সাইফুল আমিন
পল্টনের ভেতরকার অলিগলি পেরিয়ে, গ্র্যান্ড আজাদ হোটেলের সামনে যেতে না যেতেই বৃষ্টি শুরু!
অবশ্য বেশখানিক আগে থেকেই দেখে আসছি, আকাশে মেঘের তর্জন-গর্জন চলছে। বাতাসের ছোটাছুটিও ছিলো বেশ। আকাশের কালো মেঘরে মাঝে স্থিরতা ছিলো না এক বিন্দুও। ঠিক তারপরও এভাবে হুট করে বৃষ্টি নামবে, ভাবিনি।
তবুও শেষ পর্যন্ত যে বৃষ্টি এসেই গেলো, তাতে আমার কোনো রাগ হয়নি।
আরে বাবা! এ যে দেখছি, দেখতে না দেখতেই বৃষ্টি কি জটিল রূপ নিচ্ছে... তালে তালে বাড়ছে বর্ষণের মাত্রা। ভাবখানা যেনো, এক মুহূর্তেই সব ভাসিয়ে নিয়ে যাবে! কি আর করবো, অনেকের দেখাদেখি আমিও, বৃষ্টির আচমকা ছোবল থেকে নিজেকে বাঁচাতে সরে যাই।
একটা খোলা দোকানের দিকে দৌড়ে ঢুকে পড়লাম। দোকানে কার্ড, ক্যালেন্ডার আর পোস্টারের ছড়াছড়ি। বাংলা চলচ্চিত্রের কয়েকজন নায়িকার ছবিও দেখা যাচ্ছে।
আমি খুব আগ্রহ ভরে ছবিগুলো দেখতে থাকলাম- পোস্টারে নায়িকাদের যে খুব রূপের বাহার ছড়িয়ে আছে, ব্যাপার এ-রকম কিছু নয়। পত্র-পত্রিকায় প্রায় দেখতাম, বাংলা চলচ্চিত্রে অশ্লীল দৃশ্যের সংযোজন। যেহেতু বাংলা চলচ্চিত্র নিয়মিত দেখা হয়না; অতএব এতো-শতো নায়িকাদের চিনবারও কথা নয়। তাই ঠিক বলতেও পারছি না, কে নন্দিত আর কে নিন্দিত। হয়তো সে জন্যই সজাগ দৃষ্টি খুঁজে বেড়াচ্ছে, এদের মাঝেও কি আছে সেইসব নন্দিত বা নিন্দিত অভিনেত্রীরা? থাকলে কে সে?
...প্রতি বছরই এমন হরহামেশা বৃষ্টি হয়।
তারপরও, প্রতিবার যখন বৃষ্টি হয়, মন চলে যায় শৈশবে- এমন বাদলা দিনে, ছেলেবেলায় কি যে ধেই ধেই করে নাচতাম! পাড়ার সবগুলো ছেলেমেয়ের উৎসব মিলতো সেই জল-কাদায়। সে কি অপার আনন্দ! মা-বাবার হাজারও ডাক-দোহাই কাউকে বাধা দিয়ে রাখতে পারতো না।
এখন বড় হয়ে গেছি। বিয়ে করেছি। সংসার হয়েছে। হলাম সেই সংসারের এক সন্তানের জনক। নিজের মা-বাবারাও কেউ বেঁচে নেই আজ আর। বয়েসের তালে তালে যদিও, বৃষ্টিতে ভেজার তীব্রতা মন থেকে মুছে গেছে। কিন্তু স্মৃতিচিহ্ন হারিয়ে যায়নি।
অথচ, এখনই হয়েছে যতো জ্বালা।
সামান্য দু-চারটে ফোঁটা বা ছাঁট গায়ে লাগতে পারে না। গোটা শরীরজুড়ে বর্ষা নামতে একবিন্দু দেরি হয় না তখন। শরীরের বর্ষা মানেই তো সর্দি আর কাশিতে একাকার কারবার।
বউটাও আমার একটা বউই! কি মহিলারে, বাবা!
পতি-দেবতার সর্দি-কাশি হলে একটা সেবা-কর্ম করবে, তা নয়; বরং উল্টো খেঁকিয়ে উঠবে। সারা বাড়ি একাই মাথায় তুলে চিল-চিৎকার জুড়বে- ‘তুমি মশাই জানো না, বৃষ্টি এলেই তোমাকে কোনো ধরনের শর্তহীন যুক্তি নিয়ে পালাতে হয়? যার সামান্য দু-এক ফোঁটা বৃষ্টি গায়ে পড়তে পারে না; আর তিনি কিনা বৃষ্টিতে কাকা-ভেজা হয়ে বাসায় ফিরেছেন! এখন ভালোই হলো; হাঁচি আর কাশিতে সারা বাড়ি মাথায় তোলো। তারপর বানরের মতোন মুখ লাল করে ঘরের কোণে বসে থেকো! আমার কি? আমার কি?!’
০২.
বৃষ্টি কমে এসেছে।
হুট করে যেমন শুরু হলো, ঠিক সে রকমই হুট করে থেমে যেতে দেখলাম। আড়ালে-আবডালে আশ্রয় নেয়া মানুষগুলো ফের রাস্তায় নামা শুরু করেছে। দু-একজনের দেখাদেখি, অন্যরাও সাহস পাচ্ছে। ক্রমেই সকলের ধারণা স্থির হতে থাকে- এই থেমেছে বুঝি বৃষ্টি, হয়তো আজ আর হবে না।
অল্পক্ষণেই রাস্তুগুলোয় চিরচেনা পরিবেশ ফিরে এলো- পায়ে হাঁটা মানুষ, রিকশা, ভ্যান, প্রাইভেট কার; এই কি শেষ? আছে ভিক্ষুক, ভবঘুরে, জ্যাম... ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে নগরীর মুখরিত জীবন। ছুটছে মানুষ দিগ-বিদিক। যেনো কতো কাজ, কতো ব্যস্ততা সবার!
