somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাজা টংকনাথের জমিদার বাড়ি

০৮ ই মার্চ, ২০১১ সকাল ৮:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সালেক খোকন
পিচঢালা চওড়া এক রাস্তায় চলছি আমরা। ঠাকুরগাঁও ছাড়া এ রকম রাস্তা দেশের অন্য কোন জেলা শহরে খুব একটা চোখে পড়বে না। মসৃণ রাস্তায় ছুটে চলছে আমাদের মাইক্রোবাসটি। মৃদুমন্দ দোলায় বাজছে রবীন্দ্র সংগীতের সূরে। চারপাশে অন্যরকম সবুজের হাতছানি। রাস্তার দু’পাশে পুরনো আমলের বড় বড় গাছ। ঝাকড়া গাছের ভেতর দিয়ে উকি মারছে নীল আকাশ। মনে হচ্ছিল ক্রমেই আমরা একটি সবুজ টেস্টটিউবের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। গানের সুরে চারপাশ দেখতে দেখতে আমরা যেন ক্রমেই কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যাচ্ছি।
ঠাকুরগাঁও থেকে রাণীশংকৈল উপজেলার দূরত্ব ৪০ কিলোর মতো। মসৃণ রাস্তায় চলার আনন্দে যে কেহই ভুলে যাবে দূরত্বটিকে। ঠাকুরগাঁও এসে ঐতিহাসিক মালদুয়ার জমিদার বাড়ির কথা শুনে রওনা হয়েছে রাণীশংকৈল উপজেলার দিকে।
রাণীশংকৈল এর কাছাকাছি রাস্তার দুদিকেও নানা জাতের সবুজ গাছে ভরা। চোখে পড়ছে বড় শিমুল গাছগুলো। পাতাবিহীন গাছগুলোতে বিপ্লবীবেসে ফুটে আছে অজ¯্র রক্তাক্ত লাল ফুল। এক ঝাক শালিক মনের আনন্দে ঠোটদিয়ে শিমুল ফুল থেকে কি যেন খুজছে। অবাক হয়ে আমরাও তাকিয়ে থাকি সে দিকে। শালিকগুলোর পাখার ঝাপটায় মাঝে মধ্যেই দু’একটা ফুল নিচে ঝরে পড়ছে।
ঘন্টা খানেকের মধ্যেই আমরা পৌছে যাই রাণীশংকৈল উপজেলা পরিষদের সামনে। মালদুয়ার জমিদার বাড়ীটি স্থানীয়দের কাছে রাজা টংকনাথের বাড়ি হিসেবেই অধিক পরিচিত।
আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল উপজেলার প্রতিভাবান সংস্কৃতকর্মী শামীম। সে জানালো রাণীশংকৈল নামকরণের কাহিনীটি।
উনিশশত খ্রীষ্টাব্দের প্রথম দিকে এ জনপদটি ছিল মালদুয়ার পরগণার অর্ন্তগত। পরে জমিদার বুদ্ধিনাথের ছেলে টংকনাথ বৃটিশ সরকারের আস্থা লাভ করতে ‘মালদুয়ার স্টেট’ গঠন করেন। রাজা টংকনাথ চৌধরীর স্ত্রীর নাম ছিল জয়রামা শঙ্করী দেবী। ‘রানীশংকরী দেবী’র নামানুসারে মালদুয়ার স্টেট হয়ে যায় ‘রাণীশংকৈল’।

শামীমের কথা আমরা মন দিয়ে শুনছিলাম। টংকনাথের গল্প শুনতে শুনতে আমরা এগুতে থাকি জমিদার বাড়িটির দিকে। উপজেলা থেকে মাত্র এক কিলো ভেতরে রাজা টংকনাথের বাড়ি।

প্রধান সড়কের ওপর ছোট্ট একটি ব্রিজ ঠেকলো। ভাঙ্গাচোড়া মাইলফলক দেখে জানা গেল এটিই কুলিক নদী। চর পড়া নদীটি এক সময় ছিল প্রমোত্ত।

ব্রিজ পেরিয়ে বামের ছোট রাস্তা দিয়ে নদী ঘেষা পথে খানিক এগুতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে রাজা টংকনাথ চৌধুরীর চমৎকার বাড়িটি।

