ইচ্ছে কথাটা শুনলেই আমার কানে সুদূর থেকে ভেসে আসে গুনগুন একটি প্রায় ভুলে যাওয়া তবুও অভুল কবিতার স্বর। ইচ্ছে হয়ে ছিলি মনের মাঝারে। হ্যাঁ রবিঠাকুরের কবিতার লাইন। আমার মায়ের মুখেই শোনা সে বাণী তারপর সঞ্চয়িতাতে পড়া।
খোকা মাকে শুধায় ডেকে--
"এলেম আমি কোথা থেকে,
কোন্খানে তুই কুড়িয়ে পেলি আমারে।'
মা শুনে কয় হেসে কেঁদে
খোকারে তার বুক বেঁধে--
"ইচ্ছা হয়ে ছিলি মনের মাঝারে।
রবিঠাকুরের এই কবিতার মত সকল শিশুই বুঝি মায়ের ইচ্ছের এক জীবন্ত পুতুল।
ছিলি আমার পুতুল-খেলায়,
প্রভাতে শিবপূজার বেলায়
তোরে আমি ভেঙেছি আর গড়েছি।
তুই আমার ঠাকুরের সনে
ছিলি পূজার সিংহাসনে,
তাঁরি পূজায় তোমার পূজা করেছি।
একজন মায়ের কাছে তার শিশুটি পূজার সিংহাসনের ঠাকুরের চাইতেও বুঝি বেশি পূজোনীয়। এ কবিতা যারা পড়েনি, যাদের কোনো অক্ষর জ্ঞানও নেই তাদের কাছেও একজন সন্তান একজন মায়ের কাছে কতখানি তা বোধ হয় বলে দেবার অপেক্ষা রাখে না। তবু তবুও দ্বন্দ, তবুও বিরোধ, কত শত অভিমান, কত শত সুন্দর হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা কিংবা কিশোর কাল।
দেখছিলাম সুচিত্রা ভট্টাচার্য্যের "ইচ্ছের গাছ" গল্প অবলম্বনে বাংলা ম্যুভি "ইচ্ছে"। ভাবছিলাম নিজের কিশোরীকাল। কত শত ইচ্ছের দাম পাইনি আমিও মায়ের ইচ্ছের কাছে। কত শত রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ক্রোধ কিংবা ভালো লাগা বা ভালোবাসা বুকে চেপে রেখে বড় হয়ে গেছি। মায়ের ইচ্ছের কাছে বলি দিয়েছি নিজের ভালোলাগা বা নিজের ভালোবাসার কতকিছুই। লুকিয়েছি আড়াল করেছি। কিছু তার জানায় কিছু তার অজানায়। মা বাবার এমন অবুঝ ইচ্ছে বা ভালো বুঝবার নামে অবুঝপনায় হারিয়ে যায় কত শত শিশু ও কিশোরের শৈশব বা কৈশোর যা জানা হয় না আমাদের। আমরা বড় হয়ে উঠি মায়েদের ইচ্ছের সাথে সাথে নিজের ইচ্ছের অনেক কিছুই গলা টিপে মেরে।
আমাদের শৈশবকাল যেন ছিলো অভিভাবকের বড় বেশি ইচ্ছেই মোড়া। মায়ের ইচ্ছেই পড়াশোনায় ফার্স্ট হতে হবে। হতে হবে সবার সেরা। মায়ের ইচ্ছেই নুপুর পায়ে নাচতে শেখা, বাবার ইচ্ছেই মায়ের কেনা হারমোনিয়ামে কোন গান শিখবো ভাবতে গিয়ে রবিঠাকুরের গান ডিসাইড করে দেওয়া। মায়ের শাসনে শিখে যাওয়া পা মেলে বসতে নেই,হাম হুম করে খাবার খেতে নেই। কেমন করে সুন্দর আর সভ্য থাকতে হয় শিখতে গিয়ে সংযত করে নিয়েছি নিজেকে অনেক বেশিই। ঠিক একই