বৃষ্টি কমার পরপরই দোকানে ক্রেতারাও ভিড়তে লাগে। আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় না ভেবে, বেরিয়ে এসেছি। তবে এখনো রাস্তায় নামিনি।
এমন কোনো তাড়াহুড়োও নেই। অন্যদের সাথে আজ আমার পার্থক্য শুধু- আমার হাতে এখন আর কোনো কাজ নেই, কোনো ব্যস্ততাও নেই। ধীরে সুস্থে কেবল ঘরে ফিরতে পারলেই হয়।
ময়লা জমে থাকা থিকথিকে কাদাময় রাস্তায় নামছি না শুধু এই একটা কারণেই। এতো ব্যস্ততা কি? বাসাতেই তো যাবো। পাপড়ি ছাড়া অপেক্ষা করার মতোন আর কেউ নেই আমার। মানুষ তো ওই একজনই। অপেক্ষা না হয় আজ তার একটু বাড়লোই... তাতে কি? অপেক্ষার পর, ফিরে পাবার ক্ষণ মানেই অনাবিল আনন্দ!
দাঁড়িয়ে আছি।
আমার সামান্য কিছুটা পাশে, বাঁয়ে, দেড় কি দু-হাত তফাতে মেয়েটা দাঁড়ানো। এতোক্ষণ খেয়াল করিনি। খুব সম্ভবত, বৃষ্টির কবল থেকে বাঁচার জন্যই অন্য দশটা মানুষের মতোন সে ওখানে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজেছিলো।
তবে দেখা যাচ্ছে, তার নিরাপদ আশ্রয় তাকে খুব একটা নিরাপত্তা দিতে পারেনি। গায়ের খয়েরি রঙের জামা অনেকটাই ভিজে আছে। একই রঙের ওড়না কাঁধের উপর দিয়ে পেঁচিয়ে পরেছে সে। ডান পাশটা ফুলে থাকার অর্থ হলো, বগলজুড়ে চেপে ধরা ওর হাতব্যাগ।
বয়েস কতো হবে? হয়তো বিশ। হয়তো একুশ। হয়তো এ-সবের ধারে কাছেও সে নেই। হয় না এ রকম? অনেকের বয়স যা অনুমান করি, দেখা গেলো বয়স তার দ্বিগুণ! আবার কমও হয়।
পাশ থেকে মেয়েটাকে ভালো করেই খেয়াল করলাম। চেহারার মলিন ভাবটুকুন লুকোবার কোনো প্রচেষ্টা নেই। খুব হতাশ আর নিরাপত্তাহীন মানুষের মতোনই লাগছে কোনো কারণে। ...বৃষ্টিতে আটকা পড়েছে না হয়। এখন তো সে বৃষ্টিও আর নেই। চাইলেই এবার ঘরে ফিরে যেতে পারে। তবু মেয়েটাকে এমন অসহায় দেখাচ্ছে কেনো?
আমি কিছুটা চমকে যাই।
আসলেই কি মেয়েটার কোনো বিপদ? কিংবা উপায়হীন ধরনের কোনো সমস্যার মুখোমুখি সে? নাকি, বৃষ্টিতে নিজের পোশাক ভিজে গেছে বলে মন খারাপ? ...দূর! এটা কোনো বিষয় হলো?
আমি কি একটু বেশিই ভাবছি না মেয়েটাকে নিয়ে? এটা কি আমার অতিরিক্ত কল্পনাপ্রসূত আবেগ নয়?
এখানে, আশেপাশের কম মানুষ তো মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে না। তারা কেউ কি আমার মতোন ভাবছে?
ভাবুক, না-ভাবুক; আমি আর কিছু না ভেবে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। ‘আপনি কি কাউকে খুঁজছেন?’
সম্ভবত, পাশে দ্বিতীয় কারো উপস্থিতি টের পেয়েই মেয়েটা চমকে গিয়েছিলো। আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলো না। উল্টো দেখলাম, কেমন যেনো কুঁকড়ে গেছে।
কেনো? ভয়ে?
আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘একা আপনি?’
এবারও সে আগের মতোন। নিরুত্তর। কেবল শূন্য দৃষ্টি মেলে কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। কি বলবে, কিছু কি বলার আছে- যেনো সেটাই সে বুঝতে পারছে না।
বললাম, ‘আমি রমিজ রহমান। আপনার সমস্যা হয়ে থাকলে আমাকে বলতে পারেন। আমি হয়তোবা আপনার জন্য বেশি কিছু করতে পারবো না। তবে যেটুকুন সম্ভব, তা অবশ্যই করবো। আপনি আমাকে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পারেন।’ এইটুকুন বলেই ঠোঁটে একটা সৌজন্যমূলক হাসি ঝুলিয়ে রাখি।
একবার চোখের পলক ফেলেছে সে। গায়ের ওড়নাটা আরো শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরলো- নড়াচড়া বলতে এতোটুকুনই দেখলাম মেয়েটার। তবু মুখে কিছুই উচ্চারণ করলো না।
বলি, ‘আপনি হয়তো ভাবছেন, আমিই বা গায়ে পড়ে উপকার করতে চাইছি কেনো? স্বার্থ কি? ...আসলে, এখানেই বাঙালির সমস্যা। এই যে আপনার বিপদ দেখেও যদি আমি বা কেউই এগিয়ে না আসতো; আপনি ভাবতেন- শালার দেশটায় অমানুষে ভরে গেছে! মানুষের বিপদেও মানুষ এগিয়ে আসছে না। আবার বিপদে পড়েছেন মনে করে এই যে এগিয়ে এসেছি; এখন সাহায্যকারী হিসেবে আমারই বিপদ! ভাবছেন, গায়ে পড়ে উপকার করতে চাইছি কেনো? কু-মতলব নেই তো?’
