বদরুদ্দিন উমরের জাতির জনক প্রসঙ্গে লেখাটি পড়লাম। লেখাটি পড়ে
হাজার ভেবেও কিছু কুল-কিনারা করতে পারলাম না। এই একটি লেখা
আমার সব চিন্তা সম্পূর্ণ উলট পালট করে দিল। আমি হুবহু তার লেখাটি
ডনচে তুলে ধরছি। আশা করছি লেখাটি একবার হলেও সবাইকে চিন্তা করতে বাধ্য করবে।
"একটি দেশে কোন কীর্তিমান ব্যক্তিকে জাতির জনক হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রবণতা কোন কোন পশ্চাৎপদ এবং অনগ্রসর দেশে দেখা যায়।কালের হিসেবে বলা যেতে পারে, এর শুরু বিংশ শতাব্দীর প্রথম চতুথর্াংশে। যে দেশ গুলোতে এটা দেখা যায়,তার মধ্যে একমাত্র তুকর্ী ছাড়া অন্য সবাই ছিল কোন না কোন ইউরোপীয় রাষ্ট্রের উপনিবেশ। তুকর্ী নিজে ছিল একটি ঔপনিবেশিক শক্তি,যাকে আখ্যায়িত করা হত অটোম্যান এম্পায়ার নামে।
... কামাল পাশা তুকর্ীর অধিষ্ঠিত হয়ে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন একটি সেকু্যলার রাষ্ট্র।তিনি তুকর্ী সমাজ আধুনিকীকরণের জন্য অনেক পদক্খেপ নেন। এর মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্খার আধুনিকীকরন ও নারী সমাজের স্বাধীনতার ঊদ্দেশ্যে বিবিধ পদক্খেপ,যার মধ্যে সর্বপ্রধান ছিল কঠোর পদর্া প্রথার পরিপূর্ণ উচ্ছেদ। কামাল পাশা যা কিছু করেছিলেন তার বিস্তারিত বিবরন আমাদের এ আলোচনার জন্য প্রয়োজন নেই। এখানে যতটুকু বলা হয়েছে তা থেকে বুঝা যায়, তিনি তুকর্ীতে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রবর্তন না করলেও তুকর্ী সমাজের যে পরিবর্তন তিনি সাধন করেছিলেন তার চরিত্র অবশ্যই ছিল বৈপ্লবিক। এ পরিবর্তন দ্বারা মুগ্ধ হয়ে এবং কামাল পাশা একজন প্রভাবশালী জেনারেল বা সমরনায়ক ও বিশাল রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইউরোপের দ্বারাও স্বীকৃত হওয়ায় তুকর্ীরা নতুন সমাজের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তাকে আখ্যায়িত করেছিল আতা তুর্ক বা তুর্কির পিতা হিসেবে।
এখানে মনে রাখা দরকার,কামাল পাশার নেতেৃত্বে যে সময় তুর্কিতে এ পরিবর্তন ঘটছিল সেই একই সময়ে রাশিযায় হয়েছিল লেলিনের নেতৃত্বে। লেলিনের নেতৃত্বাধীন কমিউনিস্ট পার্টি সেখানে সমাজ ও রাস্ট্র ব্যবস্থার যে পরিবর্তন সৃস্টি করেছিল সেটা ছিল তুর্কির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের থেকেও অনেক বেশী গভীর ও মৌলিক। কিন্তু সোভিয়েট ইউনিয়নে লেলিনকে জাতির পিতা আখ্যা দেয়ার কোন প্রশ্নই ছিল না।
... রাশিয়ার পর চীন,ভিয়েতনাম,উত্তর কোরিয়া,কিউবা প্রভৃৃতি দেশে কমিউনিস্ট নেতৃত্বাধীন বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, সেখানে সমাজের ভিত্তিভূমি ও কাঠামো তে আমূল পরিবর্তন সাধিত হলেও এসব দেশের কোনটিতেই বিপ্লবের নেতাকে জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করার চিন্তা তাদেও থাকেনি। কারন বিপ্লব ও সমাজ পরিবর্তন সম্পর্কে এ ধরনের ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা যে বাস্তবতা এবং ঐতিহাসিক ভাবে ভিত্তিহীন, এ বিষয়ে তাদের