আমরা ছুটে যাই প্রাচীন এই জমিদার বাড়িটির দিকে। বাড়িটিতে ঢুকতেই বড় এক সিংহদরজা। দরজার কারুকাজ দেখে আমরা ঢুকে পরি ভেতরে। লালা রঙের দালানটি যেন কালের সাক্ষি হয়ে দাড়িয়ে আছে। আমরা অবাক হয়ে দেখতে থাকি লাল দালানের ধারগুলো।

মনোরম এই বাড়ির প্রধানভবনটি এক সময় কারুকাজ খচিত ছিল। এর স্থাপত্য শৈলীতে আধুনিকতার ছোঁয়া যেমন আছে, তেমনি আছে প্রাচীন ভিক্টোরিয়ান অলংকরণের ছাপ। বিশেষ করে মার্বেল পাথর আচ্ছাদিত এই রাজবাড়ির মেঝের কাজ ছিল দেখবার মতো বিষয়। সেগুলো কিছুই এখন আর অবশিষ্ট নেই। মার্বেল পাথরের জায়গাটিকে আমরা হাত দিয়ে ছুয়ে দেখি।

রাজা টংকনাথের জমিদার বাড়ীর চারপাশ আমরা ঘুরে দেখি। বাড়ি সংলগ্ন উত্তর-পূর্ব কোনে কাছারি বাড়ি। পূর্বদিকে দুটি পুকুর। পুকুরের চারদিকে নানা ধরণের গাছগাছালি। জমিদার বাড়ি থেকে প্রায় দুশো মিটার দক্ষিণে রামচন্দ্র (জয়কালী) মন্দির। ধারণা করা হয় এই মন্দিরটি আরো প্রাচীন। জমিদার বাড়ি সামনে টাঙ্গানো তথ্য থেকে জানা যায় রাজা টংকনাথের নানা কাহিনী।
টংকনাথ মূলত একজন জমিদার ছিলেন। কথিত আছে, টাকার নোট পুরিয়ে জনৈক বৃটিশ রাজকর্মচারিকে চা বানিয়ে খাইয়ে টংকনাথ ‘চৌধরী’ উপাধি লাভ করেন। এরপর দিনাজপুরের মহারাজা গিরিজনাথ রায়ের বশ্যতা স্বীকার করে ‘রাজা’ উপাধি পান। তখন থেকে তিনি রাজা টংকনাথ চৌধরী।

মজার বিষয় হলো টংকনাথের পূর্বপুরুষ কেহই কিন্ত জমিদার ছিল না। টংকনাথের পিতা বুদ্ধিনাথ ছিলেন মৈথিলি ব্রাহ্মণ এবং কাতিহারে ঘোষ বা গোয়ালা বংশীয় জমিদারের শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েত। নিঃসন্তান বৃদ্ধ গোয়ালা জমিদার কাশীবাসে যাওয়ার সময় সমস্ত জমিদারি সেবায়েতের তত্ত্বাবধানে রেখে যান এবং তাম্রপাতে দলিল করে যান যে তিনি কাশী থেকে ফিরে না এলে শ্যামরাই মন্দিরের সেবায়েতই জমিদারির মালিক হবেন। পরে বৃদ্ধ জমিদার ফিরে না আসার কারণে বুদ্ধিনাথ চৌধুরী জমিদারি পেয়ে যান।

টংকনাথের গল্প শুনতে শুনতে আমরা পুকুরের দিকটায় হাঁটতে থাকি। পুকুরের অন্যপাশে টংকনাথের আমলে ছিল একটি হাতিশালা। আমাদের মনে হচ্ছিল প্রাচীণ কোন আমলে আমরা যেন চলে এসেছি।
ইতিহাসের প্রাচীণ এই রাজবাড়ীটি এখনও রয়েছে অরক্ষিত। রাজবাড়ি থেকে যখন বের হচ্ছি তখন বেশ কিছুলোকের জটলা লেগেছে গেইট মুখে। কয়েকজন বিদেশী পর্যটকদেরও দেখা মিলল সেখানে। প্রতিদিন এভাবেই দেশী বিদেশী পর্যটকদের হট্টগোলে রাজা টংকনাথের জমিদার বাড়ীর নিরবতা ভাঙ্গে। সত্যি, ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে টিকে আছে রাজা টংকনাথের অনন্য জমিদার বাড়িটি।
ছবি : লেখক
[email protected]

২টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×