একটু থামলাম। পল্টনে আছি বলে, নিজেকে বিশাল জনসমাবেশের মঞ্চে আছি মনে করাও ঠিক নয়। রাজনৈতিক নেতাদের মতোন বড় বড় বুলি মারাটা তাই তাৎক্ষণিক থামিয়ে দিই। কি লাভ ওসব বড় বড় বুলি মেরে? যা শুধু কাজের বেলায় ঠন ঠন হয়েই বাজে! জনসমাবেশে যে সাধারণ মানুষগুলো হাজির হয়, তাঁদের জন্য আমার করুণাই হয়। কেনোনা, এ দেশের রাজনীতি কখনোই দেশ ও জনগণের জন্য ছিলো না। রাজনীতিবিদরা তাঁদের ক্ষমতায় যাবার জন্যই রাজনীতিকে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করছেন। আর আমরা আমজনতারা, সে সব বুঝে না-বুঝে, ওই লোলুপ ক্ষমতাবানদের জন্য নিরন্তর সিঁড়ি বানিয়ে চলেছি। সে সিঁড়ি বেয়ে তাঁরা ক্ষমতায় বসেন; তারপর নিজেদের আখের গোছাতে গোছাতে আমাদের কথা আমূল ভুলে যান।
হঠাৎ করেই মাথায় এমন রাজনীতির কুলশ ভাবনাগুলো কেনো কাজ করলো, বুঝে উঠতে পারলাম না। মুহূর্তে সব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে, মেয়েটার উদ্দেশে নরম স্বরে বললাম, ‘হ্যাঁ, তবু স্বার্থ খুঁজতে চাইলে বলবো- আপনার সত্যিই যদি কোনো উপকারে আসি, আপনি নিশ্চয়ই শেষ মুহূর্তে একটা আন্তরিক ধন্যবাদ হলেও দিবেন। আমার স্বার্থ ওটুকুনই। সত্যি বলছি, বিশ্বাস করুন, নিতান্তই একজন ভদ্রলোক ছাড়া আর কিছু নই আমি!’
কথাগুলো শেষ করেই হাসলাম। ভাবছি, শালার দুনিয়ায় কতো রকমের পাগল আছে! একটা ধন্যবাদ পাবার জন্য অচেনা মানুষের গায়ে পড়ে উপকার! ...মেয়েটা কি বিষয়টাকে খুব একটা হালকা চোখে ভাববে? ভাববার কি কথা? আমি হলে কি করতাম? দাঁড়িয়ে আছি; হুট করে একটা লোক পাশে এসে বললো- ভাই, আপনার কোনো বিপদ? চলেন, দেখি আপনার কোনো উপকার করতে পারি কিনা!
নাহ! ওইতো, মেয়েটা বোধহয় একটু একটু স্বাভাবিক হয়ে এসছে। হাসতে চাইছে ঠিকই, কিন্তু হাসিটা বরাবরই ম্লান হয়ে যাচ্ছে। আমার চোখের দিকে ক-মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে, চাপা শব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বলে, ‘হ্যাঁ ভাই, সত্যি আমি বিপদে পড়েছি।’
‘কি রকম?’
‘আমাদের বাসা ফার্মগেট। মণিপুরী পাড়া। ঢাকা শহরে আমি একেবারেই নতুন। কিচ্ছু চিনি না। এদিকে এসেছি আমার এক খালাকে সঙ্গে নিয়ে। বৃষ্টি শুরু হবার ঠিক আগে আগেই তাঁকে হারিয়ে ফেলেছি। এখন আমি কি করবো, কোন দিকে যাবো...’
ওর অসহায়ত্বটা টের পেলাম। তবু শব্দ করে হেসে উঠি আমি; চাইছি, অন্তত ওর ভেতরের ভয়টা কেটে যাক। বললাম, ‘ও! এই তাহলে ঘটনা? খালাকে হারালেন কিভাবে?’
‘আমরা দু-জনে রিকশায় ছিলাম। বৃষ্টির...’
‘দাঁড়ান দাঁড়ান।’ হাত তুলে ওর কথায় বাধ সাধলাম, বলি, ‘আপনাকে খুব কান্ত মনে হচ্ছে। কিছু খাবেন? অবশ্য, তার আগে একটা কথা, এখন অন্তত আমাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন তো?’
মেয়েটা বোবা দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে আছে।
বললাম, ‘যদি বিশ্বাস করে থাকেন, তাহলে আমার সাথে আসতে পারেন। প্রথমে আমরা কোনো একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকবো। তারপর কিছু একটা খেতে খেতে আপনার হারিয়ে যাবার গল্প শুনবো। ...আবারো বলছি, আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। কথা দিচ্ছি, এরপর আমি নিজেই আপনাকে বাসায় পৌঁছে দেবার একটা ব্যবস্থা করে দেবো।’
এই বলে, আমি আর দাঁড়ালাম না। মেয়েটার কাছ থেকে কোনো উত্তরের আশা না করে, সামনের দিকে এগিয়ে গেলাম। ছয় সাত পা এগিয়ে পিছু ফিরে তাকাই; দেখি, সে আমাকে অনুসরণ করবার জন্য পা বাড়িয়েছে...
০৩.
আমাদের খাওয়া চলছে। এরই মাঝে মেয়েটা দারুণভাবে সহজ হয়ে এলো। একটু আগের বিষন্ন ভাবটা চেহারা থেকে পুরোপুরি গায়েব। নড়াচড়াতেও কোনো জড়তা নেই; খুব স্বাভাবিক চিত্তে দু-হাতে ধরা কাটা চামুচ দিয়ে শিক-কাবাব ছিঁড়ছে।
ওর ব্যক্তিগত ব্যাপারে এখনো কোনো প্রশ্ন করিনি। চামুচ দিয়ে কেটে মাংসের একটা দলা মুখের ভেতর পুরে বলে, ‘আমি আয়না।’
আমি মেয়েটার চোখের দিকে তাকাই। তাহলে এতোক্ষণে জানা হলো, তার নাম আয়না। ...হাসলাম, ‘সুন্দর তো!’
‘কি?’
