somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Protofeminist বা প্রাচীন নারীবাদী

০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ২:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রায় সকল কিছুর মতোই নারীবাদেরও একটি সুপ্রাচীন ইতিহাস রয়েছে। বিশ্বের প্রথম নারীবাদীর সাথে পরিচিত হতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় ৪ হাজার বছর। নগর সভ্যতার শুরু থেকে গত ১৮ শতক পর্যন্ত নারী সমাজের উন্নতিতে কাজ করা এসব ব্যক্তিদের প্রোটোফেমিনিস্ট বা আদি নারীবাদী হিসেবে অভিহিত করা হয়।

একটি চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে মানব সভ্যতার পালাবদলেই নারী কখনো তার সম্মান হারিয়েছে, আবার কখনো মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। তুলনামূলক কম শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও শিকার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় নারীরা পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়েই অতিকায় শিকারকে বধ করেছে।
কিন্তু ১০,০০০ খ্রিস্ট পূর্বে কৃষির আবিষ্কারের সাথে সাথে সামাজিক সাম্যাবস্থায় বিচ্যুতি ঘটে। অধিক পরিশ্রম এবং ভারী কাজের জন্য ফসলের মাঠে নারীর বিচরন কমে যায়। বেশীরভাগ সমাজেই নারীর পরিচয় হয় শুধুই সন্তান উৎপাদনের মাধ্যম হিসেবে এবং গৃহস্থালি কাজের জন্য। কিন্তু এই অবস্থা সব সময় একরকম থাকেনি, বিভিন্ন যুগে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের দ্বারা এই পরিবর্তন হয়েছে।

এই ব্লগ পোস্টে মূলত প্রাচীন সমাজিক প্রেক্ষাপট ও বিভিন্ন ধর্মীয় আবহে নারীর অবস্থান এবং অনেক বিস্মৃত প্রোটোফেমিনিস্টদের ভূমিকা তুলে ধরাই মূল উদ্দেশ্য। সে সময়ের প্যাগান সমাজে একজন সাধারণ নারীর মর্যাদা কেমন ছিল তা ভাইকিংস, গেম অব থ্রোনস অথবা প্রাচীন রোমানের স্পার্টাকাস জাতীয় সিরিয়ালগুলোতে দেখতে পাবেন। এর মাঝেই বিভিন্ন সময় প্রাচীন সুমেরীয়, ব্যাবিলন ও গ্রীসের সমাজ সংস্কারকরা নারীর উন্নতিতে অবদান রেখেছেন।
তো পরিচিত হওয়া যাক এই ইতিহাস বিখ্যাত নারীবাদীদের সাথে।

আকাদিয়ান সম্রাট সারাগন (Sargon of Akkad); ২৩৩৪-২২৭৯ খ্রিষ্টপূর্ব
বেশীরভাগই সম্রাট সারাগনকে নারীবাদীদের তালিকায় রাখতে চাইবে না। কিন্তু মানব ইতিহাসের প্রথম সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সুমেরীয় সভ্যতার সম্রাট সারগন একটি বিশেষ কাজের জন্য অবশ্যই এই তালিকায় আসার যোগ্যতা রাখেন।
ইউফ্রেটিস-টাইগ্রিস নদীর মধ্যবর্তী কৃষি ভিত্তিক নগরগুলো মোটেই নারীদের জন্য আদর্শ জায়গা ছিল না। প্যাগান সমাজে উর্বরতাই ছিল তাদের মূল মর্যাদা। এদিকে উত্তরে ভূমধ্য সাগর হতে দক্ষিনে পারস্য সাগর পর্যন্ত বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সারাগনের মাথার উপর ছড়ি ঘুরানোর ক্ষমতা রাখতো শুধু প্যাগান পুরোহিতরা।