আদর্শই তাদের সচেতন রেখেছিল। কাজেই পশ্চৎপদ দেশে সেসব বিপ্লব ঘটলেও জাতির পিতৃত্ব কারো উপর অর্পণ করার মত পশ্চৎমুখী এবং ঐতিহাসিক চেতনাবিহীন চিন্তার কোন উদ্ভব সে দেশ গুলোতে হয়নি। ইতিহাসে লেলিন,মাও সে তুং, হো চি মিন, কিম ইল সুং, কাস্ত্রোর মত অন্যান্য দেশের অনেক নেতারাও আছেন। কিন্তু এটা অবশ্যই মনে রাখা দরকার যে, উপরোক্ত ব্যাক্তিরা যেমন ইতিহাস সৃস্টিতে সহায়তা করেন, তেমনি তারা নিজেরাও ইতিহাসের সৃস্টি, যে সৃস্টিকার্যে প্রত্যেক দেশের সামাজিক সম্পর্ক ও জনগনের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
... ইতিহাসে আর একটি দেশের জাতির জনকের চিন্তার উদ্ভব হওয়ার মত ব্যাপার ঘটতে পারত; কিন্তু তা ঘটেনি। সে দেশটি হল মার্কিন যুক্তরাস্ট্র। ইউরোপিয়ানদের দ্বারা সেই মহাদেশ আবিস্কৃত হওয়ার পর যুক্তরাস্ট্র নামে পরিচিত বর্তমান অংশে বহু জাতির লোকের আগমন ও বসবাস শুরু হয়। থাদেও মধ্যে রক্তের মিশ্রন চলতে থাকে এবং প্রক্রিয়া শুরু হয়, এক নতুন মিশ্রিত জাতি গঠিত হওয়ার। সেখানে একটি রাস্ট্রীয় ব্যবস্থার পত্তন হয় এবং তার ভিত্তি স্বরুপ তৈরী হয় এক সংবিধান। এ ব্যাপারে জর্জ ওয়াশিংটন, টমাস জেফারসন, ম্যাডিসনের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ; তাদেরকেও জাতির জনক আখ্যা দেয়া যেত; কিন্তু তা হয়নি। কারন তাদের মধ্যেও ছিল ইউরোপের উন্নত ও প্রগতিশীল চিন্তার ধারাবাহিকতা। এ কারনে তাদেও ভূমিকা কে যথাযোগ্যভাবে উপত্থিত করার উদ্দেশ্যে তাদের আখ্যায়িত করা হয়েছিল জাতির জনক হিসেবে নয়; তাদেও আখ্যায়িত করা হয়েছিল 'সংবিধানের পিতৃস্খানীয় প্রতিষ্ঠাতা' হিসেবে। এ আখ্যা যথার্থ ছিল। কারন মার্কিন যুক্তরাস্ট্রের সংবিধান, যা আজো বলবৎ আছে, তার রচিয়তা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তারা।
ভারতবর্ষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ও পাকিস্থান উভয় অংশেই জাতির পিতা হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেছিল যথাক্রমে মোহনদাস করমচাদঁ গান্ধী ও মো: আলী জিন্নাহ্ কে।
... ভারতবর্ষ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে স্বাধীন হওয়ার পর ঔপনিবেশিক চিন্তাধারার প্রভাবেই গান্ধী ও জিন্নাহ্ কে জাতির জনক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এ আখ্যা লাভ করা সত্ত্বেও তাদেও এ পিতৃত্ব নিয়ে কেউই ব্যস্ত নয় এবং পিতৃত্বেও এই খেতাব এখন ঐতিহাসিকভাবে তাদের গলায় শুকিয়ে যাওয়া মালার মতই ঝুলছে। কার্যত এর বিন্দুমাত্র গুরুত্ব নেই। এ ধরনের এক চেষ্টা ইন্দোনেশিয়াতেও হয়েছিল। ডাচদেও থেকে ইন্দোনেশিয়া স্বাধীন হওয়ার পর স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদী নেতা হিসেবে সুকণ কে বুং কানের্া বা পিতা কানের্া নামে অবিহিত করা হয়েছিল;কিন্তু তারও পরিনতি দাড়িয়েছিল একই প্রকার।
... প্রত্যেক ব্যক্তিই কোন না কোন জাতির মধ্যে জন্মগ্রহন করেন। কাজেই ব্যক্তির আগে হল জাতি। কোন ব্যক্তিকে জাতির পিতা বলতে যাওয়া তাই এমন এক অবাস্তব ব্যাপার,যা নিয়ে যুক্তি,বিচার ও বিশদ ব্যাখ্যার প্রয়োজন পরে না।