‘আপনার নাম।’
সেও হাসে। ‘জন্মের পর কে রেখেছে এই নাম, জানি না। নানি আমাকে খুব ভালোবাসতেন, তিনিই রেখেছেন কিনা- কে জানে! নাম নিয়ে আলাদা করে কখনো ভাবিনি।’
‘এমন হয়। অন্যে ধরিয়ে না দিলে, নিজের সৌন্দর্য অনেক সময়ই ধরতে পারি না আমরা। যাই হোক, আয়না, এবার আপনার কথা শোনা যাক।’
কাবারের সাথে রুটি নিয়েছিলাম। মাংসের সাথে এক টুকরো রুটি ছিঁড়ে ফের মুখে দেয় ও। বলে, ‘হ্যাঁ, এটাই প্রথম আমার ঢাকায় আসা। উঠেছি ছোটখালার বাসায়। আজ সকালে, দু-জনে এক সঙ্গেই বাসা থেকে বের হয়েছি। নাম জানি না, ঠিক মতোন চিনিও না এই শহরের কিছু। ছয় কি সাততলা বিল্ডিংটা, ওখানে নিয়ে গেলেন ছোটখালা। সেখানে আমাকে বসিয়ে রেখে নিজেই অনেকগুলো কাজ করেছেন দেখেছি। প্রায় আড়াই ঘন্টা পর, সেখান থেকে আমরা বের হই। তারপর রিকশা করে এদিকে এলাম। এখানকারই কোনো একটা জায়গায় দু-জনে নেমেছি। তারপর কিছু বুঝলাম না; আমাকে পাঁট মিনিটের জন্য দাঁড়াতে বলে তিনি চলে গেলেন। কোথায় গেছেন, কি করতে গেছেন, কিছুই বলে তো গেলেন না।’
এ পর্যন্ত বলে আয়না থামে।
আমি বলি, ‘তাঁকে বলেননি- একা একা দাঁড়িয়ে থাকা আপনার জন্য ঠিক হবে না। কতোক্ষণই একা একা ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকা যায়?’
‘বলেছিলাম।’ আয়নার মুখটা আবার মলিন হয়ে যায়। ‘আরো বলেছি- আমিও সাথে গেলে কি এমন ক্ষতি হবে? তিনি আমার কথা একটুও আমলে নিলেন না। একগাল হেসে উল্টো অভয় দেন, বলেন- ভয় কিসের? এই যাবো আর আসবো। পাঁচ মিনিটও লাগবে না।’
‘তারপর?’
‘তারপর কি! আমাকে দাঁড় করিয়ে সেই যে গেলেন, আর ফেরার নাম গন্ধ নেই। প্রায় বিশ মিনিট গত হয়, কোনো খবর নেই। এদিকে আমি ভয়ে অস্থির। গলা শুকিয়ে কাঠ। ভেবে-চিন্তে আরো মিনিট চারেক দেখলাম; যদি ফিরে আসেন? এরপরও যখন ফিরে এলেন না, আমার তো কেঁদে ফেলবার মতোন অবস্থা। আচ্ছা, বলেন, আমি মেয়ে মানুষ। পথঘাট চিনি না। অচেনা একটা জায়গায় এভাবে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে, মিনিটের পর মিনিট পার করি কি করে? শেষমেশ, ছোটখালা যে পথে সামনে গেছেন, আমিও কি মনে করে সে পথে হাঁটা ধরেছি। ভাবলাম, একটু সামনে এগিয়ে দেখে আসি। বেশি দূর না-হয় যাবো না। আবার ফিরে এসে আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকবো।’
আয়না ওর হারিয়ে যাবার গল্পটা বলে যাচ্ছে...
আমি ঠিক যতোটা না খাচ্ছি, তারচেয়ে বেশি মনোযোগ দিয়েই ওর কথাগুলো শুনছি। কারণও আছে, ব্যাপারটা আমার কছে অবশ্যই জরুরি। বিশেষ করে, যেখানে মেয়েটাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব এখন আমার কাঁধেই। আর নিজেই যখন কাজের ভার মাথায় তুলে নিয়েছি, অতএব এবার ওজন মনে করে তা ধপাস করে ফেলে দেবো; আমি তেমন মানুষ নই।
আয়না বলে যাচ্ছে, ‘...জানেন, বিপদটা এরপরই টের পেলাম। হাঁটতে হাঁটতে কিছুদূর যাবার পর, আবার যখন পিছনে ফিরলাম ফিরে যাবো বলে; তখনই বুকটা লাফিয়ে উঠছে ভয়ে! বুঝতে পারলাম, পথ হারিয়েছি। কারণ, যে পথে দিয়ে এই মাত্র এতোটা এগিয়ে এসেছি, এখন আর সেই পথটাই চিনতে পারছি না!’
আয়নার কথায় হেসে ফেলি, ‘কেনো? যাবার সময় কিছু লক্ষ্য করে হাঁটেননি?’
‘সেভাবে কিছুই দেখা হয়নি। আমি শুধু মানুষ দেখেছি; মহিলা কাউকে দেখলেই থমকে দাঁড়াতাম- এই বুঝি ছোটখালা! কে জানতো, ওইটুকুন পথ গেলেই আর ফিরে যেতে পারবো না?’
ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য হলেও, হয়তো সত্যি। পল্টনের এই ঘূর্ণিটায়, নতুন যে কারো পক্ষেই পথ হারিয়ে ফেলা অসম্ভব নয়। বললাম, ‘তারপর?’
‘পথ হারিয়ে আমি তো একেবারেই অসহায়। পুরোপুরি উপায়হীন। হায়, কি করি! নিজের জায়গা থেকে না নড়াই কি ভালো ছিলো না? ছোটখালা যদি এতোক্ষণে আগের জায়গায় ফিরে যান? আমাকে না পেয়ে তিনি কি করবেন?’
অপেক্ষা করছি আমি। শুনছি আয়নার কথা।
‘আসলে,’ ও আবার বলে ওঠে, ‘কিভাবে কিভাবে যে এ-গলি ও-গলি করে, এখান পর্যন্ত চলে এসেছি- বুঝতেই পারিনি। পরে, বিপদটা টের পেতেই একটা ফোনের দোকানে যাই। ছোটখালার মোবাইল নাম্বারটা জানা ছিলো। কিন্তু অবাক ব্যাপার, কল করতেই দেখি ওটা বন্ধ। বারবার চেষ্টা করেও আর পাচ্ছিলাম না।’
‘মোবাইল বন্ধ থাকবে কেনো?’
‘জানি না। কখনোই কিন্তু ছোটখালার ফোন বন্ধ থাকতে দেখিনি। অথচ আজ আমার এই চরম বিপদের দিনেই কিনা, সেটা বন্ধ! খুব রাগ হয়েছে। কান্নাও পেয়ে যায়। দোকান থেকে বেরিয়ে কি করবো, কোথায় যাবো- কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। ...ভাবতে ভাবতেই ফট করে নেমেছে বৃষ্টি। উপায়ান্তর না পেয়ে ছুটে যাই ওখানে, যেখানে আপনি আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছেন।’
আয়না থামে।
বুঝলাম, ওর হারিয়ে যাবার গল্প এ পর্যন্তই। এবার তাহলে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার গল্পটা শুরু করতে হবে। এবং এটা করতে হবে আমাকেই।
খাওয়া শেষ করে ওকে বললাম, ‘যা হবার হয়ে গেছে। ভয় পাবার কিছু নেই। আপনার খালার বাসার নম্বরটা বলতে পারবেন তো?’