প্রাচীন প্রত্নশিলা এবং শিল্পির তুলিতে এন-হেদুয়ান্না

আর তাদের এই ক্ষমতা খর্ব করার জন্যই হোক অথবা অন্য কোন উদ্দেশ্যেই হোক সারাগন চন্দ্র-দেবতার প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ দেন নিজ কন্যা এন-হেদুয়ান্না’কে(Enheduanna)। প্রায় সাড়ে ৪ হাজার বছর সারাগনের এই নিয়োগ কতোটা দুঃসাহসী ছিল বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়তো নারী সমাজে এর কোন তাৎক্ষণিক প্রভাব পড়েনি, কিন্তু এন-হেদুয়ান্না’র ভূমিকা ছিল সুদূরপ্রসারী। বিশ্বের প্রথম কবি, রচয়িতা, বর্ণনাকারী হিসেবে স্বীকৃত এই পুরোহিত রাজকুমারী যে প্রাচীন যুগে অনেক নারীর আদর্শ হয়েছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আর অনেকে স্বজনপ্রীতি হিসেবে দেখলেও একজন নারীকে প্রধান পুরোহিত বানানোর জন্য সম্রাট সারাগন ইতিহাসের প্রথম নারীবাদী হিসেবেই সম্মানিত হবেন।

কিং গুডিয়া (King Gudea); রাজত্ব- ২০৮০-২০৬০ খ্রিষ্টপূর্ব
তখনো সাধারণ নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় নি। স্ত্রী-রক্ষিতার মাঝে তফাৎ ছিল না খুব একটা। বরং রক্ষিতাদের স্বাধীন জীবনের তুলনায় স্ত্রীদের উদয়াস্ত সংসারের হাজারো কাজ করতে হতো। একজন পুরুষের যথেচ্ছ বেশ্যাগামী হবার অধিকার ছিল, কিন্তু এক্ষেত্রে নারীদের একমাত্র শাস্তি ছিল মৃত্যুদন্ড। স্বামী বা পিতার মৃত্যুতে সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়া থেকেও সম্পূর্ণ বঞ্চিত হতো নারীরা।
সাধারণ নারীদের এমন অবস্থার উত্তরণে সর্বপ্রথম পদক্ষেপ নেন সুমেরীয় নগর লাগাশের রাজা গুডিয়া। ছেলেদের মতো মেয়েদেরও সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবার আদেশনামা জারি করেন এই মহান রাজা। বিধবা, এতিম, দুঃস্থ নারীদের জন্য অসীম কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসে এই আইন।
গুডিয়া সিলিন্ডার বলে সুপরিচিত দুটি পোড়ামাটির সিলিন্ডার এবং কিছু শিলা খন্ডে পাওয়া যায় কিং গুডিয়ার আইন এবং আরাধনার বর্ণনা সমূহ।


রাজা গুডিয়ার সিলিন্ডার

ব্যাবিলনের রাজা হাম্মুরাবি (King Hammurabi); রাজত্ব- ১৭৯২-১৭৫০ খ্রিষ্টপূর্ব
বিভিন্ন আশ্চর্য নির্মান শিল্প উপহার দেওয়ার পাশাপাশি ব্যাবিলন সাম্রাজ্যের অন্যতম অবদান ছিল মানব ইতিহাসে প্রথম পরিপূর্ণ আইন প্রণয়ন। ইতিপূর্বে সুমেরীয় নগর রাজ্যগুলোতে নিজস্ব আইন বা কোড প্রচলিত থাকলেও কোনটাই ব্যাবিলনের দিগ্বিজয়ী রাজা হাম্মুরাবির মতো এতোটা সুলিখিত, ব্যাপৃত এবং বৈষম্যহীন ছিল না।


চেয়ারে বসা ব্যাবিলন গড শামাস/মারদুকের উদ্দেশ্যে আইনমালা উৎসর্গ করছেন রাজা

পোড়া মাটি এবং শিলায় উৎকীর্ণ ৪১৩০ লাইনে রাজার নির্দেশ মতো ২৮২টি আইন বা কোড লিপিবদ্ধ করা হয়। এর মাঝে ধারা ১২৭ হতে ১৯৪ পর্যন্ত মোট ৬৮টি কোড প্রণীত হয়েছিল শুধুমাত্র পারিবারিক সমস্যা সমাধানের জন্য। বিয়ে, তালাক, দেনমোহর, অসুস্থ স্ত্রীর সেবা, এই সবই স্থান পেয়েছিল ইতিহাস বিখ্যাত ‘হাম্মুরাবি কোডে’। এমনকি পরবর্তী ধর্মমতগুলোতেও এই আইনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব দেখতে পাওয়া যায়।

