আমি জানিনা এই জগতে ঠিক ক'জনা কালচারাল থেরাপী সম্পর্কে জানেন বা ইতিবাচক ধারনা করেন। আমিও যখন জেনেছিলাম খুব অবাক হয়েছিলাম এবং উপলদ্ধ করেছিলাম আসলেই তো এভাবে অবশ্যই সম্ভব। যদিও কারণ এটা হতে পারে খুব ছোট থেকেই আমি সাংস্কৃতিক চর্চার মাঝেই ছিলাম। যাইহোক কালচারাল থেরাপী এটা শুনতে একটু অবাক লাগলেও এই কালচারাল থেরাপীর মাধ্যমে মানুষের জীবনের ভয়ংকর সব অবসাদ, বিষন্নতা, দুঃখ, বেদনা থেকে শুরু করে ভয়ংকর সব অপরাধ প্রবনতাকেও দূরীভূত করা সম্ভব। সোজা কথায় কালচারাল থেরাপী বলতে কাউকে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাঝে জড়িয়ে দিয়ে তার অন্তরে সূর বা ছন্দের মূর্ছনা ছড়িয়ে দিয়ে সকল দুঃখ, বেদনা বা অপরাধের গ্লানিকে দূর করে দেওয়াকেই বুঝািয়ে থাকে। তাই তো সদা সর্বদা গুনগুন করা আমার মনে জাগে সেই গান- তুমি যে সূরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে, সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে, সবখানে সবখানে......
ঠিক এমনই এক কালচারাল থেরাপীর অংশ হয়েছিলেন নাইজেল আকারা। লম্বা চওড়া ও বিশালাকার এই মানুষটিকে অতিমানব বা দেবতাই বুঝি মনে হয় আমার। কিন্তু তার অতীত কোনো দেবতাসুলভ সুন্দর গুনাবলীতে মোড়ানো ছিলো না। সে ছিলো এক ভয়ংকর অপরাধী। কিন্তু অন্ধকার জগত হতে আলোর পথে ফেরানোর প্রত্যাশায় সংশোধনাগারে থাকার সময় তিনি অলকানন্দা রায়ের হাত ধরে এই কালচারাল থেরাপীর অংশ হিসাবেই বাল্মিকি প্রতিভা’য় অংশ নিয়ে নতুন মানুষে রুপান্তরীত হন। অলকানন্দা রায়ের ভালোবাসা মমতা ও এই কালচারাল থেরাপীতে নাইজেলের মত আরও অনেকগুলো মানুষ সুন্দর জীবন ফিরে পেয়েছে। অলকানন্দা রায়ের আরেক নাম তাই জেল জননী। নাইজেল আকারার মতন সমাজের চোখে কুখ্যাত আরও অনেক অপারাধীদের মা তিনি। নাইজেল আকারা অলকানন্দা রায়ের হাত ধরেই কলকাতার অভিনেত্রী ঋতুপর্ণার সাথে প্রথম সেলুলয়েড দুনিয়ায় পা রাখেন ‘মুক্তধারা’ ছবিতে। আমি ওই সিনেমাটা দেখেছিলাম। অবাক বিস্ময়েই মুগ্ধ হয়েছিলাম এটা ভেবেই। রবিঠাকুর কি সত্যিই ভবিষ্যৎবক্তা ছিলেন? তিনি কি এই শতবছর পরে নাইজেল আকারার জন্যই লিখেছিলেন ঐ বাল্মিকী লেখাটা!