প্রশ্নটা করতেই, ওর চেহারায় উজ্জ্বলতার দ্যুতি ছড়ায়। যেনো সে এক লাফে অন্ধকার ছেড়ে আলোতে যাবার পথ পেয়ে গেছে! বলে, ‘পারবো। সাতানব্বুই বাই চার। চারতলা বাড়ি। দোতলার ডান দিকে ছোটখালারা থাকেন।’
বললাম, ‘যথেষ্ট। মণিপুরী পাড়া খুব ভালো না চিনলেও, কাজ সারবার মতোন উপায় জানা আছে ভালোই। আপনি আসুন...’
০৪.
সিএনজি থেকে ঠিক ওদের বাসার সামনেই নামলাম দু-জনে।
তবে যতো সহজে বলে ফেললাম- এসে গেছি; আসলে এতোটা সহজ ছিলো না। একটা নাটকই হলো বলা চলে। প্রায় আট কি নয়জন লোককে জিজ্ঞেস করে, তবে ঠিকানা খুঁজে পাওয়া গেছে!
ঘটনা হলো- প্রথমেই একটা লোককে প্রশ্ন করেছিলাম, ‘ভাই, সাতানব্বুই বাই চার, বাড়িটা কোনদিকে?’
লোকটা সামনের দিকে ইশারা দিয়ে বললেন, ‘ওইদিকে।’
কথা মতোন তাঁর ওইদিকে যাবার পর দেখি, ওদিকে এই নম্বরের কাছে-ধারের কোনো বাড়িই নেই। আবার আরেকজনকে ধরলাম। তিনি খুব নিশ্চিত ভঙ্গিমায় বললেন, ‘বামে যান। সোজা ডানদিকের বাড়িটা।’
কথা মতোন বামে যেতে থাকি। কিন্তু ডানে কোনো চারতলা বাড়ি দেখতে পাচ্ছি না। কি আর করা! সিএনজি-ওয়ালাকে বললাম, ‘ভাই ঘুরান, আবার পিছনে দেখতে দেখতে যাই।’
কিছুদূর এলে মাঝবয়েসি একজন লোককে পেলাম। এ লোকটাও আগের দু-জনের মতোন ফাও কিছু বলে কিনা ভাবতে ভাবতেই, জিজ্ঞেস করি, ‘চাচা, সাতানব্বুই বাই চার, বাড়িটা কোনদিকে একটু বলতে পারেন?’
তিনি এক নজর আমাদের দেখলেন; সঙ্গে আয়নাকে দেখে কি ভাবলেন, কে জানে! তারপর হঠাৎ করেই বললেন, ‘আরে ভাই, কই গেলেন, আরো সামনে যেতে হবে।’
মেজাজ যখন একটু একটু করে বিরক্তির চরমে পৌঁছাচ্ছে, ঠিক তক্ষুণি বাড়িটা নজরে এলো। ড্রাইভারকে থামতে বলে, আয়নাকে দেখাই। ‘এটাই কি?’
ও মাথা বের করে দেখার চেষ্টা করে। তারপরই প্রায় চিৎকার জুড়ে দেয়। ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, ওমা! এটাই তো!’
ভাড়া মিটিয়ে সিএনজি বিদায় করে দিয়েছি। প্রথম অবস্থায় অবশ্য ব্যাটাকে ছেড়ে দিতে চাইনি। আয়নাকে নামিয়ে দিয়ে বলেছিলাম, ‘তাহলে এবার আমি আসি?’
ও আমার হাতটা একেবারে ছেলেমানুষের মতোন চেপে ধরে। ‘কি বলছেন! এতোটা করলেন আমার জন্য, আর বাসায় এসে একটু বসবেন না?’
‘দেখেই তো গেলাম। এরপর না হয় আরেকদিন...’
‘আর আরেকদিন! আজই আসতে হবে আপনাকে। অন্তত এক কাপ চা খেয়ে তো যেতেই হবে। আসেন, আসেন...’
এরপর আর কি করার থাকে? হাত ধরেই যখন এতো টানাটানি!
সাদা রঙের বাড়িটার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে এলাম দু-জনে। পাশেই দরজার কলবেল। আয়না নিজেই বাজায়। আবার দরজায়ও দু-চারটে টোকা দেয়। এরমানে একটাই; ভেতরে যাঁরা আছেন, তাঁদের বোঝাচ্ছে দ্রুত করতে।
দেখলাম, ত্রিশোর্ধ্ব একজন মহিলা দরজা খুলে দিলেন। আমরা ভেতরে প্রবেশ করতে না-করতেই, তিনি অন্যঘরে চলে গেলেন।
আশেপাশে তাকিয়ে বুঝলাম, এটাই বসার ঘর। আসবাবপত্র কিংবা সাজসজ্জায় কিছু নেই বললেই চলে। তিনটে বেতের তৈরি চেয়ার। সবগুলোই সোফার আদলে বানানো। একটা টেবিল আছে, ওটা অবশ্য কাঠের। কি কাঠ হতে পারে, তা দেখে বুঝতে পারছি না। এই জিনিসটা আমার ধারণার বাহিরে। দেয়ালে সূর্য ডোবার একটা দৃশ্য, রক্তিম আভায় লাল হয়ে আছে পুরো পুথিবী। এমন পোস্টার পনেরো-বিশ টাকায় হরদম বিক্রি হচ্ছে। অনেকে ফেরি করেন হাতে নিয়ে।
অর্থাৎ, পুরো ঘরের সবকিছুতেই একটা অতিমাত্রার সাধারণ ছাপ। আমার কাছে কেমন যেনো সামঞ্জস্যহীন বলেই মনে হচ্ছে। এতোটা সরল হয় ফ্যাটবাড়ির কোনো বসার ঘর?