গ্রীক দার্শনিক প্লেটো (Plato); ৪২৭-৩৪৭ খ্রিষ্টপূর্ব


গ্রীক দার্শনিক প্লেটো

প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো একজন প্রথিতযশা নারীবাদ হিসেবে অনেকের কাছেই গৃহীত। দি রিপাবলিক গ্রন্থে তিনি যে আদর্শ রাষ্ট্রের বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে নারীরা যে কোন ক্ষেত্রে পুরুষের সমান ক্ষমতা অর্জন করতে পারবে। তিনি পশু সমাজের উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, আমরা তো শুধু পুরুষ কুকুরকে দিয়ে পাহারা দেওয়াই না, এতো এতো বাচ্চা দেওয়ার পরেও স্ত্রী কুকুর পাহারা, শিকার, সব কাজই করে যাচ্ছে। উনি নারীদের শিক্ষার উপর সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীদের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করায়, আধুনিক নারীবাদীদের চোখে তিনি মিঃ পারফেক্ট ফ্যামিনিস্ট হতে পারেনি।
আর প্লেটোর নারীবাদ তত্ত্ব অনেকটাই ম্লান হয়ে যায় পরবর্তীতে উনার জগদ্বিখ্যাত, তীব্র নারীবিদ্বেষী ছাত্র এরিস্টটলের কল্যাণে।

আব্রাহামিক ধর্মের প্রবর্তক বৃন্দ
একটা দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে শুধুমাত্র ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক ছাড়া খ্রিষ্ট এবং ইহুদী, কোন ধর্মের প্রবর্তকেরই ঐতিহাসিক প্রমাণাদি পাওয়া যায় না। শুধুমাত্র ধর্মগ্রন্থই তাদের ব্যাপারে জানার মূল তথ্য সূত্র। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে যথেষ্ট ঐতিহাসিক তথ্য প্রমাণ থাকার পরেও মুসলমানেরাও ধর্মীয় নেতাদের বক্তব্যকেই তথ্যের একমাত্র উৎস বলে মনে করে। তাই অথেন্টিসিটি নিয়ে তাদেরও গর্ব করার কোন সুযোগ নেই।

হযরত মুসা আঃ (Moses); আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৩শতক থেকে ১৬শতক এর মাঝে


ইতিপূর্বে বলেছিলাম ব্যাবিলনিয়ান রাজা হাম্মুরাবির আইনমালা পরবর্তী ধর্মমতে প্রভাব ফেলেছে। মুসা নবীর টেন কমান্ডমেন্টসেও নারীর দায়িত্ব, কর্তব্য, অধিকার বিষয়গুলো এসেছে; বরং ইহুদী ধর্মে নারীকে পুরুষের প্রায় সমকক্ষ হিসেবে স্থান দেওয়া হয়েছে। ক্রিতদাসের ঘরে জন্ম ছিল বিধায় মোজেস বা মুসা নবী তাদের প্রতি অনেক উদার ছিলেন। এক্ষেত্রেও একজন পুরুষ ক্রিতদাসের পূর্বে একজন নারী ক্রিতদাসের মুক্তির বিধান আছে তাওরাতে। এসব বিবেচনায় হযরত মুসা আঃ কে আদর্শ নারীবাদী বলাই যায়।

যিশু খ্রিস্ট (Jesus); খ্রিষ্টপূর্ব ০৪ – আনুমানিক ৩৩ খ্রিষ্টাব্দ
শুধুই মাতৃ সাহচর্যে জন্ম এবং বড় হওয়া যিশু খ্রিস্ট নারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবেন সেটা সহজেই অনুমেয়। বাইবেলের গস্পেলগুলোতে উনার সাথে অনেক নারীর ঘটনাক্রম পাওয়া যায়। যার মাঝে রোগ সাড়িয়ে তোলা থেকে বিধবার মৃত সন্তানকে ফিরিয়ে দেবার মতো মিরাকলীয় ঘটনাও রয়েছে। যেহেতু বাকি দুই ধর্মের প্রবর্তকের মতো যিশু খ্রিস্ট কোন গোত্র বা অঞ্চলের শাসক ছিলেন না, তাই উনার কোন সরাসরি নির্দেশ বা বিধান সচরাচর মিলে না। তাও বাইবেলে অসংখ্য নারীর ঘটনা বর্ণনা হতে বুঝা যায়, নারীরা সেসময় অনেক স্বাধীন ছিল এবং ইচ্ছাপূরণ বা পূণ্য কামনায় যিশু খ্রিস্টকে স্পর্শ করার অনুমতিও তাদের ছিল।


