আজ সকাল থেকেই হাসানের মন খুব খারাপ। কাজে যেতে ইচ্ছে করছে না। কত কাল হয়ে গেছে দেশ ছেড়ে সে প্রবাসে পড়ে রয়েছে। এখন আর মাস বছর মনে থাকে না। পরিবারের লোকজনের চেহারাও এখন অনেকটা ঝাপসা হয়ে এসেছে।
কত দিন বাবা-মা, ভাই-বোনদের দেখে না। ছোট ভাই-বোনটা কত বড় হয়েছে। হাসানের কাছে তাদের বয়স বাড়েনি। সেই অনেক কাল আগে তাদের সেই ছোট্রটি দেখে এসেছে। এখনও তার চোখে তাদের সেই ছেলেবেলাটাই ভেসে উঠে।
দেশে এখন কোন কাল চলছে। শীতকাল নাকি বর্ষা কাল। এই মরুর দেশেও মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই বৃষ্টির পানিতে দেশের বৃষ্টির মত মন আকুলি বিকুলি করে না।
শরীরটা কয়েক দিন ধরে ভাল যাচ্ছে না। থেকে থেকে জ্বর আসে। কিন্তু কাজে না গিয়ে কোন উপায় নেই। যে মালিকের কারখানায় সে কাজ করে সেই মালিক নিজের দামী হাত ঘড়িটা হারিয়ে ফেললে যেটুকু দুঃখ পাবে হাসান মারা গেলে সেটুকুও পাবে না। মালিকের কাছে তার পাসপোর্ট আটকানো রয়েছে। মালিক যতদিন না চাইবে ততদিন হাসান দেশে ফিরে যেতে পারবে না। অনেক দিন দেশের সাথে তার যোগাযোগ বন্ধ। মাস শেষে শুধু নাম মাত্র বেতন আর তিন বেলা খেতে দেয়া হয়। বাকী বেতন মালিক কেটে রেখে দেয় । মালিক যখন তাকে দেশে ফিরতে দেবে তখন তাকে তার পাওনা টাকা বুঝিয়ে দেয়া হবে। হাসান জানে বেশির ভাগ শ্রমিকের ক্ষেত্রেই মালিক তাদের কথা রক্ষা করে না। কিছু বলতে গেলে পুলিশের হাতে ধরিয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। অবৈধ বাঙালী শ্রমিকদের সাথে এই দেশের পুলিশ জন্তুর মত আচরণ করে।
মাঝে মাঝে রাতে হাসান চুপি চুপি কাঁদে। তার তখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে-বাবা ও বাব আমাকে তুমি দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাও। আমি আর এখানে থাকব না। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। ভাল চাকরির লোভে দেশে বাবার জমিজমা মার গহনা বিক্রি করে বিদেশে এসেছে। এখন ইচ্ছে করলেও খালি হাতে দেশে ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। মাঝে মাঝে হাসান দেশে ফোন করলে মা ফোন ধরে কাঁদেন আর বলেন ও বাব তুই ভাল আছিস। হাসান কোন উত্তর দিতে পারে না। শুধু তার বুকের ভেতর কান্না দলা পাকিয়ে উঠে।
অনেক দেশে পোষা প্রাণীদের অধিকার সংরক্ষণের জন্যে অনেক মানবাধিকার সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মতো অধিকার বঞ্চিত শ্রমিকদের জন্যে কেউ কি কখনও মাথা ঘামায়। তারাতো ঐ সব পোষা প্রাণীদের চেয়েও মানবেতর দিনযাপন করে থাকে।
হাসান সময় মতই অফিসে এসে পৌছে। আজ মালিক অফিসে আসেননি। প্রবাসীদের নিয়ে এখানে কি একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। দেশ থেকে বিভিন্ন মিডিয়া থেকে অনেক লোকজন এসেছে। পুরো অনুষ্ঠান যারা স্পন্সর করছেন, তার মধ্যে হাসানের মালিকও একজন। হাসানের মতো লোকদের ঐ সব অনুষ্ঠানে যাওয়ার সৌভাগ্য কখনই হবে না। সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রমের পর রাতে বাড়ী ফিরে টিভিতে হাসান অনুষ্ঠানের পুনঃপ্রচার দেখতে পায়। অনুষ্ঠানের সবাই খুব আনন্দ করছে। চারদিকে চোখ ধাঁধাঁনো লেজার শো। আনন্দ শুধুই আনন্দ। হাসানের চোখ এক সময় ঝাপসা হয়ে আসে। এখন আর সে টিভিতে কিছুই দেখতে পাচ্ছে না।
প্রতি বছর প্রবাসী বাঙালীদের নিয়ে এমনি আরও অনেক অনুষ্ঠান হবে কিন্তু তার মত লোকদের ভাগ্যের কখনও কোন পরিবর্তন হবে না। কারও কাছে এত সময় নেই যারা তাদের নিয়ে মাথা ঘামাবে। তাদের হয়ে সবার কাছে দুটি কথা বলবে। সবাই আছে অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। দর্শকদের যে কোন ভাবে একটি উপভোগ্য বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান তাদের উপহার দিতে হবে। দেশের সব টিভি চ্যানেল ব্যস্ত হয়ে পড়বে কার আগে কে ঐ অনুষ্ঠান প্রচার করবে। পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হবে-মরুর বুকে হয়ে গেল প্রবাসী বাঙালীদের নিয়ে আনন্দঘন এক জমকালো অনুষ্ঠান। প্রবাসীদের নিয়ে এ ধরনের অনুষ্ঠান আরও বেশী বেশী হওয়া দরকার। কারণ এরাই হচ্ছেন আমাদের দেশের চালিকা শক্তি। এদের পাঠানো কষ্টের উপার্জনের টাকা দিয়েই দেশে চলছে।
** কিছুদিন পূর্বে কুয়েতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের বেতন বাড়ানোর আন্দোলনের পরবর্তী ফলাফল আমরা জানি। কয়েকজন শ্রমিকের ভুল সিদ্ধান্তের দায় দায়িত্ব নিতে হয়েছে শত শত শ্রমিকদের। প্রবাসী শ্রমিকরা যখন দেশে ফেরত আসে তখন এয়ারপোর্টে তাদের নামার ছবি ছাপা হয় বিভিন্ন দৈনিকে। সেখানে শ্রমিকদের পায়ে কোন জুতা নেই। যাদের আছে তাদের দুই পায়ে দুই ধরনের জুতা। এই ছবির পর আর কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রবাসে তারা কিরকম দীন হীন অবস্থায় বাস করে এটা হচ্ছে তার নমুনা।
কুয়েত সরকার তাদের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করেছে তখন সেখানকার বাংলাদেশী দুতাবাসের কাজ কি ছিল। তারা কেন তখন একটি কার্যকরী ভূমিকা নেয়নি। প্রবাসে কখনও বাঙালীরা কোন সমস্যায় পড়লে বাংলাদেশী দূতাবাসের খুব ভাল সহায়তা পেয়েছে বলে আমার জানা নেই। যার জন্যে একই কাজের জন্যে একজন বাঙালীকে যে অর্থ দেয়া হয় সেই একই কাজের জন্যে একজন ইন্ডিয়ান কে তার তিন গুন অর্থ দেয়া হয়। তাহলে এত অর্থ অপচয় করে বিদেশে এই সব দূতাবাস রাখার দরকার কি। তাই এদের কাছ থেকে আমরা আজ আর কোন কিছু প্রত্যাশা করি না।
মিডিয়া প্রবাসে বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ করছে। প্রবাসীদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা বিদেশে দেশের সংস্কৃতিকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি তারা যদি ঐ সব হতভাগ্য প্রবাসী বাঙালীদের কথা সমগ্র প্রবাসীদের সামনে তুলে ধরতে পারে তবে তা অনেক বড় একটা কাজ হবে। মিডিয়ার শক্তি অনেক তবে সে যদি তার শক্তিকে শুধু মাত্র ব্যাবসায়িক কাজে না লাগিয়ে যথাযথ ভাবে তার শক্তিকে মানুষের প্রয়োজনে কাজে লাগায়।
** রিপোস্ট।
আলোচিত ব্লগ
বাংলাদেশে কোন প্রজন্ম সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত? ১৯৭১ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত ভাবনা
বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রশ্নটি প্রায়ই ব্যক্তি বা দলের দিকে ছুড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু একটু গভীরে গেলে দেখা যায়, এটি অনেক বেশি প্রজন্মভিত্তিক রাজনৈতিক - অর্থনৈতিক বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত। ১৯৭১ এর পর... ...বাকিটুকু পড়ুন
চাঁদগাজীর মত শিম্পাঞ্জিদের পোস্টে আটকে থাকবেন নাকি মাথাটা খাটাবেন?