আয়না আমাকে বসতে বলে। লজ্জিত ভঙ্গিতে হাসে প্রথমবার। বলে, ‘আমার ছোটখালার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। সামান্য যেটুকুন আয়, তাতে এই শহুরে জীবনে তাঁর নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যায়।’
আমি বসলাম।
মেয়েটা ভেতরের দিকে চলে গেলো। দশ-বারো মিনিটের মাথায় ফিরে আসে। হয়তো এতোটা সময়ও লাগেনি। অপেক্ষার সময়টা দীর্ঘই হয়; তাই নিজের কাছে এমন মনে হয়েছে। আয়নার হাতে ছোট্ট একটা ট্রে। ওতে কিছু বিস্কিট দেখতে পাচ্ছি। এছাড়াও চানাচুর আর এক গ্লাস কমলার রস... অবশ্য, ওটা কমলার রসই কি? রঙটা কেমন একটু ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে না? ভুলও হতে পারে! তবে, কুমড়ো চিপে রস বের করলে, সেটা কমলার রসের মতোনই দেখাবে- আমার এমনটাই ধারণা!
আয়না ওসব আমার সামনে রেখে আবারো ভেতরে চলে যাচ্ছিলো। আমি ডাকলাম, বলি বসতে। বলি, ‘আপনি আমার জন্য অস্থির হবেন না, আয়না। ও আচ্ছা, আপনার খালা কি ফিরেছেন?’
‘না।’
আমি চমকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘বলেন কি!’
আয়না হাসে। উল্টো আমাকে অভয় দেয়, ‘সমস্যা নেই। বিপদ ছিলো আমাকে নিয়েই, কারণ আমি তো কিছু চিনি না। ছোটখালা একসময় ফিরে আসবেনই। তাঁর সবই চেনা।’
বসলো না তবু মেয়েটা। কথাগুলো শেষ করেই ভেতরের দিকে চলে গেলো।
দু-টো বিস্কিট খাই। কিছু চানাচুরও খেলাম কুটকুট করে। যদিও, কমলার রসটুকুন সবার আগেই সাবাড় করে ফেলেছি। নাহ! সন্দেহ করার কিছু ছিলো না। কোনো দুই নাম্বরি করা হয়নি রসটুকুনের মধ্যে। কুমড়ো-আনারস কিচ্ছু না; খাঁটি কমলার রসই ছিলো ওটা।
আমার খাওয়া শেষ হবার আগেই আয়না আবার ফিরে আসে। এবার ওর হাতে চা। সামনে যখন কাপটা নামিয়ে রাখছিলো; দেখলাম, আরো দু-জন পুরুষ মানুষ ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে। ভয় নয়; এদের দেখে কিছুটা চমকেই উঠেছি। এ বাড়িতে যে কোনো পুরুষ মানুষও থাকতে পারে- এটা এতোক্ষণ মনেই হয়নি আমার।
আয়না একটা চেয়ারে বসেছে, মুখোমুখি। আর পুরুষ দু-জন আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। ব্যাপারটা ঠিক মাথায় ধরলো না, এরা পেছনে কেনো? ঘাড় বাঁকিয়ে দু-জনকেই দেখলাম। চেহারায় ভদ্র, বয়েসে যুবক। চব্বিশ বা ছাব্বিশের বেশি হবে না করো বয়সই।
আয়না সামনে থেকে বলে, ‘কই, চা খান? ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।’
বলি, ‘নাহ! চা আর খাবো না। এমনিতেই গরম পড়ছে। ...এবার তাহলে আমি উঠতে চাচ্ছি।’
উঠি কথাটা মুখে বললেও, ওঠা হয়নি তখনো। আমার কথার পরপরই পেছনের একজন বলেন, ‘আরে বসেন বসেন। আপনার সাথে অনেক কথা আছে।’
ঘাড় ফিরিয়ে দেখলাম আবার ওদের। দু-জনেই দাঁত বের করে হাসছে।
মেয়েটা বলে ওঠে, ‘আমরা দুঃখিত। আপনি ভদ্র মানুষ। নিজেই ইচ্ছে করে অন্যকে সাহায্য করতে এসে, বিপদে পা দিলেন। আপনার কাছে সত্যি কথাই বলি এবার- আমার নাম আয়না ঠিকই। কিন্তু এটা আমার ছোটখালার বাসা নয়। আর আমি হারিয়েও যাইনি এ ঢাকা শহরে!’
‘তার মানে?’
কিছুই বুঝতে পারলাম না। এসব কথাবর্তার মানে কি? কি বলছে ও এসব?
‘হ্যাঁ, এখন আর আপনার কাছে বলতে কোনো বাধা নেই। একটা অতি সাধারণ মেয়ে আমি। আমার কর্ম সম্পর্কে জানলে সভ্য সমাজের লোক হয়ে, আপনি হয়তো বলবেন- নষ্টা মেয়ে। যার আভিধানিক বাংলা হলো, যৌনকর্মী। এ শহরের নামি-দামি যতো হোটেল, অ্যাপার্টমেন্ট; সবখানেই নিয়মিত যাওয়া-আসা আমাদের। বহু কোটিপতি, রাজনৈতিক হোমরা-চোমরা, যারা সভ্য সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে বলতে সমাজ উল্টে ফেলেন; তারাও আসেন আমাদের গতরে সুখের রস ফেলতে। শুধু আমি নই, আমাদের এ দলটা অনেক বড়। গোটা দলকে ছোট ছোট করে এলাকাভিত্তিক ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আর ওই যে, আপনার পেছনের ওদের দেখছেন; এরাই এখানকার দায়িত্বে আছে।’
আমার চোয়াল ঝুলে পড়েছে!
কি সব আবোল-তাবোল বলছে মেয়েটা? একটা কথাও মাথায় ঢুকছে না। মাথাটা বোধকরি এলোমেলো হয়ে গেছে। অন্ধকার-অন্ধকার লাগছে সবকিছু। স্পষ্ট বুঝতে পারছি, কমলার রসকে আমার এমনি এমনি কুমড়োর রস বলে মনে হয়নি। অবচেতন মন ঠিকই সতর্ক করে দিয়েছিলো। নিশ্চয়ই কিছু একটা ছিলো ওতে। এমন কিছু, যা খেলে মানুষ ধীরে ধীরে ঘোরের ভেতর চলে যায়। আমারও তাই হচ্ছে হয়তো... চারপাশটা উল্টোপাল্টা মনে হচ্ছে। ঘুরছে সব। কাঁপছে সব। আর...