ভাবে বন্ধুরা সবাই যখন দল বেঁধে পিকনিকে গেছে কিংবা কোনো জন্মদিন বা বিয়ের অনুষ্ঠানে সেখানে নিজের ইচ্ছের কোনো মূল্য পেতে শিখিনি আমি। কোথায় পড়বো, কোনটা শিখবো, বাড়ি থেকে মেপে মেপে ঠিক কয় পা দেবো, বন্ধুরা কি হবে কে হবে সবকিছুই পইপই করে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছিলো আমাকেও আমার ছেলেবেলায়। আমার নিজের পছন্দের কোনো মূল্য ছিলো না। আমি কাকে বন্ধু হিসেবে পেতে চাই তাতেও বড় বাঁধা ছিলো আমার জীবন মায়ের ইচ্ছের কাছে।
এই বুঝি আমাদের বাংলাদেশের মায়েদের চির চেনা চিত্র। তারা স্বপ্ন দেখে, নিজেদের চাইতেও বেশি বড় করে গড়তে চান সন্তানকে। এই আশা এবং আকাঙ্খার কাছে একটি সন্তান তার শিশুজীবন বা কৈশোর জীবন তাদের শৈশব ও কৈশোরকে মন ভরে উপভোগ করতেই হারিয়ে ফেলে। নিজে তারা শৈশব ও কৈশোরে কতখানি নিয়ম ভেঙ্গেছেন সেসব বেমালুম ভুলে গিয়ে আরও বেশি নিয়মের বেড়াজালে আটকে দেন তাদের সন্তানদেরকে।
হ্যাঁ এ কথা সত্যি শিশু ও কিশোর অভিজ্ঞতার অভাবে বা বয়সের অপরিপক্কতায় অনেক ভুলই করতে পারে যার জন্য তার দরকার আছে অভিভাবকের সঠিক গাইডেন্স বা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মা বাবার উপদেশ বা পরামর্শের। তাই বলে আমাদের দেশের আমাদের সমাজের বেশিভাগ বাবা মায়েরাই ভুলে যান তাদের এই কড়া শাসন বা ভালোর নামে করা অতিরিক্ত শক্ত আচরণের কারনে তারা একটা সময় সন্তানের ভালোবাসা না হারালেও শ্রদ্ধা হারাতে পারে।
ইচ্ছে ম্যুভিতে যেন দেখা যায় আমাদের আজকালকার সমাজের শ্বাসত একজন বাঙ্গালী মায়ের প্রতিযোগীতামূলক মানসিকতা। সন্তানকে স্কুলে সবার সেরা বা ফার্স্ট হতেই হবে তাই সাত সকালে অবুঝ শিশুটির ঘুম না ভাঙ্গতেই কবিতা মুখস্ত করানোর দৃশ্যটি। তারপর স্কুলের গেটে পৌছে দেওয়া। বার বার পরীক্ষায় যেন ভুল না করে এবং পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে ভুল উত্তর বলায় সবার সামনে মারধোর করা।
এমন দৃশ্য বা এমন বাবা মা আমাদের আশেপাশেই আমরা দেখেছি। তাদের জন্য একটি কথা বলার আছে এখানে শিশুটির স্বাভাবিক বিকাশ নষ্ট হয়। সে একটি সুন্দর সকালের স্মৃতি বঞ্চিত এবং পরীক্ষা ভীতি নিয়ে পরবর্তীতে এক অসুস্থ্য মানসিকতা বা বিষন্নতার শিকার হতে পারে।
