আজ ২৫শে নভেম্বর। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস আজ।
১৯৯১ সালের এই দিনে শুরু হয় দক্ষিনাঞ্চলের মানুষের বহু আকাঙ্খিত এই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা। বয়রায় অবস্থিত খুলনা আর্ট কলেজের (বর্তমানে চারুকলা ইন্সটিউট, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়) অবকাঠামো নিয়ে যাত্রা করে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান টি। চারটি ডিসিপ্লিনে ২০ জন করে মোট ৮০ জন ছাত্র ছাত্রী ছিলো প্রথম ব্যাচে। ডিসিপ্লিন ৪ টি ছিলো স্থাপত্য, কম্পিউটার বিজ্ঞান, ব্যবসা প্রশাসন ও নগর এবং গ্রামীন পরিকল্পনা। গল্লামারীর ময়ুর নদীর তীর সংলগ্ন এলাকায় ১০১ একর জায়গা নিয়ে শুরু হয়েছিলো অবকাঠামো নির্মানের কাজ। প্রথম ছাত্রাবাস ছিলো নিরালা এলাকা ও খালিশপুর এলাকার কিছু ভাড়া করা বাড়ি নিয়ে।
সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেবর। আজ এই প্রতিষ্ঠানে ২১ টি ডিসিপ্লিনের ছাত্র ছাত্রী সংখ্যা প্রায় ৬,০০০। বিদেশি ছাত্র ছাত্রী (প্রধানতঃ নেপালী) আছে ২৫ জন। শুধুমাত্র বিএসসি প্রোগ্রাম নিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন প্রায় সব ডিসিপ্লিনেই মাস্টার্স প্রোগ্রাম অফার করা হয়। অনেক ডিসিপ্লিনে ডক্টরেট প্রোগ্রাম ও চালু করেছে। যদিও যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়েছিলো তা থেকে অনেক খানি দূরে সরে এসেছে এটি। সন্ত্রাস ও ছাত্ররাজনীতি মুক্ত ক্যাম্পাস, কিন্তু শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রাজনীতি তে বাধা নেই। যা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রগামীতার পথে একটি বড় বাধা।
আমাদের দক্ষিনাঞ্চলের মানুষেরা সবসময়ই অবহেলিত। স্বাধীনতার পর যেখানে প্রত্যেকটি বিভাগেই একটি করে পূর্ণাঙ্গ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিলো সেখানে আমাদের খুলনা বিভাগে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় হয় ১৯৯১ সালে। অনেকে বলবেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৫ সালে শুরু হয়েছিলো। কিন্তু আমার জানামতে সেটি শুরু হয়েছিলো গাজীপুরে (বর্তমান জাতীয় বিশ্বঃ ও উন্মুক্ত বিশ্বঃ এর ক্যাম্পাস)। ১৯৯২ সালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার বর্তমান লোকেশনে স্থানান্তরিত হয়। প্রথম মেডিকেল কলেজ ও স্থাপিত হয় ১৯৯১ সালে। এটা কি আমাদের নেতাদের ব্যর্থতা নয়?
সেজন্যই এই বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আমাদের অনেক স্বপ্ন। তাই যখন দেখি আমাদের স্বপ্ন থেকে পিছিয়ে পড়েছে অনেক আরাধ্য এই প্রতিষ্ঠান টি, তখন খুব খারাপ লাগে। সেশনজ্যাম মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলো যারা, আর তাদের ক্লাস শুরু করতেই সময় লাগে ৮ মাস। ভর্তির ৮ মাস পরে ক্লাস শুরু হলে নতুন ছাত্র ছাত্রী রা যখন দেখে তাদের অন্যান্য ইউনির বন্ধুরা প্রায় ১ বছর শেষ করে ফেলেছে, তখন তাদের মোটিভেশন কী পর্যায়ে থাকে। ছাত্র রাজনীতি নেই, সেই সুযোগ টা নিয়ে অনেক শিক্ষক ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। কখনো কখনো পুরো ব্যাচকে ফেল করিয়ে দেন, যেটা একেবারেই অন্যায্য।
সর্বশেষ মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ভিতর ৫৬ টি ডিসিপ্লিন, ১৫ টি ইন্সটিউট, আধুনিক ভাষা ইন্সটিটিউট, সকল ছাত্র ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করার কথা। এখন পর্যন্ত ২১ টি ডিসিপ্লিন তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিগত কয়েক বছরে যেসমস্ত ডিসিপ্লিনে খোলা হয়েছে তার ভিতরে বাংলা, ইংরেজী, সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, পরিসংখ্যান অন্যতম। আমি বলছিনা যে এই সমস্ত ডিসিপ্লিনের দরকার নেই, কিন্তু যে বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়েছে স্থাপত্য, ব্যবসা প্রশাসন, কম্পিউটার বিজ্ঞান ইত্যাদি ডিসিপ্লিন দিয়ে সেখানে এখন আর কেন কর্মমুখী বিষয়গুলোর উপর জোর দেয়া হয়না?