মেয়েটা বলে, ‘আপনি সরল মানুষ। আপনাকে আমরা ঠকাতে চাইনি। কিন্তু কিছুই করার নেই। আপনার কাছে যা আছে, সব বের করে একে একে সামনে রাখুন।’
বিপদে যে পড়েছি; এটা এখন দিনের আলোর মতোন পরিষ্কার। তাও কি বিপদ শুধু? ঘোরতরো বিপদ! একেবারে সিংহের খাঁচাতেই তো বসে আছি! এখানে আমি সম্পূর্ণ ওদের আয়ত্তে। কোনো দিক থেকেই সাহায্য পাবার এক বিন্দু উপায় নেই। যা করতে বলে, তা করাই হবে একমাত্র সম্ভাব্য বাঁচার উপায়।
বোহেমিয়ান স্বভাবের মানুষ আমি।
তবু কম কিছু সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াই না। হাতের ঘড়ি, গলায় লকেট সমেত সোনার হার, পকেটে হাজার নয়েক টাকা মূল্যমানের মুঠোফোন, মানিব্যাগ- সব একে একে বের করে সামনে রাখলাম। এছাড়াও আমার সাথে যে একটা অ্যাগজেকিউটিভ ব্যাগ আছে; ওটার কথা আপাতত ভুলেই থাকতে চাইছি। ব্যাগটার ভেতর জরুরি সমস্ত কাগজপত্র ছাড়াই, চল্লিশ হাজার টাকা দামের একটা নোটবুক-ল্যাপটপ আছে।
আয়নার দিকে তাকিয়ে অসহায় হাসলাম। ভাবি, যাকে অসহায় ভেবে সাহায্য করতে এসেছি; সে নিজেই এখন আমাকে সহায়হীন করে দিলো। মেয়েটার চোখের দিকে চেয়ে কেমন যেনো আঁতকে উঠলাম! কি ভয়ংকর দেখাচ্ছে না ওকে?
হায় খোদা! আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠলাম?
পাপড়ির? আমার পাশের বালিশে তো ওরই ঘুমানো হয় প্রতিদিন। কিন্তু অবধারিতভাবে, রোজই বেচারিকে আমার আগে বিছানা ছাড়তে হয়। অবন্তিকে নিয়ে ও যখন ইশকুলের মাঝপথে থাকে, তখন আমি মাত্র বিছানায় উঠে বসি। তারপর প্রাকৃতিক ডাকে হাজিরা দেওয়া, তারপর পরিষ্কার হওয়া, তারপর গোসল... তারও পর, সবশেষে টেবিলে গিয়ে ঠান্ডা হয়ে আসা নাস্তার ওপর মুখ ডোবানো।
তারমানে পাপড়ির মুখ দেখবার কোনো সম্ভাবনাই থাকে না। তবে?
নাকি কারো মুখ না দেখে ঘুম ভাঙার পরিণতি এই? মনে মনে নিজেকেই তিরষ্কার করি- দূর! তা হতে যাবে কেনো?
হঠাৎ মেয়েটা শব্দ করে হেসে ওঠে। আমি চমকে উঠেছিলাম। এবার ভয়ও পাই। শুনি, সে বলছে, ‘আপনি একটা কাজ করেন, ঝামেলার হাত থেকেও বাঁচবেন। মোবাইলের সিমকার্ড আজকাল তো সস্তা, ওটা আপনি খুলে রেখে দিন। সরকার যেখানে মানুষের একাধিক সিমকার্ড ব্যবহার রোধ করতে, সন্ত্রাসীদের যাতে সহজে ধরা যায়; তাই এই সিমকার্ডের উপর ভ্যাট বসিয়েছিলো। কিন্তু সেখানে মোবাইল কোম্পানিগুলো কি ভোল দেখাচ্ছে, দেখতে পাচ্ছেন? আইনকে তারা বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, সিমকে আরো সহজলভ্য করে বাজারে ছেড়েছে। ফলে ঘটনা সেই একই ঘটছে, একজন গ্রহকের কাছে কয়েক হালি করে সিমকার্ড।’
আমি ভাবি- তাইতো!
স্থাণু হয়ে যাই এই ভেবেও- সমাজ বোধের মতোন দুর্লভ আগ্রহ তবে এ মেয়ের মাথাও আছে? অসাধারণ!
চিন্তা করতে হলো না। সুযোগ যখন পাওয়া গেছে, মুঠোফোন থেকে সংযোগটা খুলে নেয়াই হয়তো কাজের কাজ হবে। নতুন সংযোগ মানেই বাড়তি ঝামেলা। পুরোনো নম্বর তুলতে যাওয়াটাও আবার বিরক্তিরকর।
মুঠোফোন থেকে সংযোগ বের করে হাতের মুঠোয় চেপে রেখেছি। পকেটে ভরার সাহস পাচ্ছি না। নড়লেই যদি ওরা সন্দেহ করে? মারামারির সিনেমাগুলোয় এমন দৃশ্য প্রায় দেখায়- নায়ককে খলনায়ক অস্ত্রের মুখে রাখে। তখন নড়াচড়া বন্ধ। নড়লেই গুলি করে খতম করে ফেলে!
আয়না বলে, ‘আপনাকে এভাবে ধোঁকা দেওয়ার ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু উপায়ও নেই। বেশ কিছুদিন কোনো কাজ করা হয়নি, আর কাজ না করলে টাকা পাবো কই? খেতে তো হবে; নাকি ভাবছেন যৌনকর্মী বা জিম্মিকারীরা না খেয়েই বাঁচে? এ ছাড়া, নিরাপত্তার জন্য কিছুদিন পরপরই বাসা পাল্টাতে হয় আমাদের। আজ এখানে তো কাল ওখানে; এ-ই জীবন। বাসা পাল্টানোর ঝামেলাও বিরাট; তার উপর টাকা ছাড়া তো কিছুই হয় না।’
তাকিয়ে আছি মেয়েটার দিকে। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে যেনো। কেউ যেনো খুব করে গলা চেপে ধরে আছে...