ইচ্ছে ম্যুভিটাতে ছেলেটি যখন একটু বড় হয়। মানব জীবনের স্বাভাবিক ধর্ম হিসাবেই তার মনে একটি ভালোবাসার সূচনা হয়। মেয়েটির লেখা চিঠিগুলি নিজের কাছে লুকিয়ে রেখে বা মেয়েটির জন্য যে দায়িত্বটি সে নিয়েছিলো সেই দায়িত্ববোধ, তার সন্মান সব ধুলোয় লুটিয়ে দেয় তার মা মেয়েটিকে সকলের সামনে অপমান করে এবং সাথে তার ছেলেটিকেও। মা এখানে শুধু তার নিজের সন্তানের মঙ্গল চেয়েছেন। এই বয়সে কোনো মেয়ের সংস্পর্শ তাকে অধঃপাতে ডুবাবে এমনই মানসিকতায় তিনি ভুলেই গেছেন নিজের কিশোরীকাল। যে বয়সে তিনিও একদিন প্রেমপত্র লিখেছিলেন। ভুলে গেছেন নিজের সন্তানটির মান সন্মান। ছেলেটিকে অবুঝ ভেবে তিনি নিজেই সবচেয়ে বড় অবুঝপনাটাই করেছেন।
ছেলে মায়ের অবুঝ ইচ্ছের বলি হয়েছে। কিশোর ছেলেটি হার মেনে নিয়েছে। তবুও যৌবনে সে ফের নতুন ভালোবাসায় জড়িয়েছে এবং নিজের ইচ্ছে প্রতিষ্ঠিত করতে মাকে বুঝিয়েছে, অবজ্ঞা করেছে কিন্তু মা তার জিদ ছাড়েননি। তিনি শুধু এক তরফাভাবে নিজের দিকটাই ভেবেছেন তিনি ছাড়া তার ছেলের ভালোটা তার ছেলে নিজেও বোঝে না এমন ভাবনাতে তিনি একের পর এক ভুল করে গেছেন। নিজের অজান্তেই ছেলের সাথে এক অসুস্থ্য প্রতিযোগীতায় নেমেছেন। তিনি ছেলের ভবিষ্য যশঃ, মান, খ্যাতির মোহে মোহাছন্ন হয়ে পড়েছিলেন।
মোহাছন্ন ছিলেন তিনি সন্তানের ভালোবাসাতেও। সেই ছোট্ট ছেলেটির জুতো মুছে ঝকঝকে করে রাখার দৃশ্যটি কিংবা টিফিন বক্সে পরম যতনে টিফিন ভরে দেওয়া, রোজ রোজ বসে ছোট থেকে বড় হওয়া অবধি ছেলের পাওয়া সকল সার্টিফিকেট, প্রাইজের হাত বুলোনো এসব দেখেও তাকে মোহাবিষ্ঠা এবং ছেলেই যার ধ্যান জ্ঞান সকল স্বপ্নাবিষ্ঠা একজন কিছুটা অপ্রকৃতিস্থাও মনে হয়েছে আমার কাছে। মা আসলে ছেলেকে বড় করার বদলে, যথার্থ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলার বদলে বড় বেশি নিজের ইচ্ছের গন্ডিতে বেঁধে ফেলেছিলেন যার জালে তিনি নিজেও বন্দী হয়ে পড়েছিলেন। যার দামও তাকে দিতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই ম্যুভিতে গল্পের লেখিকা খুব ভালোভাবেই বুঝাতে পেরেছেন, পৃথিবীর সকল মায়েদের বিশেষ করে আমাদের বাঙ্গালী মায়েদের সন্তান পালনে ভুল সংশোধনের জন্য আসলেই নিজেদেরকে কোথায় কখন সংশোধন করা উচিৎ।
ইচ্ছে ম্যুভিটির লিঙ্ক-
ইচ্ছে
এই ম্যুভীর প্রতিটি কলাকুশলীকে পারলে আমি নিজেই এওয়ার্ড দিতাম। তবে মায়ের যত ভালোবাসা, আশা, আকাংখা, রাগ, ক্ষোভ, ভুল বা জিদ যথার্থভাবে ফুটিয়ে তোলার জন্য আমি এই ম্যুভির মাকে দিলাম বিশেষ পুরষ্কার আর ভালোবাসা।