজেও মাধু মিয়ার শহিদ বাবার লাশ খুঁজে পাওয়া যায়নি। এর ফলে তিনি আরো প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠেন।রাগে-ক্ষোভে বন্দী পাক সৈন্যকে বেধড়ক ঝাড়ু পিটা করেন।মাধু মিয়ারা তখন চিতলিয়া আর সলিয়া গ্রামে অবস্থান নেন।
আনুমানিক ৩ নভেম্বরের সকাল, চিথলিয়া রেলস্টেশনের উত্তরে ব্রাভো কোম্পানির করা বাংকারে অবস্থান নেন মাধু মিয়া, এয়ার আহমেদ সহ আরো কয়েকজন।হঠাৎ রসদ সহ একটি রেলওয়ে ট্রলিতে ছয় পাকিস্থানী (এক জন অফিসার সহ) চিথলিয়া থেকে পরশুরামের দিকে আসছিল। বাংকারের কাছাকাছি আসতেই অতর্কিত গুলি চালায় মাধু মিয়ারা। এতে সব পাকিস্থানী মারা যায়। ট্রলির অস্ত্র সংগ্রহে এগিয়ে যান হাবিলদার এয়ার আহমেদ। ইতিমধ্যে গোলাগুলির আওয়াজ শুনে চিথলিয়া স্টেশন ও পরশুরামের হানাদাররা গুলিবর্ষন শুরু করে। গুলির আঘাতে শহীদ হন এয়ার আহমেদ। প্রচন্ড বৃষ্টিতে পাকিস্থানীদের উভয় দিক থেকে আক্রমণে মাধু মিয়ারা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। তাঁরা দ্বিমুখী অবস্থান নিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে যান।আশপাশের মুক্তিযোদ্ধারাও এগিয়ে আসেন। টানা দুই দিন সব মুক্তিযোদ্ধাদের যৌথ যুদ্ধের পর পরশুরাম ও চিথলিয়ার পাকিস্থানীরা বিচ্ছিন্ন হয়।এবং পরশুরাম থেকে পালানোর সময় অনেক পাকিস্থানী মুক্তিযোদ্ধাদের হাতের বন্দী হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধারা অনেক অস্ত্র পাক বাহিনী থেজে সংগ্রহ করেন
এবং এখান থেকে বাংলাদেশের মুল বিজয় উল্লাস ক্রমেই বাড়তে থেকে।
কৃতজ্ঞতায় ওসমান গনি জাহিদ
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৫০