মেরি মেগডালিয়ান
এক্ষেত্রে ম্যারি মেগডালিয়ানের (Mary Magdalene) কথা না বললেই নয়, যাকে আমরা ভিঞ্চি কোডের মাধ্যমে অনেকেই চিনেছি। ক্রুশবিদ্ধ হবার আগ পর্যন্ত যিনি যিশুর পাশে ছিলেন এবং ১৯৬৯ সালে ক্যাথলিক চার্চ তাকে দুশ্চরিত্রার পরিবর্তে যিশুর পবিত্র অনুসারী বলে রায় দেয়। পরবর্তীতে ধামাচাপা দেওয়া হলেও যিশুর অনুসারীদের মাঝে নারীদের গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই।

হযরত মুহাম্মদ সাঃ, ৫৭০-৬৩২ খ্রিষ্টাব্দ
আব্রাহামিক ধর্মের প্রবর্তকদের মাঝে সবশেষে আলোচনায় আসে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। কিন্তু বাকি দুই প্রবর্তকের তুলনায় উনার পরিপার্শ্বের একটা মোটা দাগের পার্থক্য শুরুতেই চোখে পড়ে।
প্রথমত মুসা নবী বা মোজেসের আবির্ভাব হয়েছিল মূলত মিশরীয় সভ্যতার স্বর্ণযুগ এর সময়। এবং দ্বিতীয়ত যিশু খ্রিস্টের জন্ম হয়েছিল আধুনিক নগর আইন মেনে চলা রোমান শাসিত অঞ্চলে। সেই তুলনায় প্রফেট মুহাম্মদ (সাঃ) পেয়েছিলেন আইয়ামে জাহেলিয়াত নামে আখ্যায়িত বর্বর আরব ভূখণ্ড। আভিজাত সমাজে কিছুটা মর্যাদা পেলেও সমাজের নিম্নস্তরে মেয়েদের বাজারের পণ্য হিসেবে কেনাবেচা, কন্যা শিশুকে হত্যা করা এসব ছিল অহরহ ঘটনা। এমন পরিস্থিতিতে নারীদের স্বার্থে কার পক্ষে কতোটুকু করা সম্ভব হতো জানা নেই। তবে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) একজন নারীকেই প্রথম মুসলমান ধর্ম গ্রহণের সম্মান প্রদান করেন, তাদের বাজারের পণ্য হওয়া থেকে রক্ষা করেন, সম্পত্তির উত্তরাধিকার হওয়ার হক প্রদান করেছেন এবং শিক্ষা গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছেন।
মক্কা জয়ের পর নারীদের কোন রকম অত্যাচার নির্যাতনের মাঝে পড়তে হয়নি। এমনকি নিজের চাচা হযরত হামজা রাঃ এর কলিজা চিবিয়ে খাবার পরেও আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সেসময় যুদ্ধ, অভিযানেও মেয়েরা মুসলিম সাহাবাদের সাথে অংশ নিতো। উহুদের যুদ্ধে নবীকে রক্ষার জন্য চারপাশে ব্যূহ সৃষ্টিকারীদের মাঝে অন্যতম ছিলেন একজন নারী সাহাবা নুসাইবা বিনতে কা’ব।
পরবর্তী যুগে যাই ঘটুক, আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে হযরত মুহাম্মদ সাঃ একজন উদার নারীবাদী ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই।

সনাতন হিন্দু ধর্ম
যেহেতু সনাতন যুগে হিন্দু ধর্মের একক কোন প্রবর্তক পাওয়া যায় না। তারপরেও বিভিন্ন শাস্ত্রে নারীর জন্য কল্যাণকর বিধানের বর্ণনা রয়েছে। মনু স্মৃতি অনুযায়ী একজন পুরুষের তত্ত্বাবধানে নারীরাও সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে পারে। মহাভারতে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে শিখন্ডির ভূমিকা দেখতে পাই। এছাড়া রাজকন্যাদের সয়ম্বর অনুষ্ঠানেও নারীদের নিজের বর নিজেই পছন্দ করার ক্ষমতাও দেখতে পাওয়া যায়। তবে উনিশ শতকে সতীদাহ রদ এবং বিধবা বিবাহ চালুর পূর্বে হিন্দুধর্ম নারীর স্বার্থ রক্ষায় কিছুটা পিছিয়েই ছিল বলা চলে।