কেউ হয়তো বলবেন খুলনা বিশ্বঃ একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, এখানে টেকনিক্যাল সাবজেক্ট চালানো যাবেনা, ঐগুলার জন্য তো ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি আছেই। তাদের জন্য বলি, বিশ্বের বহু নামকরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামের সাথে ইঞ্জিনিয়ারিং বা টেকনোলজি কথা টা নেই এমন কি কোন কোন গুলার নামের সাথে ইউনিভার্সিটি ও নেই। শুধু ইন্সটিটিউট বা কলেজ নাম দিয়েই তারা বিজ্ঞান শিক্ষায় বিশ্বখ্যাত। যাই হোক, প্রতিদিনই পড়াশোনার নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিষ্কার হচ্ছে, আমাদের কে এর সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। নাহলে হারিয়ে যেতে হবে কালের অতল গর্ভে।
প্রকৌশল শিক্ষার সাথে সাথে লাইফ সাইন্স আর ভৌত বিজ্ঞানের নতুন নতুন ডিসিপ্লিন ও খোলা দরকার। সেই সাথে ফলিত অর্থনীতি, নৃবিজ্ঞান, পুরাতত্ত্ব ইত্যাদি সামাজিক বিজ্ঞানের আরো নতুন নতুন শাখা খোলা উচিত। ইনফরমেশন টেকনোলজির উপর পোষ্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা চালু আছে। এইরকম আরো কিছু ডিপ্লোমা চালু করা যেতে পারে। যেমন, কষ্টিং, ফিন্যানশিয়াল ম্যানেজমেন্ট, লজিস্টিকস, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, ব্যাঙ্ক ম্যানেজমেন্ট, ট্যুরিজম, জিওলজিক্যাল সাইন্স ইত্যাদি বিষয়ের উপর ৬ মাস/১ বছরের ডিপ্লোমা কোর্স চালু করা যেতে পারে।
দেশী বিদেশী বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির সাথে কোলাবরেশন বাড়াতে হবে। এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম একটা ভালো উদ্যোগ হতে পারে। আমার জানামতে, খুবির পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিন এক্সপার্ট এশিয়া নামে একটা মাস্টার্স প্রোগ্রামের অংশীদার। অন্যান্য ডিসিপ্লিন গুলোকে এই ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। বৈদেশিক যোগাযোগ যত ভালো হবে, গবেষনা ফলাফলের মান উন্নত হবে। যেটা খুবি কে র্যাঙ্কিং এর এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। নগর ও গ্রামীন পরিকল্পনা ডিসিপ্লিনের সাথে নরওয়েজিয়ান ইউনিভার্সিটি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির একটা সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষরিত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগে। একইভাবে কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল ডিসিপ্লিনের সাথে কানাডার ইউনিভার্সিটি অফ সাসকাচেওয়ান এরও একটা শিক্ষা বিনিময় চুক্তি আছে (আমার জানামতে, ভুল হলে জানাবেন প্লিজ)। অন্যান্য ডিসিপ্লিন গুলোকেও উদ্যোগ নিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে হবে।
এখন অন্যান্য সুযোগ সুবিধার কথায় আসি। বর্তমান যুগে ইন্টারনেট আমাদের জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গিয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ইন্টারনেট সুবিধা খুব অপ্রতুল। ধীরগতির ইন্টারনেট অনেক সময় বিরক্তির কারন হয়ে দাঁড়ায়। আপডেটেড টেকনোলজি সম্পর্কে প্রতিনিয়তই অজ্ঞ থেকে যাচ্ছি, পিছিয়ে পড়ছি অন্যদের থেকে। প্রশাসনের উচিত এইদিকে নজর দেয়া। যেন পুরো ক্যাম্পাস টাকেই দ্রুতগতির ওয়াইফাই নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়।
এবার আবাসন, এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের জন্য ২টি এবং মেয়েদের জন্য ১টি হল আছে। তৃতীয় ছাত্র হল ও ২য় ছাত্রী হলের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। বর্তমান ধারন ক্ষমতা অনুসারে ২০% ছাত্রছাত্রী হলে থাকে। অপ্রতুল আবাসন ব্যবস্থার কারনে দেশের দূরতম এলাকা থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসতে অনীহা বোধ করে। এছাড়া বাস যোগাযোগের অবস্থা ও ভালো না। শহর থেকে কিছুটা দূরে হওয়ায় শহরে যাওয়ার মাধ্যম হিসেবে ইউনিভার্সিটির বাস ব্যবহার হয়। কিন্তু সংখ্যার অল্প হওয়ায় তা সবসময় ব্যবহার করা হয়ে ওঠেনা। আমি ২০০৪-২০০৯ পর্যন্ত খুবির ছাত্র ছিলাম, তখন ই প্রচন্ড ভীড় হতো বাসে। তখন ছিলো ১৬ টি ডিসিপ্লিন। এখন ছাত্র ছাত্রী বেড়েছে, ডিসিপ্লিন ও বেড়েছে। কিন্তু বাসের সংখ্যা বাড়েনি। আশা করবো প্রশাসন এই দিকে আলোকপাত করবে।
নিজের বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে খুবি সম্পর্কে অনেক কিছু বলা হয়ে গেল। তবুও প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে রইলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা। খুলনা বিশ্ববিদ্যলয় এর সুনাম যেন বিশ্বের প্রতিটি কোনায় ছড়িয়ে পড়ে, অনেক দূর যেতে পারে এই আকাঙ্খায় থাকলাম।
লেখাটি আমার নিজস্ব ব্লগেও প্রকাশিত হয়েছে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