নাইজেল আকারার সেই অবিশ্যাস্য রুপান্তর সম্পর্কে বলার আগে আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাল্মিকি প্রতিভা নিয়ে কিছু একটু বলতে চাই। বাল্মীকি-প্রতিভা গীতিনাট্যের আখ্যানবস্তু কৃত্তিবাস বিরচিত বাংলা রামায়ণের সূচনাভাগ থেকে গৃহীত। যাইহোক- মূল গল্পটা এমন-
মহাকবি বাল্মীকি প্রথম জীবনে দস্যুসর্দার ছিলেন। অরণ্যে বাস করতেন। বনের মধ্যে তিনি নরবলি প্রদান করতেন। একদিন তার অনুচরেরা নরবলির জন্য এক ছোট মেয়েকে ধরে আনল। বলি দেবার ঠিক আগে আগে মেয়েটির করুণ গান শুনে বিহ্বল হয়ে পড়লেন বাল্মীকি। অনুচরদেরকে বলেন মেয়েটির বাঁধন খুলে মুক্তি দিতে। তারপর তার কি এক পরিবর্তন হল। বনের পথে ঘুরতে লাগলেন।
এরপর একদিন বাল্মীকি তার অনুচরবর্গকে নিয়ে মৃগয়ায় গেলেন। কিন্তু তার এক অনুচর এক হরিণছানাকে হত্যা করতে গেলে আবারও তিনি সহ্য না করতে পেরে বাধা দিলেন। এতে বাল্মীকির অনুচরেরা তাকে উন্মাদ মনে করে ফেলে গেলো। বাল্মীকি আবার শূন্যমনে বনে বনে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন। একদিন এক ব্যাধকে ক্রৌঞ্চমিথুন বধ করতে দেখে শোকার্ত দস্যুসর্দারের মুখ দিয়ে নির্গত হল প্রথম শ্লোক:
মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।।
এই শ্লোক উচ্চারণ করেই শিহরিত হলেন বাল্মীকি। নিজের অজান্তেই দস্যুপতি কিভাবে দেবভাষা উচ্চারণ করলেন তা বুঝতে পারলেন না। তখন তার সম্মুখে আবির্ভূত হন দেবী সরস্বতী। সরস্বতীর দর্শন পেয়ে দস্যুপতির পাষাণ হৃদয় বিগলিত হল। তিনি এত দিন নরবলী দিতেন যেই কালীপ্রতিমাকে। তাকে পরিত্যাগ করলেন। সরস্বতী অন্তর্হিত হলে বাল্মীকি তার অনুসন্ধান করে ফিরতে লাগলেন। লক্ষ্মী তাকে ধনসম্পদের প্রলোভন দেখিয়েও ব্যর্থ হন। তখন তার ও বনদেবীদের করুণ প্রার্থনায় সাড়া দিয়ে পুনরায় আবির্ভূত হলেন সরস্বতী। বাল্মীকি সঙ্গীতের মাধ্যমে তার বন্দনা করলে তিনি উত্তরে বললেন:
দীনহীন বালিকার সাজে,
এসেছিনু এ ঘোর বনমাঝে,
গলাতে পাষাণ তোর মন –
কেন বৎস, শোন্, তাহা শোন্।
আমি বীণাপাণি, তোরে এসেছি শিখাতে গান,
তোর গানে গলে যাবে সহস্র পাষাণপ্রাণ।
যে রাগিনী শুনে তোর গলেছে কঠোর মন,
সে রাগিনী তোর কণ্ঠে বাজিবে রে অনুক্ষণ।
…
বসি তোর পদতলে কবি-বালকেরা যত
শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত।
এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার
যে গান গাহিতে সাধ, ধ্বনিবে ইহার তার।
ঠিক এভাবেই যেন একদিন নাইজেল আকারার জীবনে বীণাপাণি রূপে আশীর্বাদ হয়ে এসেছিলেন অলকানন্দা রায়। নাইজেল আক্কারা দস্যু রত্নকরেরই এক আধুনিক ভার্সন যেন। দুধর্ষ গুন্ডা বলেই পরিচিত ছিল সে। ছিলো সকলের ঘৃনার পাত্র। ১৮টি খুনের মামলা মাথায় নিয়ে কয়েকটি’বছর কারাগারে কাটিয়েছিলো সে। আলোকানন্দা রায়ের কারণেই নাইজেল আক্কারার জীবনে নতুন আরেক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিলো। নাচ-গান-নাটক কী ভাবে বন্দিদের জীবন বদলে দিতে পারে, তা নিয়ে অনেক কথা হলেও আসল গল্পটা ছিলো আসলে ভালোবাসার। এডিজি (কারা) বংশীধর শর্মার উদ্যোগে প্রেসিডেন্সি সংশোধনাগারে বন্দিদের ‘ড্যান্স থেরাপি’ করাতে গিয়েছিলেন অলকানন্দা। প্রথমে তিনি এমন কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে যাননি।শুধুই একজন ভিজিটর ছিলেন। কিন্তু বন্দীদেরকে দেখে তার মনে হয় মানুষ তো কেউ অপরাধী হয়ে জন্মায় না। মাঝে মাঝেই ছন্দ পতন হয়। এই ছন্দই ফিরিয়ে দেওয়া যায় নাচ, গান বা কবিতার ছন্দে। তিনি নিজেই জানতেন নাচলেই তার সব থেকে বেশি ভালো লাগে।