রাজকন্যার সয়ম্বর

মধ্যযুগীয় প্রখ্যাত নারীবাদী
ক্রিস্টিন ডি পিৎসান (Christine De Pizan); ১৩৬৪-১৪৩০ খ্রিষ্টাব্দ
খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতকের ইটালির এই রাজকবি পরিচিত ছিলেন ইউরোপের প্রথম ‘ওম্যান অব লেটার’ হিসেবে। রাজ পরিবারের সদস্য ও বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে উপদেশমূলক কাব্য রচনা করতেন তিনি। ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধের সমকালীন তার লেখাসমূহ ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হয়।



তবে তার সবচেয়ে অসাধারণ দুটি কাজ ছিল The Book of the City of Ladies এবং The Treasure of the City of Ladies। তার মৃত্যুর শত বছর পর বই দুটি ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়। পরবর্তী শত শত বছর ধরে বই দুটি বিভিন্ন দেশে নারী লেখিকাদের উদ্বুদ্ধ করেছে নারী সমাজে জাগরনের বার্তা ছড়িয়ে দিতে। আমাদের দেশের বেগম রোকেয়া সাখাওয়াতের অনেক সাহিত্যকর্মও এই রচনাগুলো থেকেই অনুপ্রেরণা পাওয়া।

ক্যাথরিন অব অ্যারাগন (Catherine of Aragon); ১৪৮৫-১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দ
১৫৪৮ সালে ইংল্যান্ডের ইটন স্কুলের প্রধান শিক্ষক নিকোলাস উদাল মন্তব্য করেন, “সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইংল্যান্ডের তরুণী মেয়েদের শিক্ষা গ্রহণে যে উৎসাহ, উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে তা ইতিপূর্বে কখনোই দেখা যায়নি। শিক্ষার খাতিরে তারা তাদের প্রিয় মুহূর্তগুলোও বিসর্জন দিতে রাজি”।


রাণী ক্যাথরিন
নারী সমাজের এই অভূতপূর্ব পরিবর্তনে সম্পূর্ণ অবদান ছিল ইংল্যান্ডের রাণী রাজা অষ্টম হেনরীর প্রথম স্ত্রী ক্যাথরিন অব অ্যারাগনের। উনার আরেকটি পরিচয় হচ্ছে স্পেনের বিখ্যাত রাজ দম্পত্তি ইসাবেলা-ফার্ডিনান্ডের কন্যা তিনি। কলম্বাসের অভিযান, গ্রানাডায় মুসলিম পতন এমন অনেক কিছুর সাথেই জড়িত আছে এই দম্পত্তির নাম।
স্পেন-ব্রিটেনের কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নে ক্যাথরিনের সাথে ব্রিটিশ যুবরাজ আর্থারের বিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু অল্প কয়েক মাসের মাথায় যুবরাজ মারা গেলে ছোট রাজপুত্র হেনরির সাথে ক্যাথরিনের বিয়ে হয়।
নিজের মাকে দেখেই ক্যাথরিনের ধারণা হয়েছিল উপযুক্ত শিক্ষা পেলে মেয়েরাও সব কিছু করতে পারে। ব্রিটেনের নারীদের অনগ্রসরতাও তাকে ব্যাথিত করতো।মূলত, নিজের একমাত্র কন্যা প্রিন্সেস মেরির জন্য মেয়েদের শিক্ষার উপযোগী বই প্রণয়নের নির্দেশ দেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ মানবতাবাদী টমাস মুর এবং শিক্ষাবিদ হুয়ান লুই ভাইভসের প্রচেষ্টায় এবং রাণী ক্যাথরিনের অকুণ্ঠ সমর্থনে ইংল্যান্ডে নারী শিক্ষার জোয়ার শুরু হয়। ডাচ দার্শনিক ইরাসমাসের নারীবাদী গ্রন্থগুলোও অনুবাদ করে ইংল্যান্ডের মেয়েদের পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়।
সমগ্র গ্রেট ব্রিটেন, এমনকি ইউরোপ জুড়েই নারী জাগরণের ঢেউ লাগে। আর ক্যাথরিন অব অ্যারাগন স্বীকৃত হন ব্রিটেনে নারী জাগরণের পথিকৃত হিসেবে।

