ইন্দিরাকে নেহেরু শুনিয়েছেন মিশর, ক্রীটদ্বীপ, ইরাক, চীন ও ভারতবর্ষের সভ্যতার গল্প। এসব জায়গাতে যেন চিঠিগুলোয় চড়ে মেয়েকে নিয়ে চষে বেড়িয়েছেন তিনি। বর্ণনা করেছেন অনেক সভ্যতা ও সাম্রাজ্যের উত্থান পতন। নেহেরু লিখেন -
" বিপুলা পৃথিবীর কাছে একটি জাতি বা দেশের উত্থানপতনে এমন কিছু যায় আসে না। "
প্রাচীর চীন ও ভারতসভ্যতাকে আজকের চীন ও ভারতের জীবনধারার ভিত্তি স্বরুপ হিসেবে দেখেছেন নেহেরু। এটা সত্য যে, ইতিহাসের সূচনা লগ্ন থেকে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির যে বিশাল পরিপ্রেক্ষিত ও অবিচ্ছন্নতা, তাকে কোনভাবেই আলোচনার বাইরে রাখতে চাননি তিনি।
নেহেরুর নাইনি সেন্ট্রাল জেলের চিঠিগুলোয় আমরা দেখতে পাই, তিনি কন্যা ইন্দিরাকে বলেছেন আর্যদের দুই ধারায় বিভক্ত হওয়ার গল্প, কিভাবে আর্যদের একদল এশিয়া থেকে পশ্চিমে এগিয়ে গেল আর অন্যদল ভারত বর্ষের দিকে আসলো তার গল্প। কেমন করে গ্রীক আর্যদের উপর নোসস সভ্যতার প্রভাব এবং ভারতীয় আর্যদের উপর দ্রাবিড় সভ্যতার প্রভাব পড়েছিলো তার সাবলীল বর্ণনা।
নেহেরু ইন্দিরাকে প্রাচীন নগরায়নের কথা বলেছেন। ভারতীয় আর্য সভ্যতা ও গ্রীক আর্য সভ্যতার মধ্যে নগরায়নের মিল ও দুই সভ্যতার শুরুর দিকে স্থাপিত স্বতন্ত্র নগর রাষ্ট্রগুলোর কর্মপরিধি বর্ণনা করেছেন। নেহেরুর ভাষায় এসময়ের ইউরোপে মাত্র সবুজের জাগরণ শুরু হয়েছে। মধ্য ইউরোপের যে বিস্তীর্ণ প্রান্তরটি বসবাসের অনুপযোগী ছিল, আবহাওয়ার পরিবর্তনের সাথে কিভাবে তার পটপরিবর্তন হলো সেটা নিয়ে একটা ধারনা পাওয়া যায় নাইনির জেলে বসে লেখা শুরুর দিকের এই চিঠিগুলোতে।
যে সময়টায় পীত নদীর তীরে মঙ্গোলিয়ানরা এশিয়া থেকে গিয়ে বসবাস শুরু করলো, তা হবে খৃস্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। সুনির্দিষ্ট শাসন প্রাণালী ছাড়া কয়েক হাজার বছর অতিবাহিত হওয়ার পর চীনের সমাজপতিরা কিভাবে সম্রাটে পরিনত হয়ে যান সে কথা বলার পাশাপাশি প্রাচীন কালে কৃষিবিদ্যা আবিষ্কার হওয়ার পর সমাজ ভিত্তির পরিবর্তন নিয়েও নেহেরু কন্যা ইন্দিরাকে ধারণা দেন। এই নতুন সমাজ বিন্যাসের সর্বোচ্চ স্তরে সমাজপতিদের জায়গা দখল এবং সম্পদ কুক্ষিগত করার যে প্রচলন হয়, তা এখনও বিদ্যমান, এমনটাই বলতে চেয়েছেন নেহেরু। এই চিঠিটির নাম 'ধনসম্পদ যায় কোথায়?'
নাইনি জেলে বসে লেখা প্রায় বিশটি চিঠির শেষের দিকে নেহেরু পৃথিবীর ইতিহাসকে টেনে নিয়ে আসেন খৃস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের দিকে। এই সময়টাকে ধর্ম ও সভ্যতার আঙ্গিকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে সংগায়িত করা হয় চিঠিতে। কাছাকাছি সময়ে ভারতবর্ষে বুদ্ধ ও মহাবীর, চীন দেশে কনফুসিয়াস, পারস্যে জোরোআস্টার ও গ্রীসে পীথাগোরাসের জন্ম নেহেরুকে ভাবায়। পাঠকদের ভাবনার জগতে নিয়ে যায়। বালিকা ইন্দিরাকেও কি ভাবিয়েছিল, পাঠকদের বেশ জানতে ইচ্ছে করে।
বুদ্ধের আবির্ভাবের পর ভারতবর্ষে বৈদিক ধর্মের অবনতি ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার নিয়েও নেহেরুর উৎসাহ দেখতে পায় পাঠকরা চিঠিতে৷ তবে ধর্ম নিয়ে নেহেরু ব্যক্তিগত মতামতের কিছু অংশ দেখা যায় -
" দুঃখের বিষয়, পরলোকের প্রতি আমার তেমন অনুরাগ নেই, ইহলোকে আমার কী করা উচিত এইটেই আমার কাছে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।"
তবে ধর্মের বিষয়ে যেকোন বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ইন্দিরাকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন নেহেরু -
" আজ যদি আমার সব কথা তুমি বুঝতে নাও পারো, তাতে কিছু আসে যায় না। কিছুদিন পর আপনা থেকেই বুঝতে পারবে।"
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১২:২৩