তার ইচ্ছেতেই সংশোধনাগারের সুপার বলেছিলেন, ২০-৩০ বছর বয়সীরা যেন নাচ শিখতে যায়। বিভিন্ন সংশোধনাগারে বন্দিদের নিয়ে নাচের দল গড়েছিলেন নৃত্যশিল্পী অলকানন্দা রায়। করিয়েছিলেন বাল্মীকি প্রতিভা। দস্যু রত্নাকরের আত্মশুদ্ধির গল্প! গল্পের পাতা থেকে উঠে আসা সত্যিকারের‘বাল্মীকি’ যেন নাইজেল আকারা।
এক সময়ে পার্ক স্ট্রিটের যে দোর্দণ্ডপ্রতাপ গুন্ডা নাচতে হবে শুনে প্রশ্ন করেছিল, “গুন্ডাদের পায়ে ঘুঙরু বাঁধবেন, স্যার?” বংশীধর শর্মা যাঁকে বলেছিলেন, ‘ফল-দুধের মেডিক্যাল ডায়েট দেব, দু’ এক দিন দেরি করে সেলে ঢোকার অনুমতি মিলবে। শর্ত একটাই, নাচের ক্লাসে থাকতে হবে।’ দায়ে পড়ে পা মেলানো শুরু হলেও তা পৌঁছে যায় নাচের ছন্দ ভাল লাগায়। শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্র সদনে মঞ্চের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন নাইজেল। তত দিনে অলকানন্দা অন্য বন্দিদের মতো তাঁরও মা, ভালবাসায় বদলে গিয়েছে জীবনটাই। বাল্মীকি প্রতিভার কাহিনী শুনে তার মনে হয়েছিলো, এতো তার নিজের গল্প। বদলে গেলো তার জীবন। গুন্ডা থেকে জেইলের গন্ডি পেরিয়ে আজ তিনি বাল্মিকী। সত্যিকারের জলজ্যান্ত বাল্মিকি।
সমাজের অবহেলিতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। জেল খাঁটা দাগী আসামীদের কোথাও জায়গা হয় না। তাদের নিয়ে নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। বন্ড সই করেছেন যে কোনো ক্ষতির ক্ষতিপূরণ দেবার। সমাজে পতিত মানুষগুলোকে টেনে তোলার আপ্রাণ চেষ্টায় যে মুছে দিতে চান গত জীবনের সকল অপরাধের কালীমা।
অপরাধপ্রবণতা থেকে ভালবাসা উত্তরণের এই গল্পে তবু একটি প্রশ্ন থেকে যায়। নাইজেলের কাজকর্মে যাঁরা ক্ষতিগ্রস্ত, তাঁরা কি ক্ষমা করতে পারবেন তাঁকে? করা সম্ভব? নাইজেল নিজেই বলেন, “না, তাঁদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে আমি তাঁদের অনেকের সঙ্গেই যখন দেখা হয়েছে, বলেছি, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি যদি এখন কোনও ভাবে সাহায্য করতে পারি, বলবেন। এক জনের ভাইকে বলেছিলাম, আমাকে যদি মারতে হয়, মারো। সে বলেছিল, বন্দি হিসেবে তুমি যা করেছো, তাতে আমাদের মাথা উঁচু হয়েছে।
এইভাবে চরম এক অপরাধীকে বদলে দিলো এই কালচারাল থেরাপী। এখানে ছিলো মূলত নাচ। জেল জননী অলকানন্দা রায় আন্তর্জাতিক খ্যাতি সপন্ন ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্য শিল্পী , সংশোধক এবং একজন মা। Miss India-এর একজন প্রাক্তন runner-up। সকল সৌন্দর্য্য মায়া মমতা ও শিল্পের দেবী। কারাবন্দীদের জন্য কারাবাসীদের সংস্কারের কাজ বিশেষ করে কারাগারের কারিগররা তাদের শিল্প ও প্রেম থেরাপি (Love Therapy)- র মাধ্যমে নতুন করে কঠোর অপরাধীদের নতুন জীবন দিয়েছেন এবং খ্যাতি অর্জন করেছেন যা দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে ছড়িয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশে। তাঁর এই Love Therapy আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হয়।