পরিশেষ
আলোচ্য ব্যক্তিদের পরে এবং মধ্যবর্তী সময়ে আরও অনেকেই নারীদের উন্নতিতে ভূমিকা রেখেছে। স্বাভাবিক ভাবেই স্থানাভাবে ব্লগপোস্টে সবার কথা বলা সম্ভব নয়। যুগে যুগে নারীদের মৌলিক অধিকার আদায়ের জন্য অনেকেই সরব হয়েছেন, এখনো এই আন্দোলন চলছে। তবে বর্তমান যুগে মৌলিক অধিকারের সাথে আরও অনেক অধিকার, দাবীনামা সংযুক্ত হওয়ায় তর্ক বিতর্কের অবকাশও বেড়ে গেছে। আধুনিক নারীবাদীদের দৃষ্টিতে অনেক প্রাচীন নারীবাদীই নারী বিদ্বেষী বলে প্রমাণিত হবে। বেশীরভাগ ধর্মেরই প্রবর্তক পরবর্তী অনুসারীরা নারীদের অধিকারের প্রতি কঠোরহস্ত হয়েছেন, প্রবর্তকের শিক্ষা থেকে দূরে সরে এসেছেন।

পৃথিবীতে যে জাতি উন্নত হয়েছে তারা নারীদের অধিকার এবং মর্যাদা পূরণ করেই হয়েছে। নারীদের অধিকার অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নেই।
“আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো”- যতোদিন পৃথিবীর বুকে মানুষ থাকবে নেপোলিয়নের এই অমর বাণী সত্য হয়েই থাকবে।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ দুপুর ২:২০
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বন্ধুর বউ কে শাড়ি উপহার দিলেন ব্যারিস্টার সুমন। বাটার প্লাই এফেক্ট এর সুন্দর উদাহারন।

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:০৭



এক দেশে ছিলো এক ছেলে। তিনি ছিলেন ব্যারিস্টার। তার নাম ব্যারিস্টার সুমন। তিনি একজন সম্মানিত আইনসভার সদস্য। তিনি সরকার কতৃক কিছু শাড়ি পায়, তার জনগণের মাঝে বিলি করার জন্য।... ...বাকিটুকু পড়ুন

ড্রাকুলা

লিখেছেন সুদীপ কুমার, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১২

কোন একদিন তাদের মুখোশ খুলে যায়
বেরিয়ে আসে দানবীয় কপোট মুখায়ব।

অতীতে তারা ছিল আমাদের স্বপ্ন পুরুষ
তাদের দেশ ছিল স্বপ্নের দেশ।
তাদেরকে দেখলেই আমরা ভক্তিতে নুয়ে পড়তাম
ঠিক যেন তাদের চাকর,
অবশ্য আমাদের মেরুদন্ড তখনও... ...বাকিটুকু পড়ুন

অধুনা পাল্টে যাওয়া গ্রাম বা মফঃস্বল আর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া শহুরে মানুষ!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০০


দেশের দ্রব্যমুল্যের বাজারে আগুন। মধ্যবিত্তরা তো বটেই উচ্চবিত্তরা পর্যন্ত বাজারে গিয়ে আয়ের সাথে ব্যায়ের তাল মেলাতে হিমসিম খাচ্ছে- - একদিকে বাইরে সুর্য আগুনে উত্তাপ ছড়াচ্ছে অন্যদিকে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমুল্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪১

সাম্প্রতিক দুইটা বিষয় ভাইরাল হতে দেখলাম।
১. এফডিসিতে মারামারি
২. ঘরোয়া ক্রিকেটে নারী আম্পায়ারের আম্পায়ারিং নিয়ে বিতর্ক

১. বাংলা সিনেমাকে আমরা সাধারণ দর্শকরা এখন কার্টুনের মতন ট্রিট করি। মাহিয়া মাহির... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের (সা.) পক্ষ নিলে আল্লাহ হেদায়াত প্রদান করেন

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ৩০ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:৪২



সূরা: ৩৯ যুমার, ২৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
২৩। আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদিস, যা সুসমঞ্জস্য, পুন: পুন: আবৃত। এতে যারা তাদের রবকে ভয় করে তাদের শরির রোমাঞ্চিত হয়।অত:পর তাদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×