আবার বলে সে, ‘হোটেলে যখন আপনি খাবারের বিলটা দিলেন, আমি দেখেছি, আপনার মানিব্যাগে বেশ কিছু টাকায় ভরা। এবং সিদ্ধান্তটা সে সময়েই নিয়েছি- যে করেই হোক জালে আটকাতে হবে আপনাকে। নইলে দেখতেন, কবেই আপনাকে একটা বাঁশ মেরে কেটে পড়তাম।’ একটু থামে আয়না। শব্দ করে কিছুক্ষণ একা একা নিজের মতোন হাসে। বলে, ‘কিন্তু আপনাকে জালে আটকাবো কি, আপনি এতোই বোকা, নিজে নিজেই জালে এসে আটকা পড়েছেন।’
হ্যাঁ, মনে মনে ভাবি- এতো সহজে মানুষকে বিশ্বাস করাটাই একটা ভুল।
কিছু করার নেই। অসহায়ের মতোন বসে আছি। একবার আয়নার দিকে, আরেকবার ছেলেগুলোর দিকে তাকাই। এরা আমায় স্বাভাবিক অবস্থায় বের হতে দেবে? আর কিছু চাই না।
পেছন থেকে একজন বলে ওঠে, ‘কি মিয়া, কি বাবতাচেন? বাইর হয়া পুলিচ মামুদের খোজ দিবার মতলব করতাচেন? তানায় গিয়া কইবেন- আমাগো কতা? কইবেন, ওরা মাইয়া মানুচ লয়া কারবার করতাচে? যার কাচে যা পায়, চব লয়া যায়! ...কবরদার! ঠ্যাঙের নালা কাইট্টা ফালায়া দিমু নে! কতাডা মাতায় গিঁট্টু বাইন্দা রাহেন।’
আমি ফের ভয়ার্ত চোখে পেছনে ফিরি। ছেলে দু-জনকে এখন আরো ভয়ংকর দেখাচ্ছে। খুনি-খুনি ধরনের নেশা কাজ করছে ওদের দৃষ্টিতে। দেখেই বুকটা ধুকপুক করতে শুরু করেছে। ...মনে পড়লো পাপড়ির কথা। মনে পড়ে যায় আমাদের একমাত্র অবলম্বন অবন্তির কথা। কিছু হয়ে গেলে, ওদের কি হবে?
বললাম, ‘ভাই! আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করবো না। কসম করছি, পুলিশের কাছেও যাবো না। এই যে, আমার এ ব্যাগটার ভেতর একটা দামি ল্যাপটপ আছে। আপনারা এটাও রেখে দেন!’ বলতে বলতে নোটবুকটা বের করে দিই।
ওরা হাসছে। হাসির শব্দগুলো এসে যেনো আমার বুকের ভেতর পাথরের বাড়ি মারছে। ভয়ে ভয়ে ফের বলি, ‘আমার কাছে গায়ের কাপড়গুলো ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। আপনারা এবার আমাকে ছেড়ে দেন।’
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ ভাই। কসম করে বলেছি- কাউকে কিছু বলবো না কোনোদিন।’
‘টিক আচে। মনে তাকে য্যান। আপনের বাচা পর্যন্ত আমাগো লোক পিচন পিচন থাকব। চিনা আইবো চব। কুনুদিন আমাগো কোনো কতি হইচে, ত আপনের কপালে বহুত খারাপি তাকব।’
‘আচ্ছা ভাই। আমি সব মেনে নিলাম।’
অনেক আগেই আমার ভেতরটা ঘেমে ওঠেছে। জনমের মতোন ভয় ধরে গেছে মনে। ওদের শীতল আর নিস্পৃহ কথা কথা শুনে, পুরো শরীরেই কাঁপন ধরে গেছে। এতোই ভয় পেয়ে গেলাম, বলার মতোন নয়। জীবনে ভুলবার মতোনও নয়। কেবলই মনে হয়েছে, এরা পারে। এরা যা বলে, তা এদের জন্য খুব সম্ভব। মিথ্যে হুমকির কোনো প্রয়োজন হয় না।
হঠাৎ আয়না বলে, ‘যান আপনি এবার।’
আমি সব সময় নিজেকে বুদ্ধিমান মনে করতাম। আজ এমন চরম বিপদে পা দিলাম নিজে নিজেই; তাতেই পুরো নিঃস্ব। তবে, শেষ পর্যন্ত ওরা যে যেতে বললো- এই আমার সান্ত্বনা। যদি বেঁধে রেখে, আমার বউয়ের কাছে লাখ টাকা মুক্তিপন চাইতো? কিংবা মেরে দু-চারটে হাড় গুঁড়ো করে তারপর যদি বলতো- যা চালা! দূরে গিয়া মর! ...তখন কি করার থাকতো?
ছাড়া পাবার সুযোগ পেয়ে, মুহূর্তেই ছুটে বেরিয়ে এলাম ওই নরক থেকে। একটা রিকশা যাচ্ছিলো। চলতি অবস্থাতেই লাফ দিয়ে উঠে বসেছি ওটায়। পেছনে ফিরে তাকাবার একটুও সাহস পাচ্ছিলাম না। শুধু নিজেকে প্রবোধ দিই- শান্ত হ, বাপ! শান্ত হ এবার!
রিকশাওয়ালা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দ্রুত ব্রেক কষে। ‘কই যাইবেন, ব্রেদার?’
আমি দম আটকে বলি, ‘তোমার যেদিকে মন চায়, যাও!’
এই বলেই বুকে থুথু ছিটাই। থুথু দিলে নাকি ভয় কমে। আমি তাই ভয় কমাবার চিকিৎসায় অস্থির। আর রিকশা চলছে। বেচারা রিকশাওয়ালা সম্ভবত মজে ছিলো। আমার দুরাবস্থা খেয়াল করেনি। আপন মনে হেড়ে গলায় সে গান ধরেছে, ‘ও চকিনা, গেচস কিনা, বুইলা হামারে... হামি এখন রিশকা চালাই ঢ্যাকা চহরে...’
::
লেখাটি মাসিক 'রহস্য পত্রিকা', আগস্ট-২০১০ সংখ্যায় প্রকাশিত।
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১:৫৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




