রোগ একটা সার্বজনীন অভিজ্ঞতা। মানবজাতির ইতিহাস যতটুকু জানা যায় তাতে দেখা গেছে সর্বকালের ইতিহাসে মানুষের রোগের অভিজ্ঞতা আছে। মানুষের ইতিহাস যতদিনের রোগের ইতিহাসও তার সমসাময়িক। সেই সাথে এও দেখা গেছে সর্বত্রই মানুষ এই রোগ মোকাবিলার নানা পন্থা অবলম্বন করেছেন। রোগ নিরাময়ের এই ব্যাবস্থায় দুইটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। একটা হচ্ছে স্থানিয় প্রকৃতির নানা উপাদানের উপর এবং দ্বিতীয়ত রোগমুক্তির পুরো প্রক্রিয়াটি প্রভাবিত হয়েছে স্থানিয় ধার্মিক এবং সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল দিয়ে। ফলে চিকিৎসা ব্যাপারটা হয়ে উঠেছে জাগতিক এবং আধ্যাতিক এই দুইয়ের সমন্বিত কর্মকান্ড। একটা ধর্মীয় ও সংকৃতিক কাঠামোর ভিতর দিয়েই মানব সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলের রোগ নির্নয়ের পদ্ধতি, চিকিৎসার নানা স্বতন্ত্র গড়ে উঠে। এই ধারাগুলোর অন্যতম হছে ভারতীয় আয়ুর্বেদ।
প্রাচীন ভারতের অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি ছিল আয়ুর্বেদ। সেই সুত্রে বলা বাহুল্য, প্রাচীন বাংলাতেও আয়ুর্বেদই ছিল চিকিৎসার মূল ধারা। আয়ুর্বেদ মুলত একটি ধর্মগ্রন্থই। বেদ শাস্ত্রেরই একটি শাখা এটি। আয়ু বৃদ্ধির বেদ। হিন্দু পুরানে দেবতাদের চিকিৎসক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ‘ধনন্তরীকে’ ।তাকেই বিবেচনা করা হত আয়ুর্বেদের জনক হিসেবে। ভারত বর্ষের আয়ুর্বেদ চিকিৎসার ইতিহাস দুহাজারের বছরেরেও অধিক। কথিত আছে আয়ুর্বেদের মূল নীতিগুলো পদ্ধতি আকারে সংরক্ষন করেছিলেন ‘কনিষ্ক’ রাজার চিকিৎসক ‘চরক’। যা ‘চরক সংহিতা’ নামে বিখ্যাত। আয়ুর্বেদ মনে করে দেহের ভিতরের বিভিন্ন উপাদানের ভারসাম্যহীনতাই তৈরী করে রোগ। আয়ুর্বেদ চিকিৎসার মূল লক্ষ্য হচ্ছে শরীরের সেই ভারসাম্য ফিরিয়ে আনা। ঔষধ পথ্য ও জীবনযাপনের নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চলে আয়ুর্বেদের চিকিৎসা। ঔষধের উৎস হচ্ছে ভেষজ উদ্ভিদ আর জীবনযাপনের অভ্যাসের মধ্যে রয়েছে যোগব্যায়াম, ধ্যান সহ নানা চর্চা। ধরনা করা হয় বৌদ্ধ দর্শনের নানা উপদান আয়ুর্বেদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশেষ করে ধ্যান মগ্ন হোয়াকে আয়ুর্বেদ চিকিৎসার অংশ হবার পিছনে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের ভুমিকা আছে বমে মনে করা হয় । আয়ুর্বেদ সম্পর্কে এতটুকু নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, হাজার বছর আগে মানুষের দেহ ও রোগকে বুঝার যে চেষ্ঠা আয়ুর্বেদে হয়েছে তা এখনো প্রাসংগিক । বিশেষ করে মানুষের দেহকে মহাবিশ্বের একটা অংশ হিসেবে দেখবার একটা দৃষ্টিভঙ্গী , কিম্বা দেহ ও অনুভূতির সমন্বিত চিকিৎসা আধুনিক যুগেও নান ভাবে সমাদৃত। চিকিৎসা হিসেবে ধ্যান বা মেডীটেশন নতুন করে সমাদৃত হয়ে উঠেছে সারা পৃথিবীতে । উল্লেখ্য প্রাচীন ভারতে বিশেষ করে বাংলা অঞ্চলে শল্য চিকিৎসারও ব্যাপক প্রসারের খোজ পাওয়া যায়। চরকের মত ‘সশ্রত’ নামের একজন শল্য চিকিৎসক সশ্রত সঙ্ঘিতা রচনা করেন । যিনি কাশীর অধিবাসী ছিলেন বলে ধারনা করা যায়। তাকে ভারতবর্ষের সার্জারীর জনক বলে বিবেচনা করা হয়। বিস্নয়ের ব্যাপার হচ্ছে ‘শস্রত’ তাঁর বইয়ে অসংখ্য সার্জারীর প্রক্রিয়ার বর্ননা দিয়ে গেছেন । সেই সঙ্গে দিয়ে গেছেন অসংখ্য সার্জিকাল যন্ত্রপাতির বিবরন। কামারদের কাছ থেকে কি করে অতি সূক্ষ সেইসব যন্ত্র গুলো বানিয়ে নিতে হবে তারো বিবরন আছে সেই বইয়ে ।
তবে আয়ুর্বেদ মনে করে মানুষের জীবন– দেহ, অনুভুতি ও আত্নার একটা সমন্বয়। মানুষের শরীরের ধাতুগুলো — রস,রক্ত, মাংস,অস্থি,মজ্জা,মেদ ও শুক্র নানা কারনে ভারসাম্যহীনতায় পড়তে পারে। তাই ভেষজ ঔষদ, নানাবিধ খাদ্য ও জীবন যাপনের অভ্যাস পরিবর্তনের(যোগ ব্যায়াম , ধ্যান) ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা পেতে পারি সুস্থ ও সাফল্যমন্ডিত দীর্ঘ জীবন।
সূত্রঃ এই জনপদে চিকিৎসাচর্চাঃ ডাঃ শাহাদুজ্জামান]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১২:৫৬