... বাঙ্গালী জাতির হাজার বছরের ইতিহাসের কথা বাদ দিয়ে যদি আমরা শুধু 18,19 ও 20 শতকের দিকে তাকাই তাহলে দেখব এই জাতির মধ্যে জন্মলাভ করেছেন রামমোহন রায়, দ্বারকারনাথ ঠাকুর, মাইকেল মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র, মীর মোশাররফ হোসেন, নবাব আবদুল লতিফ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জগদীশচন্দ্র বসু, ফজলুল হক, ড: মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবদুল হামিদ খান ভাসানী...। অন্য আরও অসংখ্য কৃতী ও মহান বাঙ্গালী জন্মলাভ করেছেন, যাদেও সবার নাম এখানে উল্লেখ করা সম্ভব নয়। এছড়াও এ বাঙ্গালী জাতির অনর্্তভুক্ত থেকেছেন কোটি কোটি মানুষ, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যুগ যুগ ধরে এই জাতির জীবন সচল রেখেছেন।
যে জাতির মধ্যে উপরোক্ত ব্যক্তিরা জন্মলাভ করে নিজেদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভূমিকা স্বীকৃত বা অস্বীকৃত ভাবে পালন করেছেন, তারা যদি বাঙ্গালি হন, তাহলে শেখ মুজিব সেই বাঙ্গালি জাতির জনক কীবাবে হতে পারেন? কাজেই শেখ মুজিবকে বাঙ্গালি জাতির জনক আখ্যায় ভূষিত করলে তাকে হতে হবে এমন এক জাতির জনক,যা 1971 পূর্ববতী বাংলার এবং সেই সঙ্গে পূর্ব বাংলার বাঙ্গালি জাতি থেকে ভিন্ন। শুধু ভিন্নই নয়,যোগসূত্রহীন। এই যোগসূত্রহীনতা যে ঐতিহাসিকভাবে অলীক কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়,তা বলাই বাহুল্য। তবে এটা হতে পারে যে,1971 সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশের বাঙ্গালিরা এমন বিশেষ কিছু চরিত্র অর্জন করেছেন,যার ভিত্তিতে তাদেও কেউ হয়ত বিশেষভাবে আখ্যায়িত করতে পারেন। জিয়াউর রহমান এ কাজটি করেছিলেন এবং 1971 এর পরবতর্ী জাতিকে তিনি আখ্যায়িত করেছিলেন 'বাংলাদেশী' জাতি হিসেবে। অভিধা হিসেবে যে শব্দ প্রয়োগযোগ্য বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকদেও জন্য, সেটাকেই জিয়াউর রহমান প্রয়োগ করেছিলেন জাতির পরিচয় হিসেবে। এই জাতি পরিচয়কে অবলম্বন করেই নিজেকে দাড় করিয়েছিলেন 'বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ' এর প্রবক্তা রুপে। আগেই বলেছি, কোন ব্যক্তিকে জাতির জনক হিসেবে আখ্যায়িত করতে যাওয়া এক বিষম অবাস্তব চিন্তা। কিন্তু তা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের লোক, আওয়ামী ঘরানার বুদ্ধিজীবি সমপ্রদায় ও তাদেও গন্ডি বর্হিভূত কোন ব্যক্তি বা মহল যদি শেখ মুজিব কে জাতির জনক হিসেবে আখ্যায়িত করতে বদ্ধপরিকর থাকে,তাহলে তাদের অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, তিনি 1971 পূর্ববতী বাংলার জনক নন,তিনি 1971 পরবতর্ী বাংলার জনক। এদিক দিয়ে বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য উপরোক্ত জনকবাদীরে উচিৎ জিয়াউর রহমানের প্রতি কৃতঙ্গতা প্রকাশ করা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