আমাদের ব্রেইন বা মস্তিষ্ক কিভাবে কাজ করে লেখাটি সে বিষয়ে। এখানে এক শিম্পাঞ্জির কথা উদাহরণ হিসেবে টেনেছি মাত্র।
ধরুন ব্লগে ঢুকে আপনি দেখলেন, আপনার পোস্টে মন্তব্যকারীর নামের মধ্যে "জেন একাত্তর" ওরফে... ...বাকিটুকু পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টি দিল্লী থেকে।

((গত ১১ ডিসেম্বর ধর্মীয় উগ্রবাদ ও জঙ্গী সৃষ্টির ইতিবৃত্ত ১ শিরোনামে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম। সেটা নাকি ব্লগ রুলসের ধারা ৩ঘ. violation হয়েছে। ধারা ৩ঘ. এ বলা আছে "যেকোন ধরণের... ...বাকিটুকু পড়ুন
আমাদের হাদিকে গুলি করা, আর আওয়ামী শুয়োরদের উল্লাস। আমাদের ভুল কোথায়?


৩০ জনের একটা হিটলিস্ট দেখলাম। সেখানে আমার ও আমার স্নেহের-পরিচিত অনেকের নাম আছে। খুব বিশ্বাস করেছি তা না, আবার খুব অবিশ্বাস করারও সুযোগ নাই। এটাই আমার প্রথম... ...বাকিটুকু পড়ুন
এ যুগের বুদ্ধিজীবীরা !

ডিসেম্বর মাসের চৌদ্দ তারিখ বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবী দিবস পালন করা হয়। পাকিস্তান মিলিটারী ও তাদের সহযোগীরা মিলে ঘর থেকে ডেকে নিয়ে হত্যা করেন লেখক, ডাক্তার, চিকিৎসক সহ নানান পেশার বাংলাদেশপন্থী বুদ্ধিজীবীদের!... ...বাকিটুকু পড়ুন

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।