ড্যান্স থেরাপী, লাভ থেরাপী, কালচারাল থেরাপী। অলকানন্দা রায়ের কিছু কথা আমার মনে গেঁথে গেছে। তিনি বলেছেন,আমরা সবাই ছন্দ নিয়ে জন্মাই। সেই ছন্দ পতন হয় মাঝে মাঝে। এই ছন্দ পতনের উত্তরণ একমাত্র সম্ভব ছন্দ ফিরিয়ে দিয়ে। নাচ গান আবৃতি, নাটক ..... এই তো জীবনের ছন্দ।এই ছন্দ খুঁজে পেলে ফিরে পেলে অনেক অপরাধ থেকে ফিরে আসা সম্ভব। সবাই ভালোাবাসার কাঙ্গাল। একজন অপরাধীকেও সম্ভব এই ভালোবাসা দিয়েই ফিরিয়ে আনা।সবাই ভালো হতে চায় কিন্তু অন্যের সহযোগীতা দরকার। যা একবার ভুল করে ফেলা মানুষগুলো আর সহজে পায় না।
নাইজেল অভিনীত ২টি চলচ্চিত্র মুক্তধারা এবং গোত্র
আমাদের সমাজে বিশেষ করে বাংলাদেশের সমাজে সাংস্ক্বতিক কর্মকান্ড নিয়ে তেমন মাথা ব্যাথা নেই। মানুষের মাঝে সুকুমারবৃত্তিগুলো যে নাচ, গান কবিতার ছন্দে জাগিয়ে তোলা সম্ভব তা বললে যেন বিশ্বাসই হবে না অনেকের। আমি অনেক অনেক ফ্যামিলীতে দেখেছি যাও বা ছোটবেলায় ছেলেমেয়েদেরকে গান বা নাচ শিখতে দেওয়া হয় বড় হতে হতে সে সব বন্ধ হয়ে যায় যথার্থ উৎসাহ না দেবার কারণে। সেখানে চাপিয়ে দেওয়া হয় প্রতিযোগীতামূলক পড়ালেখার বোঝা। একটা কথা কি, মনে যদি আনন্দই না থাকে তো চাপিয়ে দেওয়া কাজ কি করে সুন্দর হবে! যাইহোক অনেকেই মনে করেন বাচ্চাদের নাচ গান কবিতা নাটকে মন গেলে পড়ালেখা হবে না। কিচ্ছু হবে না জীবনে। নাচ তো পুরোপুরিই অবহেলিত যেন। আমাদের দেশে অধিকাংশ বাড়িতে মেয়েরা নাচবে এটা যেন মেনেই নেওয়া যায় না। নাচ মানে যেন অচ্ছুৎ,অপরাধের বিষয়। আর ছেলেরা নাচলে তো উপহাসেরও পাত্র হতে হয়।
অথচ এই নাচ, অভিনয় আর গীতি নৃত্যনাট্যের মাঝেই ফিরিয়ে দিলো অলকানন্দা রায় সমাজের চোখে অসুন্দর কতগুলো মানুষের জীবন সুন্দরের মাঝে। অলকানন্দা রায়কে আমার মনে হয় এমনই এক দেবী যিনি আরও কিছু দেবশিশুদের জন্ম দিয়েছেন। নতুন করে। পূণর্জন্ম হয়েছে তাদের! শ্রদ্ধা জানাই জেল জননী অলকানন্দা রায়কে। অন্তরের অন্তস্থল থেকে ভালোবাসা জানাই নাইজেল আকারা ও তার মত পূণর্জন্ম নেওয়া আরও মানুষগুলোকে। শ্রদ্ধেয়া অলকানন্দা রায় আর আমার সত্যিকারের বাল্মিকী নাইজেল আকারা যদি কখনও বাংলাদেশে আসে তাদের জন্য রইলো আমার পরীর দেশে আমন্ত্রন....... সকলের জীবন সুন্দর, সার্থক ও সাফল্যমন্ডিত হোক.....
রাগ আর ঘেন্না নয়, পৃথিবীটার চাই আরও ভালোবাসা
Alokananda Roy - Love Therapy in My Second home
অন্ধকার অপরাধ জগৎ থেকে রূপালী পর্দার জনপ্রিয় নায়ক Nigel এর জীবনে অজানা কাহিনী টি কি ?
Dance Drama
Debshankar Haldar
নাইজেল অভিনীত গোত্র সিনেমার একটি প্রিয় গান
এই লেখাটি উৎসর্গ করছি আমাদের প্রিয় মডারেটর কাল্পনিক ভালোবাসা ভাইয়াকে....
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জুলাই, ২০২০ রাত ৯:৩৬