৫ বছর ৭ মাস ৯ দিন । অনেক লম্বা সময় । দেখতে দেখতে কেটে গেল । দিয়ে গেল অসংখ্য স্মৃতি । খারাপ – ভাল মেশানো । পরিমান হিসেব করলে খারাপের সংখ্যা ভালোর তুলনায় বেশী । আবার গুরুত্ব বিবেচনায় একটি সুখস্মৃতি কয়েকশ’ খারাপকে আড়াল করে দেয় । একবার মনে হয় ... ইশ্ ... দিনগুলো কেন শেষ হল । পরক্ষণেই বাস্তবে ফিরে আসি... নিজেকে বলি ... শেষ হয়েছে আল্লাহর রহমতে, বেঁচে গেলাম ।
১৫ই এপ্রিল, ২০০৬ । ভীত, সন্ত্রস্ত পদক্ষেপে অনার্স লাইফের প্রথম ক্লাস করতে আসি এ ক্যাম্পাসে । কেমন না কেমন হয় ক্লাসের সবাই ? ভাল বন্ধুর সন্ধান পাবো তো ? শুনেছি, স্কুল আর বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক বেশি দৃঢ় হয় । স্কুলে তেমন বন্ধু হয়নি আমার । কলেজে ভাল কিছু বন্ধু পেয়েছিলাম, কিন্তু ভার্সিটির ফ্রেন্ডরা কেমন হয় সে নিয়ে ছিল সংশয় । সব সংশয় দূর করে বেশ কিছু তথাকথিত ভালো (!!!) বন্ধু পেয়েছিলাম । আল্লাহর অশেষ রহমতে তাদের মধ্যে এক জন ছাড়া আর কারো সাথে এখন আর কথাবার্তা হয় না । এদের মত বন্ধু থাকলে শত্রুর অভাব হয় না ।
দেড় বছর অনেক মজায় কাটানোর পর স্বার্থপর বন্ধুদের প্রকৃত চেহারা দেখতে পেলাম । স্বান্তনা একটাই । আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, ভালোবাসার মানুষটি , যে না থাকলে বাকি বছরগুলো এখানে কাটানো আসলেই অসম্ভব হয়ে দাড়াত আমার জন্য । পৃথিবীতে সবচেয়ে খারাপ জিনিসটারও একটা না একটা ভাল দিক থাকে । এই অভিশাপের ন্যায় ভার্সিটি লাইফেও একমাত্র যে মানুষটির জন্য গর্ববোধ করি, আল্লাহর শোকর করি , এই মানুষটিই আমার ভার্সিটির বলতে গেলে একমাত্র প্রাপ্তি । অবশ্য এছাড়া ২-৩ জন ভাল বন্ধুর দেখা পেয়েছি , যারা এ ৫ বছর আমার অনেক উপকার করেছে । তাদের কথা কখনওই ভুলব না ।
একজন আরেকজনের উপর ভরসা করে ধীরে ধীরে অনার্স পাশ করলাম । এবং মাস্টার্স পরীক্ষা দিলাম । এতদিনে এই ক্যাম্পাসে অনেক কিছুই সহ্য করেছি । এই তো , আর বেশিদিন না ... এই বলে দাঁতে দাঁত চেপে পার করেছি ৫টি বছর । সেই পাচটি বছর অবশেষে শেষ হয়ে গেল । অভিশপ্ত সেই ডিপার্টমেন্টে আর যাওয়া লাগবে না । কলঙ্কিত কিছু মুখ আর দেখা লাগবে না । খুবই খুশি লাগছে ।
বিদায় উপলক্ষে আয়োজন করা হল ক্লাসের সকলকে নিয়ে আড্ডা । সবকিছু কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলে গিয়েছিলাম সেদিন সকলের সাথে দেখা করতে শেষ বারের মত । বিকালের নাস্তা করে সবাই মিলে পুরো ক্যাম্পাস ঘুরলাম । খুব যে ভাল লাগছিল তাও না , তবে খারাপ লাগছিল না । তখন পর্যন্ত একবারের জন্যও খারাপ লাগেনি ক্যাম্পাসটা ছেড়ে যাবো বলে । খারাপ লাগল একটু পরেই । টিএসসির পেছনে যকলে মিলে গল্প করছিল , আমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম । হঠাৎ ক্লাসের বাশার নামে একজন এসে জড়িয়ে ধরল আমাকে । বুঝে উঠতে পারলাম না হলোটা কি । আজ তো ঈদও না যে কোলাকুলি করবে । চেয়ে দেখি ওর চোখে জল । আমি কিছু বলার আগেই বলল, “আর তো দেখা হবে নাকি ঠিক নেই, যদি কোন ভুল করে থাকি মাফ করে দিস”... অবাক হয়ে গেলাম । যে ২-৩ জন বন্ধুর কথা বলেছিলাম এই বাশার তাদের একজন । অনেক ভাল ছাত্র । ক্লাসের সবচেয়ে ভদ্র ছেলেদের একজন । যারা এ পাঁচ বছর অনেক ক্ষতি করেছে, তারা কিছু বলল না , আর মাফ চাইল বাশারের মত একটা ছেলে । পড়ালখায় অনেক সাহায্য করেছে আমাকে । অনেক উপকার করেছে । আর সবচেয়ে বড় উপকারটা করে গেল এই বিদায়ের সন্ধ্যায় । মনে করিয়ে দিল, এতগুলো বছরে আমার খারাপ জিনিসের পাওয়াটা হয়ত অনেক বেশি, কিন্তু কিছু ভাল জিনিসও আমি পেয়েছি । যা অমূল্য । ২-৩ জন ভাল বন্ধু, একজন ভালবাসার মানুষ ... সত্যিই আর কিছুই চাওয়ার নেই । নেই কোন অপ্রাপ্তির হতাশা । একটা বড় শিক্ষা দিয়ে গেল আমাকে । জীবনে ভালোর চেয়ে খারাপ ঘটনা ঘটে বেশি । কিন্তু খারাপ থেকেও যে ভালোটা খুজে নিতে পারে সেই সফল মানুষ ।
বাশার চলে যাওয়ার পরই প্রথমবারের মত একটু মন খারাপ করে উঠল এই ক্যাম্পাসের জন্য । যদিও সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি কিছু অপ্রীতিকর ঘটনার জন্য । তারপরও বাশারের কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকব শেষ মুহূর্তে বোধদয় করানোর জন্য । দোয়া করি সে ভাল থাকুক, অনেক সফল হোক । আসলে ওর জন্য দোয়া করা ছাড়া আর কোন কিছু করার সামর্থ নেই আমার । এ জন্যই এই লেখা ।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




